অমর শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহ

মুহাম্মদ শামসুল হক
Published : 21 May 2013, 03:25 PM
Updated : 15 April 2012, 11:54 AM

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অনেক মহৎ, দানবীর, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বা আশ্রয়দাতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ধ্বংস করেছে প্রতিবাদী মানুষের আশ্রয়স্থল ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কিংবদন্তি হয়ে আছেন চট্টগ্রামের রাইজানের সমাজসেবক শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহকে হত্যা ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত কুণ্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স ধ্বংসের কাহিনী।

নূতনচন্দ্র সিংহের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো ১৩ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে তাঁর রাউজানের নিজ বাড়ির সামনে প্রার্থনারত অবস্থায় হত্যা করে। স্বাধীনতার পর ফজলুল কাদের চৌধুরীকে এক নম্বর ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দুই নম্বর আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হলেও পঁচাত্তর পরবর্তী সরকার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়।

১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর রাউজানের গুজরা গ্রামে মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম। মাত্র আড়াই বছর বয়সে মা এবং আট বছর বয়সে পিতৃহারা হন তিনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই, কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে মানুষ হন তিনি। এক পর্যায়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন। কিন্তু এই অর্থবিত্ত ভোগবিলাসে খরচ না করে তিনি জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়োগ করেন। গড়ে তোলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কুন্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির, কুন্ডেশ্বরী মহাবিদ্যালয় এলাকায় নারী শিক্ষার প্রসারে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। এলাকায় অসহায় মানুষের অভাব অনটনে তাঁর সাহায্যের হাত ছিল সব সময় খোলা।

স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-বুদ্ধিজীবিদের আশ্রয় ও পরামর্শস্থল ছিল নূতনচন্দ্রের কুন্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স। তৎকালীন রাজনীতিক আবদুল্লাহ আল হারুন, আবদুল্লাহ আল নোমান, আবদুল ওয়াহাবসহ অনেকেরই যাতায়াত ছিল সেখানে। পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে আসা ইপিআর (পরে ইবিআর) সদস্যদের খাদ্য সরবরাহ ও যুদ্ধ প্রস্তুতিতে তাঁদের নানাভাবে সহযোগিতা দেন নূতনচন্দ্রের ছেলে প্রয়াত সত্যরঞ্জন সিংহ এবং প্রফুল্লরঞ্জন সিংহ। এই বাড়িতে বসেই ডা. আবু জাফর, ড. এম এ আর মল্লিক (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য), অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল ওয়াহাবসহ সংশ্লিষ্ট সহযোগীরা মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতি এবং কলাকৌশল নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নিতেন। পাক সেনারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছলে ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তাদের ২৮টি পরিবারের সদস্যরা কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দিরের বিভিন্ন কক্ষে আশ্রয় নেন এবং ৭ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন, ড. আনিসুজ্জামান, ড. মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক ফজলী হোসেন, ড. রশিদুল হক, ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী প্রমুখ। এ ছাড়াও এসেছিলেন মাহবুব তালুকদার, এমএ হান্নান, ক্যাপ্টেন অলি আহমদসহ অনেকে। এসব কারণে কুণ্ডেশ্বরী কমপ্লেক্সকে ধংসের পরিকল্পনা করে মুসলিম লীগপন্থী বিশেষ করে ফজলুল কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা। দালালরা প্রচার চালায়, কুণ্ডেশ্বরীতে ভারতীয় সেনা ও অস্ত্র সমাবেশ হয়েছে এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কুণ্ডেশ্বরী ভবন নিরাপদ নয় জানতে পেরে শিক্ষক পরিবার ও অন্যরা ১০ এপ্রিলের মধ্যে একে একে চলে যান সেখান থেকে।

আবদুল্লাহ আল হারুন, আবদুল্লাহ আল নোমান, ড. আনিসুজ্জামান, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ এলাকা ত্যাগ করার জন্য নূতনবাবুকে নানাভাবে অনুরোধ জানান। কিন্তু তাঁর জবাব ছিল,'আমি তো কারো ক্ষতি করিনি। জীবনে আমি অনেক কষ্ট করেছি। এই শেষ বয়সে নিজের দেশ, মাটি আর আরাধ্য দেবী কুণ্ডেশ্বরীকে ফেলে কোথাও যাব না। যদি মরতে হয় এখানেই মরব। এখানে যদি মৃত্যু হয়, তাহলে জানব এটাই মায়ের ইচ্ছা।'

১৩ এপ্রিল সকাল প্রায় সাড়ে ১০টা। কুণ্ডেশ্বরী মাতৃমন্দিরের সামনে প্রার্থনায় বসেছিলেন নূতন সিংহ। এ অবস্থায় চিহ্নিত দালাল-রাজাকারের একটি দল এসে গুলিতে নির্মমভাবে হত্যা করে। ধংস করে কুণ্ডেশ্বরী ভবন-সংলগ্ন ওষুধ কারখানা ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো। পরে স্থানীয় ও আশপাশের রাজাকার ও তাদের সহযোগীরা লুট করে নিয়ে যায় সব অস্থাবর সম্পদ।
জানা যায়, একইদিন আশপাশের অন্তত ৪৩ জন নারী পুরুষকেও হত্যা করা হয়।

চোখে না দেখলে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেওয়া কঠিন। কুণ্ডেশ্বরীর বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নূতনচন্দ্র সিংহের ছেলে প্রফুল্লরঞ্জন সিংহের ভাষায় (এ লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকার) 'সেসব অমানুষিক ঘটনা এখন বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়, এলাকার তদানীন্তন চেয়ারম্যান আমানত খানসহ আরও অনেকের কাছে ঘটনা শুনে আমি অনেকটা নির্বাক হয়ে যাই। বাড়ি ফিরে এসে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংসের চিহ্ন দেখেছি। কারখানা, বাড়িঘর, কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির, মহাবিদ্যালয় সবকিছুই ছাইভস্ম করা হয়েছে। কারখানা লুটের পর অবশিষ্ট কাঁচামাল গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ির সব আসবাবপত্র ছাড়াও কারখানা এবং স্কুল-কলেজের সমস্ত সম্পদ লুট করে গহিরা, সর্তা সুলতানপুর, চিকদারইসহ অনেক বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হয়। এমনকি ধানের গোলাশুদ্ধ তুলে নেওয়া হয়। স্বাধীনতার পরে সরকারের নির্দেশে লুটের মাল ফেরত দেওয়া শুরু হলে কিছু কিছু জিনিস ফেরত পাওয়া গেলেও সেগুলো অক্ষত ছিল না।'

প্রফুল্ল সিংহ বলেন, 'বাবাকে মন্দিরের সামনেই হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর এসে দেখি, বাবার মৃত্যুস্থলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত একটি গোল চক্রাকার সাদা দাগ এবং মাটিতে বড় গর্ত। বাড়ির ভেতর থেকে এক এক ধরণের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল দিনরাত, সে আওয়াজ ছিল অত্যন্ত মর্মস্পর্শী।'

প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ জানান, দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে নূতনচন্দ্র সিংহের হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে রাউজান থানায় মামলা দায়ের করেন প্রয়াতের দ্বিতীয় ছেলে সত্যরঞ্জন সিংহ। মামলা নম্বর-৪১ (১) ২৯/১/৭২ ধারা ৩০২/১২০ (বি) ২৯৮ বিপিসি। মামলার আসামি ছিলেন ১. এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরী, ২. সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ৩. আবদুল মাবুদ (সুলতানপুর), ৪. গোলাম আলী (সুলতানপুর), ৫. নোয়াব মিয়া (গহিরা), ৬. আবদুল আহমদ, ৭ মোহাম্মদ বক্স, ৮. ফজল হক, ৯. আবুল কাশেম, ১০. আবদুস সালাম এবং আরো কয়েকজন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের নিম্ন আদালতে সাক্ষী ও আসামিদের জবানবন্দির পর মামলা উচ্চআদালতে যায় বিচারের জন্য। কিন্তু উচ্চআদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়ে গেলে পরবর্তী সরকার রাজাকারদের বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে তালিকাভুক্ত সাক্ষীরা একে একে মারা যান। দুই নম্বর আসামি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সা কা চৌধুরী) বনে যান মন্ত্রী-সাংসদ।

আশার কথা সম্প্রতি সাকা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের নতুন করে তদন্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ধরণের অপরাধীদের যথার্থ বিচার ও শাস্তির মাধ্যমেই শহীদদের আত্মত্যাগের মূল্যায়ন হতে পারে।

মুহাম্মদ শামসুল হক : লেখক, সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী।