ঢাকা শহর ঢাকা যতক্ষণ

নাদির জুনাইদ
Published : 26 Oct 2017, 02:47 PM
Updated : 26 Oct 2017, 02:47 PM

কিছুদিন আগে কলকাতার তথ্যচিত্র নির্মাতা কিউ-এর একটি সাক্ষাতকার পড়ছিলাম। একটি বর্ণনা খুব ভাল লাগল। কিউ বলছেন, কোনো শহর যদি শহর হিসেবে পরিচিত হতে চায় তাহলে তার জন্য কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকা দরকার। কিউয়ের মতে, কলকাতার সেই কারণগুলোর ক্ষয় হতে হতে এখন এমন একটি জায়গায় এসেছে যে শহরটার রং ধূসর না, মনে হচ্ছে বাদামি।

[সুরজিৎ সেন, ডায়ালগ ১২, কলকাতা: গাঙচিল, ২০১৭, পৃষ্ঠা-১৫৭]

আমার মনে হল ঢাকা শহরের বর্তমান রূপ সম্পর্কে ঠিক এমন একটি ভাবনাই তৈরি হয়েছে আমার মনে। আমি ঠিক এমন একটি উদাহরণ দিয়ে আমার ভাবনাটি প্রকাশ করতে পারছিলাম না, আর কিউ মোক্ষমভাবে কলকাতা সম্পর্কে তা প্রকাশ করেছেন। ঢাকায় আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা। উচ্চশিক্ষার জন্য বছর পাঁচেক দেশের বাইরে কাটিয়েছি। এছাড়া বাকি জীবন কেটেছে এই শহরে। ইদানিং খুব মনে হয়, আশির দশকেও নীল আকাশ আর লালচে রোদের যে বিকেল এই শহরে দেখতাম সেই নীল আর লাল রং ঢাকায় এখন যেন আর দেখতে পাই না। দেখি না তারা জ্বলতে থাকা নীলচে-কালো আকাশের নিচে সুন্দর নিরিবিলি সন্ধ্যা যখন পাওয়া যায় তাজা বাতাস। এমন সন্ধ্যা আগে দেখতাম প্রায়ই। সেই স্নিগ্ধ পরিবেশে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াতেন অনেকে। কত বাড়ি থেকে ভেসে আসত কমবয়সী ছেলেমেয়েদের গানের রেওয়াজের সুর। বিভিন্ন বাড়িতে গান শেখার চর্চা ছিল তখন।

ঠিক এই ব্যাপার দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের ১৯৫৮ সালে তৈরি ছবি পরশ পাথর -এর একটি দৃশ্যে। সন্ধ্যাবেলা ছবির মূল চরিত্র পরেশ দত্তর স্ত্রী বাড়ির জানালাগুলো খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কানে ভেসে আসে পড়শির বাড়িতে কমবয়সী মেয়ের গানের রেওয়াজ করার সুর।

১৯৫৮ সালের কলকাতার সন্ধ্যার সঙ্গে ১৯৮০এর দশকের ঢাকার সন্ধ্যার তেমন অমিল ছিল না। অথচ এখন অজস্র বাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে ঠাসা এই শহরে মনে হয় কতদিন হয়ে গেছে এখানে সন্ধ্যাবেলা কোনো বাড়ি থেকে মিষ্টি কণ্ঠে কমবয়সীদের সংগীতচর্চার সুর শুনতে পাই না। ঢাকায় সন্ধ্যাবেলা এখনও মানুষ বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটে নিশ্চয়ই (নাকি তারা বেশি আগ্রহী থাকে বহু টিভি চ্যানেল একের পর এক বদলানোর কাজে, আর কমবয়সীরা ব্যস্ত তাদের স্মার্টফোন আর কম্পিউটারে ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা ওয়েবসাইটে সময় কাটাতে?)।

অবশ্য সন্ধ্যার পর বা অন্য কোনো সময়েও এই শহরে হাঁটা আর আনন্দদায়ক নয়। গত তিন দশকে ঢাকায় যত মানুষ আর যানবাহন বেড়েছে, আর তৈরি হওয়া গায়ে-গা-লাগানো বহু নতুন বাড়িঘর আর অফিস ভবন যেভাবে দমবন্ধ-করা এক অনুভূতি তৈরি করেছে বিভিন্ন স্থানে তাতে শহরের কোনো এলাকাতেই আর আরাম করে হাঁটার মতো নিরিবিলি, কোলাহলমুক্ত পরিবেশ নেই। সব জায়গায় মস্তিষ্ক পীড়িত করে গাড়ির হর্নের তীব্র শব্দ। চালকরা উচ্চমাত্রার গাড়ির হর্ন অনুভূতিহীনভাবে বাজিয়ে যায় মধ্যরাতেও। বহু দোকান, শপিং মল, রেস্তোরাঁ, আর অ্যাপার্টমেন্টের আবদ্ধতায় আর যানবাহনের ধোঁয়া, এসি থেকে নির্গত গরম বাতাসে এই শহরে বিশুদ্ধ, স্বস্তিকর বাতাস পাওয়াও খুব কঠিন এখন। আর ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম প্রতিদিন এই শহরে নষ্ট করছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা।

কিন্তু ঢাকা শহরে এক ধরনের লাল-নীল রং তো আগের চেয়ে অনেক বেশি এখন। প্রতি রাস্তার পাশে দিনে চোখে পড়ে নানা বিজ্ঞাপনের বহু রঙিন বিলবোর্ড। ঢাকা এখন শপিং মলের শহর। আর রাতে এইসব মলে, দোকানে, রাস্তার বিজ্ঞাপনে জ্বলে লাল, নীল আলো। কিন্তু বাজারের প্রচার তুলে ধরা লাল আলোতে লাল রঙের প্রতিবাদী, রাগী, রোমান্টিক, শক্তিশালী রূপটি কি আমরা দেখতে পাই?

আর ঢাকার বর্তমান সন্ধ্যাগুলিতে বিভিন্ন রাস্তায় বিজ্ঞাপনের যে নীল আলো দেখা যায় সেই নীলে চিন্তাশীলতা বা ভাবনার গভীরতা কোথায়? যে গভীরতা মনের বিষণ্ন আর সেই সঙ্গে উষ্ণ দিকগুলি অনুভব করতে সাহায্য করে সেই কাব্যময় অনুভব তো চটক আর চাকচিক্য বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা নীল আলোতে নেই।

বরং আকাশের নীল রং এই শহরে ঢেকে দিয়েছে উঁচু সব অ্যাপার্টমেন্ট আর অফিস বিল্ডিং। দিন দিন ভবনের উচ্চতা এই শহরে কেবল বাড়ছেই। আর বাধা পাচ্ছে সূর্যের আলো। নীল আকাশের দিকে কোনো দুপুর বা বিকেলে তাকিয়ে কল্পনায় হারিয়ে যাওয়ার অভ্যাসই গড়ে উঠছে না আকাশ দেখতে-না-পাওয়া এই শহরের কমবয়সীদের। বাজারের চটক প্রচার করা লাল-নীল আলো কোনো কবিতা তৈরি করে না। আর তাই ঢাকা শহরের রাস্তায় এখন আর কোনো কবিতাও নেই।

ঝাঁজালো রাজনীতিও কি আছে এখন এই শহরের পথে পথে? রাজনৈতিক বা সামাজিক অন্যায় তো থেমে যায়নি পুরোপুরি। বরং অতীতে যে অন্ধচিন্তার অনুসারী আর স্বার্থবাজরা ছিল দুর্বল, তারা এখন আর শক্ত রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় না। অন্ধত্ব আর অসহিষ্ণুতা দেখেও স্বার্থের প্রয়োজনে তৈরি হচ্ছে নির্বিকারত্ব।

কিন্তু রাজনীতি আর কবিতা তো ব্যবসায় নয়। ভোগবাদী সমাজে ব্যক্তিগত লাভ অর্জনের উদগ্র বাসনা পরাজিত করছে আদর্শবাদী মূল্যবোধ। অর্থনৈতিক স্বার্থচিন্তা আর ক্ষমতার রুচিহীন দাপট দেখানোর প্রবণতা সমাজে মূখ্য হলে সেখানে প্রকৃত ফুল তো ফুটবে না। এমন সময়ে জল ঢালা হবে আগাছায়, যত্ন করা হবে প্লাস্টিকের ফুলের। কৃত্রিম ফুলের চাকচিক্য আজ ঢেকে দিচ্ছে ঢাকা শহরের পুরনো ঔজ্জ্বল্য। প্লাস্টিকের ধূসরতা আজ এই শহরে। প্রকৃত সুবাস আর রং যেন এখানে নেই।

প্যারিসে ১৯৬৮ সালে তরুণরা পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ আর বিক্ষোভ শুরু করেছিল, তা শেষ পর্যন্ত সফলতা পায়নি। কিন্তু সেই তরুণদের চিন্তাশীলতা, প্রতিবাদের নান্দনিক রূপ আর অভিনবত্ব পরবর্তী দশকগুলিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবী প্রতিবাদগুলো অনুপ্রাণিত করেছে। তারা যে দেয়াল লিখন আর পোস্টার ব্যবহার করেছিল ১৯৬৮ সালে, তা আজও মনে ঝাঁকুনি দেয়, আমাদের গভীরভাবে ভাবতে সাহায্য করে।

যার আরেকটি অর্থ হল, সেই বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি আর ভোগবাদী চর্চা বিভিন্ন সমাজে টিকে আছে এখনও। চটক আর চাকচিক্যের অবিরাম প্রচার দিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে তার আসল দায়িত্ব, যে দায়িত্ব হল সমাজে টিকে থাকা অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা, তাকে প্রতিনিয়ত কীভাবে ঠকানো হচ্ছে তা অনুধাবন করে সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া। পশ্চিম বাংলার সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন:

"দিশেহারা মানুষকে নেশায় বুঁদ করে রাখার জন্য যেমন মদের দোকান দরকার, সেরকম টেলিভিশন সিরিয়াল দরকার, সোপ অপেরা দরকার, নোংরা প্রোগ্রাম দরকার, ব্লু-ফিল্ম দরকার। এগুলোর অঢেল সাপ্লাই বা বিশাল বিতরণের ব্যবস্থা দরকার। মানুষ যদি চুপ করে যায়, মানুষ যদি একটা ধোঁয়ার মধ্যে থাকে, সে কোনো প্রশ্ন করবে না।"

[নবারুণ ভট্টাচার্য, জোড়াতালি, কলকাতা: ভাষাবন্ধন প্রকাশনী, ২০১৭, পৃ-৭৫]

এই ক্রমশ বাড়তে থাকা ধোঁয়াই যেন আজ ধূসর করে তুলেছে ঢাকা শহর। যখন আমাদের টেলিভিশন নাটক বা বিজ্ঞাপনের দিকে তাকাই অধিকাংশ সময় যা চোখে পড়ে তা হল, জাঁকজমকপূর্ণ এক প্রদর্শনী বা স্পেকট্যাকল। কোথায় গেল সত্তর, আশির দশকে আমাদের টেলিভিশন নাটকের সেই চিন্তাঋদ্ধ বক্তব্য আর উঁচুমানের অভিনয়? আজ বিনোদন প্রদানই যেন একমাত্র উদ্দেশ্য। দ্রুত বাড়তে থাকা শপিং মল আর ফাস্ট ফুডের দোকানও তো এই শহরে স্পেকট্যাকলই সৃষ্টি করছে প্রতি মুহূর্তে। সেই যে ফরাসি প্রতিবাদী তরুণরা বলেছিল:

"জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর সাজসজ্জার মধ্যে চোখ কেবল দেখতে পায় সাজিয়ে রাখা পণ্য আর তাদের দাম।"

প্রায় দুই কোটি মানুষ এখন বসবাস করে ঢাকা শহরে। অথচ চিন্তাশীল বই বিক্রি হয় এমন বিশটি দোকানও এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্রতি বছর ঠিকই বাড়ছে পোশাক আর ফাস্ট ফুডের দোকান। আর বেশিরভাগ মানুষ কোনো উদ্বেগ ছাড়াই প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিচ্ছে সেই পরিস্থিতি।

ফরাসি তরুণদের আরেকটি কথা মনে পড়ে যায়:

"আমি অংশগ্রহণ করছি, তুমি অংশগ্রহণ করছো, সে করছে, আমরা করছি, তোমরা সবাই অংশগ্রহণ করছ। আর তারা লাভ করছে।"

এই 'তারা' কাদের দ্বারা গঠিত জানার জন্য ভাবা দরকার। তাদের পরিচয় জানার পর আমার করণীয় কী তা নিয়েও চিন্তা করা দরকার। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক যেমন বলেছিলেন, তেমনভাবে ভাবা কি প্র্যাকটিস করছে এই সময়ের বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা? চিন্তা করা যে প্রয়োজন তা কি তারা বুঝতে পারছে? এই শহরে মানুষের লোভ আর অপরিণামদর্শিতার জন্য হারিয়ে যাচ্ছে গাছ, খোলা মাঠ আর জলাশয়। বাড়ছে কংক্রিটের জঙ্গল। আর ফরাসি তরুণরা যথার্থই বলেছিল:

"কংক্রিট লালন করে অনীহা আর উদাসীনতা।"

কেবল সব রকমের ক্ষুধা মিটলেই কি একজন প্রকৃত মানুষ জীবনে সার্থকতা আর আনন্দ খুঁজে পাবেন? নিয়মিত পেট ভরে খেতে পারলে মানুষ না খেয়ে মারা যাবে না, কিন্তু মানুষ যদি ভোগ করার চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু কখনও না ভাবে তাহলে সেই চিন্তাহীন মানুষের সঙ্গে গৃহপালিত মুরগি বা পশুর পার্থক্য কোথায়?

আমাদের দেশে অনেক মানুষ এখন পেটভরে খেতে পারছে। নিম্নবিত্তের মানুষের হাতেও আছে মোবাইল ফোন। কিন্তু সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ মানুষকে গভীরভাবে চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করছে না। এই পরিবেশে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রও আর গভীরভাবে ভাবতে আগ্রহী নয় এমনই মনে হয়। কল্পনার সমুদ্রে কী করে জাহাজ নিয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে ভেসে পড়তে হয়, তা যেন তাদের ধারণার বাইরে। বই পড়া জরুরি তাদের আর তা শেখায় না এই শহর আর বিদ্যমান ব্যবস্থা। তাদের বাধ্য হয়েই সময় কাটাতে যেতে হয় বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়। প্রতিদিন গণমাধ্যমে আর শহরের পথে তরুণদের চোখে পড়ে বিভিন্ন পণ্যের জাঁকজমকপূর্ণ প্রচার, আর অগভীর বিনোদনের নানা উপকরণ।

এমন পরিবেশে সময় কাটানো আর বেড়ে ওঠা মানুষরা তাহলে কী করে লিখবে কবিতা, আগ্রহ খুঁজে পাবে ইতিহাসে, তৈরি করবে চিন্তাশীল চলচ্চিত্র আর শিখবে সেই রাজনীতি যা তৈরি করবে নতুন মানুষ– যারা, নবারুণ ভট্টাচার্যের ভাষায়,

"অন্যের জন্য বাঁচার মধ্যে নিজের জীবনটার সার্থকতা খুঁজে পাবে?"

[ঐ, পৃষ্ঠা-৭৭]

ঢাকা শহরের এমন রূপই এখন চোখে পড়ে যেখানে অগভীর চর্চার প্রতাপ দূরে ঠেলে দিচ্ছে গভীর ভাবনার গুরুত্ব। আর গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা না থাকলে মানুষ বুঝতেও পারে না কোন গুরুত্বপূর্ণ দিকটি তার জীবনে নেই এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত রাউফুন বসুনিয়ার ভাস্কর্যটি অযত্নে মলিন হয়ে থাকে প্রায়ই। যে তরুণরা সেই ভাস্কর্যের বেদিতে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে নিয়মিত আড্ডা দেয় তারা কি জানে রাউফুন বসুনিয়া কেন মারা গিয়েছিলেন? তা জানা কেন জরুরি তা বোঝার ক্ষমতাও হয়তো সেই কমবয়সীদের নেই। আর তাদের বোঝার এই ক্ষমতা তৈরি করার চেষ্টা কি করা হচ্ছে জাঁকজমক প্রাধান্য দেওয়া এই সময়ে?

টিএসসির পাশে ডা. মিলনের স্মরণে তৈরি স্মৃতিস্তম্ভটিতে বসে ভাত খায় পথে ফুল বিক্রি করা মানুষরা। তাদের ভাত-তরকারির কিছু কিছু পড়ে থেকে প্রায়ই নোংরা হয়ে থাকে স্থানটি। সেখানে অবলীলায় ঘুমিয়ে থাকে কেউ কেউ। ডা. মিলনের স্মৃতিজড়ানো এই স্থান যে এভাবে বিবর্ণ আর নোংরা হতে দেওয়া যায় না তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। এই স্থানগুলির বিবর্ণতা নির্দেশ করে ঢাকা শহরের বর্তমান মানুষদের মনের জড়তা আর নিষ্প্রভতা। পুরনো স্মৃতি, প্রয়োজনীয় স্মৃতি আজ মলিন এই শহরে একটি গোষ্ঠীর লাভের জন্য তৈরি করা চটক আর চাকচিক্যের কাছে।

কিন্তু এমন জৌলুস কোনো উজ্জ্বলতা আনতে পারে না। কারণ তা মানুষের মন করে তুলছে অগভীর আর বোধহীন। একটি বাউল গানের কথা এ রকম:

"ওরে ঢাকা খুলে দেখলে পরে, থাকবে না তোর সাবেক মন/ ঢাকা শহর ঢাকা যতক্ষণ।"

বিভিন্নভাবে গানটির কথাগুলো ব্যাখ্যা করা যায়। ঢাকা শহরটি ততক্ষণই আমার কাছে ঢাকা শহর মনে হয় যখন পুরনো দিনের মতো এই শহরের পথে আমি দেখব কবিতা আর রুচির স্নিগ্ধতা। দেখব না অন্ধচিন্তার অনুসারী আর লোভীদের আস্ফালন, দেখব না স্বার্থপরতার কারণে আদর্শবাদিতার হারিয়ে যাওয়া। এই শহরে আমি দেখব সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার ব্যক্তিগত অবস্থান আর সাহসী রাজনীতি। দেখব না সস্তা চটকের দাপটে গুরুত্ব হারাচ্ছে প্রকৃত সুন্দর বোঝার চিন্তাশীলতা। প্রতিবাদী ফরাসি তরুণরা বলেছিল:

"মানুষের আগে এসেছিল অরণ্য, পরে আসবে মরুভূমি।"

বর্তমান সময়ে ঢাকা শহরটি ঢেকে রাখা ধূসরতা, বাদামি বিবর্ণতা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে মরুভূমির কথা। কিন্তু ঢাকা শহর আমার কাছে ততক্ষণই ঢাকা শহর যতক্ষণ তা চিন্তা আর রূপের দিক থেকে মরুভূমি নয়।