বাংলাদেশে গতকাল তিন দফা মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় ৮ দশমিক ৬ মাত্রার প্রবল ভূমিকম্পের পর সুনামি সতর্কতা জারির পর তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রথমে সুনামি (Tsunami) সম্পর্কে একটু বলে নেই। সমুদ্র বা হ্রদের কোন বিস্তৃত এলাকার পানি সরে যাওয়ার ফলে যে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় তাকেই সুনামি বলে।
ভূমিকম্প (মূলত সমুদ্রের তলদেশে) সুনামি সৃষ্টি হওয়ার একটি প্রধান কারণ। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে উপকূলীয় এলাকায় যে জলোচ্ছ্বাস হয় তার চেয়ে সুনামি বেশ ভিন্ন। আমরা জানি জলোচ্ছ্বাসের সময় আমাদের উপকূলে ঢেউয়ের উচ্চতা অনেক বেশি হয়, কারণ আমাদের উপকূলের মহীসোপান (continental shelf) বেশ অগভীর। কিন্তু সুনামির ক্ষেত্রে এটা আবার 'শাপে বর' অবস্থা অর্থাৎ এর প্রভাব বিপরীত। কারণ, সুনামি মূলত তরঙ্গের গতির ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের উপকূলের মহীসোপান শুধু অগভীরই নয়, বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতও (প্রায় ১০০ কিমি থেকে ২৫০ কিমি পর্যন্ত)। সুনামির তরঙ্গ উপকূলে যে গতি নিয়ে আসে স্বল্প গভীরতার জন্য ঘর্ষণপ্রাপ্ত হয়ে তা বেশী দূর অগ্রসর হওয়ার কথা নয়। আবার বিস্তৃত মহীসোপানের শেষ প্রান্তে আসতে আসতে এর গতিও অনেক কমে যাওয়ার সম্ভাবনা।
সুনামির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য আতংকজনক তেমন কিছু না থাকলেও ঘনবসতিপূর্ণ এদেশে বড় কোনো ভূমিকম্প যে বিশাল দুর্যোগ বয়ে নিয়ে আসবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিরোনামে প্রস্তুতি ও করণীয় বলতে এখানে মূলত ভূমিকম্পে ব্যক্তিগত প্রস্তুতির কথাই তুলে ধরা হয়েছে। প্রচারণা, উদ্ধার ও পুনর্বাসন কাজে রাষ্ট্র এবং নগর কর্তৃপক্ষগুলোর প্রস্তুতি ও ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্পের সাথে অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলির মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে এটি খুব কম সময়ে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই সম্পন্ন হয়। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেবার মতো কোনো উপযুক্ত পন্থা বা প্রযুক্তি এখনও আবিষ্কৃত হয় নি। ভূমিকম্প বিষয়ে তাই সবার ব্যক্তিগত পূর্বপ্রস্তুতি ও এ সময়ে করণীয় সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরী।
ভূমিকম্প ঝুঁকি
নিজ এলাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা রাখাও প্রস্তুতির একটা অংশ। ভূমিকম্প ঝুঁকি অনুযায়ী ভূ-তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশকে তিনটি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। সিলেট বিভাগসহ নেত্রকোনা, শেরপুর, কুড়িগ্রাম জেলা এবং ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, গাইবান্ধা, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার অংশবিশেষ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ইত্যাদি জেলা মাঝারি ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় পড়েছে। (চিত্র-ক)
ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতির তীব্রতার যে মাত্রা রয়েছে সে সূচক অনুযায়ী ঢাকা পৃথিবীর শীর্ষ ২০ টি ঝুঁকিপূর্ণ শহরের অন্যতম। ভূমিকম্প ঝুঁকি অনুযায়ী ঢাকাকে চারটি এলাকায় ভাগ করা যায় (চিত্র-গ)। ম্যাপে দেখা যাচ্ছে উত্তরা এলাকা সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং খিলগাঁও, বাড্ডা, গুলশান, ক্যান্টনমেন্ট এবং পুরনো ঢাকার বুড়িগঙ্গা সংলগ্ন অঞ্চল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রয়েছে।
ভূমিকম্পের সময় করণীয়
নিচের পরামর্শগুলো বেশি কার্যকরী যদি ভবনে ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা থাকেঃ
১। ভূমিকম্পের সময় বেশি নড়াচড়া, বাইরে বের হবার চেষ্টা করা, জানালা দিয়ে লাফ দেবার চেষ্টা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিত। একটা সাধারণ নিয়ম হল- এ সময় যত বেশি মুভমেন্ট করবেন, তত বেশি আহত হবার সম্ভাবনা থাকবে। আপনার ভবনে যদি ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা থাকে বা রেট্রোফিটিং করা থাকে তবে ভূমিকম্পের সময় বাসায় থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ।
২। আমেরিকান রেডক্রসের পরামর্শ অনুযায়ী- ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে উত্তম পন্থা হল 'ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন' বা 'ডাক-কাভার' পদ্ধতি। অর্থাৎ কম্পন শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়ুন, তারপর কোন শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নীচে ঢুকে কাভার নিন, এমন ডেস্ক বেছে নিন বা এমনভাবে কাভার নিন যেন প্রয়োজনে আপনি কাভারসহ মুভ করতে পারেন।
কোনো ভবন ভূমিকম্পরোধক হলে তা খুব কমই ধসে পড়ে; যেটা হয় তা হল আশেপাশের বিভিন্ন জিনিস বা ফার্নিচার গায়ের উপর পড়ে আহত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এগুলো থেকে বাঁচার জন্য এ সময় কোন শক্ত ডেস্ক বা টেবিলের নিচে ঢুকে আশ্রয় নেয়া জরুরী।
৩। ভূমিকম্পের সময় এলিভেটর/লিফট ব্যবহার পরিহার করুন।
৪। ভূমিকম্পের সময় যদি গাড়িতে থাকেন তবে গাড়ি বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকুন। গাড়ির বাইরে থাকলে আহত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৫। 'মেইন শক' বা মূল ভূমিকম্পের আগে এবং পরে মৃদু থেকে মাঝারি আরো কিছু ভূমিকম্প হতে পারে যেগুলো 'ফোরশক' এবং 'আফটার শক' নামে পরিচিত। সতর্ক না থাকলে এগুলো থেকেও বড় বিপদ হয়ে যেতে পারে। সাধারণত কোনো বড় ভূমিকম্পে 'আফটার শক' প্রথম ঘণ্টার মধ্য থেকে শুরু করে কয়েক দিনের মধ্যে হতে পারে।
৬। প্রথম ভূমিকম্পের পর ইউটিলিটি লাইনগুলো (গ্যাস, বিদ্যুত ইত্যাদি) একনজর দেখে নিন। কোথাও কোন লিক বা ড্যামেজ দেখলে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিন।
ধ্বংসস্তুপে আটকে পড়লে করণীয়
১। ধুলাবালি থেকে বাঁচার জন্য আগেই সাথে রুমাল বা তোয়ালে বা চাদরের ব্যবস্থা করে রাখুন।
২। ম্যাচ জ্বালাবেন না। দালান ধ্বসে পড়লে গ্যাস লিক হয়ে থাকতে পারে।
৩। চিৎকার করে ডাকাডাকি শেষ অপশন হিসেবে বিবেচনা করুন। কারণ, চিৎকারের সময় মুখে ক্ষতিকারক ধুলাবালি ঢুকে যেতে পারে। পাইপে বা ওয়ালে বাড়ি দিয়ে বা মুখে শিস বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে পারেন। তবে ভাল হয় সাথে যদি একটা রেফারির বাঁশি বা হুইসেল থাকে, তার প্রিপারেশন নিয়ে রাখুন আগেই।
তানভীর ইসলাম: নগর পরিকল্পনাবিদ ও সহকারী অধ্যাপক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জ্যাকসনভিল স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।