রাজনীতির ভালোমন্দ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 9 Oct 2017, 02:50 PM
Updated : 9 Oct 2017, 02:50 PM

প্রধানমন্ত্রী আমেরিকাপ্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি এমনধারা কথা প্রায়ই বলে থাকেন। তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, এটা তো আগে ভাবিনি। মিডিয়ার কল্যাণে আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদানের সময় এবারও দ্বিধাবিভক্ত বাংলাদেশিরা দেশের মান-মর্যাদার কথা ভাবেননি। অন্য কোনো দেশের মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যায় না। বিশেষত দেশ বা সমাজ যখন সংকটাপন্ন কোনো পরিস্থিতিতে পড়ে, তখন সামান্য রাজনৈতিক মতবিরোধের জন্য তারা রাস্তায় নেমে বা বিদেশিদের হাসিয়ে প্রতিবাদের নামে দেশকে ছোট করে না।

ভিডিওতে দেখলাম, জাতিসংঘ অফিসের সামনে দুদল বাংলাদেশির মধ্যে মারামারি চলছে। সমানে ইট-পাটকেল ছুঁড়ছিল তারা। আর আমেরিকান পুলিশ একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করছিল। তাদের এই গলদঘর্ম চেহারা আর বয়ে নিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতা কাদের ছোট করল আসলে? কী কারণ ছিল বিএনপির এমন করার?

তাদের নেতারা তো দেশেই যা বলার বলছেন। প্রায় প্রতিদিন রিজভি কৌতুক করছেন আর জনগণ হাসছে। এরপর আর কী বলার আছে তাদের? মীর্জা সাহেব পরিমিত ভাষায় ছিদ্র খুঁজছেন। বাকি থাকল কী? তাছাড়া এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যাওয়াটা ছিল দেশ ও জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ন। এবার তিনি জাতিসংঘে কী নিয়ে বলবেন সেটা আমাদের অজানা কিছু ছিল না। আমরা এ-ও জানি, সংকটে ঐক্য আর বন্ধন ছাড়া মুক্তি নেই আমাদের। তারপরও পারা গেল না। গদিলোভী রাজনীতি আর বিভেদের অতীত বর্তমান যেমন বিষিয়ে রেখেছে, ভবিষ্যতেও ছাড় দিচ্ছে না।

জাতিসংঘ অফিসের সামনের মারামারিতে আমরা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিলাম যে, আমরা ঐক্যহীন। অথচ মিয়ানমার, যে দেশের সঙ্গে আমাদের এখন কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছে তাদের ভেতর এই ঝামেলা নেই। তারা এক ঢিলে অনেক পাখি মারছে। একদিকে ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গাদের সমস্যা মনে করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। জাতিগত সংঘাতকে সন্ত্রাস বলে চালিয়ে দিচ্ছে। ওদিকে অং সান সু চিকে এমন ফাঁদে ফেলেছে যে, তাঁর সামনে এখন আর পথ খোলা নেই। ফাঁদটা এমন– তিনি এতকাল ধরে বিশ্বের নজরে ছিলেন, গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁকে মনে করা হত বার্মা বা মিয়ানমারের মুক্তিদূত– সামরিক শাসনে দীর্ঘকাল আটকা-পড়া সু চি স্বামীকে দেখতেও যেতে পারেননি। এমন মহিয়সী একজন নারীকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে গদিলাভ ও শাসনকাজ এক নয়।

তবে সু চির জন্যে মায়াকান্না কাঁদার লোক নই আমি। বরং অবাক হচ্ছি আমাদের দেশের নোবেলজয়ী আর সু চির মধ্যে মিল দেখে। এনাদের কেউ দেশের কঠিনতম পরিস্থিতিতে রুখে দাঁড়াতে পারলেন না। এটা কি সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া মেরুদণ্ডহীন মানুষের প্রমাণ? না কি এর কারণ আসলে আন্তর্জাতিক চাপ?

যাই হোক, সু চি যে এখন ঘোর বিপাকে সন্দেহ নেই। অন্যদিকে আমাদের নেত্রী শরণার্থাী সংকটের দায় নিয়ে আরও বেশি সপ্রতিভ ও উজ্জ্বল।

যেটা দেখছি, শেখ হাসিনার সমস্যা এখন দেশের কিছু উল্টাপাল্টা নেতা আর বিএনপি-জামাতের ফসিল। প্রান্তিক নামে পরিচিত দরিদ্র ও হ্যাভ-নটদের মগজ ধোলাই করা রাজনীতি এদের এখনও এগিয়ে রাখে বলেই এরা সুবিধাভোগী। মিডিয়ার হাল দেখুন, গত দশ বছর ঘরবন্দি বিএনপি নেতাদের কভারেজ দেওয়ার জন্য কেমন মুখিয়ে আছে। তারা কি একবারও জানতে চেয়েছে নতুন প্রজন্ম বা আমাদের সন্তানেরা আসলে রিজভি সাহেবদের চেনে কি না?

আর এক সমস্যা আওয়ামী লীগের নিজেদের ভেতর। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে প্রবাসীদের বলেছেন আচার-আচরণ ও ভাষা সংযত করতে। কারণ এতেই ভোট বাড়ে। এটা তিনি দেশের নেতা-কর্মীদের বেলায়ও বলেছেন। তিনি ব্যস্ত মানুষ। তাঁর অনেক কাজ। আমি তো ভাবি যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান না হলে তিনি তৃণমূলের এত খবর রাখতেও পারতেন না। আমি বলি, দেশ চালান প্রধানমন্ত্রী আর সরকার চালায় বাকিরা। তাই তিনি জানতে পারেন না এই সিডনিতেও আওয়ামী রাজনীতির কী ভয়াল চেহারা!

প্রবাসে দেশের রাজনীতির দরকার সেদিনই আর থাকবে না যেদিন আমরা সবাই মিলে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সঙ্গীত, মাটি ও বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করে মৌলবাদের বিদায়-ঘণ্টা বাজাতে পারব। তার আগে এমনটি চাইলেও হবে না। ফলে এটুকু দরকার থাকার পরও আওয়ামী লীগের বিদেশি নেতারা মনে করেন, তারাই সর্বেসর্বা। ভাঙতে ভাঙতে এমন হাল যে, কর্মী পাওয়া যায় না। শুধু নেতা আর নেতা। যারা বছরের পর বছর নেতা ছিলেন তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের কল্যাণকামীদের সঙ্গেও এমন আচরণ করেন যা জামায়াতিরা পর্যন্ত করে না।

অষ্ট্রেলিয়ায় মুষ্টিমেয় আওয়ামী নেতার পাগলামি আর উন্মাদসুলভ আচরণে দলের ইমেজ ভবাবহভাবে আক্রান্ত। তাদের ধারণা, বাংলাদেশের মিডিয়ায় তাদের নামধাম ও কাজ প্রথম পাতায় ছাপাতে হবে। দেশ, রাজনীতি ও সমাজের জন্য বিন্দুমাত্র অবদানহীন এই মানুষগুলো মন্ত্রীরা এলে তাদের ডিনার খাইয়ে সভার আয়োজন করেন। এছাড়া তাদের আর কী কাজ জানি না। এ-ও বলব, এই নেতাদের চাইতে বিএনপি বা অন্য রাজনীতির নেতাদের আচরণে মানুষ সন্তুষ্ট। এটা কি দলের জন্য ভালো?

শেখ হাসিনা কতটা দূরদর্শী বলে এই সমস্যার কথা বলেছেন এবং ঈঙ্গিত করেছেন ভেবে অবাক হই। উত্তরণ ও সমাধানহীনভাবে একের পর এক শাখা খোলার পরিণতি জনবিচ্ছিন্নতা। আমি সাধারণ প্রবাসীদের ভেতর যতটা আওয়ামী লীগ ও দলনেত্রীর জন্য দরদ দেখি ততটাই এদের প্রতি ভয়-ভীতি দেখি। মজার ব্যাপার এই যে, সবাই দেশ থেকে অনুমোদন নিয়ে আসে। বাইরে এই পরিবেশে আমরা আর উদ্বিগ্ন নই। কারণ বিষয়টা অনেকটা হাসির খোরাক হয়ে উঠেছে বলেই ঠাট্টাচ্ছলে সবাই বলে, একটা হলে আরেকটা ফ্রি পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জমান আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এমন হতে পারে না। প্রবাসে রাজনীতি মানে দুর্দিনে দেশ ও দলের পাশে দাঁড়ানো সেটা তাদের জানানো দরকার। পথভ্রষ্ট বা আদর্শচ্যুত কিংবা ভুল বুঝতে থাকা বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনতে পারলেই দেশজ ও বিদেশের মাটিতে রাজনীতির দিশা ঠিক করা সম্ভব।