সময়টা এখন ধর্ষকদের

পারভীন সুলতানা ঝুমা
Published : 10 August 2017, 07:57 AM
Updated : 10 August 2017, 07:57 AM

সেদিন ঢাকার একটি দেওয়াল লিখন দৃষ্টি আকর্ষণ করল: 'সময়টা এখন আমাদের'। সুন্দর শ্লোগান। কিন্তু কেন যেন আমার মনে হল, 'সময়টা এখন আমাদের' স্থলে 'সময়টা এখন ধর্ষকদের' লেখা থাকলেই যথোপযুক্ত হত। সময়টা এখন ধর্ষকদের, বাংলাদেশ এখন ধর্ষকদের অভায়ারণ্য। এ দেশে ধর্ষণের মহাৎসব চলছে। তিন বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে কিশোরী, যুবতী, মধ্যবয়সী– সবাই শিকার হচ্ছেন ধর্ষণের। অভিজাত হোটল থেকে থেকে বস্তি এলাকা- ধর্ষকদের অভযারণ্য যেন সবই। পশ্চিমা পোশাকের নারী যেমন টার্গেট হচ্ছেন তেমনি হচ্ছেন হিজাব-পরিহিতারা। নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন নারী কেবল নন, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত থেকে ধনীর দুহিতাকেও পোহাতে হচ্ছে ধর্ষণের নরকযন্ত্রণা।।

ধর্ষণ করছে কারা? নন্দকিশোর থেকে শুরু করে যুবক ও মধ্যবয়সীরা– দিনমজুর থেকে দিনে কয়েক লাখ টাকা হাতখরচ পাওয়া ধনীর দুলাল। মনে হচ্ছে যেন ধর্ষণ একটা স্বাধীন সার্বভৌম ক্রীড়া, যা শুধু পুরুষরাই খেলতে পারে। নারীর মতের তোয়াক্কা না করেই!

ধর্ষণ হচ্ছে কোনো কোনো পুরুষের পৌরুষ প্রকাশের এক মহাস্ত্র। পুরুষদের শারীরিক গঠনে জৈবিক ইচ্ছার যে তীব্রতা সেটি কি তাদের ধর্ষণেচ্ছুক হয়ে ওঠার কারণ? বিষয়টি তা নয়। সমাজ আর সংসারে নারী বিষয়ে নিজের যাবতীয় সৎ-অসৎ ইচ্ছাপূরণে যাবতীয় প্রশ্রয় পেলেই পুরুষ ধর্ষক হয়ে উঠতে সাহস পায়। উন্নত বিশ্বে ধর্ষক ধরা পড়লে 'পার' পেয়ে যায় না সহজে– সমাজে বা রাষ্ট্রে ধর্ষকের অবস্থান যা-ই হোক না কেন। কিন্তু আমাদের সমাজের 'ছাড় দেওয়ার' সংস্কৃতি ধর্ষণ উৎসাহিত করে।

এই সমাজে যে ছাড়ের কথা বলছি তা আইন ও রাষ্ট্রও দেয় ধর্ষককে।। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এখন আবার ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধটির উচ্চ মাত্রা দেওয়ার বন্দোবস্ত হল। বিয়ে নামের তুলসি পাতা দিয়ে ধর্ষণকাজ ধুয়ে নেওয়ার এই উদ্ভট 'আইডিয়া' যে নীতিনির্ধারকদের মস্তিস্কে খেলা করেছে, তাদের সুপ্ত মনে ধর্ষকদের প্রতি যে খানিকটা সহানুভূতি বা সমর্থন কাজ করে তা বলা বাহুল্য। না হলে ধর্ষকদের জন্য আরও কঠিন আইন এবং ধর্ষিতার পুনর্বাসনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পনা না নিয়ে, ধর্ষণের দোহাই দিয়ে নারীর বিয়ের বয়স কমিয়ে দেওয়ার আইনটি হত না। তাতে প্রমাণ হল, রাষ্ট্রযন্ত্র এখনও পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিকতার বলয়ে আবদ্ধ।

ধর্ষণের মামলা থানাগুলো নিতে চায় না। প্রায় সকল ধর্ষণের ঘটনায় থানার এ অনীহার অভিযোগ রয়েছে। কারণটা কী? শুধু থানার কর্তৃপক্ষকে বা প্রশাসনকে দায়ী করে লাভ নেই, বনানীর ছাত্রীধর্ষণের ঘটনায় 'মেয়েগুলো গেল কেন' এ ধরনের প্রশ্ন করে অনেক প্রগতিশীলও পরোক্ষভাবে ধর্ষকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

যখন প্রগতিশীলদের মুখ থেকে এ প্রশ্ন উচ্চারিত হয় তখন মনে হয়েছে, আমাদের সমানাধিকারের লড়াইটা আসলে অরণ্যে রোদন। একেকটা ঘটনা অনেকের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। যারা মুখোশ পরে অকাতরে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বয়ান করে যান। এরা কর্মস্থলে নারী সহকর্মীকে হেনস্থা করেন– ঘরে স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বস্ত হন। এরাও মনে মনে এ মানসিকতা পোষণ করেন যে, নারী মানেই ভোগ্যবস্তু। এই প্রগতিবাদীরাও ধর্ষণ করেন। তবে তাদের ধর্ষণ অন্যরকম। একটা মেয়ের জীবনের স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দিয়ে তারাই সমানাধিকারে সোচ্চার সংগঠনের অনুষ্ঠানে প্রধান বা বিশেষ অতিথি হয়ে বসেন, বক্তৃতা দেন।

বলা হচ্ছিল ধর্ষকদের শাস্তি এড়িয়ে যাওয়া অথবা ছাড়া পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে। সমাজের ক্ষমতাধর যারা তারা আইনের উর্ধ্বে থাকেন। অর্থ, প্রতিপত্তির কারণে শুধু ধর্ষণের মতো অপরাধ নয়, যে কোনো অপরাধ থেকে তারা মুক্ত। তবে ইদানিং বনানী আর বগুড়ার ঘটনা মিডিয়ায় আলোড়িত হওয়ার কারণে হয়তো প্রভাবশালী হয়েও ধর্ষক ও তাদের সহযোগীরা বিচারের আওতায় গিয়েছে। তাতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই কিন্তু। মিডিয়ার অগোচরে আরও কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তার হিসাব করতে গেলে একটা পচা গলিত সমাজের ছবি উঠে আসবে।

এরপরও দেখা যায় সমাজে তত ক্ষমতাধর না হয়েও ধর্ষক বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। এর কারণ ধর্ষণ-বিষয়ক আমাদের আইন। অদ্ভুত এক আইন! এ আইন বলে দেয় সমাজ এবং রাষ্ট্র আসলে ধর্ষকের পক্ষে। ধর্ষিতা নারীর যে শারীরিক পরীক্ষা করা হয়, তার মতো জঘন্য আর কিছু হতে পারে না। টু ফিঙ্গার টেস্ট বা 'দুই আঙুলের পরীক্ষা' পদ্ধতি নিয়ে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার প্রতিবাদ করে আসছে। ধর্ষণ ঘটনাটি ঘটেছে কি না তা পরীক্ষার এই পদ্ধতির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন নারী ও মানবাধিকার সংগঠন এবং দুজন চিকিৎসক ২০১৩ সালে একটি রিট আবেদন করেন। এই পরীক্ষা পদ্ধতি সংবিধানের পরিপন্থী বলে রিটে উল্লেখ করা হয়। এখন পর্যন্ত জানা নেই– হতে পারে এটা ব্যক্তিগত অজ্ঞতা– সেই রিটের কিছু হয়েছে কিনা।

দুই আঙুলের পরীক্ষা পদ্ধতিতে মূলত দেখা হয় ধর্ষিতার সতীচ্ছদে জখম রয়েছে কিনা। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে জানা যায় ধর্ষিতা কুমারী নাকি তার যৌন-অভিজ্ঞতা রয়েছে। যদি দেখা যায় সেটি রয়েছে তাহলে তো ধর্ষকের উকিলের পোয়াবারো। যুক্তিতর্ক দিয়ে তিনি বুঝাতে চাইবেন যে, ধর্ষিতা স্বেচ্ছায় ধর্ষকের কাছে ধরা দিয়েছেন। কোনো অবিবাহিতার যদি যৌন-অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে তাকে কি ধর্ষণ করা যায়েজ?

মনে রাখতে হবে, ধর্ষণ সব বয়সী ও বিবাহিতা-অবিবাহিতা এবং যৌন-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও অনিভজ্ঞ সব ধরনের নারীর ক্ষেত্রে ঘটছে। তাই সব ধরনের ধর্ষিতার বেলায় তার সতীচ্ছদ অটুট আছে কি নেই কিংবা তার যৌনকর্মের অভিজ্ঞতা আছে কি না তা পরীক্ষা করার যৌক্তিকতা আছে কি?

কয়েক বছর আগে একজন মার্কিন বক্সারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। যুক্তিতর্কে বলা হয়েছিল যে, মেয়েটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সেই খেলোয়াড়ের হোটেল রুমে হাজির হন। বিচারকের রায় ছিল এরকম: তা সত্ত্বেও ওই ক্রীড়াবিদ ওই তরুণীকে ধর্ষণ করতে পারেন না, তার সে অধিকার নেই। আমাদের সমাজে এখনও ধর্ষিতার চরিত্রহনন, তাকে পতিতা বানানোর কত পাঁয়তারা যে চলে! কিন্তু এটাও আমরা ভুলে যাই যে, আইনের দৃষ্টিতে একজন পতিতাকেও ধর্ষণের অধিকার কারও নেই।

ধর্ষিতার মেডিকেল পরীক্ষাটি কারা করেন? অবশ্যই একজন পুরুষ ডাক্তার, সঙ্গে থাকেন একজন পুরুষ ওয়ার্ডবয়। গ্রামেগঞ্জে নারী ডাক্তার ও নারী কর্মচারীর অভাব হেতু। আসলে কি কেবল এ কারণেই? মোটেই তা নয়। সত্য হল, ধর্ষিতাকে যত বেশি বার নাজেহাল করা যায়। প্রশাসনের ক্ষেত্রেও এ মনোভাব বিরাজমান।

দুই আঙুলের পরীক্ষা পদ্ধতি একসময় ভারতেও ছিল। ২০১৪ সালে সেদেশে পদ্ধতিটি বাতিল করা হয়েছে। আমাদের দেশে সচেতন সংগঠন ও ব্যক্তিরা একই দাবি করে আসছেন– আইনটি বাতিল করা হোক। এ দাবির তোয়াক্কা করে কে? আমাদের আইনে আছে, কোনো নারীর শরীরে যে কোনো তল্লাসি বা পরীক্ষা শুধু নারীরাই করতে পারেন। সে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে ধর্ষিতার মেডিকেল পরীক্ষা করানো হচ্ছে পুরুষ ডাক্তার দিয়ে। ধর্ষিতার বেলায় কি এদেশের বিদ্যমান কোনো আইন প্রযোজ্য নয়? যার বলে তিনি ন্যায়বিচার ও সম্মান পেতে পারেন? একবার ধর্ষিত হওয়া ধর্ষকের দ্বারা– তারপর ক্রমাগত মেডিকেল পরীক্ষায়, আদালতের উকিলের খোলাখুলি জেরায়, পরিবারের সম্মানের কাছে, সমাজের ভালো-মন্দের নিক্তিতে বার বার বিপন্ন হতে থাকেন ধর্ষিতা।

শুধু তাই নয়, আমাদের আইনের এমনই গ্যাঁড়াকল যে, ধর্ষিতাকেই আদালতে প্রমাণ করতে হয় যে, তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কী নিদারুণ অমানুষিক যন্ত্রণা! ধর্ষিতার শাস্তি কেবল এখানেই শেষ নয়, ধর্ষণের মতো অপরাধকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী থাকার বিষয়টি হল সবচেয়ে মর্মান্তিক। ধর্ষণ মামলায় সাক্ষী হাজির করার মতো মূর্খতা আর কী হতে পারে? তবে কিছু কিছু আরব দেশের মতো ধর্ষণকাণ্ডের দুজন সাবালক পুরুষ সাক্ষী যে যোগাড় করার আইন নেই আমাদের এখানে, সেটাও রক্ষে! একজন পুরুষ ধর্ষণ করবে আর দুজন পুরুষ তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে এবং আদালতে গিয়ে তার সাক্ষ্য দেবে, এমনটাও কি সম্ভব?

আমাদের এখন ভাবা দরকার যে, এ বিচারকাজ অন্যভাবেও করা যায়। আমরা কি পুরো ব্যবস্থাটাই এমনভাবে ঢেলে সাজাতে পারি না যেখানে ধর্ষিতার প্রতি সংবেদনশীল থাকবে আদালত ও রাষ্ট্র? এর জন্য প্রথমেই এমন ব্যবস্থা করা দরকার যাতে ধর্ষককে বলা হবে সে প্রমাণ করুক যে, সে ধর্ষণ করেনি। উকিলের জেরার মুখে তার অপকীর্তি বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে তখন।

সে সঙ্গে এভিডেন্স অফ সারকামসটেন্স যাকে বলে সেটি ধর্ষণ মামলায় উপস্থাপন করা উচিত। আইন বিশেষজ্ঞদের তাই মত। বর্তমান আইনের কারণে ধর্ষিতাকে উপদেশ দেওয়া হয় ধর্ষণের পর গোসল না করতে যাতে প্রমাণ মুছে না যায়। কেন ভিকটিমকেই সব সইতে হবে? চলতে পথে গায়ে এক ফোঁটা কাদা লাগলেও যতক্ষণ না তা ধুয়ে ফেলি আমরা ততক্ষণ একটা অস্বস্তি থেকে যায়। আর ধর্ষণের পর গোসল না করে কীভাবে আক্রান্ত ব্যক্তি 'আলামত' বহন করে যাবেন?

আবার বাস্তব কারণে ঘটনার অনেক দিন পর ভিকটিম অভিযোগ দাখিল করতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক সম্মানহানির ভয়ে ধর্ষিতা বা তার পরিবারের পক্ষে মামলা বা অভিযোগ করা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষক বা তার পরিবার বা বন্ধুদের ব্ল্যাকমেইলিং বা ভয়ভীতির শিকার হয়ে ভিকটিমের পরিবার মামলা করতে বাধ্য হন।

এ প্রসঙ্গে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ২০১২ সালে ধর্ষণ-সক্রান্ত একটি মামলার রায়ের সময় বিজ্ঞ বিচারকের ভাষ্য ছিল:

"ধর্ষণ মামলায় ধর্ষিতার সাক্ষ্যই প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকও যদি ধর্ষণের কোনো আলামত না পান বাদীর একান্ত (সোল) সাক্ষ্য অবিশ্বাস করার কিছু নেই।"

আমরা এমন বিচার ব্যবস্থাই চাই। আমরা নারীবান্ধব আইন চাই। ধর্ষিতার প্রতি সহানুভূতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই। চাই এমন প্রশাসন যে ভিকটিমের প্রতি চূড়ান্ত সংবেদনশীল ও অপরাধের বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাবে। ধর্ষিতা বা ভিকটিম কোথায় গিয়েছিলেন কেন গিয়েছিলেন কী পোশাক পরেছিলেন সেটি বিবেচ্য বিষয় হবে না। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে যেতে পারেন। তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রর। সেখানে ব্যর্থ রাষ্ট্র ও সমাজ ভিকটিমের দিকে আঙুল তুলতে পারে না।

ধর্ষণ আসলে হত্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর এক অপরাধ। সে অপরাধে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না। কারণ ছাড় দিতে দিতে আজকের বাংলাদেশ একটি ধর্ষণপ্রবণ দেশে পরিণত হয়েছে। সময়টা চলে গেছে ধর্ষকদের মুঠোয়। বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বিভাগকে সেই নষ্ট হাতের বিষয়ে হতে হবে কঠোরতম। এর বিকল্প নেই।