লংগদু সহিংসতা: ওরা ভালো নেই

Published : 27 August 2017, 06:30 AM
Updated : 27 August 2017, 06:30 AM

১ জুন, ২০১৭। খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের চার মাইল (কৃষি গবেষণা এলাকা সংলগ্ন) এলাকা থেকে যুবলীগের লংগদু সদর ইউনিয়ন শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক নূরুল ইসলাম নয়নের লাশ উদ্ধার হয়। পরদিন, ২ জুন তার লাশ নিয়ে লংগদু সদরে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এক পর্যায়ে কিছু লোক তিনটিলা পাড়া, বাইট্রাপাড়া, উত্তর ও দক্ষিণ মানিকজুড় এলাকায় পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। আগুন দেওয়ার ঘটনায় পাহাড়িদের দুই শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। দুই শতাধিক পরিবারের কপালও পুড়ে তাতে।

লংগদু সহিংসতার দুই মাস পেরিয়ে গেল। যাব যাব করে এতদিন যাওয়া হয়নি রাঙামাটির সেই জনপদে। ধারাবাহিক পাহাড়ধস, বন্যা, ভারী বর্ষণ, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কারণে এতদিন যাওয়া হয়নি। অবশেষে ৪ জুলাই লংগদুতে যাওয়া হল। দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য কিছু শিক্ষা উপকরণও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাড়িঘর হারানোর পাশাপাশি এসব শিক্ষার্থী তাদের লেখাপড়ার সব উপকরণ হারিয়েছে। যাদের মধ্যে এসএসসি এবং এইচএসসিতে পরীক্ষার্থী মিলে প্রায় অর্ধশতাধিক পরীক্ষার্থীও রয়েছে।

এই ঘোর বর্ষায় ঘরবাড়ি হারানো এই পরিবারগুলো কীভাবে যে দিন কাটাচ্ছেন তা না দেখলে বোঝানো যাবে না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো শুরু থেকে সরকারের কোনো ত্রাণ গ্রহণ করেননি। তাদের দাবি ছিল, তারা ত্রাণ চান না, তারা রাষ্ট্র এবং সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চান। কারণ রাষ্ট্র ও সরকার সহিংসতার আগুন থেকে তাদের ঘরবাড়ি বাঁচাতে পারেনি। নাগরিকের জান, মাল এবং সম্পত্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। সংবিধানের কাছে এ বিষয়ে রাষ্ট্র অঙ্গীকারাবদ্ধ।

ঘটনার দুমাসের কাছাকাছি সময়ে সরকার দুশ বারটি পরিবারকে থাকার ঘর বানিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এটা নিঃসন্দেহে সুসংবাদ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রায়ণ-২ প্রকল্প থেকে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে লংগদু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও)। ২৪ জুলাই পাওয়া ওই চিঠিতে জরুরিভিত্তিতে প্রাক্কলন ও নকশা পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এমন তথ্য লংগদুর ইউএনও গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। চিঠিতে ৪ লাখ ৭২ হাজার টাকার প্রাক্কলিত খরচে বসতঘরের নকশা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবার তিন কক্ষের একটি সেমিপাকা ঘর, একটি রান্নাঘর ও একটি শৌচাগার পাবে। চিঠিতে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের (সংশোধিত) ডিপিপি অনুযায়ী প্রতিটি ঘরের প্রাক্কলিত খরচ আইটি ভ্যাটসহ ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে আইটি ভ্যাট (১০ শতাংশ) বাদে প্রতিটি ঘরের প্রাক্কলিত খরচ প্রায় ৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা।

লংগদুর ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারিভাবে ঘর তৈরি করে দেওয়ার উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা সবাই খুশি হতে পারেননি। কয়েকটি পরিবারের সদস্যের সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। তারা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত কোনো কোনো পরিবারের সদস্য তিন জন; কিছু পরিবারের ক্ষেত্রে আট জন করেও সদস্য রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য থাকার ঘর বানিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যের সংখ্যা বিবেচনায় না নেওয়ার কারণে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ ও চরম হতাশা রয়েছে।

আসলে কেবল বাড়ি নির্মাণ করে দিলেই ক্ষতিপূরণ হবে না। কারণ একটি বাড়ি পোড়া মানে একটি সংসার পোড়া। একটা সংসারে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু থাকে। যেগুলো ছাড়া একটা সংসার চলে না। এসবের কী হবে? চাল, চুলা, আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড় কিছুই তো নেই তাদের! তিলে তিলে মায়া-মমতায় গড়ে তোলা সংসার হারিয়ে বুকে পাথর চেপে ভয় আর অবিশ্বাস নিয়ে বাঁচার যন্ত্রণা কি হামলাকারীরা বুঝেন?

আমরা যখন শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করছিলাম তখন কানের কাছাকাছি এসে একজন জানতে চাইলেন তাদেরকে টাকা দেওয়া হবে কিনা। একথা তিনি লোভ করে বলেননি। ঘোর অভাব থেকে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। অথচ সব হারানোর আগে তাদেরকে এমন প্রশ্ন কাউকে করতে হয়নি। বাড়ি করে দেওয়ার পাশাপাাশি তাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে পারার মতো কিছু আর্থিক অনুদানও দেওয়া প্রয়োজন। নতুবা ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারের জন্য যে টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে সে টাকা তাদের হাতে অর্পণ করা হোক। আশা করব রাষ্ট্র ও সরকার সর্বহারা এই মানুষদের প্রতি আরেকটু সদয় হবে।

ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষক সুচিত্রা চাকমা বললেন, "২০১২ সালে সংঘটিত রামু সহিংসতায় আপনারাও তো আমাদের মতো ভুক্তভোগী। মামলার বিষয়ে কিছু ধারণা দেন না।"

আমাদের রামু সহিংসতার ঘটনায় রামু, উখিয়া এবং টেকনাফে দায়ের করা ১৯ মামলার বেশিরভাগে পুলিশ ছিল বাদী। রামুর মোট মামলা ছিল ৮টি। এর মধ্যে একটিমাত্র মামলার বাদী ছিলেন অন্য কেউ। চাপে পড়ে বাদী গত বছর মামলাটির মীমাংসা করে ফেলেছেন। ওই মামলার সব আসামী খালাস পেয়ে গেছেন।

বাস্তবতা হল, অধিকাংশ মামলার বিচারকার্য এখন সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে। রামুর কয়েকটি মামলা নতুন করে তদন্তের জন্য পিবিআইকে দেওয়া হয়েছে। রামু সহিংসতার মামলা, আসামী এবং অভিযোগপত্র সব নিয়েই বিতর্ক ছিল। ঘটনার পাঁচ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এখনও কুলকিনারা হচ্ছে না।

লংগদু সহিংসতায় পুলিশ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে যেসব মামলা করা হয়েছে সেসবে নির্দোষ কোনো বাঙালি যাতে হয়রানির শিকার না হন সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এই ঘটনার যাতে রাজনৈতিক এবং দলীয়করণ করা না হয় সেদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের সজাগ থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে কিছু সুবিধাভোগী তথাকথিত নেতা থাকেন সব সময়। এরা যাতে কিছুতেই প্রশ্রয় না পান সেটাও দেখতে হবে। অন্যথায় লংগদু সহিংসতায় সুবিচার আদৌ মিলবে না। যেভাবে এখনও আলোর মুখ দেখেনি রামু সহিংসতার বিচার।

নুরুল ইসলাম নয়নকে যারা হত্যা করেছে তারা অবশ্যই জঘন্য অপরাধী। তার পরিবার ন্যায্য বিচার প্রাপ্য। তবে এজন্য পাহাড়িদের শত শত ঘরবাড়ি লুটপাট এবং জ্বালিয়ে দিতে হবে? একটা অপরাধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর আদৌ কি প্রয়োজন ছিল? নাকি এর কোনো যৌক্তিকতা আছে? এমনকি ওই জ্বালাও-পোড়াও ঘটনায় একজনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদ এবং প্রতিক্রিয়া যদি এভাবেই হতে হয় তাহলে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আইন-আদালতের প্রয়োজন কী?

২০১২ সালে ধর্ম-অবমাননার অভিযোগ তুলে ঠিক এভাবে রামু-সহিংসতা ঘটিয়ে আমাদের নিঃস্ব করা হয়েছিল। এক দল লোক কোনো-না-কোনো অজুহাত তুলে ভিন্ন মতাদর্শের ও সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও লুটপাট করবে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে, তারপর এটা নিয়ে রাজনীতি করা হবে, এই যেন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। এরপর কেউ এর দায় স্বীকার করবে না, সে-ও যেন স্বাভাবিক!

পাহাড়ে কিংবা সমতলে আজ পর্যন্ত যত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে সব ক্ষেত্রে একই আচরণ করা হয়েছে। লংগদুর ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসন দায় এড়াতে পারে না। কারণ তারা চাইলে এমন ঘটনা ঘটবার সুযোগই মিলবার কথা নয়। পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে যেহেতু আড়াআড়ি একটা বিষয় রয়েছে, তাই নয়ন হত্যাকাণ্ড কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটতে পারে এমন আশঙ্কা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের মধ্যে থাকার কথা।। তাছাড়া ১৯৮৯ সালে ঠিক একইভাবে লংগদুতে সহিংসতা ঘটানো হয়েছিল। তাহলে শত শত বিক্ষুব্ধ জনতাকে কেন মিছিল করার সুযোগ দেওয়া হল? কেন নিশ্চিত করা হল না পাহাড়িদের নিরাপত্তা?

রামু, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ, লংগদুসহ সারাদেশে একের পর এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে চলেছে। যেসব ঘটনায় জনগণের চাপ থাকে সেটা নিয়ে কিছুদিন হৈচৈ হয়। তারপর নতুন ঘটনা ঘটে। রাতের আঁধারে কিংবা দিবালোকে ঘটা এসব সাম্প্রদায়িক হামলার ইন্ধনদাতা, পরিকল্পনাকারী, হামলাকারী এবং প্রশ্রয়দাতাদের কেউ ধরা পড়ে না, হয় না কারও বিচার। এসব ঘটনার কোনো একটির ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারেনি।

উলটে দেখা যায়, অপরাধীরা রাজনৈতিক পরিচয় এবং ছত্রচ্ছায়ায় সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষেত্রে কোনো দল বা মত কাজ করে না। এখানে মুখ্য হয়ে যায় ধর্ম এবং সম্প্রদায়।

কথাগুলো অনেকের কাছেই খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। অত্যন্ত দুঃখজনক হল যে, যে জাতি যাবতীয় শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং অত্যাচার থেকে মুক্তিলাভের জন্য বীরের মতো যুদ্ধ করে রক্তের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে, সেই একই জাতির কিছু মানুষ স্বাধীন দেশে একই অপরাধ করছেন। এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রতিরোধে রাষ্ট্রও কার্যকর ও স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।

পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়ি-বাঙালিদের উচিত হবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে নিজ নিজ দাবি আদায়ের দিকে গুরুত্বারোপ করা। কেউ যাতে তাদেরকে নিয়ে খেলতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা। অন্যতায় পাহাড়ে অশান্তি জিইঁয়ে থাকবে। এতে পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়ি-বাঙ্গালি কারো মঙ্গল হবে না।