ব্যক্তিগত আখের গোছানো নয়, বাংলাদেশের মঙ্গল হোক রাজনীতির লক্ষ্য

আবুল হাসনাৎ মিল্টন
Published : 11 August 2017, 09:40 PM
Updated : 11 August 2017, 09:40 PM

দেখতে দেখতে তেত্রিশ বছর হয়ে গেল, অথচ মনে হয় এই তো সেদিন। পঁচাশি সালের জানুয়ারি মাস। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছি, ভর্তি হতে যাব। আমার চেয়ে বাবা-মার মধ্যে বেশি উত্তেজনা। সারাজীবন তাঁরা মনেপ্রাণে চেয়েছেন তাদের ছেলেটা ডাক্তার হোক। তখন খুলনা থেকে সড়কপথে বাসে-কোচে করে ঢাকা যাওয়া যেত। সে রকমই পরিকল্পনা ছিল। বাধ সাধল আকস্মিক সড়ক ধর্মঘট। খুলনা থেকে ঢাকামুখী সব বাস-কোচ বন্ধ। এদিকে ভর্তির শেষ দিনও ঘনিয়ে আসছে। বাধ্য হয়ে বন্ধু আবরারকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে স্টিমারে রওয়ানা দিলাম।

সড়ক ধর্মঘট হবার কারণে স্টিমারে উপচে-পড়া ভীড়। কোনো রকমে উন্মুক্ত ডেকের এক কোনায় জায়গা পেলাম। এ সময় ক্যাডেট কলেজের বড়ভাই খান হিলালী ও তাঁর আরেক সহপাঠী সর্বজিত আনোয়ার কামাল বুলু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। দুজনই ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়েন। সড়ক ধর্মঘটের কারণে তাদের এই জলযাত্রা। আমাদের দীর্ঘ স্টিমার-যাত্রার সময়টা তাই ভালোই কাটল।

সেদিন ভর্তির শেষ দিন। প্রায় সবাই ভর্তি হয়ে গেছে। আমরা হাতেগোনা কয়েকজন বাকি। ক্যাডেট কলেজের আরেক বড়ভাই মামুন আমাকে আর আবরারকে সঙ্গে নিয়ে মেডিকেল পরীক্ষাসহ সব আনুষ্ঠানিকতা সারলেন। প্রথম দিন থেকেই আমাদের জায়গা হল শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী হলের আট নম্বর রুমে। ছাত্রলীগের মার্কা-মারা রুম। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কারণে তত দিনে ছাত্রলীগের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সুতরাং বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগদানের ব্যাপারে দ্বিধা ছিল না। যদিও ক্যাডেট কলেজের বড়ভাইদের কেউ কেউ চাইছিলেন যাতে জাসদ ছাত্রলীগ করি। আবার কেউ চাইছিলেন আমাকে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে।

তাদের সঙ্গে নিয়মিত রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক হত। বিতর্কের স্বার্থে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর রাজনীতি নিয়ে পড়াশুনা শুরু করলাম। এভাবেই একটা শক্ত তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে শুরু হয়েছিল আমার ছাত্ররাজনীতির দীর্ঘ পথচলা।

তখন স্বৈরশাসক এরশাদের কালো যুগ। দেশ-জাতি স্বৈরশাসক জিয়ার কালো অধ্যায় পেরিয়ে স্বৈরাচারের আরেক যুগে প্রবেশ করেছে। শুরু থেকেই সারাদেশের ছাত্ররা এটা মেনে নেয়নি। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চলছেই। সেই প্রতিবাদে সামিল হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাছেই হওয়ায় এবং সেখানে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভর্তি হবার ফলে টিএসসি, কলা ভবন আর মধুর ক্যান্টিনেও নিয়মিত যাতায়াত শুরু হল। সঙ্গে কবিতা লেখা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানো।

জীবন ব্যস্ততায় ভরপুর, পড়াশুনা বাদে সব কিছুতেই আছি। বাবা-মার ইচ্ছায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছি, নিজের আগ্রহ তাই কম। তবে প্রায় প্রতিদিনই লেগে থাকা পরীক্ষাগুলো ঠিকই দিই, পরীক্ষার জন্য পড়ুয়া বন্ধুগুলো খুব সাহায্য করে।

যুগে যুগে রাজনীতির ধরন বদলেছে, রাজনীতিতে শুদ্ধতার প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আমাদের সময়ে ছাত্ররাজনীতিতে শুদ্ধতা ও দায়বদ্ধতার ব্যাপারটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হত। সেই প্রজন্মের ছাত্ররাজনীতির একজন সামান্য কর্মী হিসেবে 'সততার যে নিজস্ব একটা সৌন্দর্য আছে' সেটা সেই বয়সেই উপলব্ধি করতে পারতাম এবং এখনও এটা মেধায়-মননে ধারণ করি। স্বৈরাচারী এরশাদের নানান প্রলোভন তখন আমরা হাসিমুখে প্রত্যাখ্যান করতাম। বরং কেউ যদি লোভে পড়ে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলাত, তবে সে সামগ্রিকভাবে ছাত্রদের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হত।

সময়ের পরিক্রমায় প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালেও মূল দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ বজায় রেখেছি। বিশেষ করে দলের প্রয়োজনে ঢাকা থেকে যখনই যে নির্দেশ এসেছে, অস্ট্রেলিয়ায় থেকে তা পালন করেছি। আমরা হলাম দলের রিজার্ভ ফোর্স, প্রয়োজনমাত্রই হাজির।

অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি পনের বছরেরও বেশি। গত বছর পর্যন্ত সরাসরি রাজনীতিতে জড়াইনি। তবে বঙ্গবন্ধুর নামে যে কোনো অনুষ্ঠানে যারাই ডেকেছে, সবরকম দলাদলির উর্ধ্বে উঠে যাবার চেষ্টা করেছি। কোনো সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ করতে অনুরোধ করলে সেটাও করেছি। একাধিক বঙ্গবন্ধু পরিষদের যে কোনো মেলার মঞ্চে গিয়েছি। নিজেদের ভেতরের বিভক্তির চেয়ে আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলেন বঙ্গবন্ধু। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গে ছিলাম, আছি এবং থাকবই।

এত কিছুর পরও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি একটা বাড়তি টান অনুভব করি। কোনো অনুষ্ঠানে কেউ সামনে এসে দাঁড়িয়ে যদি নিজেকে ছাত্রলীগ, অস্ট্রেলিয়ার নেতা বা কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। যুবলীগ অস্ট্রেলিয়ার জন্মের সঙ্গে আমার একটা পরোক্ষ সম্পর্ক আছে, তাদের সুখে-দুখে পাশে থাকি। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও ব্যক্তিগত পরিচয়-সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

তবে একটি ব্যাপারে শুরু থেকেই কষ্ট পেয়েছি। অস্ট্রেলিয়ায় আওয়ামী লীগ নামের সংগঠনগুলোতে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার ঘাটতি বরাবরই খুব প্রকট। এখানে গঠিত প্রথম কমিটি কোনো রকম সম্মেলন ছাড়া তের বছর চালিয়েছে। পরবর্তীতে গঠিত এক কমিটি এখন নয় বছর ধরে চলছে। আরেকটি কমিটি সমবয়সী হলেও সেটি প্রায়শ নিষ্ক্রিয় থাকে। সংগঠনসমূহের পরিচালনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, সদস্য সংগ্রহ সব কিছুই কেমন যেন ফ্রিস্টাইল! এমনকি প্রচলিত সাংগঠনিক প্রথাসমূহ অনুসরণের বালাই নেই।

২০০৯ সালে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এর সঙ্গে নতুন কিছু উপসর্গ যোগ হয়েছে। সিডনির আওয়ামী সংগঠনসমূহের যারা নেতা তাদের মধ্যে কেমন যেন একটা রাখ-ঢাক ভাব। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ঢাকা থেকে আগত মন্ত্রী-এমপিকেন্দ্রিক। তাঁরা এলে সিডনির কোনো এক নিভৃত রেস্তোরাঁয় অনুগত লোকজন নিয়ে নামকাওয়াস্তে অনুষ্ঠান করা, তাদের সারাক্ষণ ঘিরে রেখে অন্যদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা আর রাজনীতির পদ-পদবি ভাঙিয়ে বিভিন্ন সুবিধা নেওয়াই যেন তথাকথিত এসব প্রবাসী রাজনৈতিক নেতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

ফলে প্রবাসে দেশি রাজনীতির ব্যাপারে অধিকাংশ প্রবাসীর মনে একটা নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছে। এই সিডনি শহরে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীর সংখ্যা প্রচুর। এখানে শতাধিক মানুষ আছেন যারা বাংলাদেশে অবস্থানকালীন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, জেলা-নগর বা কেন্দ্রের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত থেকে রাজনীতি করেছেন। অথচ এরা অস্ট্রেলিয়ায় আওয়ামী রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে খুব একটা আগ্রহী নন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে প্রবাসের এই নেতারাও চান না সংগঠনটা বিস্তৃত হোক, বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা একটা জায়গায় এসে মিলিত হোক।

আবার অনেকেই নানা ধরনের অপরাধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সিডনি শহরে হয়তো কোনো হুন্ডি কেলেঙ্কারি হল– দেখা গেল, তার সঙ্গে এসব তথাকথিত নেতাদের কেউ কেউ জড়িত। অনেকে দেশে সরকারি প্লটের দালালি করেন। কেউ কেউ আবার অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের পদ ভাঙ্গিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপী হয়ে পত্রিকার শিরোনাম হন। কারও বিরূদ্ধে রিয়েল এস্টেট কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। কেউ আবার সিডনিজুড়ে মুফতে দাপিয়ে বেড়ান।

অথচ ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে থেকে আমাদেরও তো দেশের মঙ্গলের জন্য কিছু করার কথা। এসব দেশে থেকে আমাদের উন্নত গণতন্ত্রচর্চায় আগ্রহী হওয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশটার কাছে আমাদের সীমাহীন ঋণ। এই দেশের সবুজ পাসপোর্ট নিয়েই আমরা অভিবাসী হয়েছি। প্রবাসে থেকে কি আমরা পারি না দেশটার জন্য যার যার অবস্থানে থেকে ভালো কিছু করতে?

পারি, অবশ্যই এবং পারবও বটে। সমস্যা হল, সামর্থ্য থাকা সত্বেও প্রবাসে থেকে দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্বটুকু সবাই সবসময় পালন করি না। তবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী কোনো কিছুই শূন্য থাকে না। প্রবাসে যোগ্য-দক্ষ-ভালো মানুষেরা রাজনৈতিক-সামাজিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেন না বলে অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্যদের হাতে রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্ব চলে যায়।

আমাদের তাই দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। প্রবাসে বসবাস করে স্বদেশি রাজনৈতিক সংগঠন করতেই হবে এমন কথা নেই। তবে কেউ কেউ যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রবাসের বাস্তবতায় শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করতে চান, তবে তাদেরও সে সুযোগ থাকা উচিত। দিনের শেষে বাংলাদেশের মঙ্গলই প্রধান বিবেচ্য হোক, রাজনীতিকে ভাঙ্গিয়ে নিজের আখের গোছানো নয়।