ক্রসফায়ারের রাজনীতি এবং পচা শামুকে পা-কাটা

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 8 August 2017, 12:34 PM
Updated : 8 August 2017, 12:34 PM

সময়ে সময়ে আমাদের রাজনীতিতে ক্রসফায়ার নিয়ে ঝড় ওঠে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা ক্রসফায়ার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এটা বন্ধের দাবি ও আবেদন-নিবেদন করে থাকেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি থাকে ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে। আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগের অপছন্দের বিষয় হয় ক্রসফায়ার। সাভারের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান সম্প্রতি ক্রসফায়ার নিয়ে একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়ে ছোটখাট বোমা ফাটিয়েছেন। ১৯ জুলাই দৈনিক মানবজমিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমপি সাহেব বলেছেন:

"৫ জনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি, আরও ১৪ জনের লিস্ট করেছি। সব ঠাণ্ডা। লিস্ট করার পর যে দুয়েকজন ছিল, তারা আমার পা ধরে বলেছে, 'আমাকে জানে মাইরেন না, আমারা ভালো হয়ে যাব'।"

একজন সংসদ সদস্যের এমন প্রকাশ্য বক্তব্যে যেমন প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা তেমনই হয়েছে। সাভারে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এমপি সাহেব যে ১৪ জনের লিস্ট করছেন, তার মধ্যেকার কার নাম আছে তা নিয়ে আগ্রহ-কৌতূহল-উদ্বেগ-ভয় একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও জিজ্ঞাসা তৈরি হয়, এরপর তাহলে কার পালা? কে যাচ্ছে ক্রসফায়ারে?

সত্যটা গণমাধ্যমে বলার পর এমপি সাহেব অবশ্য তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। হয়তো দলের ওপরমহল থেকেই তাকে এমন বক্তব্য দেওয়ার জন্য ভৎর্সনা করা হয়েছে অথবা তার নিজেরই বোধোদয় হয়েছে যে, গোপনে যে কাজ করা হয়, প্রকাশ্যে তা বলা যায় না। বললে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

কিন্তু ডা. এনামুর রাজনীতিতে নবাগত বলেই সম্ভবত মারপ্যাঁচ বুঝে উঠতে পারেননি। পুলিশের সহযোগিতায় অপরাধী কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ক্রসফায়ারে সরকারদলীয় আরও কোনো কোনো সংসদ সদস্য হয়তো দিয়েছেন। কিন্তু তারা কেউ তা সাংবাদিকদের কাছে বড়াই করে বলেন না।

ডা. এনামুর রীতি ভেঙে গোপন কথা ফাঁস করে এখন নিজেই ফেঁসে গেছেন। বাধ্য হয়েছেন বক্তব্য প্রত্যাহার করতে। তবে অন্যদের মতো বেকায়দায় পড়ে বলেননি যে, তিনি অমন কথা বলেননি কিংবা পত্রিকায় তার বক্তব্য বিকৃত করে ছাপা হয়েছে। এ থেকেও বোঝা যায় যে, তিনি ঘোড়েল পলিটিশিয়ান হয়ে উঠতে পারেননি।

আওয়ামী লীগ তাকে শো-কজ করেছে। তিনি কিছু একটা জবাব হয়তো দেবেন। তার জবাবে খুশি হওয়া না-হওয়া আওয়ামী লীগের ব্যাপার। তিনি যদি দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে দল থেকে বহিষ্কার অথবা আগামী নির্বাচনে তাকে নমিনেশন থেকে বঞ্চিত করা। কিন্তু এতে একদিকে যেমন ৫ জন মানুষকে হত্যার অপরাধের বিচার হয় না, অন্যদিকে তার কারণে সরকারের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলো তারও প্রতিকার হয় না।

তিনি যে ৫ জনকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার কথা নিজে স্বীকার করেছেন, তারা দোষী না নির্দোষ আমরা তা জানি না। যদি ধরেও নিই যে, তারা সবাই চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা অপরাধী ছিল তাহলেও কিন্তু ডা. এনামুর আইনের আওতার বাইরে যেতে পারেন না। কাউকে বিনা বিচারে শাস্তি কেউ দিতে পারেন না।

কোনো বিচারক কি ইচ্ছে করলেই কাউকে শাস্তি দিতে পারেন? আইনের চোখে অপরাধী সাব্যস্ত হলেই কেবল কাউকে শাস্তি দেওয়া যায়, অন্যথায় নয়। ডা. এনামুর অজ্ঞ বা আইন না-জানা সাধারণ মানুষ নন। তিনি নিজে একজন আইনপ্রণেতা। কাজেই জেনেবুঝে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজসে কয়েকজনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছেন, আরও কয়েক জনকে তালিকাভুক্ত করেছেন। এরা অপরাধী হতে পারে আবার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও হতে পারে। তবে কোনোভাবেই এটা সাধারণ ঘটনা নয়। এটি যদি উপেক্ষিত হয় তাহলে বিনা বিচারে হত্যার প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।

ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার গল্প আমাদের শৃঙ্খলাবাহিনী প্রায়ই প্রচার করে থাকে, যার কোনোটাই সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। মানুষ মনে করে, শৃঙ্খলাবাহিনী তাদের হেফাজতে থাকা একজনকে মেরে ফেলে তারপর ক্রসফায়ার অথবা বন্দুকযুদ্ধের কথা বলে। এই অভিযোগও নতুন নয় যে, সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্যরা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কখনও কখনও জড়িয়ে যান অথবা শৃঙ্খলাবাহিনীও কখনও কখনও ঢাল হিসেবে সরকারি দলের প্রভাবশালীদের ব্যবহার করে। তারা পরস্পরের স্বার্থের পাহারাদার হয়ে যায়।

ক্রসফায়ার বর্তমান সরকারের আমলে শুরু হয়েছে ব্যাপারটি মোটেও তেমন নয়। এটা বিএনপি সরকারের সময় থেকে শুরু হয়ে এখনও অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে অঙ্গীকার করেছিল যে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা ক্রসফায়ার বন্ধ করবে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে অঙ্গীকাররক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে তারা। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে প্রাণনাশ চলছেই।

ক্রসফায়ার কিংবা বন্দুকযুদ্ধে মাঝে-মধ্যে প্রকৃত সন্ত্রাসী বা অপরাধী মারা যায় না, তা-ও নয়। এ রকম কেউ মারা গেলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সাময়িক স্বস্তি দেখা যায় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উৎসাহ বোধ করে থাকে। কিন্তু বিনা বিচার হত্যা যে অপরাধ দমনের কার্যকর বা আইনসম্মত কোনো পথ নয়-– এটাও সংশ্লিষ্ট সবাই জোর দিয়েই বলে থাকেন। আইনের যথাযথ প্রয়োগ, আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করা, পুলিশকে দক্ষ এবং একইসঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত করা না গেলে সমাজ অপরাধমুক্ত করা যাবে না।

আমাদের দেশের সরকার এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব এতটাই সংকীর্ণচিত্ত এবং ক্ষুদ্রস্বার্থ সাধনে ব্যস্ত যে, তারা বৃহত্তর কল্যাণকর কিছু করার কথা মুখে বললেও কাজে করার আগ্রহ দেখান না। তারা আগাছা পরিষ্কার করার জন্য কঠিন পদক্ষেপ না নিয়ে গোঁজামিল দিয়ে কাজ সারতে চান। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা শুধু বিরোধী দলে থাকলে বলা হয়। সরকারে গেলে চলে বিপরীত কর্মকাণ্ড।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে র‌্যাব গঠন করা হয়েছিল। কিছু দিন না যেতেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে এই বাহিনীর ব্যবহার সব গোলমাল করে দিল। তখন র‌্যাবকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে বিএনপি মজা পেলেও এখন বিরোধী দলে এসে যখন নিজেদের গায়ে গরম তাপ লাগছে, তখন র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি জানাচ্ছে এই বলে যে, এখন আর এই বাহিনীর প্রয়োজন নেই।

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থির কি তাহলে যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে? অপরাধপ্রবণতা কি কমেছে? না হলে কোন বিবেচনায় র‌্যাবের প্রয়োজন ফুরাল?

বিবেচনা একটাই। আর সেটা হল, দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। বর্তমান সরকার র‌্যাবকে বিএনপির বিরুদ্ধেও ব্যবহার করছে, যেমন বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে করেছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনরা মনে করেন ক্ষমতা চিরস্থায়ী, এটা আর হাতছাড়া হবে না বা অন্যের হাতে যাবে না। তাদের কখনও বিরোধী দলে যেতে হবে না। কিন্তু ক্ষমতা কারও চিরস্থায়ী হয় না। বিরোধী দলে যেতেই হয়। তখন আত্মোপলব্ধির জাগরণ ঘটায় শুরু হয় বিপরীত পথচলা।

বিএনপির এখন র‌্যাব ভালো লাগছে না। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, বিএনপি আবার ক্ষমতায় গেলেও র‌্যাব বিলুপ্ত হবে না। তখন আবার একে ব্যবহার করা হবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগ এবার টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আরও একটা মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় তাদের রযেছে। এই ইচ্ছাপূরণের জন্য নানা উদ্যোগ-পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে উদ্বেগের বিষয়টিও চাপা থাকছে না। তবে যে যাই বলুক, দেশে বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী গণআন্দোলনের আশঙ্কা কিংবা সম্ভাবনা খুবই কম। যেসব ইস্যুতে মানুষকে আন্দোলনমুখী করা সম্ভব বিএনপি সেসব ইস্যু ধরবে না। যেমন, ঢাকা শহরের তীব্র যানজট, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি সাধারণ মানুষকে নাকাল করলেও বিএনপি এ নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য করবে না। কারণ তারা জানে তাদের হাতে জাদুর কাঠি নেই, তারা ক্ষমতায় গিয়েও অচল ঢাকা রাতারাতি সচল করে তুলতে পারবে না। তাই মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাদের মনে জ্বালা নিজেরা ভোগবঞ্চিত থাকায়।

কাজেই বিএনপির দিক থেকে নয়, আওয়ামী লীগের আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার ক্ষেত্রে আমি দেখি অন্য বিপদ।

পচা শামুকে পা-কাটা বলে একটি প্রবাদ দেশে চালু আছে। অন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষকরা যাই বলুন না কেন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, বড় কোনো জাতীয় ঘটনা বা ইস্যু নয়, এবার আওয়ামী লীগের পা কাটতে পারে পচা শামুকে। এক ধরনের আত্মম্ভরিতা সরকারি মহলকে পেয়ে বসেছে। মাথার ওপর যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রয়েছেন, তিনি সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন-– এমন মনোভাব প্রায় সবার মধ্যে প্রবল থাকায় হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা বেশি। নির্বাচনের আগে দলের কোন মন্ত্রী, কোন সংসদ সদস্য, কোন জাতীয় বা স্থানীয় নেতা কোন অপকর্ম ঘটিয়ে বসবেন– ইতোমধ্যে অনেকে তা ঘটিয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছেন– তা কি আগে থেকে অনুমান করা যাচ্ছে?

সাভারের সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান কিংবা বগুড়ার শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের মতো লোক আওয়ামী লীগে কম নেই। সব ধরনের মায়া ও মোহ ত্যাগ করে দল আগাছামুক্ত করার কঠিন কাজে শেখ হাসিনা হাত না দিলে অস্বস্তির কাঁটা পায়ে ফুটতেই থাকবে।