শিক্ষা-সংস্কার প্রস্তাবকারী ঢাবি উপাচার্য ‘শিক্ষাদূত’ হোন

সৌমিত জয়দ্বীপসৌমিত জয়দ্বীপ
Published : 16 Nov 2011, 11:32 PM
Updated : 16 August 2017, 02:26 PM

ভিনদেশে থাকার সুবাদে বুঝতে পারি আমাদের দেশের যে বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি সেটা অনেকাংশে শুধু ভালো নয়, দুর্দান্ত। আমার মনে হয়েছে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থা পূর্ণ বিকশিত রূপে দেখা দিলে শিক্ষার্থীদের পরিপক্কতার মাত্রা আরও বাড়বে। এমনিতে যদি আপাতভাবে তুলনা করি, প্রতিবেশি দেশগুলোর স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় আমাদের শিক্ষার্থীদের পরিপক্ক ও বিকশিত হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি।

উদাহরণস্বরূপ বলি, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কাটাই পাঁচটা শিক্ষাবর্ষ। বিপরীতে ভারতের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্যতিক্রমগুলোর মধ্যে দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য) শিক্ষার্থী শুধু স্নাতকোত্তরের এক বা দুই শিক্ষাবর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে কাটানোর সুযোগ পায়। স্নাতক পর্যায়টা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কোনো কলেজে পড়েই অতিবাহিত করতে হয়। পৃথিবীর বহু দেশে এটাই ব্যবস্থা। জগদ্বিখ্যাত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন অক্সফোর্ড, এমন অসংখ্য অধিভুক্ত কলেজের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছে তার বিশ্ববিদ্যালয়-কাঠামো।

প্রশ্ন হতে পারে, এত সুযোগ পাওয়ার পরও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক মানদণ্ডে পিছিয়ে পড়ছে কেন? এর সহজ উত্তর হতে পারে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকৃত অর্থে গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় মূলত গবেষণাকাজের জন্যই স্বীকৃত শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। দুনিয়ার তামাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক অবস্থান তাই নিত্যনতুন বিষয়াদি নিয়ে গবেষণার সাফল্যের ওপর নির্ভর করে। ঠিক এখানেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়ছে।

আমাদের লেখাপড়া ঠিক গবেষণা-মনন নিয়ে গড়ে ওঠে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমও সে মাত্রায় গবেষণাধর্মী কাজে উৎসাহিত করার মতো নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রশ্নপত্র দেখলেই আপনি বুঝবেন, আদতে স্কুল-কলেজে পড়ে আসা প্রশ্নকাঠামোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর তেমন হেরফের নেই। কি, কী, কেন, কীভাবে, কোথায়, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-আলোচনা ইত্যাদি রয়ে গেছে আমাদের চিরাচরিত পরীক্ষাসংক্রান্ত প্রশ্নের ধারা– শিক্ষাস্তরের শুরু থেকে একদম শেষাবধি। যেন এসব পরীক্ষা দিয়ে আমরা মস্ত বড় গবেষক তৈরি করে ফেলতে পারি!

এ ধরনের পরীক্ষাধারা আসলে গবেষক তৈরি করে কম– যতটা না তৈরি করে প্রতিযোগী ও পরীক্ষার্থী। উত্তরপত্র লেখার মুখস্থ-মনন দিয়ে তাই জিজ্ঞাসু মন তৈরি হয় না। সম্ভবও নয় সেটা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো 'মাইর' খাচ্ছে আসলে ওখানে।

গবেষণার বিষয়েও কিছু কথা বলা যেতে পারে। যারা গবেষণা করেন সাধারণত বাংলাদেশে তারা সময় পান খুব কম। দেখা যায় অধিকাংশই 'রেগুলার রিসার্চার' নন। কোনো একটা কর্মক্ষেত্রে যুক্ত থেকে তাদের গবেষণা (এমফিল-পিএইচডি) করতে হয়। এটা অত্যন্ত দূরুহ বিষয়। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যারা নিয়মিত গবেষণা করেন কিংবা 'পেশাগত পদোন্নতির স্বার্থে' যাদের গবেষণা করতে হয়, তাদের অধিকাংশ সময় চলে যায় স্নাতক প্রথম বর্ষ থেকে স্নাতকোত্তর, এই পাঁচ ক্লাসের লেকচার প্রস্তুত, প্রশ্নপত্র তৈরি, পরীক্ষা হলে দায়িত্ব পালন ও পরবর্তী সময়ে উত্তরপত্র নিরীক্ষণ এবং একইভাবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র তৈরি, উত্তরপত্র নিরীক্ষণ, মৌখিক পরীক্ষায় পরীক্ষক হিসেবে যাওয়া, গবেষণার তত্ত্বাবধায়ন করা এবং অবশ্যই শিক্ষক-রাজনীতির দল-আনুগত্য ইত্যাদি 'মহান' কাজে ব্যস্ত থাকা নিয়ে।

তার উপর গবেষণাকাজে রাষ্ট্রীয় আর্থিক বরাদ্দ 'জঘন্য' পর্যায়ের। গবেষণাকাজে বাজেট এতে কম কেন হয়, এই 'প্রবলেম কোয়েশ্চেন' সামনে রেখেই বরং গবেষণা হওয়া উচিত। সঙ্গে গবেষণার গুরুত্বের চেয়ে গবেষকের ডিগ্রি লাভ, সামাজিক ও পেশাগত অবস্থান অলংকৃত-উন্নত করার বৈষয়িক মনোবাসনা গবেষণার 'বারটা থেকে তেরটা' বাজিয়ে দেয়। এ অবস্থায়, বিশ্বমানের গবেষণা আশা করাই উচিত নয়। তারপরও যদি এদিক-ওদিক আকছার দু-একটা বড় ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে বুঝতে হবে, 'গোবরে পদ্মফুল' ফুটেছে!

আবার ভাবুন, সেই একই ব্যক্তি যদি ভিনদেশে গিয়ে গবেষণা করেন, তবে তার গবেষণার মান উন্নত পর্যায়ের হয়। কেন? কেনই-বা 'বিদেশি ডিগ্রি মানসম্পন্ন হয়, কিন্তু আমাদেরটা হয় না' বলে ধারণা তৈরি হয়েছে? এ কি তবে মেধার পার্থক্য? আমরা কি মেধাবী নই? কিন্তু মেধা কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন সময়-সুযোগ-অর্থ-লোকবলের প্রতুলতা। এখানেই 'ওদের-আমাদের' পার্থক্যটা তৈরি হয়ে যায়। তাছাড়া যিনি গবেষকের তত্ত্বাবধায়ক হন তিনিও পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন গবেষককে। গবেষক হয়ে ওঠেন তত্ত্বাবধায়কের সহযোগী। ক্ষেত্রবিশেষে 'টিচিং অ্যাসিটেন্ট' নামক একটি পদও গবেষক অলঙ্কৃত করার সুযোগ পান।

একটা সমীকরণ মিলিয়ে নিলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত দুটো ধারায় কাজ করছে। প্রথমটি হলে গবেষণা, যেটাতে সামগ্রকিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যর্থ এটা বলতে হবে। দ্বিতীয়টিতে প্রতিষ্ঠানগুলো আবার দারুণ সফল– একজন ১৯-২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীকে পাঁচ-ছয় বছরের ক্যাম্পাসজীবনের পরিক্রমায় বিকশিত ও পরিপক্ক করে তুলতে পারছে। এর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমের নয়, করিডোরের জ্ঞানের। বলা হয়ে থাকে, হলজীবনে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের করিডোর থেকেই একজন শিক্ষার্থীর প্রায় ৮০ ভাগ জ্ঞান অর্জিত হয় নানারকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ও অন্যান্য সহপাঠ্যক্রম কর্মতৎ পরতার মধ্য দিয়ে। এই অর্জিত জ্ঞানের সনদপত্র থাকে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঁচ বছরের সবচেয়ে বড় সনদপত্র এটাই। এটি আমরা প্রত্যক্ষ দেখাতে পারি না সত্য, কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়োত্তর জীবনের প্রায় প্রতিটি কর্মকাণ্ড ও কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে এর এক নিবিড় যোগ রয়েছে।

পরীক্ষার খাতায় 'বমি করার' (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়) বদৌলতে যে সনদপত্র আমরা পাই, সেই সনদের টিআরপি বাড়াতে এই ৮০%এর ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। ঠিক এ কারণেই বাজারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর বেশ উঁচা। যদিও করিডোর-কেন্দ্রিক জ্ঞানের মর্যাদা বাজার কোনোদিন স্বীকার করেছে বলে মনে হয় না। তার তো চাই ফলাফল– আরও উন্নত, আরও ভালো ফলাফল। যে ফলাফল মাত্র একটা মানুষের ২০ ভাগকে চেনাতে পারে। অথচ আমরা এটা কোনোদিন অনুধাবন করতে পেরেছি বলে মনে হয় না।

বোঝা যাচ্ছে যে, মানসিকভাবে বিকশিত ও পরিণত হওয়ার সঙ্গে ভালো গবেষক হওয়ার বা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সফল হওয়ার সম্পর্ক অন্তত বাংলাদেশে নেই। অথচ ঠিক উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। যার বিকাশ যত সমৃদ্ধ হবে, সে তত ভালো গবেষক হয়ে উঠবে। দুঃখের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দ্বিতীয়বার জন্ম দিয়ে 'দ্বিতীয় জন্মের আঁতুড়ঘর' হলে ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতের যুগস্রষ্টা গবেষক হিসেবে গড়ে তোলার পাঠ দিতে পারল না। আজকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠেছে এক একজন সরকারি চাকুরি তথা বিসিএস ক্যাডার তৈরির অদ্ভুত কারখানা। নইলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার এত দুর্দান্ত কাঠামো থাকার পরও, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে টক্কর দিতে না পারার অলৌকিক কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।

২.

এখন অনিবার্যভাবেই একটু নিচে তাকানো দরকার। নিচে বলতে, শিক্ষাস্তরের প্রাথমিক-মাধ্যমিক পর্যায়ে তাকানোর কথা বলছি। এতক্ষণ 'ধান ভাঙতে শিবের গীত' গাওয়া মূলত এই নিচে তাকানোর নিমিত্তেই। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আলোচনা যেহেতু শেষ, সেহেতু গবেষণা নিয়েই আলোচনারও আর প্রয়োজন নেই এই লেখায়। বাকি রইল, শিক্ষার্থীর বিকশিত হওয়ার ব্যাপারটি। শৈশব থেকে কৈশোর থেকে যৌবন পর্যন্ত মানুষের বিকশিত হওয়া একটি প্রাকৃতিক ঘটনা এবং এই বিকাশ কখনও থেমে থাকে না। কিন্তু প্রশ্নটা হল, সেই বিকাশ কি শুধুই শারীরিক-মানসিক বিকাশেই সীমাবদ্ধ থাকবে? শিক্ষার সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তির একটা নির্মোহ যোগ আছে। সেটা কতটা হচ্ছে? একটা দেশ, একটা সমাজকে বদলে দেওয়ার জন্য সেই বিকাশই সবচেয়ে জরুরি। নয় কি?

প্রাথমিক-মাধ্যমিক পর্যায়ে কতটা বিকশিত হয় আমাদের শিক্ষার্থীরা? বিশেষত, এই বহুধাবিভক্ত বাণিজ্যমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থায়? এটা সত্য যে, আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষাধর্মী বানিয়েছি। আমরা শিক্ষার্থী বা বিদ্যার্থী নয়, শেষ পর্যন্ত একজন ছাত্র বা ছাত্রী পরীক্ষার্থী হিসেবে কতটা ভালো, কতটা ভালো তার ফলাফল সেটা দিয়ে সেই বহুযুগ ধরে মেধার মূল্যায়ন করেছি। কথায় কথায় আমরা রবীন্দ্রনাথ কী নজরুল কী বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে আইনস্টাইনের স্কুল ফেইল বা স্কুল পালানোর পরও প্রতিভার বিকাশের চূড়ায় ওঠার উদাহরণ টেনেছি বটে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা আইনস্টাইনরা যে রকম শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন, সে দিক খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছি। তা না হলে যে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করার পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে যায়! শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যবসা করা যে রীতিমতো 'অপরাধ', সেটা ভয়ঙ্কর কোনো সর্বনাশা শক্তির প্রশ্রয়ে আমলেই নিইনি!

৩.

এতেক্ষণ যা বলা হল, সে সব কিছুর পেছনে প্রধান দায় মূলত সিস্টেমের এবং সিস্টেম যারা বানান তাদের। সঙ্গে দায় অংশত শিক্ষকদেরও। কেননা তারাই সিস্টেম টিকিয়ে রেখেছেন এবং সেটা শিক্ষার্থীদের প্রায় বিনাপ্রশ্নেই মেনে নিতে হয়, হচ্ছে। এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই হচ্ছে না, আমাদের পুরো শিক্ষাস্তরেই চলছে এমনধারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, যাদের পরিবর্তনের দিশারী মনে করা হয়, তারা এই গৎবাঁধা সিস্টেম বদলাতে পারেনি– বরং লেজুড়বৃত্তির দলীয় রাজনীতিতে ব্যস্ত থেকে, গৌরবময় ছাত্ররাজনীতি দংশন করে সিস্টেমের দাসত্ব করেছে। যারা লড়াই করেছে বা করছে তারা সমস্যা দেখায় বটে, সমাধান দেখাতে পারে না। ফলত, যে শিক্ষার্থীরা প্রথম-দশম শ্রেণি বা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে, বয়সের কারণেই তাদের কাছে ব্যবস্থা-বদলের আবদার করা হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে নিশ্চয়ই কোনো এক শক্তিশালী ইমেজ দরকার, যেখান থেকে এই পরিবর্তনের আওয়াজ আসতে পারে।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে আপাতত সেই শক্তিশালী ইমেজ সরকারের সমর্থনধন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেই বলতে হবে। বিশেষত, সেই ব্যক্তি যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাহলে প্রস্তাবিত পরিবর্তন 'পাস' করা আরও সহজ হয়ে যায়। আর তিনি যদি হন দেশের প্রধানতম বিদ্যাপীঠের অভিভাবক, তাহলে তো কথা নেই।

সম্প্রতি এমন একটি প্রস্তাব হাজির করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর এই প্রস্তাব বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি বলেছেন:

"শিক্ষার্থীরা যাতে লেখাপড়া করার পাশাপাশি খেলাধুলা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে। এজন্য নির্ধারিত মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার আগে সকল বার্ষিক টার্মিনাল পরীক্ষা বাতিল করতে হবে।… ছেলেমেয়েদেরকে এক্সট্রা কারিকুলামের ওপর অতিরিক্ত সময় দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে প্রাথমিক ও জুনিয়র স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো টার্মিনাল পরীক্ষা নেওয়া উচিৎ হবে না।"

আনন্দের বিষয়, তিনিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের শিক্ষা-দর্শনের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। বলেছেন: "সেখানে আপনার চারপাশের পরিবেশকেই টেক্সট বুক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।"

ঢাবি উপাচার্য জাপান ও শ্রীলঙ্কার শিক্ষাব্যবস্থারও উদাহরণ দিয়েছেন। বলেছেন:

"এ সকল দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। জাপানে ৯ম গ্রেড পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। তারা মনে করে, নিয়মিত লেখাপড়ার চেয়ে অন্যান্য কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ছেলেমেয়েদের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ।"

তিনি শিক্ষা পরীক্ষাকেন্দ্রিক ও প্রতিযোগিতানির্ভর করার যে দুরারোগ্য ব্যাধি, সেটারও একদম ফোকাস বিন্দুটি ধরিয়ে দিয়েছেন এভাবে:

"কিছু কিছু অভিভাবকের মধ্যে ছেলেমেয়ের উচ্চতর গ্রেড জিপিএ নিশ্চিত করতে অসুস্থ প্রতিযোগিতার সুযোগ নিয়ে কিছু লোক কোচিং ব্যবসা খুলে বসেছে। এ সকল কোচিং সেন্টার সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় না।"

এছাড়াও তিনি বলেছেন:

"প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।"

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সূত্র দিয়ে ওই প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়েছে, তিনি সরকারি ও বেসরকারি বাংলা ও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল এবং মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অভিন্ন মৌলিক কারিকুলাম চালু করার পরামর্শ দেন। যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানান সুযোগ থাকবে।

যদিও তিনি তাঁর সংস্কার-প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তনের কথা বলেছেন, কিন্তু ঢাবিতে সম্প্রতি সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে তিনি যে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন সেটাও প্রসঙ্গক্রমে এসে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সমাবর্তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছাত্রসংসদ নির্বাচন 'মাস্ট' বলার পরও, ডাকসু নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। উপরন্তু, ২৯ জুলাই সিনেট অধিবেশনের দিন ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানাতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকরা হাতাহাতি করে যে ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, উপাচার্য হিসেবে তিনি সেটার দায় এড়াতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয় যাদের জন্য সেই শিক্ষার্থীদের ৫জন প্রতিনিধিসহ সিনেটের ১০৫টির মধ্যে ৫০টি প্রতিনিধিপদের অনুপস্থিতিতে একজন উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দিয়ে নিজেকে 'লেজিটিমাইস' করে নিচ্ছেন, এটা অন্তত শিক্ষা-সংস্কারের অমন বৈপ্লবিক প্রস্তাব আনা একজন ব্যক্তির কাছে প্রত্যাশা করা যায় না।

মনে হচ্ছে, তৃতীয় মেয়াদে উপাচার্য হওয়ার জন্য তিনি মরিয়া বটে। অবশ্য সরকারের উপরমহল থেকে 'গ্রিন সিগন্যাল' না পেলে সাধারণত এমন মনোভাব কারও থাকার কথা নয়। কিন্তু আট বছর দায়িত্ব পালনের পর তিনি ২৪ আগস্ট সসম্মানে বিদায় নিতে পারতেন। বিদায় নিয়ে হয় নিজের বিভাগে ফিরে যেতে পারতেন, নতুবা প্রেষণে মহাগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে সরকারের 'বিশেষ শিক্ষাদূত' হিসেবে নিজের এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে কাজ শুরু করতে পারতেন। বলাবাহুল্য, উপাচার্য নির্বাচন নিয়ে বিতর্কিত হওয়ার আগেই তিনি প্রস্তাবগুলো দিয়েছিলেন। ফলে, তাঁর সামনে আরও দূরদর্শী হওয়ার সুযোগ ছিল। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা-সংস্কারের মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে, বাংলাদেশে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সন্দেহ নেই, তিনি যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন সেগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বিপ্লব ঘটে যাবে। বিশেষত, প্রথম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত যদি কোনো বার্ষিক পরীক্ষা না থাকে, যদি দশম শ্রেণির পরই একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সত্যকার অর্থেই শৈশব-কৈশোরে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর যে মানসিক চাপ প্রয়োগ করে রাখা হয়েছে তার বিলুপ্তি ঘটবে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথা হলে, 'বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটি বাঁধবে কে?'

সরকার বরং তাঁকেই 'শিক্ষাদূতে'র মর্যাদায় আসীন করে ঘণ্টা বাঁধানোর মহাগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে পারে।

৪.

আমরা জানি, সংবিধান অনুযায়ীই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অসীম। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁর ক্ষমতা আরও অসীম। সুতরাং আমরা আশা করতে পারি যে, ঢাবি উপাচার্যের জনমুখী ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠা প্রস্তাবটি যদি বাস্তবায়ন করতে হয় অর্থাৎ বিড়ালের গলায় যদি ঘণ্টাটি বাঁধাতে হয়, তাহলে সরকারের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীকেই উদ্যোগ নিতে হবে। গোলটা এখানেই বেঁধেছে। প্রধানমন্ত্রী যে ঢাবি উপাচার্যের প্রস্তাবের প্রায় ছয় মাস আগেই বলে দিয়েছেন যে, তিনি পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা অব্যাহত রাখার পক্ষে। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৭ উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন:

"সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে বোর্ডের পরীক্ষার ভীতি দূর করা, মেধাবী ও দরিদ্রদের মাঝে বৃত্তির নিয়মানুযায়ী বৃত্তি প্রদানের সুবিধার্থে পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা ২০০৯ সালে চালু করা হয়।… আমি দেখলাম হঠাৎ এই দুইটি পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে কিছু কিছু সমালোচনা শুরু হয়ে গেল এবং এই পরীক্ষা বন্ধ করারও দাবি উঠল। কিন্তু তাদের এই দাবি মোটেও বাস্তবসম্মত নয়।"

নিজের যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন:

"ক্লাস ফাইভে এবং ক্লাস এইটে আগে থেকেই বৃত্তি দেওয়া হত। তাই বৃত্তি পাওয়ার জন্য উভয় ক্লাস থেকেই কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে বেছে নিয়ে আলাদাভাবে ক্লাস করানো হত। কিন্তু এই শিক্ষার্থীদের বাইরে যারা ছিল তারা অবহেলিতই থেকে যেত। বাদ পড়ে যাওয়া এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যেও কিন্তু মেধাবী থাকতে পারে, যাদের মূল্যায়ন হত না। সে জন্য আমি চিন্তা করলাম সবাই পরীক্ষা দেবে। সেখান থেকে যারা মেধাবী বা দরিদ্র, অসচ্ছল তাদের যে নিয়মমতো বৃত্তি দেওয়া হয় সেভাবে বৃত্তি দেওয়া হবে।"

কচি বয়সেই একটি বোর্ডের সার্টিফিকেট পাওয়া অত্যন্ত সুখকর অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন:

"স্কুলে ভর্তির ১০ বছর পর (এসএসসি) আগে শিক্ষার্থীরা একটা সার্টিফিকেট পেত। আর সেখানে ক্লাস ফাইভেই তারা যদি একটি সার্টিফিকেট পেয়ে যায় তাহলে বিষয়টি যেমন ভালো লাগে, তেমনি তাদের সেলফ কনফিডেন্সও বৃদ্ধি পাচ্ছে।"

৫.

আমরা পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের প্রধানতম নীতিনির্ধারক ও বাংলাদেশের প্রধানতম বিদ্যাপীঠের প্রধান নীতিনির্ধারক একদমই বিপরীতমুখী দুটি মতামত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত সনদীয় পরীক্ষাপদ্ধতির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। গভীরভাবে দেখলে বুঝবেন, চিন্তার দিক দিয়ে ঢাবি উপাচার্যের প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর অভিমতের চেয়ে অনেক প্রাগসর ও যুগোপযোগী। প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারেন। আর যেহেতু একজন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ শিক্ষা-সংস্কারের পক্ষে কথা বলেছেন, ফলে এখানে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ দেখার সুযোগ নেই। বরং রাজনীতিক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর উপাচার্যের প্রস্তাবটি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষা নিয়ে শিক্ষাবিদদের চিন্তাভাবনা ও সংস্কার প্রস্তাবের যদি মূল্যই না থাকে, তাহলে একা রাজনীতিবিদরা দেশ চালাতে পারবেন বলে মনে হয় না।

যদি এমনও হয় যে, এসএসসির আগে শুধু পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা থাকবে, আর কোনো ধরনের বার্ষিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের কোনো শ্রেণিতেই দিতে হবে না, তবুও একটা শিক্ষা-সংস্কার আদতে আনা অনিবার্যভাবেই প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজনে জাতীয় উন্মুক্ত আলোচনা কিংবা জাতীয় কনভেনশন হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর সামনেই ঢাবি উপাচার্য (নাকি 'বিশেষ শিক্ষাদূত') তাঁর প্রস্তাব পেশ করবেন। দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদরাও আলোচনায় মতামত দেবেন। তবুও এই রুগ্ন অবস্থার প্রতিকার জরুরি। কবি শহীদ কাদরী লিখেছিলেন, 'রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো?'

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি মেনে নেবেন আমাদের প্রস্তাবগুলো?

৬.

শিক্ষার কথা যখন আসে, তখন সারা বিশ্বেই এখন একটা দেশের কথা সবার আগে একযোগে আসে। দেশটির নাম ফিনল্যান্ড। পৃথিবীতে শিক্ষাক্ষেত্রে নর্ডিক অঞ্চলের যে দেশটির অবস্থান এখন এক নম্বর। অথচ দেশটিতে ৭ বছরের আগে শিশুদের স্কুলে যেতে হয় না। ১৬ বছরের আগে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী হতে হয় না। 'হোমওয়ার্ক' করতে হয় বড়জোর ২০ মিনিট। স্কুল আর বিদ্যার্জন মানে খেলাধুলা ও অফুরন্ত আনন্দ। তবুও সবচেয়ে বিস্ময়কর হল, পিসার (Programme for International Student Assessment – PISA) গণিত, বিজ্ঞান ও পঠন পরীক্ষা ২০১৫তে ফিনল্যান্ডের ১৫ বছর বয়সী বিদ্যার্থীদের জয়জয়কার এবং সবগুলো বিভাগেই দেশটির পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ওইসিডির সর্বোচ্চ গড়ের চেয়েও বেশি নম্বর তুলেছে। ২০০০ সালে প্রবর্তিত পিসা চালু হওয়ার পর থেকেই ফিনিশরা একদম সেরাদের কাতারে নাম লিখিয়েছে। কীভাবে এটা সম্ভব? তাদের তো পরীক্ষা দেওয়ারই অভিজ্ঞতা বা চর্চা নেই এই বয়সে, তাহলে কীভাবে তারা সারাবিশ্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাচ্ছে?

শিক্ষাক্ষেত্রে 'ফিনল্যান্ড মডেল' নিয়ে দেশে দেশে গবেষণা হচ্ছে। অক্সফোর্ড-হার্ভার্ডের অধ্যাপকরা এই গবেষণাকাজে নিবিষ্ট হয়েছেন। মাইকেল মুরের মতো জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকরা দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিখ্যাত, সেই যুক্তরাষ্ট্রে পর্যন্ত ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি উঠেছে।

প্রসঙ্গক্রমেই, পাসি শলবার্গের নাম করতে হচ্ছে। ৫৭ বছর বয়সী ভদ্রলোক দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের প্রধান। নব্বই দশকের শুরুর দিকে তিনি ছিলেন ফিনল্যান্ডের সর্বশেষ প্রধান স্কুল পরিদর্শক। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের আর প্রয়োজন নেই, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উপরে তুলে ধরার জন্য শিক্ষকসমাজই যথেষ্ট। সেই শলবার্গ আজ ফিনল্যান্ডের 'বিশ্ব শিক্ষাদূত'। তাঁর বই 'ফিনিশ লেসনস' পৃথিবীর পনেরটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি নিজেও আজ এখানে তো কাল ওখানে, দেশ থেকে দেশে ছুটে চলেছেন। বক্তৃতা দিচ্ছেন তাঁর দেশের এমন বিস্ময়কর সাফল্য নিয়ে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বিশেষ নিমন্ত্রণ দিয়ে আনতেই পারে। নয় কি?

তার আগে, চাইলে এই মুহুর্তেই, প্রধানমন্ত্রী এক নির্বাহী আদেশে পরীক্ষা নামের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৬ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের রক্ষা করতে পারেন। হলে, আগামীকাল এক নতুন বাংলাদেশের জন্ম হবে। বাজি ধরে বলা যেতে পারে, সেই নতুন দেশে সবচেয়ে আনন্দময় মুখগুলো হবে এই ছেলেমেয়েদের। আগামীকাল থেকে তারা স্বাধীন, বুক থেকে নেমে যাবে বিশাল এক জগদ্দল পাথরের চাপ। কাঁড়ি কাঁড়ি পুস্তক মুখস্থের বোঝা থেকে তাদের শৈশব-কৈশোর রক্ষা করা হবে। তাদের নিয়ে ব্যবসা বন্ধ হবে। তারা আনন্দ নিয়ে পড়বে– যা খুশি তাই করবে খেলাচ্ছলে– যা মনে চাইবে তা-ই হবে, ফিনল্যান্ডের শিশুদের মতো। জগতে শিশু-কিশোরদের সুখী মুখ দেখার চেয়ে আনন্দ আর কী-ই-বা হতে পারে?

হ্যাঁ, এখানেই লুকিয়ে আছে শিশু-কিশোরদের সর্বতোভাবে বিকশিত হওয়ার মহৌষধ। এই বিকশিত মননই শিশুমনে এক একজন দুর্দান্ত গবেষকের জন্ম দেবে ভবিষ্যতের জন্য। গবেষক হঠাৎ করে সৃষ্টি করা যায় না। শিশুকাল থেকেই এই পরিচর্যা শুরু করা দরকার। দেখা যাক সব চাহিদা পূরণ হলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বমানের গবেষণার শিরোনাম হতে পারে কি না।

আমাদের ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়, শিক্ষাক্ষেত্রে সেই স্বপ্নটা দেখানো হয় না কেন? স্বপ্ন সত্য হবে। সবার আগে, শিক্ষার্থী-বিদ্যার্থীদের পরীক্ষার্থী হওয়ার জেলখানা থেকে পরিত্রাণ দিন।

অধ্যাপক ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক, এমন যুগোপযোগী শিক্ষা-সংস্কার প্রস্তাবের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য তাঁর শিক্ষা-সংস্কার সংক্রান্ত দারুণ প্রস্তাব। যদিও উপাচার্য পদ নিয়ে চলমান বিতর্কটি প্রসঙ্গক্রমে আনতে হল, তবুও বলি তাঁর এখন আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে সীমাবদ্ধ থাকার প্রয়োজন নেই। এবার নিজের প্রস্তাবিত শিক্ষাসংস্কারে মনোযোগ দিলেই তিনি দূরদর্শতিার প্রমাণ দিবেন। পাসি শলবার্গ যদি ফিনল্যান্ডের 'বিশ্ব শিক্ষাদূত' হতে পারেন, এমন দুর্দান্ত প্রস্তাবের পর তিনি তো বাংলাদেশের 'জাতীয় শিক্ষাদূত' হতেই পারেন।