আতা গাছের তোতা পাখি ও হতাশ বউটির কথা

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 1 Nov 2017, 06:12 AM
Updated : 1 Nov 2017, 06:12 AM

মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে এক সভায় চলচ্চিত্রকার খান আতার বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ তুলে নতুন করে প্যান্ডোরার পুরনো একটি বাকসো খুলে দিয়েছেন: ১. ১৯৭১ সালে খান আতা রাজাকার ছিলেন এবং ২. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর খান আতা নাকি স্যাম্পেনের বোতল খুলে উল্লাসই শুধু করেননি, ঘাতকদের প্রশংসা করে গানও লিখেছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাচ্চুর বক্তব্য প্রচারিত হবার পর চলচ্চিত্রকার সোহেল রানা এবং নায়ক-মুক্তিযোদ্ধা ফারুক দাবি করেছেন, খান আতা বন্দুকের মুখে পাকিস্তানের পক্ষালম্বন করেছিলেন। ১৫ আগস্টে মদ্যপানের ঘটনা নিয়ে কেউ কেউ বলছেন, এটা মিথ্যা; কেউ-বা ব্যাপারটি এড়িয়ে যাচ্ছেন। হাসান ইমামসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একাধিক বুদ্ধিজীবী বলেছেন, জনাব বাচ্চুর বক্তব্য সর্বৈব সত্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খান আতার রাজাকারত্ব প্রতিপাদন ও খণ্ডন করে তুমুল বাদানুবাদ চলছে। আতা গাছে তোতা পাখি গিয়ে বসেছে দেখে অনেকেই এলোপাতাড়ি ঢিল ছুঁড়তে শুরু করেছে।

হোমিওপ্যাথির ভাষায় বলা যায়, উপরোক্ত ঘটনা একটি উপসর্গ মাত্র, সত্যিকারের রোগ অনেক গভীরে।অন্যভাবে বলা যায়, ঘটনাটি এমন একটি বিষফোঁড়ার মুখ যার নিচে পর্বতপ্রমাণ পুঁজ জমা আছে, যে পুঁজ গত পাঁচ দশকেও বাঙালি-মানস থেকে বের হতে পারেনি; আগামী পাঁচ দশকেও বের হবে কিনা সন্দেহ। যদিও এই পুঁজ বের হবার উপরই কোনো একদিন বাঙালি রাষ্ট্র-জাতির গঠন নির্ভর করছে। সুতরাং আতা গাছে তোতা পাখি বসে ভুল নাকি ঠিক করেছে, কে বা কাহারা ফোকটে ডালিম গাছের মৌ খেয়ে নিচ্ছে– এই সব প্রশ্নের জবাব দেবার আগে সমস্যার গভীরে যাওয়া যাক।

বহু শতাব্দী ধরে ঘটে যাওয়া বহু বিচিত্র ঘটনার ঘনঘটার প্রেক্ষিতে সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রশ্নে বাংলাদেশের জনগণের সংখ্যাগুরু অংশটি, ধরা যাক, গত শখানেক বছর ধরে, কমপক্ষে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে আছে। প্রথম দল বাঙালি সংস্কৃতি আর ইসলাম ধর্ম উভয়ই ষোল আনা বজায় রাখার পক্ষপাতী। দ্বিতীয় দল শুধু ধর্ম বজায় রাখতে ইচ্ছুক এবং সংস্কৃতি বেমালুম বাদ দিতে বদ্ধপরিকর (এরা মূলত বকধার্মিক অর্থাৎ ধর্মের ব্যবহার করে ফায়দা লুটতে চায় কিনা, সে জটিল বিচারে যাচ্ছি না)।

তৃতীয় সংখ্যালঘু দলটি সাধারণত রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের মিলন চায় না। তাদের কথা হচ্ছে: ধর্ম যার যার, সংস্কৃতি সবার (এদের একটি অংশ অস্থির নাস্তিক, অর্থাৎ যৌবনে অগভীর উপলব্ধির ভিত্তিতে নাস্তিক হন, কিন্তু প্রৌঢ় বয়সে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে ধর্মকর্মে মন দেন)।

ভূপৃষ্ঠের টেকটোনিক প্লেটগুলোর মতো বাংলাদেশের উপরোক্ত তিন জনখণ্ডের মধ্যে চলমান সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হবে সন্দেহ নেই। এতে কে জিতবে, অথবা এই তিন পক্ষের মধ্যে কী ধরনের মীমাংসা হবে বা না হবে, তার উপরও নির্ভর করবে নিকট ভবিষ্যতে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি রাষ্ট্র-জাতি গঠন করা সম্ভব হবে কিনা।

এই তিন দলের বিভিন্ন উপদল আছে এবং রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ভেদে এই সব দল-উপদলের মধ্যে সংযোজন-বিয়োজনের ঘটনাও প্রায়শই ঘটে। প্রথম দলের একটি উপদল ৭২ সালেই জাসদ গঠন করে মূল দলের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিল। সত্তরের দশকে তৃতীয় দলের দুটি প্রধান উপদল ছিল, যার একটি মস্কোপন্থী, অন্যটি পিকিংপন্থী। মস্কো যেহেতু ১৯৭১ সালে ভারত ও বাংলাদেশের পক্ষে ছিল, সেহেতু মস্কোপন্থী উপদলটি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। পিকিংপন্থী উপদলের একটি অংশ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল বটে, কিন্তু অন্য একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধকে (চীনের কথামতো) 'দুই কুকুরের লড়াই' বিবেচনা করে নির্লিপ্ত ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দলের রাজাকার-আলবদর বাহিনী এই নির্লিপ্ত বুদ্ধিজীবীদেরও রেয়াত করেনি, এদের মধ্যে অনেককেই তারা হত্যা করেছিল ১৪ ডিসেম্বর।

পিকিংপন্থীদের অনেকে অবশ্য অভিযোগ করেন যে, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। এই অভিযোগে সত্যতা আছে। তবে চীন যে যুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশের বিপক্ষে, সেই যুদ্ধে চীনের মতাদর্শেই চলে এমন কাউকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করাটা সুবিবেচনার কাজ হত কিনা সমর বিশেষজ্ঞরা তা ভালো বলতে পারবেন।

১৯৭১ সালের গণহত্যা প্রথম ও তৃতীয় দলের উপর দ্বিতীয় দলের প্রতিশোধ। এরাই রাজাকার হয়েছিল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অত্যাচার করেছিল আপামর বাঙালির উপর। এদের সিংহভাগ ধর্মপন্থী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে ভাবা হয়েছিল, দ্বিতীয় দল বাংলার ইতিহাসে চিরদিনের জন্যে পরাজিত হল। কিন্তু রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে দ্বিতীয় দল পুনরায় যুগপৎ উল্লসিত ও আশাবাদী হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সেনাশাসন যুগের প্রথম পর্বে (১৯৭৫-১৯৮১) মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান দ্বিতীয় দলের পুনর্বাসন করেছিলেন। দ্বিতীয় পর্বে (১৯৮২-১৯৮৯) এরশাদীয় স্বৈরাচার যুগে এবং দ্বিতীয় (অনেকের মতে প্রথম) গণতান্ত্রিক যুগের প্রথম পর্বে (১৯৯০-১৯৯৫) দ্বিতীয় দলের সার্বিক অবস্থা প্রথম দলের তুলনায় ভালো ছিল। দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক যুগের দ্বিতীয় পর্বে (১৯৯৬-২০০১) প্রথম দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে দ্বিতীয় দলের বরাভয় প্রয়োজন হয়েছিল। তৃতীয় পর্বে (২০০১-২০০৬) দ্বিতীয় দলের নেতারা মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন।

প্রায় দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক হাইফেনের পর তৃতীয় গণতান্ত্রিক যুগের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে প্রথম দল আবার ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রপিতা হত্যাকারীদের এবং ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দ্বিতীয় দলের প্রথম সারির নেতাদের বিচার করে শাস্তি বিধান করেছে। তৃতীয় গণতান্ত্রিক (?) যুগের দ্বিতীয় পর্ব এখনও শেষ হয়নি। উপরিউক্ত কালবিভাগের সঙ্গে সবাই পুরোপুরি একমত নাও হতে পারেন, তবে ঘটনাপ্রবাহ যে অনেকটা এ রকমই, সে ব্যাপারে খুব বেশি দ্বিমত হয়তো থাকবে না।

বাঙালির তথাকথিত হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। কারণ মানুষের স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ এখনও তাজা এবং মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, দেখেছেন– এমন অনেক মানুষ এখনও জীবিত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপরিউক্ত তিন দলের সংবেদনশীলতা তিন রকমের। প্রথম দল ভাবে, বাংলাদেশ তারাই স্বাধীন করেছে এবং বাংলাদেশ তাদের পৈতৃক সম্পত্তি। মুক্তিযুদ্ধে অন্যেরা সঙ্গে ছিল, তবে কেউ সঙ্গে না থাকলেও স্বাধীনতা আটকাত না। দ্বিতীয় দল তো স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতাই করেছিল এবং এখনও তারা বাংলাদেশকে 'বাংলাস্থান' বানাতে মুখিয়ে আছে।

তৃতীয় দলের কোনো কোনো নেতা ভেবেছিলেন, বাংলাদেশ তারাই স্বাধীন করবেন। কিন্তু বহু বিচিত্র কারণে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। এই নেতারা এবং তাদের হাল আমলের সমর্থকদের সারাজীবনের দুঃখ এই যে, হাতি ঘোড়া গেল তল, কোথাকার কোন শেখ মুজিব, সে কিনা যুদ্ধে অনুপস্থিত থেকেও দেশ স্বাধীন করে 'রাষ্ট্রপিতা'হয়ে গেল!

স্বাধীন হবার পর পর তৃতীয় দল প্রথম দলকে প্রস্তাব দিয়েছিল সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে। কিন্তু প্রথম দলের নেতারা তখন ডালিম গাছে চড়ে বসেছে। মজাসে ডালিমের সবটুকু মৌ চুষে নেবার সুযোগ ছাড়বে কেন তারা? এমনিতেই জনগণ প্রথম দলকেই ভোট দিত, তবুও বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে কমবেশি কারচুপি করে প্রথম দল নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছিল। তাতেও অবশ্য সন্তুষ্ট হয়নি তারা, প্রায় দুই দশকের জন্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে একদলীয় শাসন চালু করেছিল।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দ্বিতীয় দল, প্রথম দলের উপদল জাসদ এবং তৃতীয় দলের নেতা বা সমর্থকদের মধ্যে অনেককেই উল্লাস করতে দেখা গেছে। প্রথম দলের বেশ কিছু নেতা মীরজাফর খোন্দকার মোস্তাক সরকারে যোগ দিয়েছিলেন। তারাও খান আতাদের মতো বন্দুকের নলের দোহাই দিয়েছিলেন, যে ধরনের দোহাই কারাগারে নিহত চার নেতাকে দিতে দেখা যায়নি। খান আতা যদি উল্লাস করেও থাকেন, তবে তিনি একা নন। তাছাড়া ভুলে গেলে চলবে কেন যে, এই উল্লাসকদের কেউ কেউ আজ প্রথম দলের অন্যতম সহযোগী?

মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের নায়ক ইব্রাহিম কার্দি এবং একটি পার্শ্বচরিত্র আতা খাঁর আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক। ইব্রাহিম কার্দি ছিলেন জন্মগতভাবে মুসলমান, কিন্তু পাঠানদের বিপক্ষে মারাঠা বাহিনীর হিন্দু সেনাপতি ছিলেন তিনি। কারণ মারাঠারা তাঁর সামরিক যোগ্যতার মূল্যায়ন করেছিল। আতা খাঁ ওরফে অমর যতটুকু মনে পড়ে, জন্মগতভাবে মুসলমান ছিল, কিন্তু তাকে মানুষ করেছিল হিন্দু মারাঠারা।দ্বৈত-গুপ্তচর হিসেবে দুই শিবিরেই যাতায়াত ছিল আতা খাঁর। ইব্রাহিম কার্দি জানতেন তিনি আসলে কে, কিন্তু আতা খাঁ জানত না সে আসলে কোন পক্ষের লোক।

বাংলাদেশ শুধু নয়, যে কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ রকম হাজার হাজার কার্দি বা আতা খাঁ থাকে।মুনীর চৌধুরী বা খান আতার মধ্যেও ইব্রাহিম কার্দি বা আতা খাঁর ছায়া খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। এমনও হতে পারে যে, এই চরিত্রগুলোর মধ্যে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী নিজের মানসিক অবস্থাই তুলে ধরেছিলেন।প্রধানত আতা খা বা ইব্রাহিম কার্দিদের সঙ্গে নিয়েই দুই মেয়াদে সরকার গঠন করা বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছিল।

'জীবন থেকে নেয়া' ছবিতে প্রতিবাদী ভগ্নীপতির চরিত্রে অবিস্মরণীয় অভিনেতা কিংবা 'নবাব সিরাজদৌলা' এর পরিচালক খান আতার সঙ্গে কাদের মোল্লা কিংবা সাকা চৌধুরীকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। একইভাবে অন্য অনেক স্বাধীনতাবিরোধীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না 'কবর' বা 'রক্তাক্ত প্রান্তর' এর নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকেও, যিনি স্বাধীনতার আগেই স্বীকার করেছিলেন: 'আমি জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হয়েছি!' (সরদার ফজলুল করিমের 'সেই সে কাল: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা' দ্রষ্টব্য)।

১৪ ডিসেম্বর আলবদরের হাতে নিহত এক বামপন্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের স্ত্রীকে এক বেতার সাক্ষাৎকারে আমি নিজমুখে বলতে শুনেছি: 'আমার স্বামীকে কেউ না কেউ মারতই! হয় এরা, নয়তো ওরা!'

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং এর অব্যবহিত পূর্বে সময়টা খুব সরল ছিল না। এই জটিল সময়ে কার্দি বা আতা খাঁয়েরা বহু বিচিত্র কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হতেও পারে।

দ্বিতীয় সেনাশাসন আমলে একটা গল্প ছিল এরকম: স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপ্রধানের চুল কাটতে কাটতে তাঁর নাপিত প্রায়ই জিগ্যেস করে: 'স্যার, আপনি চট্টগ্রাম যাইবেন কবে?'

কয়েক বার একই অবান্তর প্রশ্ন শুনে রাষ্ট্রপ্রধান বিরক্ত হয়ে ধমক দিলে নাপিত বিনীতভাবে বলেছিল: 'স্যার চট্টগ্রামের নাম শুনলেই আপনের চুল খাড়াইয়া যায়। আমরা কাটতে সুবিধা হয়!'

মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে দ্বিতীয় দলের সদস্যদেরও আতঙ্কে চুল দাঁড়িয়ে যায়। যে কয়েকটি কাহিনি এদের মনে (জীবনানন্দের ভাষায়) 'দুদণ্ড শান্তি' দিয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে: ১.মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের নেতারা কোলকাতায় ছুটি কাটিয়েছেন আর কষ্ট করে যুদ্ধ করেছেন (জিয়াউর রহমানের মতো অ-আওয়ামী) মুক্তিযোদ্ধারা; ২. স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা ডাকাতি করে বেড়িয়েছে; ৩. শান্তিবাহিনীর অনেক চেয়ারম্যান গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে (যার নিগলিতার্থ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে কিছু কিছু রাজাকারেরও ইতিবাচক ভূমিকা আছে)।

জেলে খুন হওয়া চার জাতীয় নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় কোলকাতাতেই অবস্থান করছিলেন বটে। তাজউদ্দীনসহ আওয়ামী লীগের সব নেতা যদি কোলকাতায় ছুটি কাটিয়ে থাকবেন, তবে যুদ্ধটা পরিচালনা করল কে? বহু ধরনের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে কারও কারও পদস্খলন নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু এমন মুক্তিযোদ্ধাও তো আছেন যারা সারাজীবন সৎপথে থেকে বৃদ্ধ বয়সে ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কোন ধরনের মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি, অসৎ নাকি সৎ? মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, দেশপ্রেম আর সততা নিয়ে কটা ছবি হয়েছে, কটা উপন্যাস লেখা হয়েছে? তাছাড়া যে সমাজে বেশিরভাগ লোক অসৎ, যেখানে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারেরা রাজার হালে জীবন কাটায়, সেখানে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদেরই-বা কেন সৎ থাকতে হবে?

খান আতার বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ এই যে, ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করে এবং হানাদার বাহিনীর প্রশংসা করে রেডিও পাকিস্তানের জন্যে বেতার-কথিকা লিখেছেন। সোহেল রানা এবং ফারুকের দাবি, খান আতা বন্দুকের মুখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই অপকর্ম করেছেন। খান আতার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ, তিনি তাঁর 'আবার তোরা মানুুষ হ' ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের চারিত্রিক পদস্খলন দেখিয়েছেন। শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যায় না বলে আমরা অবশ্যই জিগ্যেস করতে যাব না, কেন খান আতা তাঁর কোনো ছবিতে রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদারদের অপকর্ম তুলে ধরেননি। বাকি থাকে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হওয়াতে খান আতার উল্লাস প্রকাশ এবং খুনিদের প্রশংসা করে গীত রচনার অভিযোগ। শেষ দুটি অভিযোগ যদি প্রমাণ করা যায়, তবে বন্দুকের নল এবং শিল্পীর স্বাধীনতার মতো শক্ত অজুহাতও হালে পানি পাবে না।

জনাব বাচ্চু কি আতাফলের পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে ভুল করেছেন– কেন তিনি এতদিন পরে এসব কথা তুলছেন, অথবা অন্য ছদ্ম-রাজাকারদের কথা কেন তিনি বলছেন না– এ ধরনের অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। দ্বিতীয় দলের সমর্থকেরা প্রায়ই বলে থাকেন: 'পুরনো কথা তুলে কী লাভ?' কারণ কে না জানে, মুক্তিযুদ্ধে কার কী ভূমিকা জাতি সেটা ভুলে গেলে, দ্বিতীয় দলের লাভই সবচেয়ে বেশি। ইতিহাস রচনার স্বার্থে পুরনো, নতুন সব কথা তুলতেই হবে। প্রতিটি শিল্পী একজন মানুষও বটেন। শৈল্পিক গুণের জন্যে তাঁর যেমন প্রশংসা ও পুরষ্কার পাওয়া উচিত, তেমনি মানুষ হিসেবে তাঁর অপরাধের জন্যে শাস্তি বা নিদেনপক্ষে তিরষ্কার তাঁর প্রাপ্য। পুরস্কার যদি মরণোত্তর হতে পারে, তবে তিরষ্কারই-বা হবে না কেন?

হিটলারও ভালো ছবি আঁকতে জানতেন। সারাদিন গ্যাস দিয়ে জীবিত ইহুদি বা জিপসি পোড়াতেন যেসব জার্মান পুলিশ অফিসার, নিজেদের ছেলেমেয়েদের কাছে তারা একেক জন স্নেহময় বাবাই ছিলেন (জীবিত পুড়ে ছাই হওয়া ইহুদি ও জিপসিদের মধ্যে ছিলেন বহু শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী। এদের মধ্যে আইনস্টাইনও থাকতে পারতেন, যদি তিনি সময়মতো আমেরিকায় পালিয়ে না যেতেন, অথবা থাকতে পারতেন কার্ল মার্ক্স, যদি তিনি কিছুদিন পরে জন্ম নিতেন)!

হিটলারের শৈল্পিক গুণের কথা আমরা অবশ্যই বলব, কিন্তু তাঁর নৃশংসতার কথও আমরা বিস্মৃত হব না। জাতির জানা উচিত কোনটা সাদা কোনটা কালো এবং কোনটা সাদা-কালো। জনাব বাচ্চু মুক্তিযুদ্ধে খান আতার ভূমিকা নিয়ে কথা তোলাতে ছাত্রলীগ নেতা সোহেল রানা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক এবং চলচ্চিত্রকার হাসান ইমামের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছে আমাদের। এই সব বক্তব্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নির্মোহ ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

'আতা গাছে তোতা পাখি, ডালিম গাছে মৌ। এত ডাকি, তবু কথা কয় না কেন বউ'? প্রথম চরণটি নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের কাছে এই শিশুতোষ ছড়ার শেষ চরণটি অধিকতর দুশ্চিন্তার কারণ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। গত একশ বছরে দুই দুই বার স্বাধীন হয়েও বহু বিচিত্র (বদ) জাতের তোতাপাখিদের জ্বালায় বউমা পরম শান্তিতে আতা গাছের তলায় পা ছড়িয়ে বসে আতা খেতে পারেনি।

এদিকে তিন দলের ধান্দাবাজ সব নেতা ডালিম গাছের বেশিরভাগ মউ খেয়ে নিয়েছে অথবা ফোকটে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে, বংশানুক্রমে রসিয়ে রসিয়ে খাবে বলে। হিন্দিতে বলে: 'বাপ পেরেশান বেটাসে, দেশ পেরেশান নেতাসে।' বাংলাদেশ শুধু কেন, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নেতাদের মধ্যেই 'নে-তা' বেশি, 'দে-তা' কম! গত শখানেক বছর ধরে ধান্দাবাজ নেতাদের রাজ্যের যত ফালতু ডাকে সাড়া দিতে দিতে ইদানিং যুগপৎ অবসন্ন ও হতাশ বৌটি ধরেই নিয়েছে, এদেশের কিছু হবে না, অথবা ভাবছে, বৃথাই ১৯৭১ সালে রক্ত ঝরিয়েছেন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা।

বউ এখানে বাংলাদেশের জনগণ, বলাবাহুল্য।