সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপিত হল কীভাবে?

স্বদেশ রায়
Published : 3 August 2017, 05:04 AM
Updated : 3 August 2017, 05:04 AM

আমাদের সংবিধানের ৬৫(১) ধারায় বলা হয়েছে:

"'জাতীয় সংসদ' নামে বাংলাদেশের একটি সংসদ থাকিবে এবং এই সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত হইবে।"

সংবিধানের ৭(১) ধারায় আছে:

"প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে।"

এর থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, সংবিধান অনুযায়ী এই রাষ্ট্রে 'জাতীয় সংসদ' ছাড়া অন্য কারও আইন প্রণয়ন করার অধিকার নেই। জনগণ কাউকে সে অধিকার দেয়নি। সংবিধানেরই ৭(২) ও ২৬(১) অনুয়ায়ী এই সংবিধানের সঙ্গে অসমঞ্জস কোনো আইন প্রণয়ন করলে ওই আইন স্বাভাবিকভাবে বাতিল হয়ে যাবে।

ষোড়শ সংশোধনী মামলার আপিল বিভাগের রায় প্রকাশ পেয়েছে। ওই রায়ে সংশোধনীটি বাতিল করা হয়েছে। সংশোধনী নিয়ে মামলা পরিচালনায় সরকারপক্ষের শুধু দুর্বলতা ছিল না, অনেকখানি উদাসীনতাও ছিল বলে মনে হয়েছে প্রতি মুহূর্তে। কারণ হাইকোর্টের রায়ে যখন বাহাত্তরের সংবিধানকে একটি 'দুর্ঘটনা' বলা হল, তখন সরকারের নীরব থাকার অর্থই হল বিষয়টি মেনে নেওয়া। সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে, কিন্তু যে ব্যক্তি বাহাত্তরের সংবিধানকে 'দুর্ঘটনা' বললেন, তার বিরুদ্ধে কী আদালতে, কী রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো ব্যবস্থার জন্যে কেউ যায়নি।

দুর্ভাগ্য, কোনো একজন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতি এমনকি প্রধান বিচারপতির কাছে একটি আবেদনও করেননি এই বলে যে, যিনি বাহাত্তরের সংবিধানকে 'দুর্ঘটনা' বললেন, রাষ্ট্রের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বা প্রধান বিচারপতি তার বিরুদ্ধে কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন না?

সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে অস্বাভাবিকভাবে নিশ্চুপ থেকেছে। বাহাত্তরের সংবিধান 'দুর্ঘটনা' হলে এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকে কীভাবে? এর চেয়ে আর কত সরাসরিভাবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি অস্বীকার করা হতে পারে!

সরকার, সরকারের আইন মন্ত্রণালয়, জাতীয় সংসদ সকলে বলতে পারেন, তারা মনে করেছেন আপিল করলে সুপ্রিম কোর্ট ওই অংশ এক্সপাঞ্জ করবেন। তাতে তো শুধু রায় থেকে ওই অংশ বাদ গেল, কিন্তু এর ভেতর দিয়ে কি এটা প্রতিষ্ঠিত হয় না যে, এই রাষ্ট্রে যে কেউ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে, সৃষ্টিকে অস্বীকার করেও সাংবিধানিক পদে থাকতে পারেন?

সরকারপক্ষের দ্বিতীয় দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেছে আপিল বিভাগে ষোড়শ সংশোধনী মামলার শুনানিকালে। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে যে কজন সংশোধনীর বিপক্ষে বলেছেন তাদের মধ্যে ব্যরিস্টার আমীরুল ইসলাম ছাড়া আর কারও ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে বলা নিয়ে আশ্চর্যান্বিত হবার কিছু নেই। আর যারা বলেছেন তাদের সকলেরই হৃদয়ে পাকিস্তান ও সামরিক শাসন। তাদের বিশ্বাস নিয়ে, তাদের অবস্থানে থেকে তারা বলেছেন। তাদেরকে দোষারোপ করে লাভ নেই।

সাংবাদিক হিসেবে মামলাটির রিপোর্ট ছাপতে গিয়ে দেখেছি, প্রথম দুদিনের রিপোর্টে প্রধান বিচারপতির এজলাসে দেওয়া বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে তাঁর অবস্থান। শুনানি শেষ হবার আগেই তিনি তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করেন আদালতে দেওয়া বক্তব্যের মাধ্যমে। তাই তখনই সরকারের পক্ষ থেকে উচিত ছিল সিদ্ধান্ত নেওয়া– তাঁর ওপর অনাস্থা আনা। যাতে তিনি ওই মামলা থেকে সরে দাঁড়ান। আর তিনি যদি সরে না দাঁড়াতেন তাহলে সরকারেরই উচিত ছিল মামলা থেকে নিজেদের তুলে নেওয়া।

সরকার সে কাজ করেনি। সরকারই তাদের নীতি ভালো বুঝবেন, কী তাদের করা উচিত ছিল আর কী নয়। তবে দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে বলা যায়, সরকার এখানে তাদের দুর্বলতা বা উদাসীনতা প্রকাশ করেছে।

যাহোক, শেষ অবধি আপিল বিভাগ অতি সহজে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছে। শুধু তাই নয়, সেখানে প্রধান বিচারপতিসহ দুই বিচারপতি ওই মামলার অংশ নয় সেটাও অর্থাৎ সংবিধানের আরেক অনুচ্ছেদ ১১৬ বাতিলের সুপারিশ করেছেন। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হল, ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে তাঁরা বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হবার মধ্য দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপিত হল।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপিত হয়েছে এই কথা বলার প্রকৃত মালিক কে? এই কাউন্সিল সংসদ দ্বারা বাতিল হয়েছে। সংসদ বিচারপতিদের অপসারণ আইন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বদলে সংসদের ওপর ন্যস্ত করেছিল ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে। এখন বিচার বিভাগ বলছে, ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাই এটা বাতিল। সাংঘর্ষিক বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা সে বিচার এ লেখায় নয়। এখানে শুধু উল্লেখ করছি, বিচার বিভাগ একে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করেছে ভালো কথা– যদি তাদের বিচারে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে বাতিল বলে তারা ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু তার পরিবর্তে কোন আইন কার্যকর বা প্রতিস্থাপিত হবে এটা কি তারা বলতে পারেন?

শুরুতেই উল্লেখ করেছি, "'জাতীয় সংসদ' নামে বাংলাদেশের একটি সংসদ থাকিবে এবং এই সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত হইবে"– এটাই সংবিধানের নির্দেশ।

সংবিধানের নির্দেশ মানতে এই প্রজাতন্ত্রের বা পিপলস রিপাবলিকের সকল বিভাগ বাধ্য। তাই সংসদ ছাড়া আর কেউ কি বলতে পারে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর কী আইন হবে? কেউ কি উল্লেখ করতে পারে? স্বাভাবিকভাবে জাতীয় সংসদের কাছে প্রশ্ন, তারা কী সংবিধানের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের অন্য কোনো অঙ্গের চাপিয়ে দেওয়া আইন চালু করতে পারে?

অন্যদিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রধান হবেন রাষ্ট্রপতি। তিনি সংসদ দ্বারা নির্বাচিত। তিনি কোনো চিফ মার্শাল ল' অ্যাডমিস্ট্রেটর ও রাষ্ট্রপতি নন। রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সংসদ ছাড়া অন্য কারও প্রণীত বা চাপিয়ে দেওয়া কোনো আইন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মানতে পারেন কি?

সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কোনোমতেই একমাত্র জাতীয় সংসদ ছাড়া আর কারও প্রণীত বা চাপিয়ে দেওয়া আইন মানতে বাধ্য নন। স্বাভাবিকভাবে এখানে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গ্রহণ করবেন না বা করতে পারেন না। তিনি কাউন্সিল গঠনও করবেন না। কারণ এই কাউন্সিল ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদ অবলুপ্ত করেছে। সংসদ যতক্ষণ না এটা বহাল করবে ততক্ষণ রাষ্ট্রপতি এটা মানতে বাধ্য নন। অন্যদিকে সংসদও সংসদের বাইরের থেকে বা রাষ্ট্রের অন্য কোনো অঙ্গের চাপিয়ে দেওয়া আইন সংবিধানের অর্ন্তভুক্ত করতে পারে না।

রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ কখনও আইন প্রণয়ন করতে পারে না, তারা আইনের ব্যাখ্যা দিবেন এবং যতটুকু সাংঘর্ষিক ততটুকু বাতিল বলে ঘোষণা করবেন। তার বদলে নতুন আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা তাদের নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল মার্শল ল'র অধ্যাদেশ দ্বারা বাতিল হয়নি, জাতীয় সংসদ দ্বারাই হয়েছে। তাই এখানে এ কথা বলারও সুযোগ নেই যে, যেহেতু ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ সরকারের দ্বারা হয়েছিল, অতত্রব ওই সরকার অবৈধ, তাই স্বাভাবিকভাবে সে সরকারের সব আইন অবৈধ হবে, পূর্বের মূল আইন বহাল থাকবে।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর এখন কোন আইনে বিচারকদের অপসারণ করা হবে সে বিষয়ে আইন প্রণয়নের মালিক সংবিধানের ৬৫(১) অনুযায়ী একমাত্র জাতীয় সংসদ। সংসদ যদি মনে করে তারা ষোড়শ সংশোধনীর আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউ করে আবার সেটি ফেরত পাবে তবে তারা রিভিউতে যেতে পারে। আর তা যদি মনে না করে, তাহলে সংসদের মাধ্যমে আবার সংশোধনী এনে নতুন করে বিচাপতি অপসারণ আইন তৈরি করতে হবে।

তবে কোনোমতেই সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ সংসদের কাছে আশা করবে না যে, তারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের আইন সংসদের মাধ্যমে বৈধ করুক। কারণ কাউন্সিল সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সমঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখানে মূল ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে রাষ্ট্রপতির নির্দেশ মোতাবেক কয়েক বিচারপতি ও অন্য পেশার কয়েক ব্যক্তিকে নিয়ে। তারা কোনো বিচারক অপরাধ করলে তার তদন্ত করে প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবেন। সংসদীয় গণতন্ত্র অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী।

এর অর্থ দাঁড়ায়, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল হলে শেষ বিচারে প্রধানমন্ত্রীই একক ক্ষমতার অধিকারী। এ কারণে কাউন্সিল মূলত স্বৈরশাসনের সঙ্গে সমঞ্জসপূর্ণ, সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে নয়। গণতন্ত্রে এ ক্ষমতা সংসদকেই দিতে হবে– কোনো ব্যক্তিকে বা একক কোনো পদের অধিকারীকে নয়। সংসদকে তাই এ ক্ষেত্রে পুনরায় সংবিধান সংশোধন করে আইন প্রণয়ন করতে হবে।

১৯৬২ সালে এদেশে প্রথম সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রবর্তন করেন সামরিক শাসক আইয়ুব খান। তারপর একই কাজ করেন তারই প্রেতাত্মা, জিয়াউর রহমান। বর্তমানে যারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে কথা বলছেন, তারা আইয়ুব খান না জিয়াউর রহমানের প্রেতাত্মা তা নির্ণয়ের জন্যে জাতিকে হয়তো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে।