জিপিএ ফাইভের চেয়েও জরুরি

ডা. আহমেদ হেলাল
Published : 31 Oct 2017, 05:43 AM
Updated : 31 Oct 2017, 05:43 AM

ইংরেজি মাধ্যমের ট্যাঁশ স্কুলগুলোতে নিয়মিত পেরেন্টস মিটিং হয়। বিষয়টি ভালো। শিক্ষকদের সঙ্গে বাবা-মায়ের একটা যোগাযোগ থাকে। সন্তান পড়ালেখা কেমন করছে, বাসায় আর কী কী করলে সে আরও 'যোগ্য' হয়ে উঠবে সেটার নির্দেশনা দেন 'মিস'রা। ইংরেজি মাধ্যমে তো আর জিপিএ ফাইভের বালাই নেই– সেখানে আছে 'যোগ্য' হয়ে ওঠার লড়াই। কীসের যোগ্য?

সেটি জানতে পারলাম ঢাকার একটি ট্যাঁশ স্কুলে 'শিশু মনস্তত্ত্ব'এর উপর একটি ছোট্ট বক্তৃতা দিতে যেয়ে। সেই স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল গর্ব করে বলছিলেন, "আমার এখান থেকে পাশ করে কেউ দেশেই থাকে না। স্টেটসের ভালো কলেজ বা অস্ট্রেলিয়া-কানাডাতেই বেশিরভাগ চান্স পেয়ে যায়।"

শুনে একটু ঢোক গিললাম। এটা কি স্কুল না ট্রাভেল এজেন্সির অফিস? উনি কি ভাইস প্রিন্সিপ্যাল নাকি ট্রাভেল এজেন্সির কর্ণধার? যোগ্য হয়ে ওঠা মানে কি দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে পারা?

বলছিলাম পেরেন্টস মিটিং নিয়ে। বাবা হিসেবে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার মেয়ের স্কুলের পেরেন্টস মিটিংএ যাবার। বৃষ্টিবিঘ্নিত দিনে প্রায় কাকভেজা হয়ে মেয়ের হাত ধরে উপস্থিত হলাম স্কুলে। এমন নয় যে, এবারই প্রথম, কিন্তু প্রতিবার এইসব মিটিংএ আসতে আমার গা কেমন যেন ছম ছম করে। মনে হয় কোনো দূতাবাসে ভিসার ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। ঢুকতে একবার নাম আর সাকিন নিবন্ধন করা।

হলরুমে ঢুকে রিপোর্ট কার্ড নেবার সময় দ্বিতীয়বার। হলরুমের দুধারে টেবিল পেতে টিচাররা বসে আছেন। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানের হাত ধরে এ-টেবিল থেকে ও-টেবিলে বিচরণ করছেন। টিচাররা নানা কিছু বলছেন, তারা গোগ্রাসে গিলছেন। কারণ 'যোগ্য' করে তুলতেই হবে তাদের আদরের সন্তানটিকে!

টিচারদের চেয়ে পেরেন্টদের ভিড় বেশি। তাই কে কার আগে যাবেন তা নিয়ে ছোটখাটো হুড়োহুড়ি। কে কার আগে এসেছেন তা নিয়ে মৃদু অনুযোগ, "ভাবি, আমি আপনার আগে ছিলাম, এই একটু জিয়োগ্রাফি মিসের কাছে গিয়েছিলাম, ঠিক এই জায়গাটি আমার ছিল।"

দুর্বল ভাবি, সবল ভাবির কাছে পরাজিত হয়ে জায়গা ছেড়ে দিলেন।

কন্যা বলছে, "বাবা, আইটি টিচারের কাছে যেতেই হবে, চল না।"

আমি বল্লাম, "ওখানে ভিড়, একটু অপেক্ষা কর।"

সে বলল, "অপেক্ষা করলে আর দেখা হবে না, এখুনি চল।"

সেখানেও একই বিষয়। চপলা ভাবিরা কীভাবে যেন সব ম্যানেজ করে কিউএর আগে চলে যাচ্ছেন! নিজের সন্তানকে উপদেশ দিচ্ছেন, "… তুমি ওই ওর আগে যেয়ে দাঁড়াও, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওর আগে।"

সরলমনা মেয়েটি বলছে, "মা, আমরা তো ওদের পিছনে ছিলাম!"

সন্তানের ভুল ভেঙে দেন মা, "না, না, আমরাই আগে ছিলাম, ফারাহর আম্মুর সাথে কথা বলতে একটু পাশে গেলাম না।"

মায়ের ব্যাখ্যা পেয়ে এগিয়ে যায় সাহসী মেয়েটি। আরেকজনকে পেছনে ফেলে যোগ্য হয়ে উঠতেই হবে তাকে। মায়ের মুখে যেন বিশ্বজয়ীর তৃপ্তি। নিজের সন্তানকে 'যোগ্য' হয়ে ওঠার টিপস দিচ্ছেন। আমার কন্যার রিপোর্ট কার্ডের দিকে তাকাই। এ বি সি– সাড়ে নয়, নয়, সাত ইত্যাদি অক্ষর আর নম্বরগুলো আমার মাথায় কোনো অনুরণন তৈরি করে না। মনে হয়, এই গ্রেড, নম্বর, জিপিএ ফাইভ এগুলোর পেছনে দৌড়ুতে দৌড়ুতে আমরা অনেক জরুরি জিনিস হারিয়ে ফেলছি। সরলতা, সততা, সামাজিক শিষ্টাচার, সামাজিক দক্ষতা, শৃঙ্খলার চেয়ে জিপিএ ফা্ইভ অনেক বড় হয়ে গেছে। হয়তো উদাহরণটা একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে নেওয়া। কিন্তু বাংলা মাধ্যমের স্কুলেও একই ঘটনা ঘটছে।

আমার একজন ইন্দোনেশিয়ান বন্ধু বলছিলেন, 'তোমাদের দেশের মানুষগুলো খুব ভালো, কিন্তু তারা কিউ ধরতে চায় না, ধৈর্য কম'। তার কথাটি আমার মনে পড়ে গেল। কীভাবে আমার দেশের মানুষ কিউ ধরবে? ছোটবেলা থেকে বাবা-মা তাকে শিখিয়েছে যোগ্য হয়ে উঠতে হলে আরেক জনকে যেনতেন প্রকারে পেছনে ফেলে আগে যেতে হবে। তাই তো স্কুলে বেতনের কিউতে শ্যুট করে ঢুকে যাওয়া, নামি হাসপাতালের লিফটের গোড়ায় মাছির মতো ভিড় করে ধাক্কাধাক্কি করা, রাস্তায় এক গাড়ি পেছনে ফেলে আরেক গাড়ির অন্যায় এগিয়ে যাওয়া।

আর হ্যাঁ, সন্তানের সামনে বলার মতো যুক্তির অভাব বাবা-মায়েদের নেই। আমি বলতে শুনেছি সন্তানকে তারা শিক্ষা দিচ্ছেন, 'এটা বাংলাদেশ, এখানে নিয়ম মানতে গেলে পেছনে পড়ে থাকতে হবে, একটু টেকনিক্যাল হতে হবে, বুদ্ধি করে চলতে হবে'– 'নিয়ম-কানুন এইগুলা আমাদের দেশের জন্য না, এই দেশে নিয়ম মানলেই বিপদ'।

এইভাবে কুযুক্তি দিয়ে আমরা আমাদের শিশু-কিশোরদের মাইন্ডসেট পরিবর্তন করে দিচ্ছি। অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা আর অশিষ্টাচারে উৎসাহিত করছি।

জিপিএ ফাইভের চেয়ে, অন্যায়ভাবে যোগ্য হয়ে ওঠার চেয়েও জরুরি কিছু বিষয় আছে যেগুলো আমরা কখনও আমাদের শিশু-কিশোরদের শেখাচ্ছি না। শিশুর জন্য সামাজিক দক্ষতা (সোশ্যাল স্কিল) অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একটি অভিজ্ঞতা বলি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটি স্কুলের একজন অভিভাবক তার ক্লাস থ্রি-পড়ুয়া সন্তানকে নিয়ে আমার চেম্বারে এলেন। তার চেহারা কাঁদো কাঁদো। ব্যাপার কী?

গুরুতর! স্কুল ছুটি শেষে বের হবার সময় তার ছেলে এক সহপাঠীর গায়ে পানির ফ্লাস্ক ছুঁড়ে মেরেছে, তাতে সহপাঠীর হাতে আঁচড় লেগেছে। সহপাঠীর বাবা-মা স্কুলে নালিশ করেছেন। গুরুতর বিষয় হচ্ছে, স্কুল কর্তৃপক্ষ সেই ক্লাস থ্রি-পড়ুয়া ছেলেটির 'মানসিক সুস্থতা' যাচাই করার জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সার্টিফিকেট আনতে বলেছেন!

মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার খুশি হবার কথা। বাহ্, দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ছে, আমার পসার বাড়ছে!

কিন্তু আমি খুশি হতে পারিনি। বরং স্কুল কর্তৃপক্ষের মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম। বলাই বাহুল্য, সেই ক্লাস থ্রি-পড়ুয়া ছেলেটির কোনো মানসিক সমস্যা ছিল না। তার সহপাঠীর বাবা-মা সেই আঁচড়-লাগা সন্তানকে সামাজিক দক্ষতা শেখাতে পারলেন না, নালিশ করে বসলেন– আর স্কুল কর্তৃপক্ষ শিশুর স্বাভাবিক চপলতা ও স্বতস্ফূর্ততা গলা টিপে মারার কাজটি করে বসলেন!

ভাববেন না, আমি ছুটি শেষে পানির ফ্লাস্ক ছুঁড়ে ফেলার মতো কাজে উৎসাহিত করছি। কিন্তু বিষয়টির সমাধানে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণ নেওয়া কোনোভাবেই সমথর্ন করা যাচ্ছে না। তাহলে শিশুদের সাধারণ দুষ্টুমিগুলো কি স্কুল কর্তৃপক্ষ মানসিক রোগ বলে মনে করেন?

অভিজাত এলাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কথায় আসা যাক। সেখানে ক্লাস সেভেনের ছাত্র আর ছাত্রীদের মধ্যে কথা বলা নিষেধ। তারা আলাদা আলাদা রুমে ক্লাস করে। সেই সহশিক্ষার আবরণে ঢাকা 'আধুনিক রক্ষণশীল' স্কুলে দোতলা থেকে একটি মেয়ে নাকি তার ছেলে সহপাঠীকে বলেছে, 'হাই'। উত্তরে একতলায় থাকা সেই ছেলেটিও কিছু একটা বলেছে। তাদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা আছে কিনা সেটা আলাদা বিষয়। কিন্তু তাদের এই ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলা স্কুল কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে যায়। আবার সেই দুজনকেই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে প্রেরণ। খটমট ই্ংরেজিতে যা লেখা তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, 'মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সুস্থতার দলিল না-আনা পর্যন্ত আপনার পোষ্য যেন স্কুলে না আসে'।

দুজনের মধ্যে মেয়েটি ও তার বাবা-মা আসেন আমার কাছে। মেযেটি বলে, ছেলেটি তার 'জাস্ট ফ্রেন্ড', তবে তার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। মেয়েটির সবচেয়ে বেশি রাগ এ জন্য যে, এত বছর তো তারা এক ক্লাসে কথা বলে এসেছে, এখন কেন তাদেরকে আলাদা করা হল?

"এই জন্য ছেলেদের সাথে বেশি বেশি কথা বলি, আই ডোন্ট লাইক দি উইয়ার্ড রুলস।"

আমার কাছেও এই আইন অদ্ভুত লাগল। ওই স্কুলের এক ম্যাডামকে ফোন করে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নাকি পেরেন্টস মিটিংএর পর গার্ডিয়ানদের দাবির কারণেই করা হয়েছে! গার্ডিয়ানরাই নাকি চান ছেলেমেয়েরা আলাদা থাকুক, তাদের মধ্যে কথাবার্তা না হোক। এই ছেলেমেয়েরা ও-লেভেল এ-লেভেল পাশ করে যখন 'যোগ্য' হয়ে উঠে আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়ায় যাবে, তখন ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসতে গেলে তারা তো হোঁচট খাবে। অনেক সময় একই ডরমিটরিতে ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে আবাসনের ব্যবস্থা থাকে। তখন এই 'যোগ্য'দের অবস্থাটা কী হবে?

কেন গার্ডিয়ানরা এমনটা ভাবছেন? কেন তারা এত নিরাপত্তাহীনতাবোধের মধ্য দিয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ তৈরি করার পরিকল্পনা করছেন? কেন তারা ভাবছেন না জিপিএ ফাইভ আর এ-লেভেলে ভালো গ্রেডের চেয়েও জরুরি কিছু বিষয় আছে যা সন্তানদের জানা উচিৎ, শেখা উচিৎ?

কেবল স্কুলেই নয় বাড়িতেও ভুল দীক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠছে শিশুরা। বাবা-মায়ের কাছে স্বজনের সমালোচনা, আরেক জনের সঙ্গে তুলনা, স্কুল আর শিক্ষকের নিন্দা শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব কখনও গড়ে ওঠে না।

বাবা-মা আর শিক্ষক সবাইকে মনে রাখতে হবে, পরীক্ষার রেজাল্টের মতো বিষয়ে গুরুত্ব দিতে যেয়ে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় জরুরি বিষয়গুলো যেন হারিয়ে না যায়। শিশু যেন তার স্বতস্ফুর্ততার প্রকাশ করতে পারে। তার দুরন্তপনা যেন মানসিক রোগ হিসেবে গণ্য করা না হয়। বাবা-মায়ের কাছ থেকে সে যেন চালাকি আর ধূর্ততার বদলে শিষ্টাচার আর সভ্য সমাজে চলবার রীতিগুলো রপ্ত করতে পারে। বাবা-মায়েরা যেন নিভৃতে ক্ষণিকের জন্যও নিজেদের আচরণের জন্য লজ্জ্বিত আর অনুতপ্ত বোধ করে সন্তানকে শৃঙ্খলা শেখাতে সচেষ্ট হন।

পারিবারিক জীবনে যেন কারও সমালোচনা শিশুকে শুনতে না হয়। সে যেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা নিয়ে বেড়ে ওঠে। ছোট ছোট সমস্যা শিশু যেন নিজেই সমাধান করতে পারে। সব কিছু বাবা-মায়েরা হাতে ধরে যেন করে না দেন। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান নিয়ে শিশুকে বেড়ে উঠতে দিন। ভীতি বা দূরত্ব তাদের মধ্যে যেন স্থান না পায়।

নৈতিকতার চর্চা আর শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকলে শিশু এগুলোর পাঠ তার পরিবার থেকেই পাবে। নিজস্ব সংস্কৃতি আর শিশুতোষ বিনোদনের পথে কোনো কিছু বাধা হয়ে না দাঁড়াক।

সেই সঙ্গে শিশুদের হতে হবে একুশ শতকের জন্য যোগ্য– বিদেশ যাবার যোগ্যতার চেয়ে যা অনেক বেশি। সে জন্য কোনো জুজুর ভয়ে সে যেন চার দেয়ালে বন্দি না থাকে। তথ্যপ্রযুক্তির যৌক্তিক ব্যবহারে সে যেন পারদর্শী হয়।

সামাজিক দক্ষতাগুলো জিপিএ ফাইভের চেয়ে অনেক জরুরি, বাবা-মাযেরা যেন বিষয়টি কখনও ভুলে না যান।