নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও একটি প্রাসঙ্গিক কর্মশালা

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 20 Nov 2011, 11:33 AM
Updated : 3 Oct 2017, 05:49 AM

'দি স্পেক্ট্রাল উন্ড: সেক্সচ্যুয়াল ভায়োলেন্স, পাবলিক মেমোরিজ অ্যান্ড দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন ১৯৭১' গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হয় গত ২৭ আগস্ট। গ্রন্থটির লেখক ডারহাম ইউনিভার্সিটির ড. নয়নিকা মুখার্জি। মোড়ক উন্মোচনের পর দিনব্যাপী বইটি নিয়ে আইনবিদ, রাজনীতিবিদ, নারীসংগঠক, উন্নয়নকর্মী ও সাংবাদিকসহ এ বিষয়ে সচেতন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় এবং সেখান থেকে উঠে আসা সংশ্লিষ্ট তথ্য ও দিকনির্দেশনা নিয়ে বইটিকে পূর্ণাঙ্গ করার জন্য ফলোআপ কর্মশালার আয়োজন করা হয় বলে জানান আয়োজকেরা। এই কর্মশালা আয়োজন করেছিল গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা রিইব (RIB)।

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষাধিক ধর্ষিত নারীকে 'বীরাঙ্গনা' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, যুদ্ধকালীন ধর্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত নীরবতার ব্যাপারে জবাবদিহিতার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যৌন সহিংসতার জনস্মৃতিসমূহ সূত্রবদ্ধ করা এবং ৪৫ বছরের প্রণীত সাহিত্য ও ভিজ্যুয়াল আর্কাইভে ১৯৯০ অবধি তুলে ধরা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বীরাঙ্গনাদের অধিকারভিত্তিক সাক্ষ্য এই গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে।

১৯৯৭-৯৮ এবং পরবর্তী সময়ে ২০১১-১৩ সালে বছরব্যাপী মাঠপর্যায় থেকে উঠে আসা তথ্যসহ প্রণীত এই বিভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের বক্তব্যসমূহ বিচার-বিশ্লেষণের পর এই লিখিত ভাষ্য প্রণীত হয়েছে। এর ফলে যুদ্ধকালীন ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত স্টিগমা, নীরবতার সম্মান লজ্জা ও ক্ষতিপূরণে প্রভাবশালী বোধ স্পষ্ট করে যুদ্ধে যৌনতার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক অনুসন্ধানের সম্ভবনা উন্মুক্ত করেছে।

আমরা জানি, যুদ্ধের সময় ব্যাপক মাত্রায় নারী নিগৃহীত হয়েছে দেশের সর্বত্র। তাদের শরীরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় কলঙ্ক যে যুদ্ধের কারণে, সেটা বুঝতে দীর্ঘসময় লেগেছে অনেকের। শুধু তা-ই নয় বুঝতে সময় লেগেছে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত যারা, তাদেরও। এর পরিপ্রেক্ষিতে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধার মতোই নারী নিজেকে যে উৎসর্গ করেছেন সেই সত্য ক্রমান্বয়ে সামনে এসেছে। বীরত্বের মহিমা দেওয়ার জন্য তাই রাষ্ট্র তাদের 'বীরাঙ্গনা' আখ্যা দিয়েছে।

তবে দুঃখজনক সত্য হল, আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, এখনও এঁদের সঠিক সংখ্য নিরূপন করা হয়নি এবং এঁদের অনেকেই বীরাঙ্গনা উপাধির মহত্ব তাদের জীবন, সর্বোপরি তাদের মনে ধারণ করতে পারেননি।

মূলধারায় না আনার কারণ, সমাজের নিম্নবিত্ত ও তৃণমূলের নারীরা উভয় ধরনের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার তিন দশক পরে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ভাষা ব্যবহারে পুরুষের আধিপত্য আরও দীর্ঘদিন নারীকে বন্দি করে রেখেছিল, সেখান থেকে এখনও তাদের মুক্তি ঘটেনি। ধর্ষণের ব্যাখ্যায় এখনও আমাদের যে অপর্যাপ্ততা রয়েছে তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। যেহেতু পুরুষ নারীর অভিভাবক, ধর্ষণ করা মানে পুরুষের অভিভাবকতা চ্যালেঞ্জ করা। আবার জেনেভা কনভেনশনে বলা হয়েছিল, একে নারীর সম্মানবোধের ওপর হামলা বলা চলে, কিন্তু এর সঠিক সমাধান স্পষ্ট হয়নি।

এ দেশের নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণকে পৃথকভাবে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করার দাবি ওঠে। যার ফলে ১৯৯৫ সালে বেইজিং ঘোষণায় ধর্ষণকে 'যুদ্ধাপরাধ' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর আগে ১৯৪৯ সালে জেনেভা কনভেনশনে ধর্ষণকে মূলত 'মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং এর সাজা ছিল তুলনামূলকভাবে কম এবং অনেকটা নমনীয়। কাজেই ধর্ষণকে পৃথকভাবে গণ্য করার দাবি সঠিক ছিল যার বাস্তবায়ন ঘটে বেইজিং সম্মেলনে।

জানা গেছে, এর পেছনে দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করেছে রুয়ান্ডা ও বসনিয়ার নারীদের ওপর চালানো অমানুষিক নির্যাতন এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কোরিয়ান ও ফিলিপিনো কমফোর্ট নারীদের জাপানের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরণের দাবি।

আমাদের দেশের নারী আন্দোলনকারীরা মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই নারী উৎসর্গ করেছেন নিজেকে দেশের জন্য, এ সত্য বুঝতে হবে। তাঁরা মনে করেন, ধর্ষণ হচ্ছে চরম সহিংসতা যা আঘাত হানে নারীর দেহে, সততায়, স্বাতন্ত্র্য, নিরাপত্তা, আত্মপরিচয় এবং সর্বোপরি তাঁর মর্যাদাবোধে।

হাইতি, বসনিয়া, রুয়ান্ডার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তাদের জীবনের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘকালীন প্রতিক্রিয়াসমূহ স্পষ্টভাবে তাদের লিখিত পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। অনেকে দেখিয়েছেন, এই প্রতিক্রিয়া দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক বড় সত্য হল মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ওঠা এই নারীরা মৃত্যুমুখী হয়েই বেঁচে থাকবেন চিরকাল। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধাহত এই নারীযোদ্ধারা আত্মসম্মান, যৌনবোধ ও সংসার করার স্পৃহা হারিয়ে নিজগৃহে গৃহহীন হয়ে আছেন বলে অনেকে মনে করেন। নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পরও তাদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যা কোনোভাবেই সংগত ছিল না বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

তবে আশার কথা, দীর্ঘ বিস্মৃতি ও অবহেলার পর ইতিহাসে ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন তাঁরা প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে খবর আদানপ্রদান, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ও গোপনে পৌঁছে দেওয়া, খাবার-ওষুধ সরবরাহ, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, গোপনে রান্না করে খাওয়ানো, পুরুষদের যুদ্ধে পাঠিয়ে ঘর-সংসার-সন্তানসন্ততির দায়িত্ব নিয়ে সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা– সব ক্ষেত্রেই তাদের সেই সাহস ও উদ্যম যথাযথ মর্যাদায় লিপিবদ্ধ করা হয়নি, যা করা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক।

কেবল বাঙালি নয়, মুক্তিযুদ্ধে প্রবলভাবে অংশগ্রহণ করেছেন আদিবাসী নারীরাও। শরণার্থী শিবিরের জন্য মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট, প্রচার ও প্রশাসনের কাজ, ট্রেনিং, গান-কবিতার মধ্য দিয়ে মনোবল ঠিক রাখা, চাঁদা তোলা, ওষুধ সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাদান, কী না করেছেন তাঁরা। তাদের মহিমা ও বীরত্ব মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণভাবে আসা দরকার, তবে সে ক্ষেত্রে ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে যাতে পুুরুষের আধিপত্য নারীকে বন্দি করে না রাখে।

পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রের বৈষম্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মোট ৬৭৬ জনের মধ্যে মাত্র দুজন নারী 'বীরপ্রতীক' খেতাব পেয়েছেন।

পৃথিবীর যে কোনো দেশে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীরাই বেশি। তাদের প্রতি সহিংসতা ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি একধরনের যুদ্ধ-কৌশল। এই চরম সত্যটি মাথায় রেখে সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখা উচিত। সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে সরকার কর্তৃক তাদের ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের সঠিক ব্যবস্থা করতে হবে।

নারী নির্যাতনের চিত্র নারীদের চোখ দিয়েই দেখতে হবে। নীরবতা এখনও আছে, সেই নীরবতা ভাঙতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বিশিষ্ট কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, "এসো এই নারীর বীরত্বগাঁথার জন্য তাকে সম্বর্ধনা দিই।"

পরবর্তী প্রজন্মকে বলি: এঁদের দেখো। এঁদের ঋণ তোমরা শোধ করতে পারবে না।

তাই মুক্তিযুদ্ধে নারীর ইতিহাস নারী অধ্যয়নে প্রতিফলিত হতে হবে।