ইলিয়া এরেনবুর্গের সাহিত্য বিচার

জাহেদ সরওয়ার
Published : 16 May 2013, 09:10 AM
Updated : 16 May 2013, 09:10 AM

দি রাইটার এন্ড হিজ ক্র্যাফট নামের লেখাটি ছাপা হয় ভারত- সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির মুখপত্র 'ইসকাস'র প্রথম সংখ্যায় ১৯৫৪ সালে। পরে একই নামে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। এরেনবুর্গ সোভিয়েত রাশিয়ার নামজাদা লেখক। এই লেখাটি বিশেষ করে লেখকদের জন্য এমন এক গুরত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত লেখা, যেখানে লেখক নিজের সাথেই তর্কে জড়িয়ে পড়বেন। লেখক কেন লেখেন, সমাজের সাথে লেখকের সম্পর্ক কী, লেখক ফরমায়েশি লেখা লিখতে পারেন কিনা, অধ্যয়ণ, অভিজ্ঞতা ও আবেগ লেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিনা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন বেশ কয়েকটি শিরোনামে। 'অনিশ্চয়তা' 'পুস্তক সমালোচনা কিভাবে করা হয়' 'সমাজ বদলাচ্ছে' 'লেখক ফরমায়েশী লেখা লিখতে পারেন কিনা' 'প্রগতিশীল সাহিত্য কি উদ্দেশ্যমূলক?' 'হৃদয়াবেগ ছাড়া কখনো শিল্প হয় না' 'অধ্যয়ণ একটি সৃজন-প্রক্রিয়া' 'চরিত্র হচ্ছে নানা জিনিসের সংমিশ্রণ' 'অভিজ্ঞতা ও আবেগ' 'জ্ঞানার্জনের অর্থ নকল করা নয়' ' রোমান্টিকতা বলতে কী বোঝায়?' ইত্যাদি বিষয়ে তিনি তুলে আনেন লেখক সত্ত্বাকেই।

বইটির বিভিন্ন উদ্বৃতি থেকে ধারণা করা যায় তিনি মূলত উপন্যাস ও গল্পকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
বইটির শুরুতেই দেখা যায় এরেনবুর্গ আসলে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। যে প্রশ্নটা তাকে করেছিল লেলিনগ্রাদের এক যুবক ইঞ্জিনিয়ার। প্রশ্নকারী তার চিঠিতে একটা মারাত্মক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন 'আমাদের বাস্তব জীবনের তুলনায় আমাদের উপন্যাসগুলো অনেক দুর্বল এবং ম্লান, এ সত্যটাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? আমরা সম্প্রতি এ প্রশ্নটা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। বর্তমান সোভিয়েত সমাজের সঙ্গে জার আমলের রাশিয়ার কোন তুলনাই হয় না। অথচ সে সময়ে অনেক মহৎ গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এটা মানছি যে সম্প্রতি এমন কিছু বই লেখা হয়েছে, যেগুলো আপনি সাগ্রহে পড়ে থাকেন। কিন্তু এমন অসংখ্য বই আছে, সেগুলো কেন লেখা হল! এই বিশ্ময়কর প্রশ্নটাই তখন আপনার মনে উদয় হবে। সবকিছুই যথাযত হয়েছে, তবু কি যেন নেই বইগুলোতে। সেগুলো আপনাকে ধরে রাখতে পারেনা। পারে না আপনার হৃদয়ের গভীরে অনুপ্রবেশ করতে; সে সব উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবজগতের মানুষের কোন মিল নেই।'

পাঠক সমাজের এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বলা যায় এরেনবুর্গ এই বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন। মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বের ভিত্তিতে কথা বললেও এরেনবুর্গ এমন কিছু স্বাধীন মত এখানে প্রয়োগ করেন যা খানিকটা পরস্পরবিরোধীও। যুবক ইঞ্জিনিয়ারের প্রশ্নটা শুধু যে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে প্রযোজ্য তা না। এটা বই সম্পর্কে একটা চিরকালীন নৈতিক প্রশ্নও বটে। আমাদের দেশেও প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির বইমেলার আগে টনটন কাগজে ছেপে হাজার হাজার বই বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রকাশিত হয়। ফেব্রুয়ারি জুড়ে এসব বইয়ের বিজ্ঞাপনও দেখা যায় পত্রিকাগুলোতে কিন্তু একমাস পরেই হয়ত আর কেউ একটা বইয়ের নামও নেয়না। সেই তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে এই প্রশ্ন সহজেই করা যায় যে তাহলে এই সব বই প্রকাশের পিছনে কী উদ্দেশ্য কাজ করে। কেনই বা লেখা হয়।

অনিশ্চয়তা পর্বে এরেনবুর্গ বলেন 'প্রত্যেক সমাজেরই শিল্পসুষমায় বিকশিত হয়ে ওঠার একটা নিজস্ব পর্যায় থাকে। থাকে জয়োল্লাসের ঐকতানে ছন্দিত হয়ে ওঠার কাল। থাকে অনবদ্য কালজয়ী সৃষ্টিসুধার প্রাচুর্যের কাল। সমাজের এরকম একটি কালকেই বলা হয় উৎকর্ষতার চুড়ান্ত পর্যায়। সোভিয়েত সমাজ এখন তার উন্নয়নের প্রত্যুষপর্বে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাসের পটভূমিতে কয়েকটি যুগ আর কিছুই নয়, কয়েকটি ঘণ্টা যেন। আমাদের লেখকরা বর্তমানে ঠিক স্কাউটের মত। সে কারণেই একজন পুশকিন বা একজন তলস্তয় এখনো আমরা পেতে সক্ষম হইনি। কিন্তু আমরা পাবই। চুড়ান্ত লগ্ন এখনো আমাদের সম্মুখে রয়েছে।'

কিন্তু পাঠকমাত্রেই জানেন আসলে সেই চুড়ান্ত লগ্ন আসে নাই আর। মানুষের প্রকাশভঙ্গি ব্যক্তিস্বাধীনতার মতই নৈর্ব্যক্তিক। একটি ফুল যেমন প্রকাশিত হয় নিজস্ব নিয়মে, স্বাধীনতায়; তাকে কোনো খাদে ফেলে প্রকাশ করা যায় না। এটা গাছের সামাজিক জীবনের ফল। সাহিত্যও তেমনি একেকটা সামাজিক বিকাশের ফসল। যে সমাজ নিয়ন্ত্রিত–তা সে সমাজতান্ত্রিক পুঁজিতান্ত্রিক যাই হোক না কেন– সেখানে কোনো মহৎ শিল্প হতে পারে না। আমাদের সমাজ বর্তমানে পুঁজিবাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলেই এখানে কোনো মহৎ সাহিত্যের বিকাশ সম্ভব হচ্ছে না। সাধারণত যে শ্রেণির মানুষেরা সাহিত্য করে সেই শ্রেণিটা এখন চরম অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতায় নিমজ্জিত। কারণ শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয়, কোনো রকম স্বাধীনতাই নাই তাদের। আর এখানে এখনও কোনো কালচারাল বুর্জোয়া তৈরি হয় নাই। তলস্তয়েরা যেই শ্রেণির মানুষ ছিল এই দেশে সেই শ্রেণির মানুষ কোনরকম নৈতিক চিন্তার ধারই ধারেনা। তারা প্রকাশ্যে লুটেরা। এরেনবুর্গের পুরো বইটার মধ্যেই এই নিয়ন্ত্রিত লেখক সমাজের দেখা মেলে।

অনিশ্চয়তা পর্বে তিনি আরো বলেন 'ফরাসীতে আজ বালজাক, স্তাঁদাল, হুগো অথবা জোলার মত লেখকের আবির্ভাব ঘটছে না। তেমনি ইংল্যন্ডে দেখা মিলছে না ডিকেন্স, বায়রন বা শেলীর। নতুন একজন ডিকেন্স বা স্তাঁদালের জন্ম-প্রত্যাশার আগে সেসব দেশে অবশ্যই প্রভূত পরিবর্তন ঘটাতে হবে।'

এই পরিবর্তনের প্রশ্নেই এখনো স্তব্দ হয়ে আছে পৃথিবীর সাহিত্য সমাজ। পুঁজিবাদী বিশ্ব শিল্প-সাহিত্য নিয়েও বিভিন্ন প্রকল্প ভিত্তিক আগ্রাসন চালাচ্ছে। এমন সব সাহিত্যকে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে, উদ্ভুদ্ধ করা হচ্ছে যা জীবন ঘনিষ্ট নয়। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সাহিত্যকেও বাজার ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে। ফলে লেখক নিজে যা, যে সমাজে বাস করে তা ভুলে পথ বাড়াচ্ছে প্রকল্পের পথে। ফলে তার লেখাটা লাভজনক হলেও হয়ে উঠছে আত্মপ্রতারণা।

এরেনবুর্গ বলেন একজন ঔপন্যাসিক যে সমাজে বসবাস করেন, তার লেখার উপাদান স্থিরীকৃত হয় সে সমাজের গর্ভ থেকেই, এ সত্যটা এখন সকলেই জানে। লেখকের সৃষ্টির কাজটি কিন্তু তার জীবন বৃত্তান্ত, তার অভিজ্ঞতা ও তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকেই উৎসারিত হয়।'

লেখক সমাজের গড়পড়তা মানুষের সাথে বাস করলেও তিনি গড়পড়তা মানুষ নন। লেখক গড়পড়তা মানুষের চাইতে মানুষের অন্তর্জগত সম্পর্কে বেশি জানেন এবং জগতের রাজনৈতিক দার্শনিক যেকোনো প্রায়োগিক প্রতিক্রিয়ায় সর্বাগ্রে বিচলিত হয় তার হৃদয়।

এরেনবুর্গ বলেন ' লেখক শুধু জীবিকার তাগিদেই বই লেখেন না। মানুষকে কিছু বলবার তীব্র তাড়না অনুভব করেন বলেই তিনি লেখেন। সৃষ্টির যন্ত্রণা মুক্তির তাড়নায় তার বুকের ভেতর আঁচড় কাটে বলেই তিনি লেখেন। তিনি লেখেন, কারণ তিনি জনগণকে বুঝেছেন, অনুভব করেছেন তাদের প্রাণবন্ত আবেগ-শক্তিকে, দেখেছেন তাদের এমন কিছু যা শিল্পরূপে বিকশিত হবার জন্য আকুলিত হচ্ছে।'

এই দায়িত্ববোধ, চৈতন্যকে জীইয়ে রাখতে সৎ ও মহৎ লেখকরা যে তাদের প্রাথমিক আবেগকে ক্রমাগত অভিজ্ঞতায় পরিণত করেন সে সম্পর্কে তিনি বলেন ' অতীতের বহু লেখকের চলার পথ কি ভীষণ আঁকাবাঁকা ও জটিলতাপূর্ণ ছিল, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। অসংখ্য শহরে শালটিকভ-শ্চেদ্রিন-এর সরকারী চাকুরি, দস্তইয়েভস্কির দীর্ঘমেয়াদী সশ্রম কারাদন্ডের কথা মনে করুন, গর্কির ইউনিভার্সিটিস কারালেঙ্কোর নির্বাসন, কবলার এন্ড পেইন্টার এর কথা স্মরণ করুন। এসব লেখকের প্রত্যেকেই অন্তত এক-ডজন বই লেখার মত বিপুল আত্মিক সম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে সাহিত্য জগতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।'

তিনি আরো বলেন ' ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় লিখে জীবনধারন করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। পেশাধারী লেখক হবার আগে পশ্চিম ইউরোপ, বিশেষত আমেরিকার অনেক নামজাদা লেখক শ্রমিক, ডাকহরকরা, জাহাজের খালাসি, পথের আলোক-চিত্রকর, সোনার খনি অনুসন্ধানকারী দলের সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করেছেন। তারা বিপুল সংখ্যক মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের অনেক নিপীড়ন সইতে হয়েছে। ধনবাদী সমাজব্যবস্থার অন্ধকার চেহারা উন্মোচিত করে উপন্যাস লিখতে তা তাদের সাহায্য করেছে।'

এরেনবুর্গের এসব কথা থেকে এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, লেখা ও জীবন আলাদা কিছু নয়। জীবন থেকে বরং পালিয়ে বেড়ালেই লেখা কৃত্রিম হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, আমাদের কালের বুর্জোয়া লেখকরা এত বন্ধ্যা কেন? কারণ তারা জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ান।

লেখার সাথে লেখকের আবেগ ও অভিজ্ঞতার অনিবার্যতা সম্পর্কেও তিনি আলোকপাত করেছেন। যদিও এই বিষয়টা নিয়ে বিশ্বসাহিত্যে অনেক তর্কবিতর্ক আছে। এরেনবুর্গ বলেন, শুনেছি বালজাক যখন পিয়ের গরিয়ের মৃত্যুদৃশ্য চিত্রিত করছিলেন, তখন তিনি এতই মুষড়ে পড়ছিলেন যে তখন নাকি ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। শোক-সন্তাপে হৃদয় যদি আকুলিত না হয়, তবে একজন লেখক কেমন করে তার প্রিয়তম চরিত্রের মৃত্যুদৃশ্য বর্ণনা করবেন? আমি আরো এগিয়ে বলতে চাই, প্রকৃত মৃত্যুর অনেক আগেই লেখক বহুবার মৃত্যু যন্ত্রণায় জর্জরিত হন। বালজাক ছিলেন অকপট। তিনি অনেক কিছু খোলাখুলি বলেছেন, যা অন্য লেখকরা নিজেদের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের কাছেও গোপন করে থাকেন।'

এই বইয়ে এরেনবুর্গের যে বক্তব্য তা নিয়ে তৎকালে সমাজতন্ত্রীরাও ক্ষেপেছিলেন: 'কোটি কোটি সোভিয়েতবাসী জানে কিভাবে লোহা তৈরি হয়ে থাকে। তারা জানে কেমন করে নানা জাতের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন প্রজন্মের আপেল সৃষ্টি করা যায়, জানে কিভাবে তৈরি করা হয় অভ্রভেদি অট্টালিকার। কিন্তু উপন্যাস সৃষ্টির প্রক্রিয়া সকল পাঠকের জানা নেই। সৃজনী শিল্প-কলার মনস্তত্বের অনুশীলন তেমন হয়নি বললেই চলে।'

ফলে বইটি পড়ার অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে এমন এক স্বাধীন লেখকের স্বাধীন মতামত যা চিরকালীন লেখক সত্তা বা লেখকের দায়িত্বকে বাক্সময় করে তোলে। মূলত এই বইটি লেখকদের জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ হলেও যেকোনো পাঠকের জন্য হয়ে ওঠে ভিন্নরকমের পাঠাভিজ্ঞতা।

এরেনবুর্গ ১৮৯১ সালে জন্ম নেন কিয়েভের এক বুর্জোয়া পরিবারে। তার বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। চার বছর বয়সেই সপরিবারে তারা মস্কো চলে আসেন। এরেনবুর্গকে বলা হয় তিনমহাযজ্ঞ দেখা লেখক। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্পানিয়ার গৃহযুদ্ধ। এই তিন যুদ্ধেই তিনি প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন সাংবাদিক হিসাবে। ১৯০৮ সালে বলশেভিক পার্টির কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫ মাস জেল খাটেন। পুলিশের নির্যাতনে অনেক দাঁত হারান। গোয়েন্দাদের অতিরিক্ত নজরদারি থেকে বাঁচতে তিনি প্যারিসে চলে যান। এবং সেখানে তিনি লেলিনের সঙ্গে বলশেভিক পার্টির কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু বিপ্লবী কার্যক্রমের পাশাপাশি তিনি সবসময় কবিতা, উপন্যাস, অনুবাদ ও প্রবন্ধ লেখা চালিয়ে যেতেন। তিনি সেই সময়ের বোহেমিয়ান শিল্পীদের আস্তানা 'ক্যাফে দ্যু মন্তপারনাসে'তে নিয়মিত যেতেন।

প্রসঙ্গত প্যারিসে পাবলো নেরুদার সাথে নাটকীয় যোগাযোগ ঘঠে এরেনবুর্গের। নেরুদা তার বিখ্যাত অনুস্মৃতিতে লেখেন 'ফ্রান্সে বহিরাগতদের জন্য রেজিস্ট্রি অফিসের একটি ফাইলে আমার সম্মন্ধে তদানীন্তন চিলের সরকারের এই মন্তব্যটি লিপিবদ্ধ ছিলো: 'নেরুদা ও তাঁর স্ত্রী দেলিয়া দুজনই সোভিয়েত গুপ্তচর এবং সোভিয়েত দেশ থেকে বিপ্লবী-সাহিত্য ও সংবাদ তাঁদের মাধ্যমে এসপানিয়ায় পাচার করা হয়। রাশিয়ান সাহিত্যিক এলিয়া এরেনবুর্গের সঙ্গে নেরুদা প্রায়শই গোপনে এসপানিয়া যাওয়া আসা করেন। এরেনবুর্গের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ রাখার উদ্দেশ্যেই নেরুদা সোভিয়েত সাহিত্যিকদের সাথে একই বাড়িতে থাকেন।'

'মন্তব্যটি সবটাই মিথ্যায় ভরা। জ্যঁ রিশার ব্লক আমায় একটা চিঠি দিয়ে তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে বললেন, পররাষ্ট্র দপ্তরের উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী ইনি। আমি গিয়ে তাঁকে সব কিছু জানিয়ে বললাম যে, আমাকে এখান থেকে নির্বাসিত করার জন্যই এই চক্রান্ত। আমি একথাও তাকে বলেছিলাম এরেনবুর্গের সাথে সত্যি সত্যিই দেখা করতে চাই, কিন্তু সে সৌভাগ্য এখনও আমার হয়নি। উনি অনুগ্রহপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, 'এ বিষয়ে একটা তদন্ত করে দেখবো।' অবশ্য তার এই প্রতিশ্রুতির পরেও আমার বিরুদ্ধে সেই অসত্য বহুকাল ছিলো।

'তখন আমি ঠিক করলাম এলিয়া এরেনবুর্গের সঙ্গে আলাপ আমাকে করতেই হবে। জানতাম প্রতিদিন সুর্যাস্তে তিনি খেতে যান লা কুপোলে। কাজেই একদিন তাঁর সামনে হাজির হয়ে বললাম, আমি চিলের কবি পাবলো নেরুদা। পুলিশের মতে আমরা দুজনে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা বলেন, আমরা এক বাড়িতেই থাকি। আমাকে এই সব কারণে ওরা ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত করতে চান। তাই মনে করলাম আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়টা হওয়া দরকার। অন্তত নির্বাসনে যাবার আগে আপনার সঙ্গে করমর্দন করে যাওয়া উচিত।

আমি জানিনা এরেনবুর্গ কোনদিন চোখের পলক ফেলতেন কিনা, কিন্তু সেদিন বিস্মিত অভিভূত এরেনবুর্গ তাঁর রোমশ ভ্রুজোড়ার নিচে চোখের দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। মাথার উপর কাঁচা-পাকা চুলগুলো ছিলো অবিন্যস্ত। আমাকে তিনি বললেন, 'আমিও তো তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি নেরুদা। তোমার কবিতা আমার ভীষণ ভালো লাগে। তার আগে এসো কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।'
সেদিন থেকে আমরা দুজনে সত্যিই বন্ধুত্ব-সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলাম। ফ্রান্সের পুলিশকে ধন্যবাদ যে, তাঁদের জন্যই অমাদের মধ্যে এই সখ্য সেদিন গড়ে উঠেছিলো। 'হে সোম আমার হৃদয়' এই কবিতাগুচ্ছটি এরেনবুর্গ রাশিয়ান ভাষায় সেদিন থেকেই অনুবাদ শুরু করেছিলেন। তারপর তিনি তাঁর অনন্যসাধারণ লেখনীতে রাশিয়ান ভাষায় আমার বহু কবিতাই অনুবাদ করেছিলেন।

শিল্পীদের মধ্যে বিশেষ করে পাবলো পিকাসো, দিয়াগো রিভেরা, আমেদু মদিগ্লিয়ানি প্রমুখের সাথে মিশতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সেন্ট পিটার্সবুর্গ পত্রিকার জন্য 'যুদ্ধের মুখ' নামে একটা সিরিজ লিখতেন। যা নিয়ে পরে তার বই যুদ্ধের মুখ বা ফেস অব ওয়ার প্রকাশিত হয়। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পরে এরেনবুর্গ রাশিয়া ফিরে আসেন। তার বইগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পঠিত কয়েকটি বই।
*The Tempering of Russia, Knopf, NY, 1944.
* European Crossroad: A Soviet Journalist In the Balkans, Knopf, NY, 1947.
* The Ninth Wave, Lawrence And Wishart, London, 1955.
* The Stormy Life of Lasik Roitschwantz, Polyglot Library, 1960.
* A Change of Season, (includes The Thaw and it's sequel The Spring), Knopf, NY, 1962.
*Chekhov, Stendhal and Other Essays, Knopf, NY, 1963.
* The Second Day, Raduga Publishers, Moscow, 1984.
* Life of the Automobile, Serpent's Tail, 1999.
*The Fall of Paris, Simon Publications, 2002.
* The Storm, University Press of the Pacific, 2003.
দি রাইটার এন্ড হিজ ক্র্যাফট নামের এই লেখাটি লেখক ও তার শৈলী নামে বাংলায় অনুবাদ করেন কালিদাস রক্ষিত। এটা ১৯৮৪ সালে কৃষন চন্দরের একটা আলোচনাসহ বই আকারে প্রকাশ করে কলকাতার অগ্রণী বুক ক্লাব।