এক ধর্মগুরুর সাজা ও ভারতের রাজনীতি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 30 August 2017, 06:29 AM
Updated : 30 August 2017, 06:29 AM

ক্ষমতায় আসার চল্লিশ মাসের মধ্যে নরেন্দ্র মোদি সরকার এমন সব কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে যা স্বাধীনতার সত্তর বছরে কখনও শোনা যায়নি। সরকার সম্পূর্ণ দিশাহারা। কী অভ্যন্তরীন নীতি, কী বিদেশনীতি– সবেতেই তালগোল পাকিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়েছে প্রশাসন চালাতে বা দেশরক্ষা করতে জানে না তারা। ২০১৩ সাল পর্যন্ত চীনের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল তা ভেঙে চুরমার। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মানসিকতা নিয়ে চলছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশ ভারতের পাশেই আছে।

মোদি সরকারের অগ্রাধিকার হিন্দুত্ববাদ এবং আত্মকেন্দ্রিক সাধু-সন্ন্যাসীদের মাথায় তোলা। সংঘ পরিবারের দাপটে কাশ্মীর থেকে কম্যাকুমারী সর্বত্রই অরাজকতা চলছে। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। মানুষ হাপিত্যেশ করছে। রাজ্যে রাজা হিন্দু জাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়েছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিতটাই তারা উপড়ে ফেলতে চাইছে।

গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তাঁর মাসিক 'মন কি বাঁত' এ বলেছেন, যারা আইনশৃঙ্খলা হাতে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু অপরদিকে তাঁর দলের সভাপতি অমিত শাহ সংঘ পরিবারকে উস্কে দিয়ে বলেছেন, দেশে যা ঘটছে তা তিনি সমর্থন করেন। তার মানে হরিয়ানায় ডেরা-ভক্তদের সাম্প্রতিক তাণ্ডবও তিনি সমর্থন করেছেন!

সমস্ত বিরোধী দল একই দিনে বিহারের রাজধানী পাটনায় সভা করে দাবি তুলেছেন, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীকে অপসারণ করে সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করতে হবে। হরিয়ানায় যে কয়েক হজাার কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে, গুরমিত রাম-রহিমের সম্পত্তি বিক্রি করে তার ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে আদালত।

সম্প্রতি আধার-বিতর্ক এবং ডেরা সাচা সৌদার প্রধানকে নিয়ে দুদুটি কাণ্ডে চরম বিপাকে পড়েছে মোদির সরকার। এই দুটি ঘটনার কালি থেকে কী করে দলকে উদ্ধার করা যায় তা নিয়েই আপাতত চিন্তায় রয়েছে বিজেপি এবং সংঘ পরিবার। প্রথমত, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মুখ পুড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের। প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের নেতৃত্বাধীন ৯ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ে ব্যক্তিগত পরিসর বা গোপনীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি মেলায়, আধারসহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

দ্বিতীয় ধাক্কাটি এসেছে ধর্ষণের মামলায়। ভারতের উত্তরের রাজ্য হরিয়ানার ডেরা সাচা সৌদা আশ্রমের প্রধান বাবা গুরমিত রাম-রহিম সিংয়ের ধর্ষণের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর। এই ডেরা সাচা সৌদার ভক্ত ও অনুগামীরাই হরিয়ানায় গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিল। প্রধানমন্ত্রীর স্বচ্ছ-ভারত প্রকল্পে তাঁর পাশেই একাধিকবার দেখা গিয়েছে এই বাবাকে। এমনকি নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে নরেন্দ্র মোদি ও সংঘ পরিবারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন এই বিতর্কিত বাবা। ফলে পরপর জোড়া ধাক্কায় আপাতত খানিকটা কোনঠাসা হয়ে রয়েছে মোদি ও অমিত শাহের দল।

আধার আদৌ কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবহার করতে পারবে কিনা তা নিয়ে এই মুহূর্তে আদালতের কোনো নির্দেশ না থাকলেও আগামী দিনে এই-সংক্রান্ত একটি মামলায় সরকার ফের ধাক্কা খাবে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে। এই পরাজয় ধামাচাপা দিতে সরকার এখন থেকেই আধার-কার্ডের গুণগান গাইতে শুরু করেছে। এমন একটা ভাব করা হচ্ছে যেন সুপ্রিম কোর্টের এই রায় আধার প্রকল্পর ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।

সরকারের এই ভান একেবারেই পছন্দ হয়নি প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল মুকুল রোহতগির। তিনি স্পষ্ট বলেন, সরকারের উচিত ছিল পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া। তিনি বলেন, "আমি অ্যাটর্নি জেনারেল হলে বলতাম, এই মামরায় হেরে গিয়েছি। এর ফলে আধার নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল। তাহলে সরকারের জয়টা হল কোথায়?"

চারদিকে যখন সরকারের হেরে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে তখন অরুণ জেটলি বলেন, "জনধন, আধার ও মোবাইলে ফোন একটি সামাজিক বিপ্লব। ৭৩.৬২ কোটি অ্যাকাউন্টের মধ্যে ৫২.৪ কোটি অ্যাকাউন্ট আধারের সঙ্গে যুক্ত। প্রতি মাসে এই আধার-যুক্ত একাউন্টগুলি ৭ কোটি টাকা লেনদেন করেন গরিবরা। ভিম অ্যাপ ও ইউপিআইয়ের দৌলতে গরিবরা এখন ডিজিটালের মূলস্রোতে। ফলে অনায়াসে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া একশ কোটির লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।"

বিরোধীদের বক্তব্য, আধার-কার্ড চালু করা হয়েছিল যাতে গরিবরা সরাসরি টাকা পান সেদিকে নজর রেখে। কিন্তু তার পরিসর বড় করে এই সরকার চাইছে সব কিছুর সঙ্গে আধার যুক্ত করতে। বিরোধীদের বক্তব্য, আধার নিয়ে শুনানি শুরু হলে আরও একদফা সরকারের মুখ পুড়বে।

ডেরা সাচা সৌদার স্বঘোষিত গুরু গুরমিত রাম-রহিম সিংকে ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত করার পর তার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সব খবর আসতে শুরু করেছে। প্রায় ২০০ জন মহিলা এই বাবাকে সর্বদা ঘিরে থাকতেন। 'মাফি' দেওয়ার (ক্ষমা করার) কথা বলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো মহিলাকে ধর্ষণ করতেন এই নরাধম ধর্মগুরু। শুধু ধর্ষণই নয়, তার ৭০০ একরের ডেরা জুড়ে চলত নানা সন্দেহজনক ঘটনা। গুরু গুরমিত রাম-রহিমের শয়নকক্ষকে বলা হত বাবার 'গুফা' বা গুহা। এই গুহায় প্রবেশধিকার ছিল ২০০ সেবাদাসীর। তাদের মধ্যে ৩০ জন সাদা বসনে থাকতেন।

২০০২ সালে ডেরার সাধিকাদের ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত হন রাম-রহিম। ধর্ষণকে এখানে ক্ষমা বলা হত। 'পিতাজি কি মাফি' বলে যাকে ধর্ষণ করা হবে, তাকে রাম-রহিমের ঘরে নিয়ে যাওয়া হত। ভারতীয় সেনার গোপন সূত্রে খবর, ২০১০ সাল থেকে এই ডেরায় চলত অস্ত্রশিক্ষা। অনেক প্রাক্তন সেনাকর্মীকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজেও ব্যবহার করতে রাম-রহিম। আদালতের রায় শোনার পর সেই অস্ত্রশস্ত্র হাতে রাস্তায় বেরিয়ে তাণ্ডব দেখিয়েছে বাবার চ্যালাচামুণ্ডারা।

তিন-চারদিন ধরে হরিয়ানাসহ ভারতের চারটি শহরে আগুন জ্বলে গিয়েছে, প্রাণ হরিয়েছেন ৩৮ জন মানুষ। এই হিংসাত্মক পরিস্থিতির জন্য প্রধানত বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থকেই দায়ী করেছে রাজনৈতিক মহল। হরিয়ানার গত বিধানসভা ভোটের সময় থেকে বিজেপির বড় ভোট ব্যাংক হিসেবে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে 'বাবা'র ডেরা সাচা সৌদা নামে ধর্মীয় সংগঠনটি। হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তর প্রদেশের মতো উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলিতে আসন্ন লোকসভা ভোটে জিততে হলে 'বাবা'র সাহায্য দরকার হবে বিজেপির। সে কারণেই পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টের কড়া নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ডেরার ভক্তদের প্রতি খুব কড়া পদক্ষেপ নিতে পারেনি মনোহরলাল খাট্টারের প্রশাসন।

রায় বের হওয়ার পর ডেরা-সমর্থক এবং 'বাবা'র ভক্তদের দাপটে কার্যত অগ্নিগর্ত হয়ে ওঠে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অংশ। এই রাজ্যগুলির আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন এবং সাধারণ নির্বাচনে গুরমিত রাম-রহিমের আশীর্বাদ থেকে বিজেপি যাতে বঞ্চিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই এখন শাসক দলের প্রধান মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নরেন্দ্র মোদি প্রধামন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বিজেপির কাছাকাছি আসতে শুরু করে ডেরা সাচ্চা সৌদা। প্রধানমন্ত্রী হয়েই স্বচ্ছ-ভারতের ডাক দিয়েছিলেন মোদি। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে প্রকাশ্যে মোদির সংসম্পর্শে আসেন ডেরাপ্রধান গুরমিত রাম-রহিম সিং। সে সময় প্রকাশ্যে 'বাবা'কে প্রণামও জানিয়েছিলেন মোদি। এরপরই প্রধানমন্ত্রীর 'মন-কি-বাত' বুঝতে পেরে ডেরার আশ্রমে ছুটে যান একের পর এক তাঁবড় বিজেপি নেতা। কারণ রাম-রহিম শুধু একজন ধর্মীয় গুরুই নন, তার অগণিত ভক্তকুল যে অচিরেই বিজেপির একটা বড় ভোট ব্যাংক হয়ে উঠতে পারে সে কথাও বুঝেছিলেন তারা।