বাংলাদেশে দুর্গাপূজার ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 30 Sept 2017, 02:13 PM
Updated : 30 Sept 2017, 02:13 PM

রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের শাসনামলে বাংলায় দুর্গাপূজার শুভ সূচনা হয়। একসময় দ্বিতীয় কালাপাহাড়ের অভুদ্যয় ঘটে এবং বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় ধ্বংসের বিভীষিকার সূচনা করে। রাজা কংসনারায়ণ সম্রাট আকবরের কাছে সুরক্ষা প্রার্থনা করেও খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারেননি। পরে তাহেরপুরে প্রত্যাবর্তন করে জমিদারিতে মনোযোগ দিলেন, কিন্তু মনের অগোচরে আশঙ্কায় স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। অবশেষে পণ্ডিতদের ডেকে প্রায়শ্চিত্ত কল্পে মহাযজ্ঞে ব্রতী হতে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বিখ্যাত তান্ত্রিক রমেশ শাস্ত্রী তখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে সুপরিচিত।

কীভাবে দুষ্ট গ্রহের প্রভাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়– রাজার এরূপ প্রশ্নের উত্তরে শাস্ত্রী বিধান দিলেন যে, "শাস্ত্রে বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ যজ্ঞের বিধান আছে। প্রথম দুটির জন্য রাজা অধিকারী নয় এবং শেষ দুটি কলিতে নিষিদ্ধ এবং ক্ষত্রিয়ের করণীয়।"

রাজা বিমর্ষ হলেন। রমেশ শাস্ত্রী উত্তর দিলেন, "বিধান আছে, তা হচ্ছে কলিতে মহাযজ্ঞ হচ্ছে দুর্গোৎসব। এ যজ্ঞে সকল যজ্ঞের ফল লাভ হয়। সত্য যুগে সুরথ রাজা এ যজ্ঞে ব্রতী হয়ে ফল লাভ করেছেন এবং ত্রেতা যুগে ভগবান রামচন্দ্র রাবণ বধের উদ্দ্যেশে অকালে মা দুর্গার পূজা করে সফলকাম হয়েছিলেন।"

অতঃপর রাজা কংসনারায়ণ রাজসিকভাবে দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন এবং বলা যায় রমেশ শাস্ত্রীই আধুনিক দুর্গোৎসব পদ্ধতির প্রথম প্রণেতা।

বাংলায় এভাবেই প্রথম প্রতিমায় শারদীয়া মা দুর্গার আবির্ভাব, ভাবনা ও রূপলাভ করে।

রাজা কংসনারায়ণ তখনকার দিনে সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয় করে বিশাল আয়োজনের মাঝে দুর্গোৎসবের উদ্‌যাপন করে সমগ্র ভারতবর্ষে ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে তোলেন। ইংরেজ রাজকর্মচারীরাও অংশগ্রহণ করে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। রাজা কংসনারায়ণের অনুকরণে ভাদুড়িয়ার রাজা জগৎনারায়ণ মহাসমারোহে সুরথ রাজার বিধানে বাসন্তী পূজা করলেন। এভাবেই শুরু হল বাংলায় দুর্গাপূজার সমারোহ, আরতি প্রতিযোগিতা, শারদীয়া উৎসবের আমেজ।

রাজা কংসনারায়ণের সভাপণ্ডিত ছিলেন কৃত্তিবাস পণ্ডিত। তিনি ছিলেন নদীয়া জেলার ব্রাহ্মণ। রাজার অনুরোধে ১৪৬০ শকাব্দে বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন, যা 'কৃত্তিবাসী রামায়ণ' নামে বাংলার ঘরে ঘরে নতুন এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। রামায়ণকে কেন্দ্র করে শুরু হয় নাটক, যাত্রাপালা, কবিগান ও বিবিধ উৎসব। এ সকল আয়োজনের মাঝে বাংলার সামাজিক অঙ্গনে আসে এক নবজাগরণ। সংস্কৃতি অঙ্গনে সূচনা হয় এক বিপ্লব, যা শারদীয়া দুর্গোৎসবের মাঝে বিকশিত হয় বাংলার সকল মানুষের মাঝে এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাকে ছাড়িয়ে সকল ধর্মের লোকজনকে আকর্ষণ করে ব্যাপকভাবে বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ এবং সম্প্রীতির বন্ধন হিসেবে।

তবে দুর্গোৎসব রাজা মহারাজা এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মাঝে প্রথম দিকে সীমিত থাকলেও পরবর্তীতে সর্বজনীন রূপলাভ করে সকলের মাঝে এবং ভিন্ন আবেদনের সূচনা করে। দিকে দিকে সুর ধ্বনিত হয়–

"মিলেছি আজ মায়ের ডাকে!
ঘরের হয়ে পরের মতো
ভাই ছেড়ে ভাই কদিন থাকে।"

বাংলাদেশে পঞ্চাশের দশকেও দুর্গাপূজা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক এক আনন্দঘন আয়োজন। প্রায় প্রতিটি গ্রামে পূজা অনুষ্ঠিত হত এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণ ধর্মীয় ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে সার্বিক সহযোগিতা করতেন। দুর্গাপূজা মন্ডপের আঙ্গিনায় রামায়ণ কীর্তন, পালাগান, কবির লড়াই অনুষ্ঠিত হওয়ার দৃশ্যই ছিল গ্রামের সকল মানুষের মাঝে আনন্দঘন এক মহামিলনের কেন্দ্রবিন্দু।

দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে মেলাপ্রাঙ্গনে বসত আনন্দমেলা তাতে নাগরদোলা থেকে আরম্ভ করে মুরগির লড়াই সবই ছিল বিশাল আয়োজনের অংশ। বাংলাদেশে যাদের বয়স এখন ষাটের বেশি তারা সবাই বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এ উৎসবকে উপভোগ করেছেন। বিভিন্ন রকমের নারিকেলের সন্দেশ, নাড়ু, নানা রকমের পিঠা-মিঠাই-মন্ডা এসবই ছিল বাংলার শারদীয় উৎসবের প্রধান আকর্ষণ এবং মিলনমেলার অংশ।

বস্তুত বাঙালি জীবনে এক উদার, সহনশীল, সমন্বয়ধর্মী, মানবতাবাদী ধারা দৃশ্যমানভাবে প্রবাহিত ছিল বংশানুক্রমে। তাই বাঙালি কবির পক্ষেই লেখা সম্ভব–

"শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।"

এ মনোভাব এবং সমন্বয়ধর্মী মতাদর্শ প্রকাশিত হয়েছে ১৮ ও ১৯ শতকের মরমী কবি লালন ফকিরের গানে–

"সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।"

বাংলার লালিত আদর্শ ও সংস্কৃতির পদমূলে আঘাত করেছে এক 'নীরব চক্রান্ত' যা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় মৌলবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং উগ্রপন্থী অপশক্তিকে আমন্ত্রণ করে বাঙালির জীবনধারা ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। এ চক্রান্তকে তীব্র ও ভয়াবহ করেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান। তিনি ১৯৬৪ সালে ভয়াবহ দাঙ্গা বাঁধিয়ে আঘাত হানেন শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে, গোটা বাঙালির জীবনধারায়। তারপর ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান ১৭ দিনের যুদ্ধের পর হিন্দুদের সম্পত্তি হয়ে যায় 'শত্রু সম্পত্তি' এবং রচিত হয় হিংসার মহীরুহ যার প্রভাব এখনও চলছে।

তাই এখন আর গ্রামে-গঞ্জে দুর্গাপূজা তেমন আনন্দের মাঝে অনুষ্ঠিত হয় না; কখনও নিরাপত্তার ভয়ে, আবার কখনও স্থানীয় সরকারের সহযোগিতার অভাবে। দুর্গাপূজা এখন হয়েছে শহরকেন্দ্রিক। ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ বড় বড় মহানগরে দুর্গাপূজার মহাধুমধাম। অনেক পূজা অঙ্গনে কবিগান বা পালাগানের বদলে চলে মন্ত্রী, দলীয় নেতাদের প্রশংসা এবং তাদের আগমন ঘিরে বিশাল আয়োজন। তাদের বাণী দিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ পায়, যেখানে সুন্দর সুন্দর কথা থাকে অথচ তারা সবাই তা বিশ্বাস করেন না।

অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে পূজার আয়োজন করা হয়। সরকারের আর্থিক সাহায্য এবং দলের সহানুভূতিতে পূজার আয়োজন হয় বিশাল; প্রচার ও প্ররোচনায় ভরপুর। কিছু কিছু পৌরসভায় দলীয় পূজামন্ডপ হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে। আবার নব্য ধনীরা নিজেদের জাহির করার জন্যে কিছু বিনিয়োগ করেন ঘোষণা দিয়ে।

দেবী দুর্গার পূজা-অর্চনা হয়ে উঠেছে অনেকটা রাজনীতি ও দলবাজির মিলনমেলা হিসেবে। এখন পূজার প্রসাদ হচ্ছে খিচুড়ি বা পোলাও বা মিষ্টি-মিঠাই। ঐতিহ্যবাহী নাড়ু বা সন্দেশ যেমন নেই, তেমনি নেই বারোয়ারি দুর্গোৎসবের চেতনা, অনুভুতি বা স্পর্শ।

তারপরও বলা যায়, শরতের হিমেল হাওয়া, প্রকৃতিতে অভিনব রূপ, আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, চারিদিকে ফুলের সমারোহ– এসবের মাঝে দুর্গাপূজা যেভাবে দেশের জনগণের মাঝে উৎসবের আমেজ ও সম্প্রীতির বন্ধনে বাংলার মানুষকে বিমোহিত করে, এমনটি অন্য কোনো দেশে দৃশ্যমান হয় না।

তবে এবারের পূজার আনন্দের মাঝে একটি বেদনাদায়ক বিষয় যুক্ত হয়েছে, তা হচ্ছে আরাকানের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে মিয়ানমারের ভয়াবহ নরহত্যা যজ্ঞ। বেদনায় মানবতাবাদী বাংলাদেশের জনগণ শোকে মুহ্যমান। বিষয়টি প্রতিটি পূজামন্ডপে দৃশ্যমান হবে, সমবেদনা জানানো হবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে, ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করা হবে তাদের বেদনা উপশমের লক্ষ্যে। নরখাদকদের হৃদয়ে শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

তারপরও বলব বিজয়া-সন্মিলনের দিনের মতো আমাদের হৃদয় ভরে উঠুক প্রাণদাতা, শক্তিদাতা, সম্পদদাতা স্বদেশের প্রগতির ভাবনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় একবার করজোড় করে নতশিরে বিশ্বভুবনেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি–

"বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল
পুণ্য হউক পুণ্য হউক
পুণ্য হউক হে ভগবান।।"

মানবতার বাণী চিরজাগ্রত থাকুক সর্বত্র, সকল স্তরের জনগণের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকুক চিরকাল।