প্রসঙ্গ রোহিঙ্গা ও রিফিউজি ক্যাম্প

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম
Published : 12 Sept 2017, 03:03 PM
Updated : 12 Sept 2017, 03:03 PM

প্রায় সাত বছর আগের কথা। ২০১০ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজারের উখিয়াতে একটি রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্প পরিদর্শনের সুযোগ ঘটেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের প্রফেশনাল মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনফপিএ)এর সহযোগিতায় এক শিক্ষা সফরে কক্সবাজারের চকরিয়ায় আইসিডিডিআরবি এবং সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা-সংক্রান্ত মাঠ-পর্যায়ের কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলাম। সে কার্যক্রমের পাশাপাশি, একদিন উখিয়ায় আমাদের দলটির ওই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়া হয়। সেখানে মূলত শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, প্রজননস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য বিষয়াদি সম্পর্কে জানা ছিল লক্ষ্য।

জনসংখ্যা পাঠে মাইগ্রেশন বা স্থানান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ ডেমোগ্রাফিক প্রক্রিয়া হলেও, মাইগ্রেন্ট ও রিফিউজি যে এক জিনিস নয় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের মাধ্যমে আমাদের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা সেদিন মাঠ-পর্যায়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। সেই সঙ্গে তারা দেখতে পেয়েছিল শরণার্থী ক্যাম্পবাসীদের জীবনধারা, তাদের সমস্যা ও ক্যাম্পজীবনের বাস্তব চিত্র। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ওই সফরে না গেলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনপ্রবাহ আমার পক্ষেও স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হত না।

পরে, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ও ২০১৬এর মার্চে অবশ্য আমি আরও দুবার কক্সবাজার যাই বিভাগীয় গবেষণাকাজে। তখন আবারও জানতে পারি রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে, যদিও আমার গবেষণার বিষয় তাদের নিয়ে ছিল না– ছিল বাংলাদেশে শিশু-বিবাহের প্রেক্ষাপট ও তার প্রভাব নিয়ে। আমার বিভাগের ওই গবেষণা দলের সদস্য হিসেবেই কক্সবাজার সদর ঊপজেলা ও টেকনাফে গিয়েছিলাম। গ্রাম ও শহর দুধরনের এলাকাতে ছিল আমার বিচরণ।

মনে আছে একদিন এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের একান্ত সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম শিশু-বিবাহ ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে। হঠাৎ তার অফিসে এসে হাজির হন এক বৃদ্ধা রোহিঙ্গা। তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে অনবরত কাঁদছিলেন। কয়েকদিন আগেই নাকি তিনি মিয়ানমার বাহিনীর আক্রমণে হারিয়েছেন স্বামীসহ দুসন্তান। জীবন বাঁচানোর তাগিদে ভাগ্যপরিক্রমায় তিনি এখন বাংলাদেশে। আশ্রয় ও সহযোগিতা খুঁজছেন। অর্থ নেই তার হাতে।

তার চেহারার দিকে তাকালাম। বিষাদ, ক্লান্তি আর কষ্টের ছাপ সে মুখে। চেয়ারম্যানকে দেখলাম তড়িঘড়ি পাঞ্জাবির পকেট থেকে ২০ কী ৩০ টাকার মতো কিছু অর্থ দিয়ে তাকে দ্রুত বিদায় করে দিলেন। চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎকার তখন ছিল প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাই রোহিঙ্গা নারীটিকে একটু অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলাম।

আমার কথা তিনি বুঝতে পরেছিলেন কি না জানি না। তবে তিনি চলে গেলে উপস্থিত স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ এভাবে এসে সাহায্য চান। এটি বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয় যে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের রয়েছে সরব উপস্থিতি। ইদানিং ওরা বিভিন্ন বাসাবাড়িতেও কাজ নিচ্ছে। তাদের সস্তা শ্রমের জন্য স্থানীয় এলাকায় রয়েছে তাদের বেশ চাহিদা। একদিকে মানবিকতা আরেকদিকে সস্তাশ্রমের চাহিদা– এ দুয়ে মিলে রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সে সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সঙ্গেও।

লেখার শুরুতেই ২০১০ সালে কক্সবাজারে রিফিউজি ক্যাম্প পরিদর্শনের কথা বলছিলাম। একদিনের ওই পরিদর্শনে আমার মনে হয়েছে, সে সময় বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় জনগণ রোহিঙ্গাদের প্রতি ছিল বেশ মানবিক ও আন্তরিক। সম্পদের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও তখন ক্যাম্পে দেখতে পেয়েছি সরকারের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এবং ইউএনএইচসিআর ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসমূহের সহযোগিতায় বিভিন্ন ধরনের সেবা-কার্যক্রম। বিশেষ করে বেসরকারি অলাভজনক সংস্থার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি নজরে পড়েছে। লক্ষ্য করেছি, রোহিঙ্গাদের জন্য ছিল কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও।

ক্যাম্পটি পরিদর্শনকালে আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল শিশু-কিশোরদের বিষয়ে। সে জন্য ক্যাম্পে পরিচালিত একটি স্কুলে গিয়েছিলাম। দেখলাম মায়াবী চেহারার রোহিঙ্গা শিশুরা পড়াশুনা করছে। এদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এ শিশু-কিশোররাই তো রোহিঙ্গাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। এরা কীভাবে পাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা? এরা কি ফিরে যেতে পারবে তাদের দেশে, সসম্মানে? কত সময় পর ঘটবে সেটা? ওই শিশুদের সুশিক্ষার পাশাপাশি ওদের সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টির কথাও ভাবছিলাম। ক্লাসশেষে শিশুদের সঙ্গে ছবি তুললাম। মনে হল, অতটুকুন বয়সেও তাদের চোখে বেঁচে থাকার স্বপ্ন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সংশয়।

ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা ও বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে এমন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে পারলাম, ক্যাম্পে শুধু থাকে নিবন্ধিত রোহিঙ্গারা। এর বাইরেও অনেক রোহিঙ্গা রয়েছে যারা পরিসংখ্যান বা হিসাবের বাইরে। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে রয়েছে আনুমানিক তিন থেকে পাঁচ লক্ষ রোহিঙ্গা। ইউএনএইচসিআরএর ২০১৭এর মার্চের তথ্যানুযায়ী, ২ লক্ষ ৩৩ হাজার ২শ ২৮ জন নাকি পপুলেশন অব কনসার্ন। অতিসম্প্রতি ইউএনএইচসিআর বলছে, প্রায় এক লক্ষ নতুন শরণার্থী এ মাসেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।

মনে পড়ল, অফিসিয়াল হিসাবে রোহিঙ্গাদের যে সংখ্যার কথা ২০১০ সালের পরিদর্শনে আমাদের বলা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি রোহিঙ্গা আনঅফিসিয়ালি তখনই সেখানে ছিল। ক্যাম্পের বাইরে যাবার ক্ষেত্রে ক্যাম্পবাসীদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মূলত সাইনবোর্ডসর্বস্ব বলেই মনে হয়েছিল। তারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ক্যাম্পের বাইরে যাতায়াত করত। এমনকি স্থানীয় সরকারের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও তাদের যোগসূত্রতা ছিল। ফলে ওরা স্থানীয় নির্বাচনেও ভোট দিয়েছে বলে জেনেছি। কখনও কখনও বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করে ফেলত তারা। বাংলাদেশিদের সঙ্গে বিয়ের মতো সামাজিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ত ওরা।

বিষয়গুলো জেনে ও এর ভবিষ্যৎ প্রভাব কী হতে পারে তা নিয়ে চিন্তিত না হবার কোনো কারণ নেই। ইউএনএইচসিআরএর ওয়েবসাইটে দেখতে পেলাম, বাংলাদেশে বিশাল এ শরণার্থী গোষ্ঠীর জন্য দরকার প্রতি বছর ১৩.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, অথচ সংস্থান হয়েছে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩১ শতাংশের। অবশিষ্ট অর্থ কোথা থেকে আসবে? মুসলিম দেশগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায় কতটুকুই-বা এগিয়ে এসেছে এ নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

যেহেতু জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান ও গবেষণার সঙ্গে জড়িত রয়েছি– আমার বিবেচনায়– সরকার, ইউএনএইচসিআর ও বেসরকারি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসমূহের উচিৎ হবে ক্যাম্পে ও ক্যাম্পের বাইরে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে শনাক্ত করে তাদের বয়স-কাঠামো বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা করা। উখিয়ার কুতুপালংএর ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় দেখেছি, ক্যাম্পের প্রায় ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ছিল যুবা বা কিশোর-কিশোরী, যাদের দরকার প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা। ক্যাম্পের প্রজননক্ষম নারীদের প্রজননহার, মাতৃমৃত্যু হার, শিশুমৃত্যু হার পরিমাপ ও বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী সেবা প্রদানের মাধ্যমে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়ন জরুরি।। আরও দরকার শিশুদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

একই সঙ্গে রোহিঙ্গারা যাতে স্থানীয় বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশে না যায় কিংবা কোনো অপরাধ-কার্যক্রমে জড়িয়ে না পড়ে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সবশেষে, মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে সসন্মানে ফেরত পাঠাতে প্রয়োজন ব্যাপক আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। এ ব্যাপারে সরকারকে হতে হবে আরও সক্রিয় ও আন্তরিক।