রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলো কি এভাবেই চলবে?

রাশেদ মেহেদী
Published : 1 August 2017, 03:22 AM
Updated : 1 August 2017, 03:22 AM

সর্বশেষ খবর দিয়েই শুরু করি। টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন আরও একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি আসছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের পর এর সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজনে নতুন একটি কোম্পনি গঠনের উদ্যোগ। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি এ ব্যপারে কোম্পানির একটা খসড়া কাঠামো তৈরি করেছে। আশা করা যায়, খুব তাড়াতাড়ি কোম্পানির যাত্রা শুরু হবে। কারণ চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কথা রয়েছে।

'রাষ্ট্র উপকৃত হবে, জনগণ সেবা পাবে'– নতুন এই কোম্পানি গঠনের মূল উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই এটি। কারণ এর আগে একই উদ্দেশ্য নিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতে আরও পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গঠন করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, টেলিযোগাযোগ খাতের পূর্বের পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির কোনোটি এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রের উপকারে লাগেনি। গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বরং ওই পাঁচ কোম্পানি একদিকে রাষ্ট্রের অনেকটা বোঝা হিসেবে দৃশ্যমান হয়েছে; অন্যদিকে নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে বিতর্কিত হয়েছে বারবার। এমনকি দুয়েকটি কোম্পানির কর্মকাণ্ডে আর্ন্তজাতিকভাবেও দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকেম কোম্পানিগুলোর একটিতেও পেশাদার ব্যবস্থাপনা নেই। প্রতিটি কোম্পানিতে এমডি পদে নিয়োগ নিয়ে ধারাবাহিক অস্বচ্ছতা চলছে। বিটিসিএল এবং বিএসসিসিলের ক্ষেত্রে একাধিকার নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা হলেও, প্রতিবারই মাঝপথে সেটি স্থগিত করে বিশেষ ব্যবস্থায় পূর্বের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিএসসিসিএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ক্ষেত্রে নজিরবিহীনভাবে চারবার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তাকে পদে রাখার জন্য বাড়ানো হয়েছে চাকরির বয়সসীমা। সর্বশেষ দশ মাসের জন্য বাড়ানো হয়েছে তার চুক্তির মেয়াদ।

বিটিসিএলের ক্ষেত্রেও ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের তদন্তে অনিয়মের জন্য চিহ্নিত ব্যক্তিকে বিশেষ ব্যবস্থায় এমডি পদে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

খুলনা কেবল শিল্প, টেলিটক এবং টেশিসে নিয়মিত ব্যবস্থাপনা পরিচালকই নেই। খুলনা কেবল শিল্পের ক্ষেত্রে পেশাদার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য ১১ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর হুট করে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ রেখে তৎকালীন কোম্পানি সচিবকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। সম্প্রতি এক চিঠিতে দেখা যায় যে, কোম্পানি সচিব বদল হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চলতি দায়িত্বে আগের কোম্পানি সচিবই বহাল রয়ে গেছেন!

কোম্পানিগুলোর শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবে কোম্পানিগুলোর কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা থাকছে না। ফলে কোম্পানির কর্মকাণ্ডে অনিয়ম স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। এতে সার্বিক ব্যবস্থাপনা দক্ষ হচ্ছে না। তাতে কোম্পানিগুলো ব্যবসায়িকভাবে সফল হচ্ছে না, আস্থা অর্জন করতে পারছে না গ্রাহকসেবার ক্ষেত্রেও। আশার কথা হচ্ছে যে, সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে টেশিসের এমডি পদে পূর্বের এমডিকে আগের মতো অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিশেষ ব্যবস্থায় বহাল রাখার উদ্যেগ নেওয়া হলেও, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় যোগ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগদানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এ ধরনের পরামর্শ সত্যিই রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যত নিয়ে আশার সঞ্চার করেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত একটি টেলিযোগাযোগ কোম্পনিকেও প্রকৃত অর্থে কোম্পানি বলা মুশকিল। পাঁচটি কোম্পানিরই বোর্ডের চেয়ারম্যান ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব। কোম্পানিগুলো ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন, আবার বিভাগের সচিব নিজেই প্রত্যেক কোম্পানির বোর্ডের চেয়ারম্যান। একে কি 'কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট' বলা যায় না?

বোর্ড চেয়ারম্যান আর বিভাগের সচিব একই ব্যক্তি হলে, কোম্পানির বোর্ডের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে কীভাবে? নিদেনপক্ষে অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিবকে একেকটা কে বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রাখার ব্যবস্থা থাকলেও এখনকার'কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট' এড়ানো যেত।

আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী বোর্ড ডিরেক্টরস গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও একাধিক উদাহরণ রয়েছে যেখানে আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন মানা হচ্ছে না। যেখানে বর্তমান অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে থাকার কথা, সেখানে চার বছল আগে অবসরে যাওয়া অতিরিক্ত সচিবকে রাখা হয়েছে। যেখানে এফবিসিসিআইএর সহ-সভাপতি পদাধিকার বলে থাকার কথা, সেখানে তিন মেয়াদের পুরনো সহ-সভাপতিকে রাখা হয়েছে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, কোম্পানির ওয়েবসাইটে তাদের সেই আগের পরিচয় দেওয়া হয়েছে যেটা সরাসরি মিথ্যা তথ্য প্রকাশ্যে প্রদর্শন। পাঁচ কোম্পানির এক বোর্ড চেয়ারম্যানের পক্ষে কি আর এত ছোটখাট ত্রুটি নজরে রাখা সম্ভব!

সম্ভবত দুনিয়ার আর কোথাও এভাবে কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিকে আমলানির্ভর করে রাখা হয়নি। অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম কোম্পানি শুধু নিজের দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে সফলভাবে ব্যবসা করছে। এগুলোর প্রত্যেকটিতে বেছে বেছে সেরা ব্যবস্থাপক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকার নিয়মিত নজরদারি রেখে ব্যবস্থাপকদের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করছে। ভারতের বিএসএনএল থেকে শুরু করে নরওয়ের টেলিনর পর্যন্ত সফল রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এই উদাহরণ চোখের সামনেই আছে।

বিপরীতে আমাদের দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম কোম্পানি অনেক ক্ষেত্রে নূন্যতম গ্রাহকসেবাও নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে যদি বিটিসিএলের ফাইবার অপটিক কেবল কাটা যায়, তাহলেই সর্বনাশ! শুক্র-শনি বন্ধ। অতএব রোববারের আগে লাইনম্যান পাওয়া যাবে না। টানা ৫০-৬০ ঘণ্টা কেবল কাটা অবস্থায় থাকবে। একে কি ডিজিটাল যুগের উপযোগী কোম্পানি বলা যায়?

একসময়কার বিটিটিবি আর আজেকের বিটিসিএলএর মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। বিটিসিএল গ্রাহক মাত্রই জানেন তাদের সেবা পাওয়া নিয়ে ভোগান্তি কতটা। কোম্পানির একটা গ্রাহক অভিযোগ কেন্দ্র থাকলেও সেখানে অভিযোগ দিয়ে কোনো ফল কখনও পাওয়া যায় না। লাইনে সমস্যা হলে কোনোবারই গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে অভিযোগ জানিয়ে ফল পাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার নিজেরও নেই। নিদেনপক্ষে পরিচালক মর্যাদার একজনকে সমস্যার কথা জানিয়ে অনুরোধ না করলে অতিসম্মানিত 'লাইনম্যানের' চেহারা দেখা যায় না। এই কোম্পানির পক্ষে কি বর্তমান ব্যবস্থাপনার ভেতরে থেকে ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়া সম্ভব?

রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলো দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কতটা ছেলেখেলা করতে পারে তার সর্বশেষ উদাহরণ দেখা গেছে ঢাকা-কুয়াকাটা দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের ট্রান্সমিশন লিংক স্থাপন কেন্দ্র করে। দ্বিতীয় সাবমেনির কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে ব্যাকহলিংএর জন্য ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা-কুয়াকাটা, ঢাকা-আখাউড়া এবং ঢাকা-বেনাপোল ট্রান্সমিশন লিংক স্থাপনের জন্য বিটিসিএলএর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় সাবমেরিন কেবল কোম্পানি। বিটিসিএল আর্ন্তজাতিক দরপত্র আহবান করে। প্রায় ছয় মাসের প্রক্রিয়ায় বিশ্বের এক নম্বর ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিয়েনার যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য তাদের এজেন্ট নেতাশ নামে একটি কোম্পানি যোগ্য দরদাতা নির্বাচিত হয়।

সব প্রক্রিয়া যখন শেষ, তখন হঠাৎ বিটিসিএলএর বোর্ড নিয়মতান্ত্রিক দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত করে রাষ্ট্রায়ত্ত অপর টেলিযোগাযোগ কোম্পানি টেশিসের কাছ থেকে একটা আবেদন নেয়। যেখানে টেশিসকে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে ভারতের তোজাশ নামে একটি কোম্পানি– গোটা দুনিয়ায় যাদের ১০০ জিবিপিএস সক্ষমতার ডিডব্লিউডিএম কার্ড সরবরাহের প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ ১৫০০ জিবিপিএস সক্ষমতার দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের ব্যাকহল লিংকে নূন্যতম ১০০ জিবিপিএস সক্ষমতার যন্ত্রপাতি বসানোর বিকল্প নেই।

বিটিসিসিএল প্রথম দরপত্রে এই সক্ষমতাই চেয়েছিল। কারণ ১০ জিবিপিএস যন্ত্রপাতি দুনিয়ার আধুনিক লিংকগুলোতে এখন ব্যবহৃত হয় না। একই সঙ্গে ১০ জিবিপিএস কার্ডের চেয়ে ১০০ জিবিপিএসএর ডাটা পরিবহণ ক্ষমতা শুধু বেশি নয়, বিদ্যুত খরচও পাঁচ ভাগের এক ভাগ। অপটিক্যাল সিগন্যালের বিচারেও ১০০ জিবিপিএসকে 'স্মার্ট ইনটেলিজেন্ট' বলা হয়, ১০ জিবিপিএসকে নয়।

১০০ জিবিপিএস কার্ড উৎপাদনের সক্ষমতা না থাকায় প্রথমদিকে সরাসরি তোজাশের আবেদন যোগ্যতার বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয় বলেও জানিয়ে দিয়েছিল বিটিসিএলের কারিগরি কমিটি। অথচ এবার টেশিসের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তেজাশকেই সে কাজ দেওয়া হল। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, ৩১ জানুয়ারির মধ্যে লিংকের কাজ শেখ করার সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ২০১১ সালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের এডিপি পর্যালোচনা সভায় নেওয়া হলেও, এখন পর্যন্ত সেই লিংক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যান্ডউইথ সরবরাহের উপযোগী হয়নি।

র্সবশেষ ৩১ জুলাই লিংক বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কুয়াকাটাস্থ ল্যান্ডিং স্টেশন উদ্বোধনের একটা উদ্যেগ নিয়েছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। পরে সে উদ্বোধনও স্থগিত হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন এত অনিয়ম, অসত্য তথ্য দিয়ে এ ট্রান্সমিশন লিংক স্থাপনে অভিজ্ঞতা না থাকা টেশিসকে জড়ানো হল? কেন, কাদের ষড়যন্ত্রে আধুনিক স্মার্ট-ইনটেলিজেন্ট লিংক তৈরি থেকে বিটিসিএলকে বঞ্চিত করা হল? যে কর্মকর্তারা এসব কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন, তারা কি সত্যিই এসব কোম্পানির উন্নয়ন চান?

তাদের কাজেকর্ম সাক্ষ্য দেয়, তারা যে কোম্পানির দায়িত্বে আছেন, খোদ সেই কোম্পানির স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছেন তারা। এসব কোম্পানির অভ্যন্তরে অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ার পরও ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। বরং তদন্তে যারা অনিয়মের দায়ে চিহ্নিতরা ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে সরাসরি প্রশ্রয় পাচ্ছে এমন একাধিক নজির সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে। যেমন ঢাকা-কুয়াকাটা ট্রান্সমিশন লিংকের নিয়মতান্ত্রিক টেন্ডার বাতিল করা নিয়ে উচ্চ আদালতে আইনি লড়াইও হয়েছে। আদালতের রায়ে টেন্ডার বাতিল অনিয়মের মাধ্যমে হয়েছে উল্লেখ করে যোগ্য দরদাতা প্রতিষ্ঠান নেতাশকে দশ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

নিয়মানুযায়ী অনিয়মের দায়ে আদালত থেকে অভিযুক্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং অনিয়মের সঙ্গে যুক্তরা এখনও বিটিসিএল, সাবমেরিন কেবল কোম্পানি, টেশিসের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়ে গেছেন।

বিএসসিএলএর অভ্যন্তরীন অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করে গত জানুয়ারি মাসে। এপ্রিলে সেই কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। তাতে অনিয়মের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু রিপোর্ট জমা হওয়ার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ একদম চুপ! বরং তদন্তে রিপোর্টে অনিয়মের দায়ে চিহ্নিত বিএসসিসিএলএর কর্মকর্তা বাদী হয়ে যেসব পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের কারণে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় তার বিরুদ্ধে মামলা করছেন, লিগ্যাল নোটিশ দিচ্ছেন।

সম্প্রতি বিএসসিসিএল সিঙ্গাপুরের এক অখ্যাত কোম্পানির সঙ্গে যৌথ ব্যবসায় নামার জন্য বোর্ড সভায় অনুমোদন নেয়। দেখা যায়, বোর্ড সভায় যুক্তরাজ্যের ব্লুবেরি কমিউনিকেশনের নামে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। অথচ সমঝোতা স্মারকের জন্য তৈরি খসড়ায় লেখা হয়েছে সিঙ্গাপুরের ব্লুবেরি টেলিকম গ্লোবাল নামে একটি কোম্পানির নাম। এটা সরাসরি জালিয়াতি।

এই জালিয়াতি পত্রিকার খবরে উঠে আসার পর এর বিরুদ্ধে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ব্যবস্থা নেয়নি। বরং জালিয়াতি তুলে ধরে রিপোর্ট করার কারণে তথাকথিত 'সুনাম ক্ষুণ্নের অভিযোগে পত্রিকায় লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়ে দিলেন বিএসসিএলএর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বিভাগের প্রশ্রয় না পেলে সরকারি তদন্তে রিপোর্টে অনিয়েমর দায়ে চিহ্নিত কর্মকর্তা বাদী হয়ে এভাবে প্রতিহিংসামূলক মামলা দায়ের ও লিগ্যাল নোটিশ দেওয়ার কথা নয়। অনিয়ম, জালিয়তাতিদের সঙ্গে যুক্তদের কীভাবে প্রশ্রয় দিয়ে রাখতে হয় তার একটা দৃষ্টান্ত হয়ে যাচ্ছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ!

অথচ আমরা জানি বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন শুধু দেখায়নি, সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ তথ্য কেন্দ্র স্থাপন, স্কুলে মাল্ডিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তৃণমূলে ছড়িয়ে দিয়ে তার দৃঢ় বাস্তবায়ন দেখিয়েছে। ডিজিটাল সেবায় দক্ষ জনবল তৈরি করে বিশ্বের প্রযুক্তির বাজারে অবস্থান তৈরি করা, ফোর-জি চালুসহ শাক্তিশালী নেটওয়ার্ক অবকাঠামো গড়ে তুলতেও সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে। দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলে যোগ দেওয়া ছিল ডিজিটাল স্বপ্নের পথে অনেকখানি এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেই কেবলের ব্যাকহল লিংক স্থাপন নিয়ে এ ধরনের ছেলেখেলার উদ্দেশ্য কি এটাই যে, সরকারের শুভ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা?

বিএনপি-জামায়াত আমলে অত্যন্ত অনুগত হিসেবে পরিচতিরা এখনও একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বর্তমান সরকারকে বিব্রত করতে এমন খেলায় মেতেছেন, এমন আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সরকারের নীতিনির্ধারকেদের কাছে অনুরোধ, অনেক সম্ভাবনার রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম কোম্পানিগুলো বাঁচানোর যথাযথ উদ্যেগ নিন। এসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে অনিয়ম ও জালিয়াতির জন্য চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিটিতে স্বচ্ছ ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পেশাদার ব্যবস্থাপক নিয়োগ করুন। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের যারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন, তদন্ত করে তাদেরকেও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সত্যিকারের পেশাদার মনোভাবাপন্ন সৎ, যোগ্যদের নিয়ে আসুন।

একই সঙ্গে আশা করব যে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে পুরনো পাঁচ কোম্পানির মতো ব্যবস্থাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন ও বিধির ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো ধরনের 'বিশেষ ব্যবস্থা' গ্রহণ করা হবে না।