রোহিঙ্গা সংকট: সমস্যার গভীরে যেতে হবে

Published : 16 Oct 2017, 05:41 AM
Updated : 16 Oct 2017, 05:41 AM

বছর কুড়ি আগে বার্মার সামরিক সরকার সাবেক বার্মার নাম পরিবর্তন করে মিয়ানমার রেখেছিল, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে এখনও বার্মা নামটি প্রচলিত রয়েছে। এই বার্মা বা মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাষ্ট্র। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও মিয়ানমার বাংলাদেশের পক্ষে কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে বলে জানা যায়। বিশেষ করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং বুদ্ধিজীবী মিয়ানমারে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছিলেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সীমান্তঘেঁষা দুই দেশের মধ্যে সীমিত বাণিজ্য হয়, যোগাযোগ হয়। নাফ নদী-সংক্রান্ত বিরোধ বাদ দিলে স্বাধীন বাংলাদেশের চার দশকের ইতিহাসে বোধহয় দুই দেশের মধ্যে তেমন একটা উল্লেখযোগ্য মনোমালিন্য হয়নি।

একসময় দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে সীমিত যোগাযোগ থাকলেও সম্প্রতি বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার পরস্পরের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বাড়ানোর পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান না হলে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক কোনো সম্পর্কই যে টেকসই হবে না সেটা পরস্পর প্রতিবেশি এই দুই দেশকে আরও বেশি উপলব্ধি করতে হবে। বিশেষ করে মিয়ানমারকে।

বাংলাদেশের সঙ্গে সত্তরের দশকে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ এবং স্থায়ী সমাধান না হওয়ায় বাংলাদেশকে এখনও চরম ভুগতে হচ্ছে। মিয়ানমারে ১৯৭৮ সালে 'কিং ড্রাগন অপারেশন' চালানোর মাধ্যমে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা নিপীড়ন সময়ে প্রকট আকার ধারণ করে। সত্তরের দশক থেকে কখনও দাঙ্গা কখনও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অবয়ব ২০১২ সাল থেকে চরম উদ্বেগজনক আকার ধারণ করে। গত বছরের অক্টোবরের দমন-নিপীড়নের রেশ কাটতে না কাটতেই ২৫ আগস্ট থেকে আবার রোহিঙ্গা নিপীড়ন শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

চরম উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার বিষয় হল, এবারের নিপীড়ন সবচেয়ে ভয়াবহ ও দানবীয়। এর বিরুদ্ধে জাতিসংঘসহ বিশ্ব প্রতিবাদমুখর হলেও মূলত এখনও মিয়ানমারের উপর তাদের কার্যকর কোনো প্রভাব পড়েনি। ২৮ সেপ্টেম্বর (বাংলাদেশ সময় ২৯ সেপ্টেম্বর) নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশ্বের নজর ছিল ঐ বৈঠকের দিকে।

একটি জাতিগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যুগ যুগ ধরে যে নিপীড়ন চালাচ্ছে তা শুধু অপরাধ নয়, এটা মানবতাবিরোধী। রাখাইনে জঙ্গি, বিদ্রোহী এবং সন্ত্রাসবাদী দমনের নামে সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর সামরিক জান্তার নির্দয় অভিযানে সৃষ্ট মানবিক এই সংকট কোনো অজুহাত কিংবা যুক্তিতে আড়াল করা যাবে না। মূলত মিয়ানমারে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। এটা আর লুকানোর সুযোগ নেই।

পৃথিবীর উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত কোনো দেশে কি অপরাধ হয় না? অপরাধকারীরা কোনো না কোনো জনগোষ্ঠীভুক্ত হয়ে থাকে। তাদের গুটিকয়েক লোকের জন্য এভাবে সমগ্র জাতিগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন চালানো যায় না।

আরাকান, রাখাইন ও সু চি

এখনকার রাখাইন পূর্বে স্বাধীন আরাকান ছিল। আরাকান মিয়ানমারের একটি অঙ্গরাজ্য। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত এবং অতি প্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বঙ্গোপসাগর এবং নাফ নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম মোহনা-বেষ্টিত আরাকান-ইয়োমা নামের দীর্ঘ পর্বতশৃঙ্গ আরাকানকে মিয়ানমারের অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করেছে। আরাকানের প্রাচীন নাম 'রাখাইনপিয়ে'। সেখানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের আগে অধিকাংশ আরাকানি ছিল প্রকৃতি-পূজক। চারটি প্রশাসনিক ইউনিট হচ্ছে, স্যান্ডোয়ে, সিটটয়ে, মাইয়ু এবং কিয়াউকপিউ। কোলাদানের মুখে অবস্থিত আকিয়াব ছিল আরাকানের রাজধানী শহর এবং প্রধান বন্দর। অন্যান্য প্রধান শহর এবং বন্দরগুলি হচ্ছে, কিয়াকটও, মংডো, বুথিডং এবং স্যান্ডোয়ে।

১৪৩০ সালে আরাকানে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুশ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। সে সময় মুসলমানরা সেই রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেন। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত সেখানে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।

ইতিহাস বলছে, ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ শাসনের আগে এটি ছিল একটি ছোট্ট মৎস্য-পল্লী। ১৭৩১ থেকে ১৭৮৪ সালের মধ্যে ১৩ জন রাজা আরাকান রাজ্য শাসন করেন। এ রাজাদের গড় শাসনকাল দুবছরের বেশি ছিল না।

১৭৮৪ সালে বোদাউপায়ার (১৭৮২-১৮১৯) সময়ে আরাকান রাজ্য তৎকালীন বার্মা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। পরবর্তীতে ১৮২৬ সালে এটি ব্রিটিশ শাসনের অংশে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এটি সাময়িকভাবে জাপানের দখলে ছিল।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও দেশটি মূলত যে অর্থে রাষ্ট্র সেই অর্থে রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটি সামরিক শাসনের অধীনস্থ ছিল অন্তত দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আজকের বিতর্কিত অং সান সু চি দেশটিতে সামরিক শাসন অবসান করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জীবনের দীর্ঘ সময় নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পার করেছেন। এক পর্যায়ে তিনি 'গণতন্ত্রের মানসকন্যা' হিসেবে খ্যাতি পান। সামরিকতন্ত্রের বিপক্ষে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য ১৯৯১ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য ভারত সরকার তাঁকে 'জওহরলাল নেহেরু' পুরস্কার প্রদান করে। এছাড়াও তাঁর হাতে আরও অনেক উল্লেখযোগ্য পুরস্কার উঠেছে।

১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে গৃহবন্দি হয়েছিলেন সু চি। অবশেষে দীর্ঘ দুই দশক পর ২০১০ সালের ১৪ নভেম্বর মুক্তি পান। আজকের সু চিকে বিশ্ববাসী মেলাতে পারছেন না সেই সু চির সঙ্গে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি ন্যূনতম নিরপেক্ষতা এবং মানবতা দেখাতে পারেননি। সর্বশেষ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া তাঁর ভাষণেও তিনি বিশ্ববাসীকে চরম হতাশ করেছেন।

তবে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সু চি এবং তাঁর সঙ্গে গণতন্ত্রপন্থী যাঁরা ছিলেন তাদের কম নিপীড়ন করেনি। সেদেশের হাজার হাজার নেতা, কর্মী এবং সমর্থককে হত্যা করেছে সামরিক জান্তা। বার্মিজ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি বড় অংশ সু চির গণতন্ত্রের সেই আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। জান্তা আন্দোলনকারী অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষুকেও নিপীড়ন এবং হত্যা করেছিল। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন অনেকে।

মিয়ানমারে সু চির গড়া রাজনৈতিক দল (এনএলডি) বর্তমান ক্ষমতায় এলেও একে গণতন্ত্র বলা যায় না। বর্তমান সংসদে পঁচিশ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণাণালয়গুলো সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। পৃথিবীর আর কোথাও এমন গণতন্ত্রের নজির নেই। তাদের সমর্থন বা অনুমোদন ছাড়া মূলত কিছুই সম্ভব হয় না। এটা অনেকটা আধা-গণতন্ত্র এবং আধা-সামরিকতন্ত্র।

তবে যুক্তির কথা হল, সু চির উচিত মানবাধিকার এবং মানবতার পক্ষে কথা বলা। সেনাবাহিনীর সুরে কথা বলা তাঁকে মানায় না। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিন্দার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে এটা তার বুঝা উচিত। ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত সু চিকে সেনাবাহিনী দীর্ঘ সময় ধরে কোনঠাসা করতে পারলেও এতদিন পর্যন্ত তিনি বিশ্ববাসীর কাছে অমলিন ছিলেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেনাবাহিনী সু চিকে বিশ্ববাসীর কাছে ঘৃণিত করে তুলতে পেরেছে। এটাও সু চির বিরুদ্ধে সেদেশের সেনাবাহিনীর একটা অর্জন হিসেবে গণ্য হতে পারে। তাছাড়া, জঙ্গি বা বিদ্রোহী দমনের নামে পৃথিবীর কোথাও বেসামরিক নাগরিকদের উপর নিপীড়ন চালানো হলে সেই দমন অভিযানের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।

এটা মুসলিম নিপীড়ন কিনা?

সামরিক জান্তা কর্তৃক চলমান রোহিঙ্গা নিপীড়নকে অনেকে বৌদ্ধ-মুসলিম সমস্যা হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিপীড়ন করছে। রাখাইনের নিপীড়িত রোহিঙ্গারা মুসলমান হওয়ায় অনেকের মতে এটা বৌদ্ধ-মুসলমান সমস্যা।

মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার ৫-৬ শতাংশ হল মুসলমান জনগোষ্ঠী। জনসংখ্যা পাঁচ কোটি হলে সমগ্র মিয়ানমারে অন্তত পচিঁশ লাখ মুসলমান বাস করেন। তাদের একাংশ রাখাইনে বাস করেন যারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। যুগ যুগ ধরে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেই সেনাবাহিনী নিপীড়ন করে আসছে। এর ধারাবহিকতায় ১৯৮১ সালে সামরিক শাসনকর্তা 'আরাকান' রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে 'রাখাইন' প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।

শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইনে বসবাস করলেও সরকার তাদেরকে সেদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এই জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতে ১৯৮২ সালে সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় এবং সরকারিভাবে তাদেরকে সেখানে বহিরাগত 'বসবাসকারী' হিসেবে উল্লেখ করে। এখন আবার রোহিঙ্গাদের সরাসরি বাঙালি বলছে। এর মাধ্যমে তাদের ভোটাধিকার, সাংবিধানিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

কিন্তু মিয়ানমারের সকল মুসলমান নাগরিকত্বহীন নয় এবং রাখাইনের বাইরে যারা বর্মী মুসলমান নাগরিক আছেন তাদের নিপীড়ন করা হচ্ছে এমন খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে বলে আমার জানা নেই। অবশ্য জীবনধারণের ক্ষেত্রে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। দৃষ্টিনন্দন অনেক মসজিদ মিয়ানমারে আছে বলে জানি। সেখানে বৌদ্ধ বিহার এবং মসজিদ পাশাপাশি অবস্থানে আছে যুগ যুগ ধরে এমনও অনেক নজির আছে।

ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়নো হচ্ছে

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের পাশাপাশি এক শ্রেণির গণমাধ্যম এবং স্বার্থান্বেষী মহল বিষয়টি বৌদ্ধ-মুসলিম সমস্যা বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। জাতিগত হলেও একে ধর্মীয় সমস্যা হিসেবে প্রচার করায় উস্কানি তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা ও নাশকতার মতো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটছে। সরকার এবং প্রশাসন কঠোর অবস্থানে না থাকলে তা হয়তো অচিরেই ব্যাপক আকার ধারণ করত।

এমনিতেই দেশের বৌদ্ধরা উদ্বিগ্ন, তার উপরে উসকানিমূলক প্রচারণা এই উৎকণ্ঠা আরও বাড়িয়ে দেবে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিপীড়নের ঘটনায় গৌতম বুদ্ধ, সমগ্র বৌদ্ধ এবং বৌদ্ধ ধর্ম কেন্দ্র করে নানা ধরনের মন্তব্য, বিকৃত ছবি এবং লেখা প্রকাশ করা হচ্ছে। অথচ গৌতম বুদ্ধের অহিংস নীতি সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তি মাত্রেই অবগত। এদেশের বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের জন্য যতটুকু করছেন তা অনেকের ভাষায় 'পিঠ বাঁচানোর জন্য' এবং নিরাপদে থাকার কৌশল হিসেবে। তাদের কাছে এখানকার বৌদ্ধদের মানবিক বিষয়টি উপেক্ষিত।

যে যাই বলুন না কেন এদেশের বৌদ্ধরাও রোহিঙ্গাদের উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আসছেন এবং সাহায্য নিয়ে সাধ্যমতো তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার ব্যবস্থাপনায় আমরাও (অর্ধশত ভিক্ষুসংঘ) কিছু ত্রাণ সহযোগিতা নিয়ে উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলাম।

মিয়ানমার কিংবা বৌদ্ধ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের সামরিক জান্তা কিংবা সেদেশের কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী মানুষের কর্মকাণ্ডের মানদণ্ডে যদি বৌদ্ধধর্ম, মহামতি বুদ্ধ এবং বিশ্ববৌদ্ধদের মান ও নৈতিকতা বিচার করা হয় কিংবা সামগ্রিকভাবে সবাইকে দোষী প্রমাণিত করার চেষ্টা করা হয় তাহলে বিশ্বের প্রেক্ষাপটে সকল জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, ধর্মপ্রবর্তক এবং সেই ধর্মের অনুসারী মাত্রই একই দোষে দোষী হবার কথা।

অথচ এই মানবিক বিপর্যয়ে ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ না ছড়িয়ে জাতিধর্মনির্বিশেষে সবার উচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠন করা এবং রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো, রোহিঙ্গা সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপে ফেলা এবং সর্বোচ্চ কুটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিশ্বসম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে পাওয়া ও পাশে রাখার জোর চেষ্টা চালানো।

বাংলাদেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এবং তার সরকার সঠিক পথে এগোচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং মানবিক ভূমিকায় বাংলাদেশ আগে কখনো অবতীর্ণ হয়েছে এমন নজির আছে বলে অন্তত আমি মনে করিনা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এবং তার সরকার এবং আইনশৃংখলা বাহিনীগুলো একটা সংকটময় সময় পার করছে বলা যায়।

প্রথমত, লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধকে আবাসন করা, তাদের খাদ্য, নিরাপত্তা, চিকিৎসা সেবাসহ ত্রাণকার্য পরিচালনা করা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশে কোনো উগ্র গোষ্ঠী যাতে সাম্প্রদায়িক বা যে কোনো ধরনের অপতৎপরতা চালিয়ে এদেশের বৌদ্ধদের উপর সহিংসতা ঘটাতে না পারে এজন্য বৌদ্ধদের নিরাপত্তা জোরদার করা, রোহিঙ্গা নিপীড়নে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়া, দেশি-বিদেশি চাপ সামলানো ইত্যাদি কারণে সরকার কঠিন সময় পার করছে।

এ সময় রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সবার উচিত হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে সরকার এবং প্রশাসনকে যার যার স্থান থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা। মিয়ানমারে যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার বঞ্চিত করে রাখাসহ সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ প্রতিবাদ হওয়া উচিত যেটা এখন হচ্ছে। দেশি বিদেশি প্রতিবাদের এই ধারা ধরে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকাও খুব বেশি দরকার। তবে সেটা যুদ্ধের উসকানি কিংবা ধর্মীয় উসকানি দিয়ে নয়। নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে এটাও তো ভুলে গেলে চলবে না যে, ধর্মীয় উসকানি দিয়ে বিনা অপরাধে এদেশের বৌদ্ধদের নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়া হলে রোহিঙ্গাদের উপকার হবে না।

বাংলাদেশ এবং তার জনগণ আমরা সবাই মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের কল্যাণ চাই। মিয়ানমারে তাদের নাগরিক অধিকারসহ সকল প্রকার মানবিক অধিকার নিশ্চিতকরণ চাই। এটা করতে হলে সর্বোচ্চ এবং সুদক্ষ কুটনৈতিক তপরতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার। কারণ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ মানবিক অবস্থানে আছেন। কিন্তু সেদেশে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দায় এড়াতে পারে না। এই জায়গাটিতেই দলমতজাতিধর্মনির্বিশেষে আমাদের সকলের জাতীয় ঐক্যমতের দরকার আছে। প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা এই মানুষদের সেখানে জোর করে ফেরত পাঠানো সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ নয়। রাখাইনে তাদের জীবনের সুরক্ষা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে তারপর ফেরত পাঠানোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

যত দিন এটা করা যাচ্ছে না তত দিন জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক দাতা দেশ এবং সংস্থাগুলোর সহযোগিতা ধরে রাখতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা হচ্ছে না। ২ অক্টোবর দ্বিপাক্ষিক আলোচনার অংশ হিসেবে মিয়ানমার তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা রাজি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। দুই দেশ 'জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ' গঠন করে কাজ করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে বলে জানা যায়। তবে মিয়ানমার সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, গত বছরের অক্টোবর এবং চলতি বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে যারা পালিয়ে এসেছে তাদেরসহ নিবন্ধিতের মধ্যে মাত্র ২৪১৫ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিবে তারা। বিগত সময়ে আসা আরও যত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন তাদের সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে কিছুই বলা হয়নি। যাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রাজি হয়েছে মিয়ানমার তাদের কবে নাগাদ ফিরিয়ে নেওয়া হবে এটাও স্পষ্ট নয়। আমাদের এক মন্ত্রীর ভায়ায়, 'পাঁচ বছরও লাগতে পারে আবার পঞ্চাশ বছরও লাগতে পারে'।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিদ্বেষ এবং ভীতি কেন?

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে দাবি করে আসছে। তাদের দাবি, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়েছে। মিয়ানমারে তো আরও প্রায় ১৩৫টি মত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে। ওখানকার বেশ কিছু নিপীড়িত এবং অধিকারবঞ্চিত জাতিগোষ্ঠী সেনাবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্রোহ করে আসছে। আবার অনেক দলের সঙ্গে মিয়ানমার শান্তি আলোচনা এবং সমঝোতাও করেছে। তাহলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এমন আচরণ কেন?

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর রাখাইন অঞ্চলের মুসলমানরা (রোহিঙ্গারা) প্রথমে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত 'রাষ্ট্র পাকিস্তান'এর সঙ্গে যেতে চেয়েছে। সেই লক্ষ্যে ১৯৪৭ এর এপ্রিল মাসে রোহিঙ্গা সংগঠনের প্রতিনিধিরা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু জুলাই মাসে আং সান এবং জিন্নাহ একমত হন যে, নাফ নদীর ওপারের সীমানা নিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না পাকিস্তানের পক্ষ থেকে। ফলে লাহোর প্রস্তাবের মুসলিম 'স্টেটস' পাকিস্তান নামক 'স্টেটে' এসে থেমে যায়। রোহিঙ্গাদের একাংশ পাকিস্তানের আদলে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গড়ে পুরোনো আরাকান রাজ্য উদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হয়।

তৎপরবর্তী সময়ে স্বাধীন আরাকান অঞ্চল বা রোহিঙ্গা অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠে ওই অঞ্চলে। এদের অন্তর্দ্বদ্ব ছিল বলেই বিভক্তি বাড়তে থাকে এবং সংগঠনের সংখ্যাও বাড়ে। ১৯৬৩ (মতান্তরে ১৯৬৪) সালে গঠিত হয় রোহিঙ্গা ইনডিপেনডেন্ট ফোর্স (আরআইএফ)। পরে, ১৯৬৯ সালে গঠিত হয় রোহিঙ্গা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি (আরআইএ), যেটি আবার ১৯৭৪ সালে রোহিঙ্গা পেট্রিয়িটিক ফ্রন্ট বা আরপিএফ নামে রূপান্তরিত হয়।

তবে বর্তমান সময়ের আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেনশন আর্মি (আরসা)সহ এরকম বিভিন্ন সংগঠন গঠিত হলেও মিয়ানমারের মধ্যবিত্ত রোহিঙ্গাদের একটা অংশ মিলিট্যান্ট এসব সংগঠনের প্রতি আস্থা রেখেছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তারা বরং মিয়ানমার রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকেই অন্য দশজন নাগরিকের মতো অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার পক্ষে ছিল বলে একাডেমিক রেফারেন্স পাওয়া যায়।

মিয়ানমার হয়তো মনে করে রোহিঙ্গারা আরাকান স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র করছে। তারা শক্তি এবং জনবল বাড়াতে পারলে স্বাধীন আরাকানের দাবি আরও জোরদার করে তুলবে। হয়তো সেই ভাবনা থেকেই সেনাবাহিনী রাখাইন থেকে নির্দয়ভাবে রোহিঙ্গা বিতাড়ন অভিযান চালাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা বেশিরভাগ রোহিঙ্গাকে রাখাইন থেকে ইতোমধ্যে বিতাড়ন করেছে। এভাবে কয়েক দফা চালাতে পারলে হয়তো রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাশূন্য হতে বেশি সময় লাগবে না।

নেতৃত্বহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং অদূরদর্শী বিদ্রোহী

রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার পথ বেছে নিয়েছে। কোনো জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে নিপীড়িত এবং অধিকারবঞ্চিত হয়ে থাকলে তারা চরম পন্থার দিকে ঝুঁকতে পারে। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা এই পথে পা বাড়িয়েছে। তারা একে জঙ্গিপনা বা চরমপন্থা বলে মনে করে না। তারা মনে করছে এটা তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই। তারা এ-ও মনে করে যে, তারা এ লড়াই করছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের স্বার্থে।

যেহেতু রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা এখন আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শিকার তাই হয়তো সীমিত অস্ত্র এবং অর্থ তারা আপাতত পাচ্ছে। যারা তাদের নিয়ে খেলছে তারা কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভালো চায় না। একটি শ্রেণি আছে যারা নিজেদের স্বার্থরক্ষায় রোহিঙ্গা সমস্যাটি জিইয়ে রাখতে চায়। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের ক্ষতি করাও আরেক শ্রেণির লক্ষ্য।

বাংলাদেশ হয়তো এটা বুঝতে পেরেছে বলেই মিয়ানমারের অভিযোগের ভিত্তিতে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছিল মিয়ানমারকে। কিন্তু মিয়ানমার তাতে সাড়া দেয়নি। বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছে যে, কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশের ভূমি কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।

রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের এই চরমপন্থায় যাওয়ার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। সকল প্রকার নাগরিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে হলে আরাকান স্বাধীন করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা, না হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে তাদের সঙ্গে শর্তস্বাপেক্ষ শান্তি আলোচনায় বসতে বাধ্য করা। একটি সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সামরিক যুদ্ধ করার শক্তি বা সামর্থ্য অর্জন না করে তাদের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া আদৌ সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নয়। মাঝে মাঝে বিদ্রোহীরা যে চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে তাতে বিদ্রোহীরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে নির্বিচারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের একটি মোক্ষম অস্ত্র হাতে তুলে দিচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের জীবনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে বিদ্রোহীরা অদুরদর্শী কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার পরিণাম কত যে ভয়াবহ হতে পারে তা তাদের ভালোভাবে বুঝা উচিত। তাদের এই লড়াইকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে আখ্যা দিয়ে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর বার বার ঢালাওভাবে নিপীড়ন চালাবে এটা বুঝা উচিত।

রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহক বিশ্বও ভালভাবে নিচ্ছে না। একেক বার নিপীড়ন চালিয়ে সেনাবাহিনী যদি কয়েক লাখ করে রোহিঙ্গা বিতাড়ন করতে পারে তাহলে অচিরেই রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে যাবে। বর্তমান রাখাইন রাজ্য থেকে সিংহভাগ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়েছে। তাহলে কাদের স্বার্থে এই লড়াই?

তাদের অদুরদর্শী ভাবনার কাজের মাশুল দিতে হয় সাধারণ রোহিঙ্গাদের। অতীতের রোহিঙ্গা নেতৃত্বও কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যা রোহিঙ্গাদের বংশপরম্পরা সন্দেহ, বিদ্বেষ এবং ঘৃণার চোখে দেখার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের উচিত সহিংসতার পথ পরিহার করে সকল প্রকার মানবিক এবং নাগরিক অধিকার আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। তাদের এই আন্দোলনে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর সমর্থন থাকবে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের এই আন্দোলন পৃথিবীর দেশে দেশে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। হয়তো এতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। এটা নির্ভর করে তাদের নেতৃত্বের উপর।

তাই আরাকান স্বাধীন করার নামে নিশ্চিহ্ন না হয়ে নাগরিক অধিকার আদায়ের দিকে তাদের জোর দেওয়া উচিত। অসহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের দৃষ্টান্ত তো তাদের দেশ মিয়ানমারের আছে। ২৫ আগস্ট থেকে চলা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতার কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হওয়ার ফলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা নিপীড়িত হচ্ছে এই সত্য এবং কড়া বার্তাটি বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে। এই খবর আগে এভাবে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছেনি। তাই বিশ্ববাসী এখন রোহিঙ্গাদের প্রতি গভীর সহানুভূতিশীল। তাদের মানবাধিকার সম্পর্কে বিশ্ব যথেষ্ট সচেতন এবং যত্নশীল হবে। এই সুযোগ সতর্কভাবে কাজে লাগাতে হবে।

পরস্পরের প্রতি মানবিক দায় আছে

মানবিক বিবেচনা, ধর্মীয় ও জাতিগত আবেগ, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, সাংগঠনিক দায়বদ্ধতাসহ বিভিন্ন কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি এদেশের মানুষের দয়া এবং করুণা আছে। তাই হয়তো তারা আপাতত কিছু ত্রাণ পাচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এই ত্রাণ মোটেও পর্যাপ্ত নয়। তার উপর ত্রাণ বিতরণে সুষম ব্যবস্থাপনা না থাকলে এই ত্রাণও তাদের খুব বেশি কাজে আসবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, অসহায় এই মানুষদের কিছু ত্রাণও এক শ্রেণির মানুষ প্রতারণা করে ভাগিয়ে নেওয়ার ঘটনাও প্রথমদিকে ঘটেছে। এখন সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়ায় শৃংখলা অনেকাংশে ফিরে এসেছে। আরও একটু সময় লাগবে। কারণ লক্ষ লক্ষ মানুষকে সামলানো এত সহজ ব্যাপার নয়।

কিন্তু এই ত্রাণের স্রোত বেশি দিন থাকবে না। বিশেষ করে কোনো অমুসলিম দ্বারা মুসলিম নিপীড়িত হচ্ছে এমন প্রচার এবং বোধ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি এই সহানুভূতি আরও গতি পেয়েছে। অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য কথা। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা ভীতি, সংকোচ এবং অস্বস্তি কমবেশি সবার আছে। সরকার এবং প্রশাসনের তো বটেই।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে ঢালাও একটা প্রচারণা আছে। তারা জঙ্গি তৎপরতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদক ব্যবসাসহ নানান অপরাধের সঙ্গে জড়িত এমন ধারণাই বেশিরভাগ মানুষ পোষণ করেন। একটা জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা এবং মানবিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠছে। রাগ, ক্ষোভ, প্রতিশোধের স্পৃহা ইত্যাদি বিকার নিয়ে যারা বড় হচ্ছে তাদের কাছে ভালো আচরণ আশা করাও তো উচিত নয়। মিয়ানমারে যুগ যুগ ধরে তারা মানবিক এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশ কিংবা বিশ্বের যে দেশেই থাকুক না কেন, তারা শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা এবং মানবিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রায় একই পরিস্থিতির শিকার। তাদেরকে আলোকিত হবার সুযোগ না দিলে, মানসিক সংস্কার করা না হলে তাদের মধ্যে প্রত্যাশিত পরিবর্তন হবে কী করে?

ফলে তাদেরকে খুব সহজে জঙ্গিপনা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদক ব্যবসাসহ সামাজিক নানান অপরাধে টানা যায়। তাই তাদের স্বাভাবিক জীবন গড়ে দেওয়ার প্রতিও একটা দায় থাকা উচিত।

বাংলাদেশে আগে থেকে এই পর্যন্ত যত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তাদের একটা সঠিক এবং তথ্যসমৃদ্ধ পরিসংখ্যান থাকা আবশ্যক। নিবন্ধিত হলে দেশি বিদেশি সাহায্য পেতে, নিতে এবং দিতে সহজ হবে এটা তাদের ভালো করে বুঝাতে হবে। জোর করে তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে এই নিবন্ধন করা হচ্ছে না এই আশ্বাসও যেন তারা পায়। তারা যে মিয়ানমারের নাগরিক এই প্রমাণটুকুও মিয়ানমার তাদেরকে দেয়নি। এখন বলছে প্রমাণসাপেক্ষে তারা রোহিঙ্গাদের সেদেশে ফিরিয়ে নিবে। এটা তো কৌশল এবং ফিরিয়ে না নেওয়ার ইঙ্গিত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি যথাযথ তথ্য-প্রমাণ না রাখে তাহলে ভবিষ্যতে খুব ঝামেলায় পড়তে হতে পারে।

এদেশে আশ্রিত সাধারণ রোহিঙ্গা এবং রোহিঙ্গা নেতাদের উচিত হবে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকার বেকায়দায় পড়ে এমন কোন কাজে জড়ানো তাদের উচিত হবেনা। তাদের নিয়ে সময়ে রাজনীতিও হবে। অনেকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টাও করবে। তাদের ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে লক্ষ্য ভেদ করার চেষ্টাও হবে। তাদের নিয়ে কেউ যাতে খেলতে না পারে সেদিকে সচেষ্ট থাকতে হবে। রোহিঙ্গারা এদেশের শান্তি, শৃংখলা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য হুমকি এমন ভাবমূর্তি যেন প্রতিষ্ঠা না পায় সেদিকে সাবধান থাকতে হবে খোদ তাদেরকেও। বাংলাদেশ এবং এদেশের মানুষ তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন। এ দেশ, এদেশের জনগণ, ভূমি, প্রকৃতি, শান্তি ও সুরক্ষার প্রতি তাদেরকেও যত্নশীল হতে হবে।

২০১৬ সালের ১২ মে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে আনসার বাহিনীর শালবন ব্যারাকে হামলা চালিয়ে অস্ত্র এবং বিপুল সংখ্যক গুলি লুট করা হয়েছিল। সেই হামলায় আনসার কমান্ডার নিহত হওয়ার পাশাপাশি অনেকে আহত হয়েছিলেন। তখন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এই হামলা চালিয়েছিল বলে দেশি বিদেশি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

ব্রক্ষদেশ মিয়ানমার এবং বৌদ্ধ ধর্মের পরিপন্থী কর্মকাণ্ড

মিয়ানমারকে সুবর্ণভূমি এবং ব্রক্ষদেশ বলা হয়। স্বর্ণের জন্য প্রসিদ্ধ এবং অত্যন্ত সুন্দর দেশ বলে মিয়ানমারের আরেক নাম সুবর্ণভূমি। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে অর্থ্যাৎ বুদ্ধ যুগে এটাকে ব্রক্ষদেশ বলা হত। বিশ্বের সবথেকে আগে এবং বেশি স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো বা নির্মিত জাদি (প্যাগোডা) মিয়ানমারে অবস্থিত। কথিত আছে ১৬ টনের চেয়েও বেশি স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে ওই পবিত্র জাদিতে। এর নাম সোয়েডাগং জাদি। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে সিদ্ধার্থ গৌতমের বোধিজ্ঞান বা 'বুদ্ধত্ব' জ্ঞানলাভের ৪৯ দিন পর সর্বপ্রথম ব্রহ্মদেশীয় (মিয়ানমার) দুজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, তন্মধ্যে একজন তপস্সু এবং অন্যজন ভল্লিক নামে ব্যক্তিদ্বয়ের সাক্ষাৎ হলে তারা দুজনেই অন্তরের গভীর শ্রদ্ধানিবেদনপূর্বক মধুপি-নামক আহারের উপাদান হিসেবে দান করেন।

বুদ্ধজীবনে এই ছিল তাঁর প্রথম আহার গ্রহণ। তারা দুজনেই সর্বপ্রথম দ্বিবাচক উপাসক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। এটা তাদের উভয়ের জীবনে অতীব গৌরবের বিষয়। তারা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকালে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করলেন, আমরা দুজনেই দেশে ফিরে যাবো।আপনার দর্শন পেয়ে আমরা সৌভাগ্যবান ও ধন্য হয়েছি বটে, কিন্তু জন্মজনপদের অসংখ্য ভক্তপ্রাণ নরনারী আপনার দর্শন ও পূজা থেকে বঞ্চিত। আপনার স্মৃতিস্বরূপ কিছু নিদর্শন আমাদের অর্পণ করলে দেশবাসী তা পূজো ও স্মরণ করার গৌরব লাভ করবে। তথাগত বুদ্ধ তাদের এই মহতী প্রত্যাশা পূরণের জন্য স্বীয় মস্তকে হাত দিয়ে চারগুচ্ছ (৮টি) পবিত্র কেশরাশি উত্তোলনপূর্বক তাদের কাছে অর্পণ করেন।

তারা বুদ্ধের দুর্লভ এই কেশরাশি গ্রহণ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনপূর্বক এই পবিত্র কেশরাশি সংরক্ষণ ও পূজো করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সোয়েডাগং প্যাগোডা (জাদি) বা স্বর্ণের প্যাগোডা। এই ঐতিহাসিক প্যাগোডায় সংরক্ষিত হয় বুদ্ধের পবিত্র কেশধাতু (ঐধরৎ জবষরপং). মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াংগুন হতে কিছুটা পূর্ব-দক্ষিণে সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত শৃঙ্গে এই বিশাল প্যাগোডা নির্মিত হয় যা বিশ্ববাসীর কাছে 'গোল্ডেন প্যাগোডা' নামে পরিচিত হলেও বৌদ্ধদের কাছে এটি একটি পবিত্রতম তীর্থধাম। সারাবিশ্বের অসংখ্য পর্যটক এই প্যাগোডা দেখতে মিয়ানমারে আসেন।

এটি ছাড়াও দর্শনীয় আরও অনেক পুণ্যতীর্থ মিয়ানমারে রয়েছে। মিয়ানমারের জাতীয় আয়ের একটি বৃহৎ অংশ ধর্মীয় পর্যটন খাত থেকে আসে। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় অব্দে ভারত থেকে আরাকান হয়ে বার্মায় বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটে। পরবর্তীতে বার্মা একটি থেরবাদী আদর্শের বৌদ্ধপ্রধান রাষ্ট্র হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের কতিপয় উগ্র বার্মিজ ভিক্ষুর বিতর্কিত ভূমিকার কারণে আজকে বৌদ্ধ ভিক্ষু নিয়ে একশ্রেণির মানুষ নেতিবাচক কিছু ভাবছেন। এমনকি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের হত্যা করছেন এমন প্রচারণা চলছে। অথচ একটি উন্নত এবং পরিক্ষীত ভিক্ষু জীবন পেতে হলে থেরবাদী আদর্শের সুবর্ণভূমি মিয়ানমারে যাওয়াটা অনেকটা আবশ্যক ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, ভিক্ষু জীবন কি মিয়ানমারে না গেলে তা বুঝা যাবে না। ধ্যান, শীল, বিনয়ের কঠোর অনুশীলনের সুতিকাগার এই মিয়ানমার। উগ্র জাতীয়তাবাদী কিছু বার্মিজ ভিক্ষু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এটা সত্য কথা, কিন্তু ভিক্ষুদের বিরুদ্ধে যে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের অভিযোগ আনা হচ্ছে তা ডাহা মিথ্যাচার। ভিক্ষুদের জন্য যত নিয়ম-কানুন (বিনয় বিধান) আছে তৎমধ্যে প্রধান চারটি অপরাধ যদি কোনো ভিক্ষু করেন তাহলে তিনি ভিক্ষুধর্ম হতে চ্যুত হন। তিনি দ্বিতীয়বার আর ভিক্ষুধর্ম গ্রহণ করতে পারেন না।

থেরবাদী আদর্শের পৃথিবীর দেশে দেশে এই বিনয়-বিধান একই রকম। সেই চারটি অপরাধ কী?

১) হত্যা ২) চুরি ৩) কামাচার ৪) লোকোত্তর জ্ঞান লাভ না করেও লাভ করেছেন বলে প্রচার করা। এই চারটির মধ্যে একটি অপরাধও যদি কোনো ভিক্ষু করেন তাহলে তিনি পারাজিকাপ্রাপ্ত হন। পারাজিকা মানে পরাজয়। অর্থ্যাৎ তিনি ভিক্ষুধর্ম প্রতিপালনে পরাজিত হয়েছেন। মস্তকছিন্ন তালবৃক্ষ যেমন পরাজিত ভিক্ষুও তেমন অবস্থা সম্পন্ন হন। ঘর-সংসার, ভোগ-বিলাস, পরিবার-পরিজন সবকিছু ত্যাগ করে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুধর্মে আসার পেছনে তার মূল লক্ষ্যবস্তু হল জাগতিক সকল প্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করে নির্বাণের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করা। আত্ম এবং পরকল্যাণে নিজেকে সমর্পণ করা। লোভ, দ্বেষ, মোহ ইত্যাদি কলুষতা মুক্ত হওয়া না গেলে মানুষ তখনও ভুল করতে পারে। একজন ভিক্ষু বুদ্ধের বিনয়-বিধান এবং আদর্শ ধারণ করতে না পারলে তিনি চীবর বা গেরোয়াবসনধারী হওয়ার পরও ভুল-ত্রুটি করতে পারেন।

কিন্তু এই চারটি অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য এবং ঘৃণিত অপরাধ। সমাজ কখনও তাকে মেনে নেবে না। হত্যার তো প্রশ্নই উঠে না। মিয়ানমারে লক্ষ লক্ষ ভিক্ষু আছেন। এও ঠিক যে, মিয়ানমারে ভিক্ষুসংঘের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি রাজনীতিতেও ভিক্ষুসংঘের প্রভাব রয়েছে। ভিক্ষুদের মধ্যে রাষ্ট্রগুরুও রয়েছেন। কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী বর্মী ভিক্ষু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রচারনা করেন। তাদের নেতৃত্বদানকারী জৈনক বিরাথু ভিক্ষুকে তো টাইম ম্যাগাজিন 'বৌদ্ধ সন্ত্রাসী' আখ্যা দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে। সবাই তো ঐ ভিক্ষুদের মতো রোহিঙ্গা বিদ্বেষী প্রচারণায় নামেননি।

তফাৎ হল, সিংহভাগ ভিক্ষুসংঘ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মৌনতা অবলম্বন করে আছেন। মিয়ানমারের ভিক্ষুসংঘের নেতৃত্বের উচিত এসব উগ্র ভিক্ষুদের কঠোরভাবে দমন করা। তাদেরকে এটা বুঝতে বাধ্য করা উচিত যে, এটা ভিক্ষুর কাছ নয়। তাদের মতো কিছু উগ্র ভিক্ষুর কারণে সমগ্র ভিক্ষুসংঘের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। যদিও বা যার কৃতকর্মের দায় তারই উপর বর্তায়।

মিয়ানমার থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম ধারণ করলেও বৌদ্ধধর্মের পরিপন্থী কিছু কাজ তারা আদৌ পরিহার করেনি। তাদের একটি হল মাদক বাণিজ্য। আজকে যে ইয়াবায় বাংলাদেশ সয়লাব হয়ে গেছে এর উৎস মিয়ানমার। সীমান্তঘেঁষা দেশ হওয়ার সুবাদে এই ইয়াবার আগ্রসনের সবথেকে বেশি শিকার হয়েছে আমাদের বাংলাদেশ এবং তার জনগণ। বৌদ্ধধর্মে নিষিদ্ধ পঞ্চ বাণিজ্যের কথা উল্লেখ আছে– ১) অস্ত্র-বাণিজ্য, ২) মাদক-বাণিজ্য ৩) প্রাণি-বাণিজ্য ৪) বিষ-বাণিজ্য ৫) মাংস-বাণিজ্য। এই পাঁচটি বাণিজ্য বৌদ্ধধর্মের পরিপন্থী বাণিজ্য।

মিয়ানমার মাদক বিশেষ করে ইয়াবার উৎপাদন এবং রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। রীতিমতো অনেকগুলো ইয়াবা কারখানা আছে মিয়ানমারে। মিয়ানমার ভূসম্পদ এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি সীমিত জনসংখ্যার দেশ। তাদের রয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। অথচ মিয়ানমার একটি থেরবাদীধারার দেশ হওয়ার পরও পঞ্চশীল এবং নিষিদ্ধ পঞ্চবাণিজ্যের একটি অন্যতম বাণিজ্য মাদক বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারতা ঘটাচ্ছে। এটা বুদ্ধের আদর্শ এবং নীতির পরিপন্থী কাজ।

নিপীড়ন বনাম বৌদ্ধধর্ম

আমি আগেই বলেছি যে, সামরিক জান্তা কর্তৃক চলমান রোহিঙ্গা নিপীড়নকে অনেকে বৌদ্ধ-মুসলিম সমস্যা হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিপীড়ন করছে। রাখাইনের নিপীড়িত রোহিঙ্গারা মুসলমান হওয়ায় অনেকের মতে এটা বৌদ্ধ-মুসলমান সমস্যা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও তো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের মতে এর দায় বৌদ্ধধর্মের উপরও বর্তায়।

এই ভাবনার সামান্যতম হলেও গ্রহণযোগ্যতা থাকত যদি সামরিক জান্তা বলত যে, তারা ধর্মে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই নিপীড়ন চালাচ্ছে। ধর্মটা মানুষ জন্মসূত্রে লাভ করে থাকে। জন্মের অনেক পরেই মানুষের সঙ্গে ধর্মের পরিচয় ঘটে। অথচ আমরা মানুষ হিসেবে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে লোভ, হিংসা, মোহ, ক্রোধ, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, পাশবিকতাসহ বিভিন্ন বিকার নিয়ে জন্ম গ্রহণ করি। এই বিকারগুলোর তাড়নায় আমরা নানান অপকর্ম করে বসি।

এগুলো থেকে মুক্তি পেতেই আমাদের প্রয়োজন হয় ধর্মের। মনুষ্যত্বের বিকাশে প্রয়োজন ধর্ম। মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য ধর্ম নয়। কোনো ধর্মই মানুষকে নিপীড়ক এবং অত্যাচারী হওয়ার শিক্ষা দেয়নি। কিন্তু মানুষ যদি ধর্মের নীতি-নৈতিকতা বিরুদ্ধ আচরণ করে তাহলে এর দায় ধর্মের নয়। সকল প্রাণির প্রতি সদয় থাকার শিক্ষা বৌদ্ধধর্মে অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে। 'জগতের সকল প্রাণি সুখী হউক', এই সুখ কামনা নির্দিষ্ট কোনো প্রাণি এবং জাতিগোষ্ঠীর জন্য করা হয়নি। বিশেষ কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্যও নয়। বুদ্ধ করণীয় মৈত্রী সূত্রে বলেছেন, 'দিট্ঠা বা যে চ অদিট্ঠা যে চ দূরে বসন্তি অবিদূরে, ভূতা বা সম্ভবেসী বা সব্বে সত্তা ভবন্ত সুখিতত্তা।'

অর্থাৎ, যে সকল প্রাণি দৃশ্য বা অদৃশ্য, যারা দূরে কিংবা কাছে বাস করে, যারা জন্মেছে বা জন্মিবে, যারা মাতৃগর্ভে অথবা ডিম্বের ভেতরে আছে সেখান হতে বহির্গত হবে তারা সকলে সুখী হউক।

'ন পরো পরং নিকুব্বেত্থ নাতিমঞঞেথ কত্থচি নং কিঞ্চি, ব্যারোসনা পটিঘসঞঞা নাঞঞমঞঞস্স দুক্খমিচ্ছেয্য।'

অর্থ্যাৎ– পরস্পরকে বঞ্চনা করিও না, কোথাও কাউকে অবজ্ঞা করিও না,হিংসা বা আক্রোশের বশবর্তী হয়ে কারো দুঃখ কামনা করিও না।'

'মাতা যথা নিযং পুত্তং আযুসা এশপুত্তমনুরক্খে, এবম্পি সব্বভূতেসু মানসং ভাবযে অপরিমাণং'

অর্থ্যাৎ- মা যেমন নিজের জীবন দিয়ে হলেও তাঁর একমাত্র পুত্রকে রক্ষা করেন, তেমন সকল প্রাণীর প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করবে।

বুদ্ধ মঙ্গল সূত্রে বলেছেন, 'অনাকুলা চ কম্মন্তা, এতং মঙ্গলমুত্তমং' অর্থ্যাৎ-

নিষ্পাপ ব্যবসাদি করে জীবিকা নির্বাহ করো এবং এতেই মঙ্গল।

'অরতি বিরতি পাপা, মজ্জপানা চ সঞ্মো, অপ্পমাদো চ ধম্মেসু, এতং মঙ্গলমুত্তমং'

অর্থ্যাৎ– মনোময় পাপাচারে আরতি বা অনাসক্তি, কায়িক-বাচনিক পাপকর্ম থেকে বিরতি বা পাপকর্ম পরিত্যাগ, মাদকাদি সেবনে বিরতি ও অপ্রমত্ততার সাথে পুণ্যকর্ম সম্পাদন করো এবং এতেই মঙ্গল।

ত্রিপিটকে এরকম আরও অসংখ্য বাণী আছে যেখানে বুদ্ধ মানুষকে সমস্ত পাপকর্ম এবং নিন্দনীয় কর্ম থেকে বিরত থেকে মানবিক মর্যাদা রক্ষা করে জীবন যাপন করার উপদেশ দিয়েছেন। বুদ্ধ এক কথায় বলে দিয়েছেন যে, সর্ব প্রকার অকুশল বা পাপকর্ম বর্জন করে, নিজের চিত্ত পরিশুদ্ধ করে সবর্দা কুশল বা পুণ্যকর্ম সম্পাদন করা ইহাই বুদ্ধের অনুশাসন। বুদ্ধ পুণ্যকর্ম করলে সুফল প্রাপ্তি এবং পাপকর্ম করলে দুর্গতি লাভের কথা বলেছেন।

বৌদ্ধদের নিত্যপালনীয় পঞ্চশীল বা পঞ্চনীতি পালনের সুফল এবং লঙ্ঘনের কুফল সম্পর্কেও বুদ্ধ বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। পঞ্চশীলের প্রথম শীল বা নীতি হল- 'পাণাতিপাতা বেরমণী সিক্খাপাদং' অর্থ্যাৎ প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা। এই নীতি লঙ্ঘনকারীদের উদ্দেশে বুদ্ধ বলেছেন, প্রাণি হত্যাকারী ব্যক্তি মৃত্যুর পরে আশি কল্পকাল নরক যন্ত্রনা ভোগ করে, সেখান থেকে চ্যুত হয়ে পাঁচশ জন্ম প্রেতলোকে এবং পাঁচশ জন্ম তির্যককুলে জন্ম গ্রহণ করে এবং সেখান থেকে চ্যুত হয়ে মনুষ্যলোকে আসলে প্রাণিহত্যার ফলে মাতৃজঠরে তার মৃত্যু হয়। এমনকি জন্ম হলেও অল্প আয়ু লাভ করে।

বুদ্ধ এও বলেন যে- 'ন তেন অরিয্যে হোতি যেন পনানি হিংসাতি, অহিংসা সব্বপননাং অরিযোতি পব্বুচ্চতি' অর্থ্যাৎ- প্রাণীকে হিংসা করে, আঘাত করে এবং হত্যা করে কেউ আর্য বা শ্রেষ্ঠ হতে পারেনা। যিনি অহিংসা পরায়ন হন, প্রাণীর প্রতি দয়া এবং মৈত্রী পরায়ন হন তিনিই আর্য বা শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হন।

'সুরা-মেরেয-মজ্জ-পমাদট্ঠানা বেরমণী সিক্খাপাদং' অর্থ্যাৎ সুরা-মৈরেয়, মাদক বা নেশা দ্রবা সেবন থেকে বিরত থাকার শিক্ষা।

এই শিক্ষা লঙ্ঘনকারীদের উদ্দেশে বুদ্ধ বলেছেন- মাদক সেবনকারী ব্যক্তির ইহকালে ধনহানি হয়, সর্বদা জগড়াঝাটি হয়, শরীরে বিভিন্ন ধরণের রোগের উৎপত্তি হয়, দুর্নাম প্রচারিত হয়, জনগণের মনে ক্রোধের সঞ্চার হয় এবং হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়। মৃত্যুর পরে আশি কল্পকাল পর্যন্ত নরকবাস করে, সেখান থেকে চ্যুত হয়ে পাঁচশ জন্ম কুকুর এবং অনন্ত সময় ধরে পাগল হয়ে বিচরণ করে। এভাবে প্রত্যেকটি শীল বা নীতি লঙ্ঘনের কুফল বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দেওয়া আছে। কোনো ব্যক্তি যদি তার ধর্মের বাণী অনুশীলন না করে কিংবা লঙ্ঘন করে তাহলে এর দায় কেবল তার, ধর্মের নয়। আবার লঙ্ঘনকারীর অপরাধ নিয়ে তার ধর্ম এবং জাতিরও বিচার করা যায়না।

তাই কোনো সমস্যার সমাধানে ধর্ম কিংবা ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীকে না টেনে অপরাধীকে কেবল অপরাধীর দৃষ্টিতে দেখে পৃথিবীর যেখানেই মানবতা ভূলুণ্ঠিত হবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে সেখানে অপরাধীর বিরুদ্ধে দেশজাতিধর্মনির্বিশেষে সবার সোচ্চার হওয়া উচিত। কারণ 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'।