সেকাল একালের কড়চা

মামুন আল মাহতাব
Published : 2 Oct 2017, 07:04 AM
Updated : 2 Oct 2017, 07:04 AM

আমার বাবা ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন ১৯৬১ সালে। তিনি ছিলেন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শেষ ব্যাচের ছাত্র। এর পরপরই কলেজটি 'ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি' আর স্বাধীনতার পর 'বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি'তে রূপান্তরিত হয়।

আমার বাবা ও তাঁর সহপাঠীরা তাদের ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে আশির দশকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন '৬১ ক্লাব'। উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রজীবনের বন্ধুত্বকে স্থায়ী রূপ দেওয়া। পাশাপাশি অকাল প্রয়াত কিংবা অসুস্থ বন্ধুদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদের সময়কার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রিন্সিপাল ও পরবর্তীতে 'ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি'র প্রথম উপাচার্য ড. রশিদের নামে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি 'চেয়ার' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম শক্তিশালী করা।

তাদের সেই উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সফল। '৬১ ক্লাব' টিকে আছে মৃত্যুর সীমানা পেরিয়েও। '৬১ ক্লাবে'র বন্ধুরা এখনও নিয়মিত মিলিত হন, আড্ডা দেন, ক্লাবের কর্মকাণ্ড দেখভাল করেন আর ভালো কিছু সময় কাটিয়ে ঘরে ফেরেন।

আমার বাবা আমাদের ছেড়ে গেছেন গত বছরের শুরুতে। তাঁর প্রয়াণের দেড় বছর পর কদিন আগে গেলাম '৬১ ক্লাব'-এর দাওয়াতে। বাবার অনুপস্থিতিতে বাবার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে অভিনব। একদিকে অসম্ভব মন খারাপ করা অনুভূতি আর অন্যদিকে মৃত্যুঞ্জয়ী একটি আসরে শরিক হওয়া। অনুভূতিটা বোঝানো মুশকিল।

বাসায় ফিরতে ফিরতে মনে পড়ছিল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে কাটিয়ে আসা আমার সময়ের কথা। এমএমসিতে আমাদের ব্যাচমেটদের একটা গ্রুপ ছিল। নাম ছিল 'দি-১৬'। ১৬ জনের গ্রুপ, প্রত্যেকে ছাত্রলীগ কর্মী, পরবর্তীতে কেউ কেউ আবার ছাত্রলীগের নেতাও।

সময়টা ছিল '৯০ পরবর্তী তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনকাল। প্রথমে আমরা কজন, আর তারপর আরও অনেক ব্যাচের আরও অনেক কজন হোস্টেল থেকে বিতাড়িত হয়ে আস্তানা গেঁড়েছিলাম ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়ার পাশাপাশি অনেকগুলো ভাড়া করা বাড়িতে। একসঙ্গে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, আড্ডা দেওয়া, মিছিল করা, প্রায়ই ধাওয়া খাওয়া আবার কখনও কখনও ধাওয়া দেওয়াও। সে সময়টায় আমরা ছিলাম 'হরিহর আত্মা'।

'কফি হাউজের সেই আড্ডাটা এখন আর নেই।' আমাদের বন্ধুত্ব মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়া তো দূরে থাক, কালজয়ীও হতে পারেনি। কর্মজীবন, পেশাজীবী রাজনীতি, প্র্যাকটিস ইত্যাদির অত্যাচারে আমরা এখন খুবই ছাড়া-ছাড়া। বন্ধুত্ব আছে, আবার নেইও। এই হল বন্ধুত্বের সেকাল আর একাল।

রাজশাহীতে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের কর্মসূচিতে যোগ দিতে বিমানের ড্যাশ-৮-এ বসে যখন এই লেখা লিখছি, সহযাত্রীর সামনে মেলে ধরা পত্রিকার পাতার একটা খবরে হঠাৎ চোখ আটকে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল নির্বাচন নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক বাড়াবাড়ির খবর ছেপেছে পত্রিকাটি। ছাত্র শিক্ষককে পেটাবেন–এটা এখন আমাদের গা সওয়া! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে নতুন ঘটনা। শিক্ষকেরা পিটিয়েছেন প্রতিবাদী ছাত্রদের। ক্লাসের ভেতরে নয়, ভরদুপুরে সিনেট ভবনের সামনে। একসময় প্রফেসর রশিদদের ছাত্ররা তাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে 'চেয়ার' প্রতিষ্ঠা করতেন আর এখনকার 'ড. রশিদ'রা তাদের সন্তানতুল্য ছাত্রদের কাছে মার খান এবং মাঝে মাঝে মারও দেন। বলিহারি বটে!

সম্প্রতি চিকুনগুনিয়ায় কাতর হয়ে পড়েছিল গোটা ঢাকা শহর। আমার জাপানি কোলাবরেটরের সঙ্গে ঢাকায় রিসার্চ মিটিং ছিল। সেই মিটিং চলে গেল দিল্লিতে, চিকুনগুনিয়া আতঙ্কে। সেখানেও চলছে ডেঙ্গু, মারাও গেছে তিরিশ জনের মতো। তাতে অবশ্য জাপানি ভদ্রলোক আতঙ্কিত হননি। কারণ, সে দেশের মিডিয়া এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়নি।

যাহোক, চিকুনগুনিয়ার বাহক মশাকে কাবু করতে আমাদের দুই নগর পিতা আর সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। আমার অনুজপ্রতীম সহকারী অধ্যাপক ডা. ডিউ সেদিন এডিস মশা দমনে তার দেখা একটি অভিনব উদ্যোগের কথা বলছিল। দ্রুত ছুটে যাওয়া পিকআপের পেছনে বসানো কামান সদৃশ ফগার থেকে এলাকা ধোঁয়া করে কীটনাশক ছড়ানোর কথা বলছিল ডিউ। শা-শা করে ছুটে যায় পিকআপ আর ভোঁ-ভোঁ করে পেছন থেকে ওষুধ ছড়ায় ফগার গান। একেই বোধ করি বলে 'মশা মারতে কামান দাগা'।

শুনতে শুনতে মনে পড়ল ছোট বেলার কথা। সে সময়টায় আমরা ঢাকার আকাশে মশা মারতে বিমান উড়তে দেখেছি। আগে থেকেই মাইকিং করায় ঢাকাবাসী ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখত আর আমরা ছোটরা পর্দা ফাঁক করে অবাক হয়ে দেখতাম হলুদ ফড়িংয়ের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বিমানটির ঢাকার আকাশ আঁধার করে ওষুধ ছিটিয়ে যাওয়া।

বিমান গেছে, এসেছে পিকআপ। ম্যালেরিয়া আগের জায়গাতেই আছে। নতুন উৎপাত হয়ে এসে জুটেছে ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া। এসব ভাইরাস সে সময়ে ছিলই না, সেটা একটা সম্ভাবনা বটে, তবে থাকলেও নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেটাও আরেকটা সম্ভাবনা।

'পরিবেশ', 'পরিবেশ' বলে গলা ফাটিয়ে পরিবেশবাদীরা পরিবেশের কী উপকারে আসছেন জানি না, ঢাকায় মশার তাণ্ডব যে বাড়ছে তা কিন্তু ঠিক। সেকালে পরিবেশবাদীরা ছিলেন না, একালে আছেন। পরিবেশই বলে দেয় এতে পরিবেশের কিছু এসে গেছে কি না।

সেকালের সঙ্গে একালের এমন গড়মিল এমন কত কিছুতেই। শুনেছি আগে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের সময় ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্য ছিল অন্যতম বিচার্য বিষয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিসিএসে নিয়োগের ক্ষেত্রে এখনও আছে পুলিশ ভেরিফিকেশন। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য আর ক্রিমিনাল রেকর্ড নিয়ে যাদের ব্যাপারে সংশয়, তাদের ছেঁকে বাদ দেওয়ার এটি একটি শতবর্ষ পুরনো স্বীকৃত পদ্ধতি। সেকালের মতো একালেও সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও দলীয় পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একালে দলীয় আনুগত্য আর কোনো বিচার্য বিষয় নয়। তাই যুদ্ধাপরাধীর ছেলের ঠাঁই হয় একদলের কমিটিতে তো অন্যদলে ঠাঁই পান স্বাধীনতাবিরোধীর সন্তান। আর সেই নিয়োগকে আবার জায়েজও করে দলগুলোর কেউ কেউ।

একালে আমাদের হাতে হাতে মোবাইল, সেই মোবাইলে আছে আবার ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদি। ঘরে-ঘরে আছে ইন্টারনেট আর টিভিতে শত শত চ্যানেল। তারপরও একালের বাউল আব্দুল করিম গেয়েছিলেন:

"আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম…"

লেখার শেষে এসে বাউলের সেই কথাগুলোই বড় বেশি মনে পড়ছে। আর তারপর মনে হচ্ছে এতটা হতাশারও হয়তো কিছু নেই।

সেকালে বঙ্গবন্ধু ছিলেন, আজ তিনি নেই। কিন্তু তিনি আছেন তাঁর দুই সুযোগ্য কন্যার মাঝে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন তাঁর লাখো কোটি অনুসারীর হৃদয়ে। তাই বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের দণ্ড লাঘব হলে কিংবা দলীয় কোনো পদে ভোল পাল্টে কেউ ঢুকে পড়লে তাতে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগেরই।

আর যতদিন এই রক্তক্ষরণ আওয়ামী লীগের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যাবে, যতদিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ধমনিতে থাকবে বঙ্গবন্ধুর রক্ত প্রবাহমান, ততদিন একাল সেকালকে ছাড়িয়ে যাবেই।