সাম্প্রতিক সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা বিতর্ক ও প্রাসঙ্গিক কথন

Published : 7 Oct 2017, 02:57 AM
Updated : 7 Oct 2017, 02:57 AM

সময়টা অবশ্যই খ্রিস্টপূর্ব। আইডা পর্বত। সেখানে মেষপালকের কাজ করেন নির্বাসিত এক রাজপুত্র। নাম তার প্যারিস। তিনি শুধু ট্রয়ের রাজপুত্রই নন, তার আরেকটি পরিচয় হল, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। ইনোনি নামে এক পর্বতপরী স্ত্রীকে নিয়ে বেশ শান্তির জীবন। একদিন প্যারিসের সামনে আবির্ভূত হলেন তিন দেবী। তিন জনেরই ধারণা, তিনিই সেরা সুন্দরী। বিষয়টা কী?

ঘটনা জানতে হলে আরও একটু পিছুতে হবে। জলপরী থেটিস এবং রাজা পিলিউসের বিয়ের আসর চলছে। সেখানে সকল দেবদেবী নিমন্ত্রিত হলেও নিমন্ত্রণ পাননি কলহদেবী এরিস। ব্যস, তিনি করলেন কী, হেসপাইরিডিসদের বাগান থেকে একটি সোনার আপেল নিয়ে এলেন। অতি দুর্লভ এবং লোভনীয় এই বস্তু তিনি পর্দার আড়াল থেকে গড়িয়ে দিলেন ভোজসভায়। আপেলের উপর আবার খোদাই করে লিখেও দিলেন, 'সেরা সুন্দরীর প্রাপ্য'।

আর যায় কোথায়! ভোজসভায় উপস্থিত সকল দেবীই নিজেকে সুন্দরী প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগলেন। যাহোক, শেষ অবধি তিন ফাইনালিস্ট পৌঁছুলেন গ্র্যান্ড ফিনালেতে। এই তিন জন হলেন, দেবরানী হেরা যিনি আবার অর্থসম্পদেরও দেবী; যুদ্ধের দেবী অ্যাথেনি যিনি একাধারে জ্ঞান-বিজ্ঞান, কারুশিল্প এবং অ্যাথেন্স নগরীর রক্ষাকর্ত্রী; প্রেমের ও রূপের দেবী আফ্রোডাইতি যিনি লাস্যময়ী এবং গ্ল্যামারের অধিষ্ঠাত্রী।

এখন এই তিনজনের মধ্যে কে সেরা সে বিচারের ভার কে নেবে? দেবরাজ জিউস খুবই চালাক-চতুর। তিনি এই বিচারের ভার নিতে নারাজ। কোনো দেবীকেই চটাতে তিনি চান না। দেবী তিনজন তাই চলে গেলেন বিশ্বের সেরা সুদর্শন পুরুষের কাছে। প্যারিসকে বিচারের ভার দিয়ে তারা আবার গোপনে তাকে নানা রকম উৎকোচের লোভও দেখালেন। হেরা বললেন তাকে সেরা ধনীতে পরিণত করবেন। অ্যাথেনি লোভ দেখালেন সেরা বীরের খ্যাতিলাভের। আর আফ্রোডাইতি তার সামনে তুলে ধরলেন বিশ্বের সেরা সুন্দরী মানবী হেলেনের প্রেমের আকর্ষণ।

বোকা প্যারিস (সুদর্শন মানুষের বুদ্ধি কিছুটা কম থাকতেই পারে)! প্রেমকেই প্রাধান্য দিয়ে আফ্রোডাইতিকে বিজয়ী ঘোষণা করে তার হাতে সুন্দরীর অ্যাওয়ার্ড (সেই আপেল) তুলে দিলেন। এরপরের ঘটনা সকলেরই জানা। আর কীভাবে তাতে ট্রয়ের ধ্বংস সূচিত হয় সেটা কারও অজানা নয়।

এই মিথ অনুযায়ী বলা যায়, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিষয়টি গোড়া থেকেই একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। কারণ 'কার চোখে কাকে লাগে ভালো' সেটা তো বিচার করা মুশকিল। মজনুর চোখে লাইলি ছিলেন বিশ্বের সেরা সুন্দরী। যদিও মজনুর মুখে লাইলির রূপের প্রশংসায় আকৃষ্ট হয়ে বাদশাহ স্বয়ং তাকে দেখতে এসে মন্তব্য করেন, "আমার হারেমের সবচেয়ে কুশ্রি বাঁদীও তো ওর চেয়ে সুন্দরী।"

মজনু তখন উত্তর দেন, "লাইলিকে দেখতে হয় মজনুর চোখ দিয়ে।"

রূপ একটি আপেক্ষিক বিষয়। বিভিন্ন জাতির সৌন্দর্য পরিমাপের মাপকাঠিও ভিন্ন। পিগমি জাতির কাছে খর্বকায় মানুষই সুন্দর; অ্যাব্রোজিনির কাছে স্থূলকায়; এস্কিমোর কাছে খর্বনাশা। আফ্রিকার স্বাস্থ্যবান তরুণী, ককেশাসের ঈগলচক্ষু তরুণ, চীনের পীত রঙ কালো চুলের তরুণ আর দক্ষিণ ভারতের কৃষ্ণকলি তরুণী– কারও সঙ্গে কারও কি তুলনা চলে?

মানুষের রূপের প্রকৃত মাপকাঠি আর সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, প্রতিযোগিতা নয়। তবে সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র দুয়ের কাছেই রূপও একটি সম্পদ এবং পণ্য। সামন্ততন্ত্র নারীকে বিভক্ত করে দুইভাবে, গৃহবধূ ও বারবধূ। প্রাচীন ভারতে নিয়ম ছিল দারুণ রূপসী নারীকে কেউ একা কুক্ষিগত করে রাখতে পারবে না। বিশেষ করে সে যদি রাজকন্যা না হয়ে থাকে। তাকে নৃতগীত শিক্ষা দিয়ে নগর নটি বানাতে হবে। বৈশালী নগরের সুন্দরী কিশোরী আম্রপালীকে তাই রাজআদেশে নগর নটি বানানো হয়।

মধ্যযুগে পুরো এশিয়াতেই কোন রাজার হারেমে বা অন্দরমহলে কতজন সুন্দরী আছেন (স্ত্রী হোক বা রক্ষিতা) তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত। সুন্দরী নারী বিবেচিত হত সম্পদ হিসেবে। ইউরোপেও সুন্দরী নারী সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হত। সেখানে রাজাদের ঘরে একজন মাত্র রানী থাকলেও সুন্দরী 'মিসট্রেস' বা প্রেমিকা ও রক্ষিতা থাকত একাধিক। 'ওনলি দা ব্রেভ ডিজার্ভ দ্য ফেয়ার' প্রবাদ বাক্যটি বীর নাইটদের আরও বেশি বীরত্বে প্ররোচিত করার জন্য যথেষ্ট।

রূপের জন্য নারীর শরীরের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কম চলত না। ছোট পা সৌন্দর্যের প্রতীক হওয়ায় চীনে শিশুবেলা থেকে মেয়েদের পরিয়ে রাখা হত লোহার জুতা। নাগাল্যান্ডে নারীর গলায় পরিয়ে রাখা হত লোহার বলয় যাতে তারা মরাল গ্রীবার অধিকারী হন। মধ্যযুগে এমনকি উনবিংশ শতকেও ইউরোপে সরু কোমর লাভের আশায় শিশুবেলা থেকে নারীকে লোহার জালির তৈরি করসেট পরিয়ে রাখা হত। তাতে অস্বাস্থ্যকর রকম সরু কোমর হত নারীর। আবার বলা হত, পুরুষ যেন দুহাতের মুঠোয় একজন নারীর কোমর ধরতে পারে। ভাঙা গাল ও টোল সৌন্দর্যের প্রতীক হওয়ায় ঊনবিংশ শতকে মাড়ির দুটি দাঁত ফেলে দিতেন ইউরোপের নারীরা।

এখনও নানা রকম সার্জারির মাধ্যমে নারীকে সুস্তনী, নিতম্বিনী ও সুন্দরী করার প্রচেষ্টা চলে। বলাবাহুল্য, এ সব কিছুই নারীকে 'মানুষ' নয় 'সুন্দর পুতুল'এ রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা মাত্র। মধ্যপ্রাচ্যে নারীকে কাপড়ে মুড়ে রাখার যে সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন ওয়াজে নারীর সঙ্গে খোসা-ছাড়ানো ফলের তুলনা ও ঢেকে রাখার জন্য নসিহত– সবই নারীর মানবিক সত্তা অস্বীকার করে তাকে 'বস্তু'তে পরিণত করার মানসিকতা থেকে উদ্ভূত।

পুঁজির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদী সমাজ সব কিছুই পণ্যে পরিণত করে ফেলে। মানুষের রূপও তখন বেশ ভালো দরে বিকোয় বৈকি। নারীর রূপ ব্যবহার করে সম্ভব পণ্যের প্রসার বাড়ানো। এগুলোর ক্রেতা নারী। কিন্তু পুরুষের চোখে মনোলোভা হওয়ার মানসিকতা থেকেই এর জন্য হুড়োহুড়ি। কারণ একজন ক্ষমতাবান পুরুষকে রূপ দেখিয়ে বশীভূত করতে পারলে, তার প্রেয়সী হতে পারলে ক্ষমতাবান হওয়া যায়। অর্থাৎ পুরুষের কাছে বিক্রয় হতে পারলেই লাভ।

ওদিকে পুরুষও চায় সুন্দরী নারীকে কিনতে। আর তাই বিশ্বজুড়ে কসমেটিকস ইন্ডাস্ট্রি এবং পোশাক ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি যত প্রসারিত হয়েছে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার প্রয়োজনীয়তা ততই বেড়েছে। পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিবাদ হাত ধরাধরি করেই চলে। এখনও যেহেতু অধিকাংশ পুঁজির মালিক পুরুষ, তাই সুন্দরী নারীর চাহিদা এবং ক্রেতা বেশি। বিশ্বসুন্দরীর পাশাপাশি বিশ্বসুন্দর নামেও কিন্তু একটি প্রতিযোগিতা আছে। সেই প্রতিযোগিতা বহুলপ্রচারিত নয়। কারণ এখনও পুরুষের সৌন্দর্যের ক্রেতা হিসেবে নারী বিপুলভাবে ক্ষমতায়িত নয়।

প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি কথা বলি। পুঁজির মালিক যদি বায়োলজিক্যালি নারীও হন তাহলেও তিনি পুরুষতন্ত্র ও পুজিবাদের স্বার্থই সংরক্ষণ করেন। তিনি শরীরে নারী হলেও মননে ও চেতনে পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্রের স্বার্থই ধারণ ও লালন করেন। এটাই পুঁজির ধর্ম।

পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজে একজন নারীর মূল্য প্রধানত তার যৌনাবেদনের উপর নির্ভর করে। সে কারণেই এই সমাজ তাকে 'মেরিলিন মনরো' হয়ে উঠতে যতটা প্রেরণা দেয় ততটা দেয় না 'মাদাম কুরি' হয়ে উঠতে। তাকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়– "তুমি মেধাবী হও আর না হও তোমাকে হতে হবে 'আরও ফর্সা, আরও সুন্দর'। তোমাকে হতে হবে পুরুষের চোখে আকর্ষণীয়।"

সুন্দরী প্রতিযোগিতার ক্রাইটেরিয়াগুলো দেখলেই দেখা যায় স্তনের মাপ, কোমরের মাপ, উচ্চতা দিয়ে মাপা হচ্ছে সৌন্দর্য। এই মাপগুলোর ভিত্তিতে পরষ্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কতটা মর্যাদাসম্পন্ন তা বলাবাহুল্য। এই ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া আর 'নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলি করি অপমান' একই কথা। মানুষের সৌন্দর্য তার স্তন ও কোমরের মাপে নয়– তার মেধায়, মননে, চিন্তায়, চেতনায় ও আচরণে। অথচ এই মাপগুলোই পুরুষের চোখে নারীকে আকর্ষণীয় হিসেবে প্রমাণ করবে।

এইসব অবমাননাকর মাপের ভিত্তিতে যে নির্বাচিত হবে সেরা সুন্দরী হিসেবে তাকে দিয়ে পুঁজির বাজার আরও প্রসারিত করা সম্ভব হবে। সে হবে পণ্য-বিপণনের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, 'ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর'। অন্যদের তখন বলা যাবে, "এই সুন্দরী অমুক সাবান ব্যবহার করে, তমুক শ্যাম্পু চুলে দেয়, ওই গাড়িতে চড়ে, ওই দোকানের পোশাক পরে, অমুক ক্রিম মাখে। তুমিও ওকে অনুসরণ কর, তুমিও হবে আকর্ষণীয়।"

বলা হয়ে থাকে যে, বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় মেধা যাচাইয়েরও একটা ক্রাইটেরিয়া থাকে। কথাটি সত্য। কিন্তু কতটুকু মেধার প্রয়োজন হয়? যতটুকু মেধা হলে ডিনার টেবিলে একজন পুরুষের সঙ্গে সরস কথাবার্তা চালানো যায়, ততটুকু মেধা বিশ্বসুন্দরীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হয়। প্রতিযোগীদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নগুলোর দিকে তাকালেই আমার বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে। বিশ্বসুন্দরীদের মানবসেবার দৃষ্টান্ত রয়েছে। এসবই আসলে বিষয়টির কদর্যতা চাপা দেওয়ার আধুনিক কৌশল। 'কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির' মতোই বিষয় আর কী। কারণ ক্রেতাকে শোষণ করতে হলেও তাকে কিছুটা সেবা দিতে হয়, বাঁচিয়ে রাখতে হয়। নইলে সে পণ্য কেনার জন্য বেঁচে থাকবে কীভাবে?

অনেকে আবার মধ্যপ্রাচ্যে নারীর মর্যাদা, বোরখার উপযোগিতা ইত্যাদি নিয়ে বুলি ঝাড়বেন। মধ্যপ্রাচ্যে নারী কতটা মর্যাদা পেয়েছে তা আরব ধনীদের হারেমে নারীর সংখ্যার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সৌদি আরবে এতদিন পর্যন্ত নারীর গাড়ি চালানোরও অধিকার ছিল না। কতটা মর্যাদা তারা নারীকে দিয়েছে এই ঘটনাই তার উদাহরণ। এখনও যে গাড়ি চালানোর অধিকার দেওয়া হল তা নারীকে অধিকার দেওয়ার জন্য নয়, বরং গাড়িচালক হিসেবে বিদেশি নারীর তুলনামূলক সস্তা শ্রমশক্তি ব্যবহারের উদ্দেশে। মোদ্দা কথা হল, নারীর বোরখা অথবা বিকিনি পরার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা যতদিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কুক্ষিগত থাকবে ততদিন নারী দ্বিতীয় অবস্থানেই রয়ে যাবে।

ফিরে আসি বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার দিকে। বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে, এতে বাঙালি নারী বিশাল কোনো কৃতিত্ব অর্জন করতে যাচ্ছে তা নয়। বরং এতে এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পুঁজি-বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকের এখন অর্থনৈতিক সামর্থ্য বাড়ছে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড পণ্য কেনার। তাই এদেশের নারীদের এখন সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

ভারত অনেক আগে থেকেই বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। অথচ মাত্র নব্বই দশকে এসে আমরা ঐশ্বিরিয়া রাই, সুস্মিতা সেন (মিস ইউনিভার্স), ডায়না হেইডেন, যুক্তামুখী, প্রিয়াংকা চোপড়াসহ পরপর বেশ কয়েকজন ভারতীয় নারীকে সেরা সুন্দরীর খেতাব পেতে দেখলাম। এর আগে কি তাহলে ভারতীয় নারীরা সুন্দরী ছিল না? নিশ্চয়ই তা নয়। কারণ হলো আাশির দশকের শেষে এবং মূলত নব্বই দশকে ভারত তার বাজার সংরক্ষণ নীতি থেকে বেরিয়ে এসে বৃহৎ আন্তর্জাতিক পুঁজিস্রোতে নিজেকে যুক্ত করে। তখন মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ডগুলোর প্রয়োজন ছিল ভারতের বিশাল বাজার দখলের জন্য মডেল হিসেবে ভারতীয় নারীদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানানোর।

এ বছর চীনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সুন্দরী প্রতিযোগিতা। কারণ চীনও তার বাজার খুলে দিয়েছে। চীনের সর্বত্র এখন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড শপ। চীনের অর্থনীতি বিশাল। তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডগুলো বিশ্ব জয় করছে। ফলে চীনের নারীদের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের মডেল বানানো অতিজরুরি। এই চাহিদা থেকেই ২০০৭ ও ২০১২ সালে চীনের মেয়েরা সেরা সুন্দরীর খেতাব জিতেছেন।

একটি কথা মুক্তিকামী নারীদের বুঝতে হবে। এই ধরনের তথাকথিত সুন্দরী প্রতিযোগিতা এবং আরও অন্য অনেক আয়োজন তাকে কখনও প্রকৃত মুক্তি এনে দিতে পারবে না। সাময়িকভাবে তারা লাইম লাইটে থাকবে বটে কিন্তু অচিরেই সে কারও না কারও চিহ্নিত পুতুলেই পরিণত হবে। মেধার চর্চা, মননের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা এবং সেজন্য চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা ছাড়া নারী-পুরুষ কারও মুক্তি নেই। কোনো গডফাদার বা মেন্টরের ছত্রচ্ছায়ায় নয়, তাদের হাতের পুতুল হয়ে নয়, নারীকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে একক অথবা সম্মিলিত সংগ্রামের মাধ্যমে। এই সংগ্রামের মত-পথ নিয়ে আলোচনা ভিন্ন জায়গায় হবে।

বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার যে নিয়ম নিয়ে সম্প্রতি এত কাদা-ছোঁড়াছুড়ি হল সেটার দিকেও একটু তাকাই। বিশ্বসুন্দরীকে 'অবিবাহিত' হতে হবে (ভার্জিনিটির প্রশ্ন নয়, সেটা তো মেডিকেল প্রমাণসাপেক্ষ)। মোটা দাগে বিবাহিত-অবিবাহিতর ফারাক এই কারণে যে, বিবাহিত হলে বোঝা যায় নারীটি ইতোমধ্যেই 'একজন পুরুষের দখলে আছে'। আর অবিবাহিত হলে প্রত্যেকেই তাকে দখলের স্বপ্ন দেখতে পারে। অবিবাহিত নারী হতে পারে অন্য সকল অবিবাহিত নারীর আইকন যারা প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখে ব্র্যান্ড আইটেম ব্যবহার করে ওই রকম মনোলোভা হয়ে কোনো ধনী শ্রেষ্ঠ পুরুষ বাগানোর। আসল কথা হল, 'সিনডারেলা' হওয়ার স্বপ্ন উসকে দেওয়া এবং সেই স্বপ্নপূরণে ব্র্যান্ড আইটেম ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা।

ঢাকায় আমরা দেখলাম 'এক সুন্দরী'র মাথা থেকে মুকুট খুলে 'অন্য সুন্দরীর' মাথায় পরাতে। এই উপলক্ষে প্রথম সুন্দরীর খেলার নিয়মভঙ্গ ও অন্যান্য প্রসঙ্গে তার চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণও হল ফেসবুকে ও মিডিয়ায়। আমি কোনো সুন্দরীরই সমর্থক নই। কারণ তারা প্রত্যেকেই পুঁজিতন্ত্রের ক্রীড়নক। পুঁজিতন্ত্র যদি মনে করে অমুক সুন্দরীর চেয়ে তমুক সুন্দরী তার স্বার্থ উদ্ধারে বেশি উপযোগী, তাহলে তার মাথায় উঠবে পুতুলখেলার মুকুট। নিয়মভঙ্গের প্রসঙ্গ উঠলে প্রয়োজন ছিল দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে আয়োজক কোম্পানিরই ফ্রাঞ্চাইজি বাতিল করে অন্য কাউকে দালালি দেওয়া।

হাতের পুতুলের মুকুট কাড়ার আগে মুকুট পরানোর ক্ষমতাটি বদলানোর দরকার ছিল। সেটি হত সুবিচার। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?