মানলাম দোষটা মেয়েদেরই!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 5 Sept 2017, 06:50 PM
Updated : 5 Sept 2017, 06:50 PM

পবিত্র ঈদের দিন সকালের ঘটনা। মেয়েটার মা পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। সে সারারাত মায়ের সেবা করে হাসপাতাল থেকে দশমিনায় বাসায় ফিরছিল। ভাড়ায় চালিত এক মোটরসাইকেলে উঠেছিল। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মোটরসাইকেলটি মিলঘড় এলাকার বটতলার সানু মৃধার বাড়ির কাছে পৌঁছালে ৪ দুর্বৃত্ত চলন্ত মোটরসাইকেলের গতি রোধ করে ড্রাইভারকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে পাঠিয়ে দেয় এবং মেয়েটির মুখ চেপে কাছেই একটি পরিত্যক্ত ভিটায় নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পাঠক, আবারও ভালো করে পড়ুন, পবিত্র ঈদের দিন সকালে এ ঘটনা ঘটেছে যখন বিশ্বাসী মুসলমান ঈদের জামাত ও কোরবানি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন!

যখন বনানীর রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের দাওয়াতের নাম করে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হল তখনও শুনেছি, মেয়েটারই দোষ, রাতবিরেতে বেরোয় কেন? রংপুর থেকে ফেরার পথে রূপা নামে যে মেয়েটিকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করা হল, সেখানেও এক কথা– নিজের নিরাপত্তার কথা নিজেকেই ভাবতে হয়। বিপদের আশঙ্কা আছে জেনেও মেয়েটা একা বাসে গেল কেন? থার্টি ফাস্ট নাইটে বাঁধন নামক মেয়েটির ওপর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কিছু পুরুষ হামলে পড়েছিল তখনও শুনেছি, মেয়েরা কেন মধ্যরাতে আমোদ করতে যাবে! পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে দিনেদুপুরে টিএসএসসিতে যখন মেয়েরা নাজেহাল হল তখনও সাবধানীরা যুক্তি দিয়েছে, দিনকাল খারাপ, মেয়েদের একটু সমঝে চলা দরকার!

সবখানে একই যুক্তি, একই কথা– মেয়েদেরই দোষ। ওরা পর্দা করে না। 'উগ্র' পোশাক পরে। 'উচ্ছৃঙ্খল' চলাফেরা করে। ধর্ম মানে না। আদব মানে না। তাই ওরা পুরুষদের লালসার শিকার হয়। এসব ব্যাপার নিয়ে অনেকের সঙ্গেই তর্ক হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ পুরুষের তেমন কোনো দোষ খুঁজে পায় না। সব আলোচনার শেষ কথা হল– দোষ মেয়েদেরই! কেউ একজন তো উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, সুন্দরবনের জঙ্গলে তুমি শিস দিয়ে ঘুরবে আর বাঘে ধরলে বলবে বাঘের চরিত্র খারাপ!

এসব দেখেশুনে মনে হয় আমরা চিন্তা-চেতনায় ক্রমেই যেন ছয়শ বছর আগে ফিরে যাচ্ছি! সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছিল বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ঘটনাটির পর। আমার 'শিক্ষিত' বন্ধুরা পর্যন্ত রুষ্ট গলায় বলেছে, মেয়েটি অত রাতে হোটেলে যাবে কেন? তার বাপ-মাই-বা কেন তাকে রাতের বেলা পার্টিতে যেতে দিয়েছিলেন? অত্যন্ত সঙ্গত প্রশ্ন। এসব ক্ষেত্রে যুক্তিবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। মাথা কাজ করে না। তখন মনে হয়, 'নারীবিরোধী' মানুষগুলোই ঠিক কথা বলছেন।

হিটলার না-হয় ইহুদিদের সাবাড় করেছেন, ইহুদিরা কি তাদের কাজেকর্মে হিটলারকে প্ররোচিত করেনি? বনানীকাণ্ডের সেই শিক্ষার্থী কিংবা টাঙ্গাইলে চলন্তবাসে ধর্ষণের শিকার হওয়া মেয়েটি, কিংবা দশমিনার সেই হতভাগী কি জানত না, সমাজে থাকতে গেলে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে, সরে-সরে, এড়িয়ে চলতে হয়? সে শেখেনি, বুক-মুখ লুকিয়ে চোখ নিচু করে সমাজে চলতে হয়? মেয়ে হয়ে ঘুরবে ফিরবে আর পুরুষগুলোর মনে কাম-লালসা জাগবে না? বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের যুক্তি-চেতনা-আচরণ বর্তমানে এই স্তরে এসে ঠেকেছে।

মেয়েদের পোশাক নিয়ে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই রয়েছে ব্যাপক আপত্তি। মেয়েদের মিনিস্কার্ট-জিন্স-মোবাইল-ফেসবুক নিয়ে সুদৃঢ় আপত্তি জানান শিক্ষিত মানুষজন পর্যন্ত। তাদের ভাষায়: সারাক্ষণ বেলেল্লাপনা করে বেড়াবে, ছেলেদের সঙ্গে ঢলাঢলি করবে, উত্তেজনা উসকে দেবে, তারপর সে ঝাঁপিয়ে পড়লে 'নারীবাদী' যুক্তি দিয়ে সাফাই গাইবে, এ তো সততার অপমান।

সাধারণ লোকও এখন দেখি শিক্ষিত-আধুনিক মেয়েকে চড় কষানোর পক্ষে। জীবনে যত অধর্ম, ঘুষ-দুর্নীতি-মেয়েদের প্রতি কামার্ত মনোভাব পোষণ করুক না কেন, মেয়েদের প্রসঙ্গ এলেই সবাই 'ধার্মিক' বনে যায়। এ ক্ষেত্রে ধর্ম হল, হিজাব এবং ঘরে বসে থাকা। মেয়েদের কাজ হল, ঘরের কাজ করা, পরিবারের লোকজনের সেবা করা।

তাদের যুক্তিমতে, যে মেয়েরা নিজের সমীচীন-ধর্ম ভুলে, আধুনিকতার নামে বাইরে চলাফেরা করে, পছন্দের পোশাক পরে, তারা যেন নম্রতার, লাজুকতার বিরুদ্ধে একটা জেহাদ নিয়ে এসেছে। বিপদ যেন শুধু এদেরই হয়। যে মেয়েরা বিকেল পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরে এসেছে, যে মেয়েরা দলবেঁধে কলেজ যাচ্ছে ও দলবেঁধে ফিরছে (এবং দলে ছেলে ঢুকতে দেয়নি), যারা চুপচাপ সন্ধে থেকে ঘরে বসে টিভি দেখছে, তারা কি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে না? পরিবারের সদস্যদের হাতেই কি একজন নারী নিরাপদ? ঘরে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে? যে দেশে শিশুদেরও ধর্ষণ করা হয়, সে দেশে এসব যুক্তি কি অপযুক্তি নয়?

কেউ বলছে, নিজেকে রক্ষার কৌশলগুলো তুমি নিজে বুঝে নেবে না? কেউ তর্ক করছে, প্রশাসন কেন মেয়েদের রক্ষা করবে? আরে, তুমি প্রত্যহ দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি কলা দেখাবে, কিছুতে ঘরোয়া-সুশীলা হবে না, আর বিপদে পড়লে অমনি দেশের প্রশাসনের শরণ নেবে? এটা হয় নাকি? কেউ বলছে, ছেলেরা কেন নিজেদের সংযত করবে না? আত্মসংবরণের দায় কেন তাদের নেই?

এমন এক আলোচনায় একজন সরকারি চাকুরের মুখে শুনেছিলাম আরও আজব কথা। তার ভাষায়: "কী মুশকিল, এ তো ছেলেদের শরীরধর্ম। তার হরমোন নিঃসরণ তো তার হাতে নেই। কোনো ছেলেই ইচ্ছে করে ধর্ষণ করে না। আপ্রাণ চেষ্টা করে না-করার। কিন্তু ডায়েটিংএর প্রতিজ্ঞা শেষ অবধি কজন রাখতে পারে? কজন সামনে রগরগে ফুচকা দেখেও মুখ নিচু করে তেত্তিরিশের নামতা জপতে পারে?"

পাল্টা বলেছিলাম: "মেয়েরা কি ফুচকা? ভোগ্যবস্তু? সেক্স অবজেক্ট?"

তার উত্তর: "আলবাত। ভোগ্যবস্তু বলেই তো তাদের নিয়ে রাশি রাশি গান, কোটি কোটি ক্যানভাসে ভাস্কর্যে তাদের নগ্নতা ডিটেলসহ ঝলমল, সাহিত্যে ফিল্মে তাদের রূপের উন্মোচন, স্তব। কালিদাসেও তাই, পর্নোগ্রাফিতেও। সামান্য শিল্পবোধ থাকলেই বোঝা যায়, মেয়েরা ভোগ্য, তাই এক্সট্রা ছোঁকছোঁকের যোগ্য।"

এসব শুনে শুনে নিজেরও মত একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে। আসলেই মেয়েরা আর ছেলেরা সমান নয়। সাম্য একটা অনুচিত ধারণা। দুনিয়াকে শক্তি দেখিয়ে অধিকার করা দিগ্বিজয়ী পুরুষ। আর ন্যাকা, অবগুণ্ঠিত, চব্বিশ বাই সাত ধর্ষণের ভয়ে কাঁপতে থাকা নারী সমান? সোজা কথা, মেয়েরা দেহে আনফিট– মনে কাঁদুনে– আর রূপের পুঁটুলি ভোগের রসগোল্লা। তাই তাদের নিরাপত্তার জন্যেই, সস্নেহ উদ্বেগে, ছলছল মমতায়, ছেলেরা তাদের ঘরের মধ্যে ঠুসে দিয়েছে। দিয়েছে বলেই এ দেশ এত জন অসামান্য সন্তান পেয়েছে। কারণ তাদের মায়েরা, সন্তানদের আয়ার ঘাড়ে ফেলে ড্যাংডেঙিয়ে অফিস করতে বেরিয়ে পড়েনি। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে ছেলের হাতে একটা চিপস আর আর দুটো চুমু দিয়ে মোবাইল-ফেসবুক নিয়ে বসেনি। তারা সারা দিন বাড়িতে থেকে, প্রাণ দিয়ে বাচ্চা মানুষ করেছে। এই দায়িত্ব পেয়ে রোমে রোমে অনুভব করেছে, তারা মায়ের জাত।

অকল্পনীয় মহান দেশ এই বাংলাদেশ, যা কতকগুলো ভোগ্যবস্তুকে অলৌকিক সম্মান দিয়েছে, বেদি গড়ে তার ওপর তাদের প্রতিষ্ঠা করেছে। মেয়েরা অবশ্যই স্বামীর সঙ্গে রাত্রিবিলাসে অনাগ্রহী হলে তাদের কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো হবে, কিন্তু তারপরই ফের তাদের ঘেঁটি ধরে বেদিতে চড়িয়ে দেওয়া হবে। কারণ বাচ্চার ভিজে কাঁথা পরিষ্কার করবে দেবীর জাত, মায়ের জাত। তাই পুরুষরা যদি-বা বখে যেতে পারে, অলস হতে পারে, শরীর খারাপ হতে পারে, নারীদের তা হওয়া চলবে না। কারণ তারা সন্তান গড়ে তুলবে। সমাজের সেরা মূল্যবোধগুলো ভাবী নাগরিকদের মধ্যে বুনে দেবে। সন্তান যদি দেখে মা বাইরে কাজ করে অসময়ে বাড়ি ফিরছে, তাহলে সেই সন্তান সুকুমার বৃত্তি আয়ত্ত করবে কীভাবে, কার কাছে?

মেয়েদের প্রতি এই অশেষ শ্রদ্ধার জন্যই তাদের কাছে আমাদের পুরুষেরা মহাকাব্যিক আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশৃঙ্খলা দাবি করে। শিক্ষক যেমন মদ খেয়ে ক্লাসে পড়াতে পারেন না, নারীও তেমন নিজের আনন্দে অগ্রাধিকার দিয়ে জীবনযাপন করতে পারে না। তাকে নিজেকে বঞ্চিত করে যেতে হবে ক্রমাগত, যাতে এক কণা পাপ, এক ছটাক কালিও তার চরিত্রে না লাগতে পারে। সন্তান যখন দেখবে নিরন্তর আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে মা-খালা-ফুফু-চাচী-আন্টি হয়ে উঠছেন শুদ্ধ ও স্বেচ্ছা-অবরুদ্ধ, তাঁরা স্বাধীনতার আলোর দিকে মথের মতো ফড়ফড়িয়ে ধাবিত হচ্ছেন না, তখনই তার মাথা এঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে আসবে।

অধিকার আর স্বাধীনতা দিয়ে কী হবে? রাস্তায় বেরিয়ে কী হবে? আয়-রোজগার-উপার্জন দিয়ে কী হবে? বিপদ বাড়বে। মেয়েদের না-খেয়ে থাকার, সংযমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তাহলে নিজের ঘরে, নিজের সংসারে, চার দেওয়ালের মধ্যে, স্বামী সন্তান নিয়ে, অনেক মর্যাদা শান্তি ও নিরাপত্তায় বাঁচা যাবে। দেশের কাণ্ডারীরা এই বাংলাদেশই গড়ে তুলতে চান। শান্তির নীড়। তাতে কেন ধরবে চিড়?

মনে রাখতে হবে, নূতন বাংলাদেশকে হয়ে উঠতে হবে প্রাচীন বাংলাদেশ। কারণ সেই বাংলাদেশেই ছিল রাক্ষস-খোক্কস, পান্তাবুড়ি, ডাইনি বুড়ি, পক্ষীরাজ ঘোড়া, বন-জঙ্গল। যেখানে আর কিছু ছিল না ছিল, শুধু শান্তি আর শান্তি! ভূত-পরী-দেও-দানবের দুনিয়ায় আমরা প্রত্যাবর্তন করতে চাই। মোবাইল ছু৭ড়ে ফেলে দিয়ে সুর করে আমরা কেবলই ধর্মীয় সঙ্গীত গাইব। সেই সঙ্গীত শুনে মেয়েরা-মোয়েরা অন্তপুর থেকে কেবল চোখ মুছবেন। একটু-আধটু পরিবর্তন করে সেই মধ্যযুগ ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিয়েছেন আমাদের হর্তাকর্তাবিধাতা পুরুষকুল। সেই যুগে প্রবেশ করলে নারীবাদও আর থাকবে না, নারীবাদীরা ট্যাঁ-টুঁ করে পুরুষকুলের জ্বালা বাড়াবে না।

এখন অপেক্ষা কেবল সেই সুদিনের!