আওয়ামী-হেফাজত দোস্তি: এক পলিটিক্যাল ফ্যালাসি

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 27 August 2017, 07:41 PM
Updated : 27 August 2017, 07:41 PM

নিউ ইয়ার্স রেজোলিউশন নেওয়ার সময় আমাদের বেশিরভাগেরই মনে থাকে না টু-ডু লিস্টের প্রজেক্টগুলো করা সম্ভব কিনা। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর বেলায়ও তাই।সালতামামিতে দেখা যায় কিছু কাজ বাকি থেকেই যায়। আবার কিছু কাজ বা প্রজেক্ট কোনো ঘোষণা বা পরিকল্পনা ছাড়াই করতে হয়। নোবেল লরিয়েট মনস্তত্তবিদ ড্যানিয়েল কানেম্যান এই অচরিতার্থ কাজগুলো করতে না পারার বিষয়টির নাম দিয়েন 'প্ল্যানিং ফ্যালাসি'। আওয়ামী-হেফাজত দোস্তি 'প্ল্যানিং ফ্যালাসি' বলা না গেলেও এটা 'পলিটিক্যাল ফ্যালাসি' তো বটেই।

দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো যেভাবে রাজনৈতিক সক্রিয়তা দেখাচ্ছে তা লক্ষ্য করার মতো। আশঙ্কার বিষয় হল, দেশের ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল দল ও শক্তিগুলো যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন নিজেদের যথেষ্ট শক্তিশালী মনে করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় শাসক দল ও বিরোধী দল তাদের সঙ্গে এখন যেভাবে সমঝোতা করছে তা রীতিমতো অস্বস্তির কারণ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের জন্য। শুরুতে জামায়াতে ইসলামী, এর ধারাবাহিকতায় খেলাফতে মজলিস, ইসলামী শাসনতন্ত্র এবং সর্বশেষ হেফাজতে ইসলাম এখন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আপসরফা নিয়ে জনপরিসর যখন সরগরম, তখন সরকার বলছে, হেফাজতের সঙ্গে তাদের সমঝোতা হয়নি (সেতুমন্ত্রী বলেছেন, এটা কৌশলগত, রাজনৈতিক আপসরফা)। হেফাজতে ইসলামও বিভিন্ন সময় ঘোষণা দিয়ে বলেছে যে, সরকারের শরীক নয় তারা, কিংবা আওয়ামী লীগের জোটেও নেই।

মাদ্রাসা শিক্ষা মূলধারার সঙ্গে যুক্ত করার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফী ও অন্য শরীকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দক্ষিনঘেঁষা বিএনপি তো হতাশ সরকারেরর আচরণে। তারা বলছে, সরকার হেফাজতকে হাতে রেখে নির্বাচনে পাশ করতে চাইছে। বিএনপি নেতা মীর নাছির হেফাজত প্রধান আহমদ শফীর সঙ্গে দেখা করেছেন। আর আহমদ শফী হাসপাতালে ভর্তি হলে তার শয্যাপাশে হাজির হন বিএনপি মহাসচিব পর্যন্ত। এসব ইঙ্গিতে এটা পরিষ্কার যে, হেফাজতকে করতলগত করতে চায় সবাই।

মাওলানা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে বহুসংখ্যক আলেম-ওলামার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হেফাজতে ইসলামকে এক ধরনের স্বীকৃতি। যা রীতিমতো অভূতপূর্ব (হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়া এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য অপসারণের ঘটনা, সুলতানা কামালকে হুমকি প্রদান– বিষয়গুলো ঘটছে উদারপন্থীদের হতাশ করে। এ সব ঘটনা-পরম্পরা হেফাজতে ইসলামকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। আর আওয়ামী সরকারের স্বাভাবিক মিত্র বুদ্ধিজীবীদের হতাশ করেছে। এর মাধ্যমে হেফাজতে নেতাকর্মীদের সঙ্গে ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে তাতে মলম দেওয়া হয়েছে।

সময়টা এমন যে, একালে প্রায় সব রাজনৈতিক দল ধর্ম ও রাজনীতির নিপুণ মেলবন্ধন ঘটিয়েছে এবং তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। বর্তমান প্রধানতম বিরোধী দল বিএনপি– সেই দল যে প্রতিবাদ করছে তা যতটা না ক্ষোভে তার চেয়ে বেশি নিজেদের পতাকাতলে ওইসব দল না-পাওয়ার বেদনায়।

রাজনীতিতে 'ধর্ম কার্ড' ব্যবহারের ইতিহাস নতুন নয়। রাজনৈতিক ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে শাসকরা নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেছে– যখন প্রয়োজন হয়েছে তখন– সেটা মধ্যযুগ থেকে শুরু করে এই আধুনিক যুগ পর্যন্ত। আমাদের উপমহাদেশে মানুষের নিজস্ব ধর্মীয় আবেগ কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। যে কোনো আন্দোলন সংস্কারে ধর্মের ব্যবহারের রেওয়াজের ইতিহাসও বেশ পুরনো।

এই হাইটেক যুগেও রাজনীতিবিদরা রাজনীতির ধর্মীয়করণ কিংবা রাজনীতিতে ধর্ম এনে জনসাধারণের চিন্তা-চেতনা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের রাজপথে এনেছেন বার বার– নিজেরা ক্ষমতায় আরোহণের জন্য কিংবা ক্ষমতা থেকে বিরোধীদের নামাতে। উপনিবেশ শাসকরা হিন্দু-মুসলিম এ দুটো ধর্মের ব্যবহার করেছিল তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশে। এই 'হিন্দু–মুসলিম' ভেদনীতির কৌশল যে কাজ করে ব্রিটিশরা তা করে দেখিয়েছে।

বামদের প্রতি সহানুভূতিশীল ডানপন্থী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভেতরেও প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থীরা শক্তিশালী ছিল সেই ষাটের দশকেও। ডানপন্থীদের কবলে পড়েছিল দলটি পথচলার শুরুতেই। ছয় দফা আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থীরা এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, তারা বঙ্গবন্ধুর জেলে থাকার সুযোগ নিয়ে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কারের ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল। তবে দলের ঐক্যবদ্ধ সাধারণ নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের সেই প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থীদের কূটচাল বানচাল করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব জারি রাখতে সাহায্য করেছিলেন।

ভোটের মাঠের দখল নিতে আওয়ামী লীগ ও হেফাজতের ঐক্য কৌশল কোনো কাজে আসবে কিনা তা সময়ে প্রমাণ হবে। বিশ্লেষকদের ধারণা, হেফাজতের ভোট আওয়ামী লীগ পাবে না। বরং প্রগতিশীল চিন্তার যেসব মানুষ আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার দল হিসেবে সমর্থন করেন দলটি তাদের আস্থা হারাবে। অনেকে ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েও বলেছেন, রাষ্ট্রের ওপর কোনো ধর্ম বসিয়ে দেওয়া যাবে না।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সব নাগরিকের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলনীতিও তাই।

ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী পুলসিরাত পেরুতে ব্যর্থ হলেই প্রমাণিত হবে যে, তেলে-জলে মেলে না। উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক আদর্শের পেটেন্ট এককালে আওয়ামী লীগেরই ছিল। ভোটের লড়াইয়ে তা নিয়ে আর যুত করা যাচ্ছে না বলে এইসব আপোসকামিতা।

রাজনৈতিক দলের মতাদর্শগত শূন্যতা পূরণ করতে হয় অন্য কিছু দিয়ে নয়– মতাদর্শ দিয়েই। রাজনৈতিক দর্শন ও জনসম্পৃক্ততা– এই দুই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের চেয়ে সমৃদ্ধ দল আর নেই। নিজস্ব আদর্শিক অবস্থান ভুলে ২০০৬ সালে ধর্মাশ্রয়ী খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ একটি সমঝোতা চুক্তি করে। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে ওই চুক্তি বাতিল করা হয়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকার ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করার সময় ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতিতে পরিবর্তন আনেনি। অন্যদিকে একই সংশোধনীতে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাও পুনর্বহাল করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে কোনো বিশেষ ধর্মকে আলাদা পোষকতা প্রদান অসঙ্গত হলেও সরকার বিভিন্নভাবে তা করে আসছে।

আওয়ামী-হেফাজত দোস্তিতে আরেকটা বিষয় সামনে এসেছে; তা হল, দেশের বেশিরভাগ মানুষ প্রতিবাদ করা, ভিন্নমত পোষণ করার কঠিন বাস্তবতা এড়িয়ে মেনে নেওয়ার সোজা রাস্তা ধরেছে। ধর্মীয় উন্মাদনা ও মৌলবাদের সঙ্গে দালিলিক অসাম্প্রদায়িক পরিচয় বহনকারী আওয়ামী লীগের সমঝোতা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখে প্রতিবাদের দায়মুক্তি নিয়েছেন।। বুমেরাং যেমন যে ছোঁড়ে তার দিকে তেড়ে এসে তাকেই আঘাত করে, এখন যারা মানিয়ে নিতে বলছেন এই অসম সমঝোতা– কে জানে এক সময় তারাই হয়তো তার প্রধান নির্মম শিকার হবেন কিনা।