বিত্তবানদের স্বার্থেই কি বিত্তহীনদের উচ্ছেদ?

কার্স্টেন হাকেনব্রোখ
Published : 9 April 2012, 05:12 PM
Updated : 9 April 2012, 05:12 PM

গত বুধবার, ৪ এপ্রিল ২০১২, তারিখে রাজধানীর করাইল বস্তির কিছু অংশ উচ্ছেদ করা হয়েছে। আমরা আমাদের গবেষণার জন্য দীর্ঘদিন ধরে করাইলে বাস করি এবং সেই সুবাদে আমরা বস্তিবাসীর প্রাত্যাহিক জীবন সম্পর্কে সুগভীর ধারণা লাভ করেছি। আমাদের সেই ধারণা করাইল সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার থেকে অনেকখানিই ভিন্ন। এই অপ্রচলিত অথচ সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমরা করাইলের বর্তমান উচ্ছেদ অভিযান এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি ।

ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, দুই ব্যাটালিয়ন পুলিশ ফোর্স আর বেশ কিছু ভাড়াটে শ্রমিক করাইলের এই উচ্ছেদ অভিযান চালান। অধিবাসীরা নিরাপদে স্থান ত্যাগ করেছে কিনা অথবা তাদের সীমিত জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে পেরেছে কিনা-সে ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ না করেই জোড়া বুলডোজারের ধাক্কায় অবহেলিত কাঠামোগুলি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। মঙ্গলবার বিকেলে অর্থাৎ উচ্ছেদের আগের দিন, লেক এর আশেপাশের এলাকার ঘরগুলো উচ্ছেদ করার কথা অধিবাসীদের জানানো হয়। সেখানকার লোকজন সেই মোতাবেক তাদের জিনিসপত্র সরাতে শুরু করে। কিন্তু পরদিন বিস্মিত অধিবাসীরা দেখে, বাড়িগুলো লেক সংলগ্ন কিনা সেটা বিবেচনা না করেই সমস্ত বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ২৫ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে দেয়া হাইকোর্টের নির্দেশে করাইল এবং এর সংলগ্ন বস্তি পুরোপুরি সরিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়, যার ভিত্তিতে চলে ৪ এপ্রিল ২০১২ তারিখে উচ্ছেদ অভিযান।

এই উচ্ছেদ অভিযানে বুলডোজারের মাধ্যমে অধিবাসী এবং তাদের সীমিত সহায়-সম্পত্তি আক্ষরিক অর্থেই পদদলিত করা হয় যা মানবাধিকার পরিপন্থী। যথাযথ অবহিতকরণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্থ অধিবাসীরা কোন বিকল্প খুঁজে নেয়ার সময় পায়নি। ধ্বংসযজ্ঞ শেষে তারা একই জায়গায় রয়ে গেছে, কিন্তু তাদের মাথার উপর নেই ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার আশ্রয়, নেই দৈনন্দিন ব্যবহারের পানির যোগান কিংবা টয়লেট সুবিধা। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কোন রকম সাহায্যের ব্যবস্থাও করা হয়নি। বস্তির যে অংশ উচ্ছেদ থেকে আপাত রেহাই পেয়েছে, সেখানে খাবার রান্না করা হয় এবং ক্ষতিগ্রস্থ জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। স্কুলগুলোকেও গুঁড়িয়ে দেয়া হয় এবং স্কুলের ক্লাস এবং পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, করাইলে সরকারী জমির অবৈধ দখল প্রতিহত করতেই এই উচ্ছেদ অভিযান। উচ্ছেদের পরে প্রকাশিত খবরগুলোতেও অবৈধতা ও অপরাধপ্রবণতার কথা বলে সরকারের এই বক্তব্যকে সমর্থন করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গী পুরোপুরি একপাক্ষিক এবং বাস্তবতাবিরোধী। দরিদ্রগোষ্ঠীমাত্রই অপরাধী-এই ধারণা অমূলক। বরং নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে তারা ব্যস্ত। অধিকাংশ নাগরিক সুযোগ তারা ভোগ করতে পারে না। শহরের দরিদ্রগোষ্ঠীকে অপরাধী হিসেবে প্রচার করতে সরকার বদ্ধপরিকর, অথচ উচ্চবিত্তদের অবৈধ দখল প্রসঙ্গে সরকার উদাসীন। গুলশান লেক শুধুমাত্র করাইলের দিক থেকে নয়, গুলশান, মহাখালী এবং বনানীর দিক থেকেও দখলকৃত। অথচ হাইকোর্ট আদেশের পরেও সেই অংশ দখলমুক্ত করতে সরকারের কোন উদ্যোগ নেই। এটা পুরো শহরেই সরকার কর্তৃক উচ্চবিত্তদের অবৈধ কার্যক্রম সমর্থন করার একটা ছোট উদাহরণ। এই উচ্চবিত্তদের অবৈধ কার্যক্রম বেঁচে থাকার উপায় নয়, বরং সরকারী সম্পদ ব্যবহার করার সুকৌশলী এবং লাভজনক ব্যবসা। যতক্ষণ পর্যন্ত শহরের দরিদ্রদের ন্যূনতম চাহিদা মিটানোর জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো তৈরী করা হচ্ছে না, ততদিন পর্যন্ত তাদের অবৈধ দখল উচ্ছেদের কারণ হতে পারে না। সরকারের উচিত উচ্চবিত্ত ও ভুমিদস্যুদের মুনাফাকেন্দ্রিক অবৈধ দখল থেকে সহানুভূতিশীল দৃষ্টি সরিয়ে দরিদ্রদের এই দখলকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে দেখা।

এই উচ্ছেদের পর ক্ষতিগ্রস্থ অধিবাসীদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গ আবারো পেশাদারী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত সমাধান হচ্ছে বহুতল ভবনের ফ্ল্যাট প্রদান। কিন্তু বংলাদেশের নিম্নবিত্তদের জন্য এই ধরণের সমাধানের অতীত ইতিহাস খুব একটা সুখকর না। অনেকগুলো জটিল কারণে এই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত নিরর্থক প্রতিপন্ন হয়। বর্তমান সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ফ্ল্যাটগুলোর বিতরণ শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোর প্রকল্প কিনে নেয়ার মাধ্যমে সবসময় দূর্নীতি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আবার, পুনর্বাসন প্রকল্পগুলো মূল শহর এলাকার বাইরে করার মাধ্যমে দরিদ্র্যগোষ্ঠীর শহরের অর্থনীতিতে অবদান রাখার ব্যাপারটাকে এবং তাদের কর্মস্থল নিজ বাসস্থান থেকে স্বল্পদূরত্বে রাখার প্রবণতাকে অবহেলা করা হয়। বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটগুলোতে পুনর্বাসন তাদের বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠা পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিক যোগাযোগকে ধ্বংস করে দেয় এবং তাদের প্রাত্যাহিক জীবনযাপনকে আমূল বদলে দেয়। আসলে পুনর্বাসন পরিকল্পনার জন্য বড় ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততার প্রয়োজন যা একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া এবং যার অনুপস্থিতিতে পরিকল্পনার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং সরকারী কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গী ও আচরণও একটি সফল পূনর্বাসন কর্মসূচীর পরিপন্থী।

এই ধরণের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াগুলোর অনেক সীমাবদ্ধতা এবং ব্যর্থ হওয়ার ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও এগুলো নিয়ে বারবার আলোচনার পিছনে অনেকের স্বার্থ জড়িত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যারা উচ্ছেদ অভিযানের পরপরই পুনর্বাসন পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাদের মধ্যে নিজেকে লাভবান করার প্রবণতাই বেশি। প্ল্যানিং কনসাল্ট্যান্সি, হাউজিং কন্সট্রাকশন ফার্ম অথবা প্রাইভেট রিয়েল এস্টেট গুলি সমান্তরালভাবে সম্পৃক্ত থাকার ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। এই গুরুতর বাধা আর পক্ষপাতদুষ্ট স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টাকে পিছনে ফেলা তো রয়েছেই, সেই সাথে করাইলের মত জনসমাজের যোগ্যতাকে মাথায় রেখে প্রয়োজন বিভিন্ন ধরণের সমাধান প্রণয়ন করা। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত শহরের দরিদ্রজনগোষ্ঠীর যথাযথ আশ্রয় প্রদানের পরিবেশ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিশ্চিত করা।

"সবার জন্য শহর"-এই ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করতে একটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রয়োজন এবং তা হল-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শহরে বাস করার সমান অধিকার আছে। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজার ইচ্ছাকে অপরাধ হিসেবে না দেখে তাদেরকে শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হবে। ডগ শান্ডার এর নব্য প্রকাশিত বই "আ্যরাইভাল সিটি" তে তিনি বলেছেন, দরিদ্রজনগোষ্ঠী শহরকে সুন্দর ও স্পন্দনময় করে তুলতে পারে যদি অনিশ্চয়তায় না রেখে তাদেরকে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সরকার যা করতে পারে তা হল, লেক সংলগ্ন এলাকার সীমানা নির্ধারণ করে বাকি অংশ করাইল অধিবাসীদের এজারা দেয়া। এর ফলে করাইল এলাকা হিসেবে মজবুত হবে এবং এর অধিবাসীরা বৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে। সুনির্দিষ্ট সীমানা থাকলে করাইলবাসীরা নিয়মানুগভাবে লেক সংলগ্ন এলাকার দখল প্রতিহত করতে পারবে-যার মূল্যায়ন তারা একজন নগর পরিকল্পনাবিদের তুলনায় কোন অংশে কম করে না। এই নিরাপদ বাসস্থান প্রণয়নের মাধ্যমে করাইলের সাথে এর আশেপাশের এলাকার গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক সম্পর্কও অটুট থাকবে।

সরকার ও সুশীল সমাজের প্রতি আমাদের অনুরোধ ক্ষুধার্ত রিয়েল এস্টেট এর হাতে তুলে না দিয়ে করাইলকে একটি সফল "আ্যরাইভাল সিটি"তে পরিণত করার এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শহরে জায়গা দেয়ার একটি আন্তর্জাতিক উদাহরন সৃষ্টি করার। উদ্বেগজনক ব্যাপার হল, ইতোমধ্যে এই লাভজনক জমির উপর রিয়েল এস্টেট এর নজর পড়েছে। সরকারী সম্পদ উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের মধ্যে বিতরন করার যে রীতি চালু হয়েছে, সেটাও অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। "জনস্বার্থরক্ষা" র নামে সরকার হাজার হাজার একর জমি ইজারা দিচ্ছে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের কাছে (উদাহরণঃ ঝিলমিল, পূর্বাচল, উত্তরা)। তাহলে কেন সরকার মাত্র ১৭০ একর জমি এক লক্ষেরও বেশি করাইলবাসীর কাছে ইজারা দিতে পারবে না? কখন সরকার এই মানুষগুলোর হাহাকার শুনতে পাবে? তারা কিন্তু খুব বেশি কিছু চায় না। তারা চায় বেঁচে থাকতে, কারণ তারাও মানুষ।

লেখকদ্বয় স্কুল অব স্প্যাটিয়াল প্ল্যানিং, টিইউ ডর্টমান্ড, জার্মানী-তে নগর বিষয়ক গবেষণাবিদ হিসেবে কর্মরত।