ক্ষমা করো বাংলাদেশ

saifullamahmud_dulal
Published : 31 May 2013, 03:55 PM
Updated : 31 May 2013, 03:55 PM

খুব ছোটবেলায় ভূগোল পড়তে পড়তে কানাডার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হই। মাল্টিকালচারাল কানাডা অপূর্ব এক শান্তিপূর্ণ দেশ। নিজের অজান্তেই জাদুর মতো সেই আশা পূর্ণ হল। দেখতে দেখতে বহুমাত্রিক কানাডায় কেটে গেল অনেক বছর।

একদিন ইমিগ্রেশন থেকে চিঠি এল সিটিজেনশিপ পরীক্ষার। পরীক্ষার ছমাস পর আবারও চিঠি। এবার Oath নিতে হবে, এপ্রিল ০৪, ২০১২। জাজের সামনে বলতে হবে 'O Canada! Our home and native land!/True patriot love in all the sons command….' ।
দুই মেয়ে অনাদি নিমগ্ন আর অর্জিতা মাধুর্য্যকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে রওনা হলাম টরন্টোর স্কার্বো সেন্টারে, স্থানীয় ইমিগ্রেশন এন্ড সিটিজেনশিপ অফিসে। দুপুর একটায় শপথনামা। যথাস্থানে দেড় শতাধিক লোক। এরা কানাডার নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন। সবারই একসঙ্গে শপথ হবে। সিরিয়াল মোতাবেক ডেকে নিয়ে জাজের রুমে বসাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে পিআর অর্থাৎ পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট কার্ড ও লেন্ডিং পেপার। আর হাতে হাতে তুলে দিচ্ছে নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট, কানাডার জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, মেপললিপের কোটপিন প্রভৃতি।

নাগরিকত্বের আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে ছেলেমেয়েরা বাবা কিংবা মায়ের সঙ্গে পরীক্ষা দেওয়া ছাড়াই নাগরিকত্ব পায়। অনাদি ও অর্জিতার ক্ষেত্রেও তাই। আমরা তিনজন পেলাম। আটকে থাকলেন আমার স্ত্রী। তাঁর নাগরিকত্ব পরীক্ষার নোটিস এখনও ইমিগ্রেশন অফিসে প্রসেস হচ্ছে।

পিআরের পর পাঁচবছরের মধ্যে তিনবছরের অধিক থাকতে হয়। তারপর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হয়। আমার খালাতো ভাই বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ ড. মাহবুর রেজা বহুবছর ধরে কানাডায়। কিন্তু তিনি আবেদন করতে পারছেন না। কারণ পাঁচ বছরে তিনি হাজার রজনী সঞ্চয় করতে পারছেন না, নাগরিকত্বের রাজকন্যাকেও ছুঁতে পারছেন না, গাইতে পারছেন না ব্রিটেনের রানি বন্দনার গান। কারণ, জাপানের এক আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার সুবাদে তাঁকে প্রায় সারা বছরই ঘুরতে হয় এদেশ-সেদেশ। ফলে ঝুলে আছেন পিআর-এ। আজ থেকে ডবল আইডি হচ্ছে। তারপরও আইডি ক্রাইসিস!

এসব ভাবতে ভাবতে আমাদের ডাক এল। গেলাম। অনাদি ও অর্জিতাকে ওথ রুমে ঢুকতে দিল। আমাকে বললেন, তোমার ল্যান্ডিং পেপার কই? কালো মহিলাকে বললাম এবং বুঝালাম, আমার বিষয়টি ভিন্ন। কারণ আমি ল্যান্ডিং ইমিগ্রেন্ট নই; আমি এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমার স্ট্যাটাস 'রিফিউজি'। বিটিভির আইন-আদালতখ্যাত আমার আইনজীবী ব্যারিস্টার রেজাউর রহমান বলেছিলেন, তাঁর বাংলাদেশি 'রিফিউজি' ক্ল্যায়েন্টদের মধ্যে যে চার-পাঁচজন শীর্ষে, তাঁরা হলেন– লুৎফর রহমান রিটন, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, সেলিম সামাদ, শামীম ওসমান প্রমুখ। মনে হয়, আনাড়ি মহিলা 'রিফিউজি' বিষয়টি সম্পর্কে মোটেও অবগত নন। ভেতরে গিয়ে জাজের সহকারীর কাছে আমার বিষয়টি জানালে তিনি আমাকে ডবল কংগ্রেচুলেশন জানিয়ে আসন গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বললেন, তুমি তো Convention of 28 July 1951-এর সন্মানিত ব্যক্তি। ভদ্রমহিলার কথা শুনে মনে পড়ল, আমার রিফিউজি আবেদন অনুমোদনের পর ইমিগ্রেশন বোর্ড ভিআইপি বিবেচনা করে জাতিসংঘের পাসপোর্টের মতো ট্রাভেল ডকুমেন্ট (বিকল্প পাসপোর্ট নম্বর P-Can- RS 013462) ইস্যু করেছিল এবং তাতে লেখা ছিল– This Refugee travel document is valid for travel to all countries except Bangladesh.

অথচ আমি কবিতায় লিখেছি : মৃত্যুর পর বেহেস্তে নয়, বাংলাদেশে যেতে চাই। আর মনে পড়ে শুভ্র দেব আর শাকিলা জাফরের গাওয়া গানটি- 'ও ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। অনেক সাধের স্বপ্নের জন্মভূমি/ তোমায় কখনও ভুলব না, ভুলে যাব না…।'

হ্যাঁ, সত্যি প্রতিমুহূর্তে বুকের ভেতর আমার জন্মলীন বাংলাদেশটাকে ভীষণ মিস করেছি, পাগলের মতো ফিল করছি। কষ্টে কাঁদি। মনের কোনায় চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে-থাকা আমার দুঃখিনী বাংলাদেশের জন্য মধুসূদনের মতো 'বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন'-এর জন্য কত যে চোখের জল মুছেছি। পুরনো ছেঁড়া শাড়ি পরা, চোখে ছানিপড়া, কপাল কুঁচকানো, দাঁত পড়া, মলিন মুখ এ রকম চেহারায় আমার বৃদ্ধা মা বিশ্বসুন্দরীর চেয়ে মোহনীয়। আমার মাতৃভূমিও পৃথিবীর সেরা দেশের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

আজ আমার প্রথম মৃত্যু; দ্বিতীয় জন্ম, দ্বিতীয় দেশ। মানে আমি দ্বৈত নাগরিক হচ্ছি। দ্বিখণ্ডিত জলের ধারায় দ্বিমাত্রিক হচ্ছি। ৫১% আর ৪৯% হচ্ছি। ওথ রুমে ঝুলন্ত টিভির চ্যানেলে কালারফুল কানাডাকে তুলে ধরা হচ্ছে, আর আমার মনে পড়ছে, বিউটিফুল বাংলাদেশ! কী অদ্ভুত এক দ্বিধাদ্বন্দ্বের অনুভূতি আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে! নিজেকে প্রশ্ন করছি, বাংলাদেশ বনাম কানাডা ক্রিকেট খেলা হলে আমি কাকে সমর্থন জানাব? কারণ, জিতলেও আমার দেশ, হারলেও আমার দেশ।

আমার আসল সাকিন কী? এখন আমার আসল ঘর কই? আসলে আমি কে? এই ভাবনা অনেক দিন ধরেই মাথার ভেতর প্রশ্নবোধক হয়ে আছে। সে জন্যই কবিতার বইয়ের নাম দিয়েছি 'নীড়ে নিরুদ্দেশে'। আমি নীড়ে আছি, নাকি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছি? আমার নীড় কি ঢাকায়, নাকি টরন্টো! নিরুদ্দেশটা কোন দেশ? সেদিন আমার ক্লাসের শিক্ষক যোশেফ ভারগেস জানালেন, 'ব্যাকহুম' মানে প্রিভিয়াস কান্ট্রি আর 'হোমকান্ট্রি' মানে কানাডা!

আজ যারা কানাডার নাগরিক হচ্ছেন, তাদের চোখেমুখে উচ্ছলতা আর আনন্দের হাসি। আর আমি এলোমেলো। নিজের ভেতর ভাংচুর হচ্ছে, নৃতাত্ত্বিক বোধ ও বেদনার স্রোত টের পাচ্ছি শিরায় শিরায়।

আসলে আমি অগোছালো। আমার ভেতরকার বিভাজনের মর্মস্পর্শী কষ্ট কেউ বুঝবে না। আমার বন্ধুবান্ধব, বাবা, মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, সন্তানও না। এই নীরব ভাঙনের শব্দ একমাত্র আমিই শুনতে পাচ্ছি। ইমিগ্রেশন তথা অভিবাসন নবজন্মে নতুন মাত্রা যুক্ত করে, আবার তেমনি ভিন্নভাবে প্রথম মৃত্যুর স্বাদও দিয়ে থাকে। সাধারণ অভিবাসীরা সেই বোধ টের না পেলেও লেখকেরা তা তীব্রভাবে অনুভব করেন।

মনে পড়ছে রাশিয়ার দেশান্তরী লেখক আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিন-এর কথা। যিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণের ঠিক পূর্বমুহূর্তে নাটকীয়ভাবে সিদ্ধান্ত পাল্টান। তিনি আর আমেরিকান নাগরিকত্ব নেননি। অথচ অনেকেই সন্তানকে 'আমেরিকান' বানানোর জন্য সেই দেশে গিয়ে সন্তান জন্ম দেন। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে মাননীয় জাজ এসেছেন, টের পাইনি। সবাই দাঁড়াচ্ছে। আমিও রোবটের মতো দাঁড়াছি। বসছি। শপথ নিচ্ছি : 'I swear (or affirm)/ That I will be faithful/ And bear true allegiance/ To Her Majesty Queen Elizabeth the Second/ Queen of Canada/ Her Heirs and Successors/ And that I will faithfully observe/ The laws of Canada/ And fulfill my duties as a Canadian citizen.'

আর ভাবছি, আমরা যে ব্রিটিশকে তাড়িয়েছি, আজ আবার সেই ব্রিটিশের রানির অনুগত্য মেনে নিতে হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে এসব ইতিহাস, ভূগোল, গণিত বাংলায় মিলেমিশে কঠিন রসায়ন সৃষ্টি হচ্ছে। একজন খাঁটি আত্মঘাতী বাঙালি কীভাবে দ্বৈতসত্তায় কানাডিয়ান হচ্ছে! সিটিজেনশিপ ও ইমিগ্রেশন মন্ত্রী জেসন কেনির সই করা সিটিজেন সার্টিফিকেট পাচ্ছি। আর তাঁকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মি. হারপার নিজহাতে সই-স্বাক্ষরে স্বাগত জানিয়েছেন, 'As Prime Minister, it is my great pleasure to welcome you to our Canada family. In choosing to immigrate to Canada, and to become a Canadian citizen, you have chosen the best country in the world. No other is as rich in promise and potential as our beloved Canada- for you, your children's children…।'

হ্যাঁ, চিল্ড্রেন; শিশু সন্তান। আমার দুই সন্তান যেন আমার দুই নয়নের মণির মতো। আমার সেই দুই সন্তানকে তো জন্মভূমি স্বদেশ, স্বজন, সংস্কৃতি, শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। জন্মভূমি থেকে ১৩ হাজার মাইল দূর দেশে অভিবাসনের পানসিতে রূপকথার বেহুলার মতো ভাসিয়ে দিচ্ছি। আমি কি সন্তান হারিয়ে বেদনা নিয়ে শূন্য হাতে ফিরে যাব বঙ্গ ভাণ্ডারে! বাংলাদেশ যদি আমাকে প্রশ্ন করে : আমার অনাদি কই, আমার অর্জিতা কই? আমি তখন কী বলব! বলব, বাংলাদেশ তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

১৯৭২ সালে কানাডায় বায়ান-জরিনা-শিখা যুদ্ধশিশুরা দত্তক হয়েছিল। হায়, আজ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর আমি তো পিতা হয়ে আমার প্রিয় সন্তানদের মাতৃভূমির নাড়ি ছিঁড়ে (বিশ্বায়নে বিশ্বনাগরিক, উচ্চশিক্ষা, উন্নতজীবনের প্রত্যাশায়) নিজ হাতে ভূস্বর্গের দেশে প্রতীকী 'দত্তক' দিয়ে যাচ্ছি। অনাদি-অর্জিতা এখন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান। বাংলাদেশের এই শ্যামলা মেয়ে দুটির বাংলা ভাষার লালিত্যে আস্তে-ধীরে মরচে ধরে যাবে। যারা 'ইলিশ মাছের রূপকথা' শীর্ষক বই লিখে সুনাম অর্জন করেছিল, তারা আর চিনবে না চর খার চর, ভুলে যাবে চাঁদপুর, জানবে না যশোর রোডে সেপ্টেম্বর, বুঝবে না তিস্তা নদীর কষ্ট, শুনবে না কদম ফুলের পাশে দোয়েল পাখির শিস। গাইবে না রবীন্দ্র-নজরুল, পড়বে না বাংলা কবিতা। হয়তো কোনো এক বৈশাখে ভুল ছন্দে শাড়ি পরে বলবে, একদিন বাঙালি ছিলাম রে… ।

পাগলের মতো মনে মনে হাসলাম। স্কুলে পড়ার সময় (পূর্ব পাকিস্তানে) দল বেঁধে সুর তুলে গেয়েছিলাম : পাক সার জমিন সাদ বাদ… সেই পাকিস্তানের গানকে আমরা ১৯৭১ সালে ঘৃণায় কবর দিয়েছি। আজ আবার ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিতে কানাডার জাতীয় সংগীত গাচ্ছি। ঘোরের ভিতর কেমন যেন বিভ্রান্ত আমি। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, এ গানের অনুবাদ কি হতে পারে না 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'?

আমি কি কাদঁছি?