রাজাকার সমাচার

আকতার হোসেন
Published : 23 Oct 2017, 09:44 AM
Updated : 23 Oct 2017, 09:44 AM

দৃশ্যত বাংলাদেশে কোনো রাজাকার অবশিষ্ট নেই। কিছু রাজাকার টিকটিকির মতো শুয়ে আছে শ্বেতপাথরের নিচে। কিছু পেয়েছে স্বাভাবিক মাটি। কিছু গেছে বনবাসে আবার কিছু বাস করছে তেলাপোকা ইঁদুরের সঙ্গে। যদি কেউ ঘুমিয়ে থাকে আধুনিক অট্টালিকায় কিংবা তাদের কাউকে দেখা যায় চায়ের আড্ডায় তারাও গুলিস্তানের পকেটমারের মতো ভীতসন্ত্রস্ত। ওদের নিয়ে আমরা ভাবি না। ওরা কচ্ছপের মতো পায়ের কাছে পড়ে আছে। রাজা থেকে আকারগুলো খসে পড়লে হয়ে যায় ধূলিকণা। সব রাজাকারের গা থেকে খসে পড়েছে আকার ওকার ওরা কার্যত মিশে গেছে মাটির সঙ্গে।

একদা এক মীর জাফর আলী খান ছিল বাংলার আম্রকুঞ্জে। সে-ও আজ বেঁচে নেই। লোকটা নেই মানে মীরজাফরও নেই। কিন্তু প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ঐ মানুষটির পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছে অন্য কিছু মানুষ। অগত্যা তাদেরকেই আমরা 'মীরজাফর' বলে ডাকি। রাষ্ট্রবিরোধী বা মীরজাফরদের জন্য বর্তমান যুগে এক বিকল্প শব্দ হল রাজাকার। এই শব্দের পরিবর্তে যতদিন অন্য কোনো শব্দ যোগ না হবে ততদিন তোতা পাখি থেকে শুরু করে সচেতন বাঙালির মুখে মুখে রাজাকার শব্দটি উচ্চারিত হতে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার ছাড়াও আধুনিককালে অন্য যাদের রাজাকার বলা হচ্ছে তারা মূলত ষড়যন্ত্রের শতরঞ্জি বগলে নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। এদের দল নেই জাত নেই পাত্র নেই। কাজেই বলা যেতে পারে, রাজাকার ঘৃণামিশ্রিত অপরাধ শনাক্তকারী উক্তি। এটা মুক্তিযুদ্ধের একটি ফসল। তুই রাজাকার মানে, তুই কথা বলিস না। তুই চুপ থাক, তুই তফাত যা।

যদিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কিছু গৌরবময় শব্দ ও ভাষা যা ছিল আমাদের সমষ্টিগত সেগুলোর কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে দল ও গোষ্ঠীর হাতে। বহুল ব্যবহারের কারণে সেগুলো অপব্যবহারও হচ্ছে। এর মধ্যে রাজাকার অন্যতম। কাজেই এ কথা হলফ করে বলা যাবে না যে, দেশ প্রেমিক, দানশীল, শিক্ষিত, ভালো মানুষ, ধার্মিক ইত্যাদি শব্দগুলো যেমন অপাত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে তেমনি রাজাকারও যত্রতত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। তাতে অবশ্য আসল রাজাকারদের অপরাধ কিছুতেই বিলীন হবে না। যে রাজাকার ছিল বা রাজাকার হচ্ছে তার অপরাধ তাকেই শাস্তি দিচ্ছে। রাজাকারদের বড় শাস্তি হল, তারা মুখ ফুটে বলতে পারে না ওরা রাজাকার। এমনকি একাত্তরের রাজাকারদের সন্তানেরাও বলে না যে, তাদের বাপ-ভাই রাজাকার ছিল। রাজাকার হওয়া যদি আনন্দের কিছু হত তাহলে প্রতিটি রাজাকারের সন্তান বলত, 'আমি রাজাকারের সন্তান'।

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও অনেকে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিচ্ছে। কিংবা বলছে, 'আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিল'। যদিও তার বাবা হয়তো কখনও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেনি। আদর্শগত দিক থেকে এখানেই মুক্তিযুদ্ধের অপর একটি বিজয়। আমাদের শাহবাগ ঠিক কাজটি করেছিল। একটা গতি এনেছিল। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কল্যাণে যাদের হাত মুখ চোখের ইশারা বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল শাহবাগ তাদেরকেই চিহ্নিত করেছিল।

এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের পুরোটাই কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময় 'বাংলাদেশ' নামে চিহ্নিত ছিল। ছাব্বিশে মার্চ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র প্রচারের পর থেকেই আমাদের দেশটির নাম হয়ে যায় বাংলাদেশ। তখন যা ছিল শত্রুর কবলে এবং আমাদের লক্ষ্য ছিল শত্রুর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করা। ২৬ মার্চ ১৯৭১এর পর যদি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ বলি তাহলে যেটা দাঁড়ায় তা হল, আমরা যুদ্ধ করে পাকিস্তান দখল করেছি। যদিও সেটা সঠিক নয়। আমরা আমাদের দেশকে শত্রু মুক্ত করেছিলাম ১৬ ডিসেম্বর। সে জন্য যুদ্ধের নাম ছিল মুক্তিযুদ্ধ।

কাজেই নিজের দেশে রিক্সা চালিয়ে মাস্টারি করে কিংবা পেশাদারিত্ব বজায় রেখে যারা সে সময় অবস্থান করেছিল তাদের ঢালাওভাবে দেশের শত্রু বা রাজাকার বলা যাবে না। দেশের মানুষ দেশে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেই মানুষগুলোর কেউ যদি আমাদের বিরুদ্ধে রাইফেল উঁচিয়ে যুদ্ধ না করে থাকে আমি কেন তাদের অপমান করব? মুজিবনগরপ্রবাসী সরকার ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাস নিষিদ্ধ করেনি কিংবা সকলকে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসতে বলেনি। এমন নির্দেশ থাকলে না হয় বলা যেত আদেশ অমান্য করা হয়েছে।

ভেবে দেখতে হবে, এক কোটি শরণার্থীকে জায়গা দিতে ভারতকে যে পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছিল যদি সাড়ে সাত কোটির সবাই ভারতে চলে যেত তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াত! যুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশে বসবাস করেও যে ব্যক্তি আমাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করেনি কিংবা শত্রুর পক্ষ নিয়ে মীরজাফর হয়ে ওঠেনি সে আমার বন্ধু না হলেও শত্রু নয়।

আমরা খুব সহজেই ভুলে যাই যে, রাজাকার যত উপদ্রব করেছিল তার থেকে অনেক বেশি অত্যাচার করেছিল আলবদর-আলশামসের সদস্যরা। এরাই বেছে বেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের হত্যা করেছে। পাকিস্তান আর্মিদের জিপে করে ঘুরে বেড়িয়েছে। রাজাকারদের বিচার হচ্ছে এবং হতেই থাকবে। কিন্তু আলবদর-আলশামসদের রাজাকার বলে সম্বোধন করলে তাদের অপরাধ লঘু করা হবে। ডাকাতকে চোর বললে যেমন হয় ঠিক তেমনি।

দুঃখের বিষয়, হালে কাউকে বলতে শুনি না আলবদর কিংবা আলশামসের গল্প। চারদিকে অসংখ্য রাজাকার। তাহলে সেই আলবদর-আলশামসরা গেল কোথায়? রাজাকারদের বিরুদ্ধে আমরা সার্থকভাবে ঘৃণা ছড়িয়েছি। কিন্তু হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে জল্লাদের দল। ওদের নাম কাকের মুখেও আজকাল শোনা যায় না।

সম্প্রতি আর একবার রাজাকার শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে। যদি তেঁতুলিয়া থেকে মানচিত্রের উপর কিছু সরলরেখা আঁকা যায় আজও দেশটা কয়েকটা ভাগে বিভক্ত দেখাবে। পৃথিবীর সব দেশে শিল্প-সাহিত্যের জগতে একজন বড় কবি সুউচ্চ আসনে বসে থাকেন। সব দেশের ইতিহাসে থাকে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। আবার সব দেশের মধ্যমণি হয়ে থাকেন একজন মানবিক গুণসম্পন্ন নেতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যদি বাংলাদেশের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম দিক না হয়ে থাকে তবে বাংলার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা আর কী হতে পারে? যদি বঙ্গবন্ধু আমাদের সেই বড় মাপের নেতা না হন তবে অন্যজনের নাম আমরা কেন জানি না?

তবুও কী কারণে যেন আমাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে 'তবে' 'কিন্তু' লাগিয়ে অন্যপক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজে পথ ও জনগোষ্ঠীর বাইরে গিয়ে বিদেশিদের প্রভু মানতে ইচ্ছুক যারা তারাই 'বিদেশি কুকুর বনাম দেশি ঠাকুর' প্রবাদের মধ্যে পড়ে। খুব কাছ থেকে দেখা কাউকে বড় হতে দেখলে অনেকে তা মেনে নিতে পারে না। কেননা বড় ব্যক্তিটি এমন কিছু ব্যক্তিকে অতিক্রম করে উঁচুতে উঠে যায় যা সেই কাছের লোকগুলোকে অবাক করে দেয়। তারা সহযোগী বা সহকর্মী না হলেও মনে করে, 'অমুক হয়েছে অত বড়, আরে, ওকে তো আমি চিনি'।

তাই যুগ অতিক্রমণ করা ক্ষমতাবানকে অনেক সাধারণ ব্যক্তিও এড়িয়ে যেতে চায়। এমন কিছু ঘটনা ও ব্যাখ্যা দিয়ে বলা যেতে পারে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে আজও কিছু মানুষ মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু সময়োত্তর যুগে সেই সমস্ত ঈর্ষা আর বিরোধ মিলিয়ে বেরিয়ে আসে সত্যের মুখ। বঙ্গবন্ধু হলেন আমাদের উজ্জ্বল মুখ যিনি জাতিকে গ্রহণ করেছিলেন, জাতি গ্রহণ করেছিল তাঁকে। বঙ্গবন্ধুকে যারা জাতির পিতা মানে না তাদের জাতির পিতা কে তা তারাই ভালো জানে।

তবে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের জাতির পিতাই আমাদের সবচাইতে বড় সনদ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, 'আমার বাঙালিরা আজ মানুষ হয়েছে'। এরপর আর কাউকে সনদ দিতে বলা হয়নি। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ লক্ষ জনতার সামনে পাহাড়সম তাঁর এই উক্তির পর কেউ যদি নতুন করে আমাদের বলে, 'আবার তোরা মানুষ হ' কে শুনবে তার সেই কথা?

এ কথা সত্য যে, যুদ্ধের পর প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতার অভাবে সামান্য কিছুদিন অনিয়মের মধ্যে চলেছে দেশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সংযম রক্ষা করা হয়নি, এমনকি ঢাকা শহরে কিছু কিছু লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। এসব দেখে সদ্য অস্ত্র জমা দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা সোনা হীরা কাঞ্চন মানিকেদের হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছিল। হতাশাজনিত কারণে তাদের প্রতিবাদের ভাষাও বদলে যেতে পারে। তাই বলে সোনা মানিক হীরা ওরা অমানুষ হয়ে যায়নি। যে ডাক তখন দেওয়া যেত তা হল, ধৈর্য এবং সংযমের পথে আসার ডাক। 'আবার তোরা মানুষ হ' বলার প্রয়োজন ছিল না।

ভাবতে অবাক লাগে সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক গতি পেয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ যখন দানা বাঁধতে শুরু করেছে সেই ক্ষণে খান আতা তৈরি করেছিলেন 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' চলচ্চিত্র। যার সূচনা সঙ্গীত 'ও আমার জন্মভূমি মাগো'। এই গান শুনে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যেত তখন। যুদ্ধকালীন নয় মাস শুধু ভেবেছি লর্ড ক্লাইভ আর পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সিরাজউদ্দৌলা হেরেছে, কিন্তু আমাদের পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জিততেই হবে। সেই অনুপ্রেরণা জোগানো সিনেমার চিত্রনাট্য পরিচালনায় ও সঙ্গীত করেছেন যে খান আতা।

এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন আগে বানানো 'জীবন থেকে নেয়া' ছবিতে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানের সঙ্গীত পরিচালনা করা খান আতা– যিনি সেই একই সিনেমাতে খাঁচা ভাঙ্গার গান গেয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি কী করে পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করতে পারেন? তা-ও আবার প্রাণের ভয়ে নয় স্বেচ্ছায় গিয়েছিলেন পাকিস্তানিদের সঙ্গে। কাজেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে স্বাধীনতার কিছুদিন পর যখন দেশের সোনার ছেলেদের উদ্দেশে বললেন, 'আবার তোরা মানুষ হ'– তখন তাঁর ডাক প্রত্যাখ্যান করেছিল দেশবাসী। সিনেমাটা বিভিন্ন কারণে জনপ্রিয়তা পেলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না গিয়ে বিপক্ষে স্থান পেয়েছিল।

খান আতাউর রহমানের সামান্যটুকুর জন্য আজ তাঁর অশেষ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু খান আতাকে রাজাকার বলার পূর্বে বলেছেন, 'খান আতা কিন্তু একজন বড় শিল্পী কোনো সন্দেহ নেই'– এরপর তিনি যোগ করেন, 'কিন্তু খান আতা একজন রাজাকার'। সেই থেকে দেশ-বিদেশে বাচ্চু ভাইয়ের বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশটা নিয়ে এত কথা হচ্ছে অথচ তাঁর কথার প্রথম অংশ (একজন বড় শিল্পী) সেটা যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আমরা কি তাঁকে গ্রহণ করব না বিদায় জানাব সে নিয়ে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এম এর আখতার মুকুলের 'চরমপত্র', রাজু আহমদের 'জল্লাদের দরবার' ইত্যাদি শুনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা সাহস পেত, তাদের মনের জোর বেড়ে যেত। ঠিক তার বিপরীতে ঢাকায় বসে খান আতার কথিকা বিবৃতি পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলতো। তাই প্রশ্ন এসেছে তিনি রাজাকার বেশি না শিল্পী বেশি? এই নিয়েই চলছে পক্ষ বিপক্ষ। কাজেই সাধারণ মানুষদের জানা প্রয়োজন আমরা কি খান আতার লং প্লে বাজাতে থাকব না ভেঙ্গে ফেলব? তাঁর গানের স্বরলিপিগুলো কি পুড়িয়ে ফেলব না যত্ন করে রেখে দেব?

নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমায় গোলাম হোসেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে নবাব জিজ্ঞেস করেছিল, 'গোলাম হোসেন, সেনাপতি মীর জাফর কি বিশ্বাসঘাতক'? এরপর পলাশীর যুদ্ধ শেষ হলে মোহন লালের চরিত্রে অভিনয় করা খান আতা চলে যান সেনাপতি মীর জাফর আলি খানের তাবুতে। সেখানে তাঁকে হত্যা করার জন্য তরবারি উঁচু করলে ইংরেজদের গুলিতে মোহন লাল মাটিতে পড়ে যান। মাটিতে শুয়ে থেকে মোহন লাল অর্থাৎ খান আতা বলেন, 'আমি তোমাকে হত্যা করতে পারলাম না, কিন্তু আমি তোমাকে এই অভিশাপ দিচ্ছি এদেশের মানুষ যতদিন কথা বলবে ততদিন তারা বিশ্বাসঘাতকে মীরজাফর বলে গাল দেবে'।

সেই থেকে বিশ্বাসঘাতক মানেই মীরজাফর আর বর্তমানে মীরজাফর মানেই রাজাকার। নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমার সংলাপ সেই সিনেমার স্রষ্টাকেই আজ বধ করেছে। খান আতা আমাদেরই একজন ছিলেন। রাজাকার ডাকটা তিনি নিজেই যোগাড় করে এনেছেন। কাজেই প্রশ্ন জেগেছে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি যতটুকু তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করে ঋণী হয়েছে তারপরও কি বলতে হবে, হে বন্ধু বিদায়? প্রাপ্তির অংশটুকু কি নিরাশার আঁধার গিলে ফেলবে?

এভাবে ভাঙতে থাকলে হয়তো টিকবে না অনেক কিছু। সে দিয়েছ যতো তার থেকে আরও বেশি দিতে পারত। হয়তো থাকতে পারত আমাদের সঙ্গে ঠিক আমরা যেমনটি চেয়েছিলাম। কিন্তু সে যা করেছে তার নিজের ইচ্ছেতেই করেছে। এখন যদি তাকে তফাত যেতে বলি তাহলে কোন অধিকারে ধরে রাখব তাঁর রেখে যাওয়া অবদান? তফাত মানে কি বর্জন নয়?

এত কিছুর পরও আমরা অনেককে মেনে নিয়েছি, আবার ছেড়েছি অনেককে। খান আতার ভাগ্যে কী হয় সেটাই দেখার বিষয়। তিনি যখন লিখেছিলেন 'এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা, তোমাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না'– সে গান আমি কি শুনব না শুনব না? তাঁর গান যদিও-বা শুনি তখন কি নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করব, কেন তিনি বিখ্যাত গান 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমদের ভুলব না' এই গানের বিপরীতে শহীদদের আত্মত্যাগের তুলনা করলেন নদীর সঙ্গে?

হ্যাঁ, বুঝলাম, ভাই, নদী সাগরের চেয়ে ছোট কিন্তু নদীটাই-বা কম কীসে?