ও শ্যাম, রেঙ্গুম ন যাইও

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 11 Sept 2017, 02:53 PM
Updated : 11 Sept 2017, 02:53 PM

প্রতিবেশি দেশ শুধু ভারত নয়– আমাদের তিনপাশে ভারত আর সাগর বলে আমরা আরেক পাশটা ভুলে যাই। ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু বলে আমাকে ভারতের দালাল নামে সম্বোধন করা দেশপ্রেমীদের কাছে একটা প্রশ্ন রাখি, আমাদের আরেক পাশে যে দেশ, যার নাম বার্মা, বার্মা থেকে মিয়ানমার, তার বেলায় আপনারা এমন চুপ থাকেন কেন?

জন্মেছি চট্টগ্রামে। আমাদের জীবন ও জীবনপ্রবাহে তখনকার বার্মার নাম ও নানা বিষয় ছিল অনিবার্য। বাংলাদেশের আর কোনো এলাকায় বার্মা যাওয়া নিয়ে গান আছে বলে শুনিনি। অথচ বিখ্যাত গায়িকা শেফালী ঘোষের সুবিখ্যাত গান, "ও শ্যাম, রেঙ্গুম ন যাইও" এখনও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। রেঙ্গুম মানে রেঙ্গুন। তখন বার্মা সোনার জন্য প্রসিদ্ধ। তার খ্যাতি ছিল কাঠগাছ বনজ সম্পদের কারণে। উপার্জনপ্রত্যাশী বাঙালি সেখানে যেত। কেউ কেউ আর ফিরে আসত না। বলা হত, বার্মিজ মহিলাদের আকর্ষণ আর প্রেম নাকি দুর্নিবার। সে আকর্ষণে বিয়ে করে ফেলা মানুষ তাদের প্রেমিকা বা বৌকে ভুলে থাকত বলেই এই গানের এমন কথা।

ছেলেবেলায় ছড়া শুনতাম:

এক্কানা মনার গুরগুরি ঠ্যাং
কেন মনা রেঙ্গুন গেল
হাতের বাঁশী ফেলাই গেল
মা বাপেরে কাঁন্দাই গেল।

যার মানে ছোট্ট ময়না ছোট ছোট পায়ে দূরের রেঙ্গুনে গিয়ে আর আসে না। সেই রেঙ্গুনের মানুষ থাকত আমাদের শহরে। আমাদের মাসীমা নামে পরিচিত সাদা পোশাকের এক মহিলাকে দেখলেই আমরা পালাতাম। তিনি আমাদের বার্মিজ মাসী। বিয়ে করে বাংলাদেশে চট্টগ্রামে থেকে গিয়েছিলেন। পালাতাম এই কারণে যে, তিনি হাতে যে ব্যাগটি নিয়ে আসতেন তার ভেতর থাকত টিকা আর ইনেজকশন। সেই সুমুধুর দিনগুলো যেমন অতীত, তেমনি মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও আজ জটিল।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখন আর রাখঢাকের জায়গা নেই। একটি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মুলের চক্রান্ত যেমন অসহনীয় তেমনি আপন জান বাঁচানোও ফরজ। আজ যা লিখব তাতে কথিত সমঝোতা বা মিনমিন করার সুযোগ নেই। গোড়াতেই বলি, বাংলাদেশের যে কোনো এলাকার মানুষের চাইতে আমরাই এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতম। চট্টগ্রামের লাগোয়া অঞ্চলে বসবাসকারী এই রাখাইন বা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘকালের। আপনি যদি কক্সবাজার যান নিশ্চয়ই জানবেন সেখানকার সান্ধ্য বাজারের দোকানগুলোর বেশিরভাগ চালায় এদের চেহারার মানুষেরা। কর্মঠ মহিলারা সন্ধ্যার পর কাজ করে। পুরুষরা বাড়িতে বাচ্চা রাখে কিংবা ঘুরে বেড়ায়। এই মানুষেরা আমাদের।

কিন্তু আজ যারা দলে দলে ঢুকছে তাদেরকে আপন করার নামে যে ষড়যন্ত্র আর রাজনীতি সেটা আমাদের নয়। আগেই বলেছি, আমরা শেফালী ঘোষের গান শুনে বড় হওয়া মানুষ, যেখানে "ও শ্যাম, রেঙ্গুম ন যাইও" বলে আর্তি করা হয়েছে। এখন পরিবর্তিত বিশ্বে রাজনীতি সব পাল্টে দিয়েছে। এখন 'রেঙ্গুমের শ্যামরা' দলে দলে ভিড় করছেন এদেশে–প্রাণ বাঁচাতে– অপরাজনীতি আর জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে।

সিডনিতেও প্রচুর রোহিঙ্গা রয়েছেন। এরা নৌপথে পালিয়ে আসা মানুষ। এদের মুষ্টিমেয় কজন ছাড়া বাকিরা না কোনো কাজে আগ্রহী, না তাদের রয়েছে কোনো স্কিল। এখানকার ক্যামপ্সী এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে এদের যে ঝগড়া ও মারমুখী মনোভাব দেখেছি তা দেখলে আপনার এই ভাব বা আবেগ উধাও হয়ে যাবে। বলে রাখি, আমাকে শরণার্থীবিরোধী ভাবলে ভুল করবেন। একটি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মুল করার বিষয়টি আমি কখনও সমর্খন করতে পারি না। তাদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে আমরা। কিন্তু যারা করছে তাদের সঙ্গে লড়াই করার মতো বা তাদের সঙ্গে ঝগড়ায় যাবার মতো জায়গায় নেই বাংলাদেশ।

আপনি বিশ্বরাজনীতি মানবেন না, বৈশ্বিক অবস্থান বুঝবেন না, খালি ধর্মের জিকির তুলে আবেগে বুক ভাসাবেন তাতে কী লাভ হবে? রোহিঙ্গাদের কী সমস্যা বা কেন তারা আজ নির্যাতিত সে আলোচনায় যাব না। কিন্তু কোনো দেশের অভ্যন্তরীন সমস্যা যদি আমাদের বুকে এসে লাগে রুখে দাঁড়ানোর বিকল্প কোথায়?

প্রয়াত জিয়ার আমলে প্রথমে সমস্যাটি শুরু হলেও তখনকার প্রশাসন সেদিকে নজর দেয়নি। মিনি পাকিস্তান বানানোর স্বপ্নে বিভোর নেতারা এসব নিয়ে ভাবতেন না। এরপর এরশাদের সেনাশাসনে ইচ্ছেমতো ঢুকে পড়া রোহিঙ্গারা তাদের সেইফ হেভেন বানায় আমাদের দেশকে। তখন আমি সে এলাকায় কাজ করতাম। নিজে দেখেছি টেকনাফ থেকে রামু অব্দি বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা ক্যাম্প আর শরণার্থী-বসতি। কালক্রমে সেগুলো হয়ে ওঠে মাদক আর অস্ত্রের আখড়া। যারা জানেন তারা বিশ্বাস করেন রামুর সহিংসতায় এদের জড়িত থাকার কথা। শ শ বছর ধরে একসঙ্গে বসবাসরত বাংলাদেশি মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে যে ঘটনা ঘটেনি, এরা তাই করে দুনিয়ার কাছে আমাদের কলঙ্কিত করে ফেলেছিল। সেই দাগ মোছার আগেই আবার শুরু হয়েছে শরণার্থীর স্রোত। এখন আমরা কী করব?

বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন আর আগের ভূমিকায় নেই। তার উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা বহু দেশের জন্য উদাহরণ। তার গায়ে লেগেছে নতুন হাওয়া। এই বদলে যাওয়া দেশের চেহারা প্রতিবেশিদের ভালো লাগার কথা নয়। ভারতের নেতারা স্বাভাবিকভাবেই নিজের সমস্যা ও স্বার্থের বাইরে পা ফেলবেন না। ঘটনা শুরুর পরপরই নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারে ছুটে গিয়েছেন। দেখলাম, টুইট বার্তায় সেখানকার বাগান নামের শহরে আনন্দিত চেহারার ছবি দিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানও নাকি বসবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে। আমেরিকা বরাবর দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে। একদিকে বাংলাদেশের পিঠ চাপড়ে বলছে, ভালো কাজ করছে– অন্যদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে তার অস্ত্র-ব্যবসা আর মদদও চলছে সমানতালে। চীন মিয়ানমারকে ঘাঁটাবে না। তাহলে বাকি থাকল কে?

এই পরিবেশে আপনি বা আপনারা যারা বাংলাদেশের সরকারকে ভয়াবহ বাস্তবতায় ঠেলে দিতে উস্কানি দিচ্ছেন তাদের মনে কি আসলে দেশপ্রেম আছে? সব জায়গায় খালি ধর্ম। আরবে ইয়েমেনে মুসলমানরা মুসলমানদের মারছে– একেকটি আরব দেশ আরেকটি দেশের জন্য টাইম বোমা যেন। তখন আপনারা কিছু বলেন না কেন?

এখন নিরীহ বাংলাদেশের ঘাড়ে দায় পড়েছে রোহিঙ্গাদের ভেতরে এনে জামাই-আদরে আপ্যায়ন করার। পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে সরকারকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয় যে, রোহিঙ্গাদের বিয়ে করা যাবে না। বিয়ের জন্য বা তাদের বিয়ে করে যারা দেশে রাখতে ঈমানি দায়িত্ব পালন করছে তারা কি নিজেদের মেয়ে বা বোনকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বিয়ে দেবেন? এসব ফালতু বিকৃতির মানে নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাই সামলান সব। তাঁর সরকারের ওপর মানুষের যেটুকু বিশ্বাস বা আস্থা সেটা তাঁর কারণে অটুট। তাঁকে এই কঠিন সমস্যা মোকাবেলায় সময় দিতে হবে। এখন এটি শাঁখের করাত। রোহিঙ্গাদের ঢোকা বন্ধ করলে বা আশ্রয় না দিলে আম-ভোটাররা বিএনপি ও জামায়াতের মদদে আরও বিগড়ে যাবে। আরেক দিকে এদের স্থায়ীভাবে ঢুকতে দেওয়া একদিকে যেমন অবৈধ, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও প্রগতির পথে দেশের এগিয়ে চলার পথে আত্মহত্যার সামিল।

যারা চাটগাঁর লোক তারা খুব ভালো জানেন এদের পথভ্রষ্ট কিশোর-তরুণেরা মাদকে নিমজ্জিত। মাদক ও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত এরা। আওয়ামী লীগের বহু নামকরা নেতা বা তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা এই ব্যবসায় রোহিঙ্গারা যুক্ত বলে এদের ঢুকতে দিতে ও এদের নিয়ে নোংরা রাজনীতি করতে আগ্রহী। টেকনাফের সেই বিখ্যাত ইয়াবা বদি এখন কোথায়?

আন্তর্জাতিক রাজনীতি, দেশজ রাজনীতি ও উন্নয়ন কোনোটাই আসলে আমাদের এই ঢালাও আশ্রয়দান সমর্থন করে না। সব কিছুর ওপরে পরিণাম বা ফলাফল। এদের পরিণাম কী? মিয়নমারকে যারা চেনেন তারা জানেন রোহিঙ্গারা সেখানে ফেরত যেতে পারবে না। তাই যদি হয়, এদের ভরনপোষণ ও চাকরি দেবে কে? যারা আবেগে এদের জন্য মিছিল করে স্লেঅগান দিচ্ছেন 'ইসলামি সমাজ চাই', তাদের কাছে এর উত্তর আছে?

পরিস্থিতি আসলে এটাই যে, বাংলাদেশের ওপর এক অমানবিক সমস্যা ও দুর্গতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা রোহিঙ্গাদের সম্প্রদায়গত পরিচয়ে আকুল হচ্ছেন তাদের বলি, একাত্তরে আমি নিজে কলকাতায় শরণার্থী-বিরোধী মিছিল দেখেছি। যতদিন তারা জেনেছিল আমরা ফিরে যাব, আমাদের ভয়ের চোখে দেখত তারা। আমরা এমন কি মহান আর উদার হলাম যে সব দায় আমাদেরই নিতে হবে?

রোহিঙ্গা সমস্যা যদি এই এলাকায় আরেকটি কাশ্মীর বা ফিলিস্তান সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে তাতে বাংলাদেশের সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। আজ আওয়ামী লীগ– কাল যে-ই আসুক সরকারে– তাদের কাছে এই সমস্যা হবে বিষফোঁড়া। আপাতত তাদের জান বাঁচাতে তাদের আশ্রয় দেওয়ার কাজটি করতে হবে। কিন্তু সঙ্গে জানা চাই এর পরিণামের কথা। আন্তর্জাতিক ও মানবিক সব সংগঠন, সংস্থা আর জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে যাবার পাশাপাশি বাংলাদেশকে এখন শক্ত হতেই হবে। আসলে দেশ ও জনগণের উচিৎ আগে নিজেদের ভবিষ্যত ও আগামী দিন নিরাপদ রাখা। মানবিকতার প্রশ্নে কারও মায়াকান্না, কারও বিরোধিতা বা কারও সমর্থনে কিছুই আসে যায় না। সমস্যা যার ঘাড়ে সেই জানে এই বোঝা কত কঠিন।

বাংলাদেশ, তুমি মানবিক হবার পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে কঠোর হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।