নজরুলের মানবসত্তা

আহমাদ মাযহারআহমাদ মাযহার
Published : 25 May 2013, 09:53 AM
Updated : 25 May 2013, 09:53 AM

কয়েকদিন আগে নজরুলের 'নারী' কবিতাটি পড়ছিলাম। কবিতাটি খুবই জনপ্রিয়। ভাবছিলাম এর জনপ্রিয়তার কারণ কী! বার বার পড়তে গিয়ে মনে হলো নজরুল আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারায়, সেটা কেবল মধ্যবিত্তীয় জীবনধারায় নয়, আমাদের লোকায়তিক জীবনধারায় নারী সম্পর্কে যে ভাবনাগুলো বিচরমাণ তাকে অন্তর্ভুক্ত করে অখণ্ড মানবসত্তার অংশে পরিণত করবার ক্ষেত্রে 'নারী' কবিতাটি তাঁর একটি চাবিকবিতা হিশেবে বিবেচিত হতে পারে। তাঁর রেনেসাঁসমানসতার সম্পূরক অনুভব হিশেবে কবিতাটির গুরুত্ব অপরিসীম।

নজরুলের সম্পাদিত 'লাঙল' পত্রিকার শিরোদেশে লেখা থাকতো 'সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই'। তাঁর ইহজাগতিকচেতনার এ আরেক দিক। অর্থাৎ ধর্মীয় পরিচয় নয়, মানবিক পরিচয়ই তাঁর কাছে পরম কাক্সিক্ষত! এই কারণেও নজরুল আমাদের জাতীয় কবি।

অথচ নজরুল বাংলাদেশে প্রায় সবসময়ই বিতর্কিত। ছোটবেলায়, যখন খানিকটা বুঝে ওঠার বয়স হল, তখন থেকেই অনুভব করেছিলাম যে নজরুলকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। মনে পড়ছে, নজরুল আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কে বড় তা নিয়ে পাঠকসাধারণের মধ্যে বিতর্ক ছিল। এমন উদ্ভট কথাও শুনেছিলাম যে, নজরুল-প্রতিভার প্রতি ঈর্ষাবশত রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এমন এক ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন যে তারপর থেকেই নজরুল অসুস্থ ও নির্বাক হয়ে পড়েছেন। এইসব উদ্ভট কথা যখন শুনছি নজরুল তখনও বেঁচে। তৎকালীন পিজি হাসপাতালের একটি কক্ষে গিয়ে তাঁকে দেখেও এসেছিলাম একদিন।

আমি যে-সময়ের কথা বলছি সেটা সত্তরের দশকের শুরুর দিকের কথা। দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনা তখন যথেষ্ট দুর্বল! অন্তত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন এখনকার মতো পুনরুজ্জীবিত হতে শুরু করেনি। তবে আমি যেহেতু মুসলিম পরিবারে জন্মেছি সুতরাং নজরুলও মুসলিম ছিলেন বলে একধরনের গর্ববোধ হতো আমার। এটা ছিল আমার পরিপার্শ্বের শিক্ষা। নজরুল একজন বড় কবি ছিলেন এ-ধারণার পাশাপাশি এইসব বিভ্রান্তিও ছোটবেলা থেকেই আমাদের সঙ্গী। আর একটু বড় হবার পর মুখোমুখি হলাম ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গির। সেটা হলো সামগ্রিক অর্থে তাঁর অনাধুনিকতা ও জনপ্রিয়তার কারণে তাঁকে বড় কবি না-ভাবা। সত্তর ও আশির দশকে আধুনিকবাদের ছিল প্রবল প্রতাপ। আধুনিকবাদীরা নজরুলকে কবি হিসাবে বড় জায়গা দিতে চাইতেন না। উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা ছিল তাঁর কবিত্বের শত্রু। জনপ্রিয়তা-সরলতা আধুনিকতার শত্রু– আধুনিকবাদীদের অনেকেই এই ধারণা পোষণ করতেন।


ছোটবেলায় নজরুল রচনাবলি পড়ুয়া আমার পক্ষে নজরুল বড় কবি নন এটা মেনে নেয়া খুব কঠিন ছিল। লক্ষ করেছিলাম নবীন কবিতা-সৃষ্টিপ্রয়াসীরা যা লিখতে চেষ্টা করতেন তাতে নজরুলের প্রভাব স্পষ্ট। আমার মাথায় ঢুকতে চাইতো না কেউ বড় কবি না হলে অন্যদের ওপর তিনি কীভাবে এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন! আরেকটু বড় হয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে পড়তে এলাম সেখানেও দেখলাম নজরুলের প্রতিভার সম্পর্কে বিরাট প্রশ্ন! আমার শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ তো শ্রেণীকক্ষে নজরুলকে পদ্যকারের বেশি মূল্যই দিতে চাইলেন না। শুধু তাই নয় জাতীয় কবিতা উৎসবের সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধে তো তিনি জোরেসোরে নজরুলকে মহাপদ্যকার বলে নাকচই করে দিলেন। নজরুলপ্রেমীদের পক্ষ থেকে এর যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর এল, এ নিয়ে বিস্তর হৈচৈও হল। বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের কারও কারও মধ্যে এমন ধারণা পোষণ করতে দেখেছি যে তাঁর গুরুত্ব কবি হিসাবে যতটা তার চেয়েও বেশি সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাববিস্তারী ব্যক্তিত্ব হিসাবে। তাঁদের মতে নজরুলের সৃষ্টিকর্মের অসাম্প্রদায়িক চেতনা-উজ্জীবক রশ্মি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল মানুষের মধ্যে। ফলে নজরুল বাঙালি-সমাজে গুরুত্ব পেতে থাকেন। ইহজাগতিক কর্মকাণ্ডে হিন্দুসমাজের চেয়ে বাংলার মুসলমান সমাজ তখন অনেকটা পিছিয়ে ছিল বলে হীনম্মন্যতায় ভুগছিল। কবি হিসাবে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালির মধ্যে নজরুলের জনপ্রিয়তা বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এনে দিয়েছিল আত্মবিশ্বাস। সেই আত্মবিশ্বাসেরই অতিরেক হচ্ছে কবি হিসাবে নজরুল বড় রবীন্দ্রনাথের চেয়ে– এই ভাবনা। এই অতিরেকের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তান আন্দোলনের উপজাত হিসাবে। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে নজরুলকে সবসময় মুসলমান হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এরই ফলে আমাদের কিশোর মনে নজরুল সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তির জন্ম। নজরুল সম্পর্কে এইরকম দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজ থেকে এখনও পুরোপুরি দূর হয় নি।

কবি হিসাবে নজরুলের মহত্ত্বকে যাঁরা স্বীকার করতে চান না তাঁরাও সামগ্রিকভাবে বাঙালি জীবনে নজরুলের প্রভাবকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তাঁর বিচিত্রমুখী প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের কারণে। সমগ্র বাঙালি সমাজে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোনও ব্যক্তির প্রভাব এত গভীর হয় নি। ইহজাগতিকতা-বিমুখ নিয়তিনির্ভর বাংলার মুসলমান সমাজে নজরুলের সৃষ্টিশীলতার প্রাচুর্য যে আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল তার তুলনীয় বাঙালি মুসলমান প্রতিভার দেখা মেলে নি। নজরুলের আবির্ভাব ছিল ঝোড়ো হাওয়ার মতো! ইংরেজদের ডিভাইড এন্ড রুল নীতির উত্তরপ্রভাবে বাংলা তথা ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বেশ কিছু মানুষের মধ্যে সে-সময় প্রবল হয়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প! নজরুল ছিলেন সেই বিষবাষ্প থেকে মুক্তির অন্যতম নকিব! তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা ছিল নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও। তিনি বিয়ে করেছিলেন হিন্দু পরিবারের মেয়েকে। নিজের ছেলেদের নামকরণেও ছিল অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয়। এইখানেও রয়েছে তাঁর বিদ্রোহী সত্তার পরিচয়। আর কবি হিসাবে নজরুলের বিদ্রোহীসত্তার পরিচয় যে জনমনে সবচেয়ে বেশি সেটা সবারই জানা বিষয়; সেটা প্রধানত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে 'বিদ্রোহী' কবিতার সূত্রে। আর এক খ্যাতি তাঁর প্রেমিক সত্তার। এই দুই প্রধান পরিচয় শুধু কবিতায় নয়, গানের নজরুলেরও। আরেকটা পরিচয় রয়েছে তাঁর ধার্মিকসত্তার। এইখানেই প্রধানত তাঁকে খণ্ডিত করা হয়ে থাকে। নজরুল একদিকে ইসলামি ভাবাদর্শের গান লিখেছেন অন্যদিকে লিখেছেন শ্যামাসংগীত। দুই ধরনের গানেই গভীর অনুভবলোক সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি। অথচ পাকিস্তানি আমলে রাষ্ট্রীয় মহলে চেষ্টা ছিল নজরুলের কেবল ইসলামি ভাবধারাকে প্রধান করে তুলতে। এটাই ছিল নজরুল সম্পর্কে সে-কালের পাকিস্তানবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে নজরুলকে নিয়ে চলেছে খানিকটা যথেচ্ছাচার। নজরুলের গানের বাণীকে বিকৃত করা হয়েছে; বিকৃত হয়েছে সুর! নজরুলের গানের রেকর্ড ভালো বিক্রি হয় বলে অন্যের গানকে চালিয়ে দেয়া হয়েছে নজরুলের বলে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে তাঁর রচনাবলির অভিভাবকত্ব ছিল বিশ্বভারতীর। নজরুল নিজেও ছিলেন উড়নচণ্ডী, তার ওপরে আকস্মিক তাঁর মূক হয়ে যাওয়ায় তাঁর রচনাবলি ঠিকমতো সংরক্ষিত হয় নি। পশ্চিমবঙ্গে নজরুলকে নিয়ে ব্যবসা হয়েছে বিস্তর, কিন্তু যথার্থ নজরুল চর্চা হয়েছে কম। অবশ্য পাকিস্তানি আমলে নজরুলপ্রেমীদের উদ্যোগে নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠা হলে নজরুল চর্চা গতি পেয়েছিল কিছুটা। বাংলা একাডেমীও কবি আবদুল কাদিরের সম্পাদনায় নজরুল রচনাবলি প্রকাশ করতে শুরু করলে নজরুল চর্চা বেগবান হয়ে উঠেছিল। শিশুসাহিত্যেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন নজরুল। বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর কয়েকটি রচনা প্রকাশিত হলেও ছোটদের রচনাসমগ্র প্রকাশিত হওয়া অনেক সাম্প্রতিক ঘটনা। সমগ্র বাংলাসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে নজরুলের শিশুসাহিত্য সংখ্যায় স্বল্প হলেও সৃষ্টিশীলতায় সমৃদ্ধ। চলচ্চিত্রের সঙ্গেও তাঁর যুক্ততা ছিল প্রধানত গায়ক-সুরকার-সংগীত পরিচালনাসূত্রে। বাংলাদেশের মুসলিম পরিবারে গান-বাজনা নিষিদ্ধ বলে বাংলার গোঁড়া মুসলমানরা গান-বাজনায় ছিল অনুৎসাহী, নাটকে-সিনেমায় অভিনয় করা তো ছিল আরও দুঃসাহসী কাজ। মুসলমান সমাজের মানুষ হয়ে সিনেমায় অভিনয় করার সাহস দেখিয়ে ইহজাগতিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। বাংলার মুসলমান সমাজ ধর্মীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিতে তাঁকে যেমন দেখেছে তেমনি তাঁর প্রতিভা ও অভিযাত্রী মানসিকতা দ্বারা হয়েছে উদ্বুদ্ধও। নজরুলের সাফল্য বাঙালি মুসলমানকে স্বপ্ন দেখিয়েছে নিজেদের সাহিত্যচর্চায় ব্যাপৃত হতে, এগিয়ে যেতে নানামুখী সৃষ্টিশীলতার দিকে। দীর্ঘকাল ধরে নজরুলের নাম অনুসারে বাংলার ঘরে ঘরে নবজাতকের নাম রাখা হয়েছে নজরুল ইসলাম। বাংলার মুসলমানদের স্বপ্নকে তিনি কতটা উজ্জীবিত করেছেন তার একটা দৃষ্টান্ত হিসাবে বিবেচনা করতে পারি এই ঘটনাকে।

ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমদ ছিলেন নজরুলের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। নজরুলের ওপর তাঁর গভীর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও নজরুল সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না। অথচ কমিউনিজমের প্রধান বিষয় সাম্যবাদের প্রতি সমর্থনের পরিচয় রয়েছে তাঁর কবিতায়। শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতির মধ্যেকার সাম্যবাদী চেতনাকেও নজরুল উদ্বুদ্ধ করেছিলেন গভীরতা ও তীব্রতার সঙ্গে। নজরুলের আগে সাম্যবাদী চেতনা বাংলাসাহিত্যে এতটা প্রবল হয়ে দেখা দেয় নি। ধার্মিক হয়েও ধর্মান্ধ না হওয়া, সাম্যবাদী হয়েও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হওয়ার মধ্যে তাঁর বিবেকিতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর ব্যক্তিত্বের মুক্তপ্রাণতাও উত্তরপ্রজন্মের মানুষের কাছে দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখা দিয়েছে। লেখক-বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীন, সত্যের প্রশ্নে তাদের বিচারশীল হওয়া উচিত- নজরুল-জীবনের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই পাওয়া যায় এই চেতনাও, যা বাঙালি সমাজকে এখনও উদ্বুদ্ধ করে। সাম্যবাদী চেতনারই আর এক মাত্রা নারীমুক্তির ভাবনা। 'নারী' কবিতার প্রসঙ্গে যে হথা আগেও বলছিলাম। এখানেও নজরুল সম্মুখভাগের মানুষ। কারণ নারীবাদ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আবির্ভাবের অনেক আগেই নজরুলের মধ্যে সত্যিকারের নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জাগরণ ঘটেছিল। নারীমুক্তির কথা বলতে গেলেই নজরুলের নারী কবিতার কাছে ফিরে যেতে হয়। সেই দিক থেকে এককথায় আমরা যদি বলি যে, নজরুল বাংলার নারীমুক্তিরও নকিব তাহলে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।

নজরুলের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে হলেও সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের মতো গুরুত্ব পান না। প্রাতিষ্ঠানিক নজরুল চর্চাও সেখানে নেই। নজরুল সেখানে ভারতবর্ষের একজন খ্যাতিমান কবিমাত্র। বাংলাদেশে নজরুল তারও চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। এই গুরুত্বের একটা কারণ হীনম্মন্যতা ও স্থবিরতায় আচ্ছন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির দিক থেকে মুসলিম-প্রধান এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শক ছিলেন নজরুল। পশ্চিমবঙ্গেও যে তাঁর প্রভাব একেবারে নেই তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশের সমাজের জন্য তাঁর প্রভাব যতটা সর্বব্যাপী ততটা নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান-কবিতার গভীর প্রভাবের কথা মনে করতে হয়। জাতীয়ভাবে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের মতোই উদযাপিত হয় তাঁর জন্মোৎসব। নজরুলের প্রভাব বাংলাদেশে গভীর ছিল বলেই বেসরকারী উদ্যোগে নজরুল চর্চার জন্য গড়ে উঠেছিল নজরুল একাডেমীর মতো সংগঠন। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের কাছে নজরুল আরও বেশি প্রাসঙ্গিক বলেই রাষ্ট্রীয়ভাবে নজরুলচর্চার প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউটের গড়ে ওঠা, বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়ে-ওঠা নজরুলচর্চাকে প্রাধান্য দিয়ে, গড়ে-ওঠা একাধিক নজরুল জাদুঘরের। এখানে নানা রাজনৈতিক অভিসন্ধির কথা হয়তো উঠতে পারে, নজরুলকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার যে হয় নি তাও নয়, কিন্তু যে-রকম ভাবে তাঁকে ব্যবহার করা হচ্ছে তার পুঁজি সাধারণ্যে নজরুল-প্রতিভার সার্বিক ব্যক্তিত্বের প্রভাব। সেই বিবেচনায় নজরুল-চর্চার প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগের সুফল যেমন আছে তেমনি এর কুফলের কথাও মনে রাখা উচিত। কারণ প্রাতিষ্ঠনিকতার আনুষ্ঠানিকতায় নজরুল-চর্চা প্রাণহীন হয়ে পড়তে পারে। প্রাতিষ্ঠানিকতার স্বভাবের এই দোষকে সবসময় যে অতিক্রম করা যায় তা নয়; সেইজন্য নজরুলের মতো মহৎ প্রতিভাকে খুঁজে দেখতে হবে যথার্থ মুক্তপ্রাণ মানুষের বিচারশীলতা ও আবিষ্কারের মধ্যে। লক্ষ করলে দেখব যে, সেই ধরনের মানুষ সাধারণত দূরে থাকতে চায় প্রতিষ্ঠানের প্রভাব থেকে। যথার্থ মুক্তপ্রাণ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিকতার ভেতরে থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকতা তাঁদের গ্রাস করতে পারে না। নজরুল নিজে ছিলেন এই রকম একজন মুক্তপ্রাণ মানুষের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।