অাওয়ামী লীগ কাদের জন্য?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 16 Nov 2011, 09:25 AM
Updated : 6 August 2017, 07:13 AM

কোনো দল বা রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাস করার জন্যে অনুমোদন বা লাইসেন্স দরকার হয় না। মানুষের জন্মগত অধিকারের একটি তার চিন্তার স্বাধীনতা। দেশ বা সমাজ মূলত ধারণা। সে ধারণা ধারণ করে রাজনীতি। রাজনীতি চালায় রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিকভাবে যে কোনো দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকে এবং মানুষ বা সেদেশের নাগরিকেরা তাদের পছন্দমতো যে কোনো একটি এমনকি একাধিক দলও সমর্থন করতে পারে।

যেসব দেশে একাধিক দল থাকে না তাদের দিকে তাকানো কঠিন। উত্তর কোরিয়ার কথা ভাবলেই বোঝা যাবে কতটা কঠিন ও নির্মম হতে পারে একনায়কতন্ত্রের বাস্তবতা। আমাদের অতীতে যখন আমরা পাকিস্তানে ছিলাম সেনা শাসনের কারনে মানুষ গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি । আরো অনেক কারণের সাথে এই অনিবার্য কারনটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা।

যখন দেশ স্বাধীন হল তখনও বৈশ্বিক বাস্তবতা আর দুনিয়ার রাজনীতির দোলাচলে গণতন্ত্রে বসবাসের ইচ্ছে থাকলেও আমরা তা পারিনি। অতঃপর বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের পর মূলত প্রকাশ্য ও ছদ্মবেশী সামরিক শাসনেই চলছিল আমাদের দেশ। এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্রের শুভ সূচনা ঘটে রাজনীতিতে। আজ আমরা এ কথা বলতেই পারি যে, দেশে যেভাবে হোক যে আকারে বা যত সীমিত হোক, গণতন্ত্রের ধারা চলছে। আওয়ামী লীগের দেশ-শাসন মানেই প্রত্যাশা– আওয়ামী লীগ মানেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এ দুই সত্যের বিকল্প নাই। কিন্তু আজ দেশের চেহারার দিকে তাকালে আমরা কিছুতেই মেলাতে পারি না এই দল সেদিন অকুতোভয় নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের মুক্তবুদ্ধি ও আধুনিকতার পথে ধাবিত করেছিল কি না।

দুবারের শাসনামল প্রায় সমাপ্তির পথে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি কোথায় যেন আদর্শিক দুর্বলতার শিকারে পরিণত হতে ভালোবাসছে। সবাই জানেন বাংলাদেশের সমাজ আর আগের জায়গায় নেই। আমরা কথায় কথায় দুনিয়ার উদাহরণ– আমেরিকা-ভারত বা অন্য দেশকে দোষারোপ করে শান্তি পাই– বাস্তবে খোলা দুনিয়ার অন্ধকারও আমরা গোগ্রাসে গিলছি। খুলে যাওয়া ইন্টারনেট বা মিডিয়ার হাত ধরে মধ্যপ্রাচ্য, তার পোশাক, খাবার, এমনকি তার উগ্রতাও ঢুকেছে সমাজে। আমজনতাকে কেউ বলছে না এর নাম ধর্ম হতে পারে না। বরং আমজনতা যতটা গা বাঁচিয়ে চলছে সুশীল নামের কিছু মানুষ তত এই ধারণা ও আচরণগুলো সমাজে ঢোকার জায়গা করে দিচ্ছে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশ ভারতও আগের অবস্থানে নেই। গান্ধী নেহেরু কিংবা কমিউনিস্ট ভারতের বিশাল অংশে এখন গেরুয়ার জয়জয়কার। বিজেপি আছে দিল্লীর মসনদে। কিন্তু তারা আসার পর বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা বাড়লেও পারস্পরিক নির্ভরতা কি কমেছে? আপনি দেশের বাজার-হাট সংস্কৃতি-বিনোদন জীবন-নাটক যেদিকে চোখ রাখবেন দেখবেন ফিফটি-ফিফটি। ভারত দখল করে আছে ফিফটি বা তার বেশি জায়গা। অথচ সমাজ ও রাজনীতিতে আপনার পপুলারিটি নির্ধারণ করছে আপনি কতটা ভারতবিরোধী তার ওপর।

এই খেলা বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে অনেক বছর তাদের দখলে রাখলেও এখন সে পরিবেশ নেই। আওয়ামী লীগের সামনে জামায়াত না তার চেয়ে বড় ফ্যাক্টর হেফাজত। এই হেফাজতী বিস্তার, সঙ্গে হিন্দুবিরোধী সস্তা রাজনীতি লীগকে টানছে বেপথে। জনপ্রিয়তার কিছু দায় থাকে। সে দায় মেটাতে গিয়ে রাজনীতি থেকে বহুকাল এমনকি চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া দলের সংখ্যাও কম নয়। উপমহাদেশে তার অজস্র প্রমাণ অজস্র উদাহরণ থাকার পরও গদির মোহে সেটা চোখে পড়ে না।

কথাগুলো বলতে হল সম্প্রতি লীগের সাধারণ সম্পাদকের প্রদত্ত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে। তিনি ইদানিং সব বিষয়ে কথা বলেন। দলের বিষয়ে তিনি অবশ্যই কথা বলবেন। বাকি অনেক বিষয়ে নিশ্চয়ই মানুষের কমতি নেই। তবু এই বলাটা আমাদের দেশের রাজনীতির স্বভাব। ওবায়দুল কাদের মোটামুটি বলার বিষয়ে রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন। অতি অল্পসময়ে তাঁর এই বলার রেকর্ড দলের জন্য কতটা উপকারী সেটা বলবে সময়। তবে আপাতত নানা বিতর্কে তাঁর দল নিয়ে গড়ে উঠছে বিতর্কিত মতামত-বলয়।

এবার তিনি বলেছেন রাজাকারের সন্তানেরাও চাইলে আওয়ামী লীগ করতে পারবে। গোড়াতেই বলি, কেন পারবে না? আমি যখন কম্বোডিয়ায় গিয়েছিলাম সে দেশের যাদুঘরে গিয়ে দেখি পলপট সমর্থকদের লেখা বিশাল বিশাল চিঠিও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সবাই জানেন, বিভীষিকায় তাদের দেশের নৃশংসতা আমাদের চাইতে কম কিছু ছিল না। সেদেশে এমনও ঘটনার ইতিহাস দেখেছি, পলপট যৌবনে হস্তমৈথুনকেও পাপ মনে করতেন। সে দেশের রাজাকারদের সেই চিঠিগুলো ছিল মাফ চাওয়ার আকুতি দলিল। তারা অকপটে স্বীকার করেছে তাদের কৃতকর্ম। তারা নির্দ্বিধায় বলেছে তাদের পাপের কথা। তারা মাফ চেয়ে সমাজে ফেরার জন্য আবেদন জানিয়েছে সেসব চিঠিতে। যারা ক্ষমা পেয়েছিল তারা আর কোনো দিনও পলপটের নীতিতে ফেরেনি। বরং তারা নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের শেষজীবন কাটিয়েছিল মার্জনার কোমল আলোয়।

এ কাহিনি বাস্তব। এরা নিশ্চয়ই দেশের বিজয়ী ধারার সঙ্গে মিলতে পেরেছিলেন।

আমাদের অতীত কী বলে? স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যাদের মাফ করে দিয়েছিলেন তারা কি তাঁকে বাঁচতে দিয়েছিল? বিগত চল্লিশ বছর ধরে দেশের রাজনীতিতে বেড়ে ওঠা জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি-বলয়ের কেউ কোনো দিন মাফ চাওয়া দূরে থাকুক মুক্তিযুদ্ধের দিকে এক কণাও ঝুঁকেছে কোনো দিন? কী ছিল তাদের এজেন্ডা? তারা বিএনপিতে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধার নামে এদেশকে পাকিস্তানের ছায়া-রাষ্ট্র বানাতে হেন কাজ নেই যা করেনি। সেই অপকর্মে স্বাধীনতাবিরোধীরা এমনও ধরে নিয়েছিল এদেশে ককটেল রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই চলবে না।

বলাবাহুল্য আওয়ামী লীগই ছিল তার শিকার। এখন আমরা কি ধরে নেব যে, আওয়ামী লীগে আসার জন্য রাজাকারের ছানাপোনারা সব তাদের বাপ-দাদার আদর্শ ছেড়ে দিয়েছে? যদি দিয়ে থাকে তো তার ঘোষণা আছে কোথাও? কীভাবে জাতি নিশ্চিত হবে? সে কথা কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেননি।

ইতিহাসে আমরা হুমায়ূন আহমেদের মতো মানুষেরও বৈকল্য দেখেছি। তাঁর পিতা এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিহত একজন পুলিশ অফিসার। তাদের পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধের ও চেতনার সঙ্গে। তারপরও হুমায়ূন আহমেদ ঠিক থাকতে পারেননি। আর যারা সাধারণ রাজাকার বা সুযোগসন্ধানী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তাদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা কী কারণে হঠাৎ আওয়ামী লীগের দিকে ঘুরে দাঁড়াবে এর একটা ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। সে ব্যাখ্যা সাধারণ সম্পাদক দিতে পারেননি।

আগেই বলেছি যে কারও অধিকার আছে একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য হবার, সমর্থন করার। সেটা আওয়ামী লীগের বেলায় হতেই পারে। কিন্তু বিএনপি খাল-কাটার রাজনীতি করবে আর সেই খালে আওয়ামী লীগ কুমির টেনে আনবে এটাও মানতে হবে?

দলে লোক ভিড়ানো সরকারি দলের জন্য কষ্টের কিছু নয়। তারা চাইলেই তা করতে পারেন। তবে এমনসব লোক যদি দলে ঢুকে পড়ে যারা আওয়ামী লীগের তরী ডোবানোর জন্য কাজ করবে, যাদের বুকে-মনে-চিন্তায়-স্বপনে কোথাও বঙ্গবন্ধু বা তাঁর আদর্শ নেই তাদের জন্য ভরাডুবি হলে তার দায় নেবে কে?

এমনিতেই সরকারি দল অজনপ্রিয় হয়ে থাকে। তাদের মাথার ওপর আছে চাপের বোঝা। আছে ভারতপ্রীতি, হিন্দু-তোষণসহ নানা ধরনের অভিযোগ। তারা যদি মনে করেন, এই বিষ নামানোর উপায় হল দলে যে কোনো আদর্শের মানুষকে ঠাঁই দেওয়া তাহলে মানতে হবে, চোরাপানিতে নৌকা পথ হারাবেই।

শেখ হাসিনা জনপ্রিয়তার দিক থেকে খুব ভালো জায়গায় থাকলেও দল কি আসলে সে জায়গায় আছে? আদর্শহীন জগাখিচুড়ি ও বারোভূতের আওয়ামী লীগ কারও কাম্য হতে পারেনা। না ইতিহাসে, না ভবিষ্যতের।