প্রশ্নফাঁস বন্ধে দরকার সামাজিক প্রতিরোধ

মুহম্মদ মাহবুব আলী
Published : 2 August 2017, 04:46 AM
Updated : 2 August 2017, 04:46 AM

গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষা পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এ পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে নানা সময়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। মনে পড়ে আশির দশকে যখন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন 'ক', 'খ', 'গ' সেট করা হয়েছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, প্রাইমারি স্কুলের ক্ষেত্রে ইদানীং দেখা যাচ্ছে অভিভাবকরা স্বয়ং প্রশ্নপত্র ফাঁসে উৎসাহী! তারা আমাদের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দিচ্ছে অসৎ হওয়ার। কতিপয় অসৎ অভিভাবক আর কতিপয় অসৎ শিক্ষকের জন্য জাতি আজ লজ্জায় আক্রান্ত। আরেকটু বড় হলে অভিভাবকদের কষ্ট করতে হয় না, কতিপয় শিক্ষার্থীও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করছে, তারপরও দেখা যাচ্ছে, একটি মাফিয়া নেক্সাস এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে।

আসলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র ফাঁস আটকানো এখন আর সরকারের একার দায়িত্ব নয়। এ ব্যাধির হাত থেকে মুক্ত হতে হলে অবশ্যই সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন।

গত ২১ জুলাই গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার উপর ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষা সচিব মো. সোহরাব হোসেইন প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রে যে ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে তার নিন্দা জানান। আসলে এ ধরনের নিন্দনীয় কাজ মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন, সবাই যে সেই প্রশ্ন হাতে পান, তা নয়। তবে এর ফলে ভালো ছাত্রছাত্রীদের উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে, মেধাবীরাও অনেক সময় না বুঝে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে আগ্রহী হয়, যা শিখেছিল তা ভুলে যায়।

আবার একটি দুষ্টু গ্রুপ আছে যারা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস না হলেও নিজেরাই বানিয়ে প্রচার করে পরীক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে। অথচ আমরা আমাদের ছাত্রজীবনের প্রথম পাঠ খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে নিয়েছিলাম: নকল করা ঘৃণার ব্যাপার, এটি মহাপাতকের কাজ। জানি না আজকাল প্রাইমারি পর্যায়ে এসব শেখানো হয় কি না।

পারিবারিক মূল্যবোধও আজকাল কমে গেছে। কেননা প্রাইমারি স্কুলে তো আর ছাত্রছাত্রীরা নিজেরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে ছুটছে না। আমি এখনও মনে করি, দেশে এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন পাবলিক পরীক্ষায় মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে কোনো লজিক্যাল কিংবা অ্যানালিটিকাল অ্যাবিলিটি গড়ে ওঠে না।

মা-বাবা যেভাবে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোচিংয়ে ছোটেন আর কোচিংওয়ালারা যেভাবে অভিভাবকদের পকেট কাটেন, তাতে অবশ্যই অভিভাবকদের সদয় সম্মতি থাকে। কারণ, তাদের কথা হল যেভাবে পারুক ছেলে কিংবা মেয়ে যেন গ্লোডেন জিপিএ-৫ পায়।

হায়রে হতভাগা অভিভাবক! নিজের অজান্তেই কুড়াল দিয়ে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে গ্লোডেন জিপিএ-৫ পেয়েও তারা যা জানে তার চেয়ে ঢের বেশি জানে 'এ' লেভেলে 'সি' গ্রেড পাওয়া ছেলেমেয়েরা। অথচ দেশে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের জন্য সরকার কম চেষ্টা করছে না। যেভাবে বর্তমানে প্রশ্নপত্র ফাঁস, আবার ফাঁস আটকানোর প্রয়াস কিংবা কোচিংওয়ালারা পকেট কাটছে সে ক্ষেত্রে মনে হয়, আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে অ্যাসেসমেন্টের পদ্ধতি ভিন্ন করা দরকার।

যদি একশর মধ্যে নম্বর ভিন্নভাবে এসএসসি, এইচএসসিতে পুনর্বন্টন করা যায় তবে ভালো হয়। ক্লাস অ্যাটেনডেন্স, ফিল্ড ভিজিটের ভিত্তিতে রিপোর্ট, অ্যাসাইনমেন্ট এবং বাকি পঞ্চাশ নম্বর যদি 'ওপেন বুক সিস্টেম' করা যায়, তবে হয়তো এ ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে বাঁচা যাবে। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তার যথেষ্ট অবকাশ আছে। আর পাঠ্যপুস্তক সহজীকরণের জন্য সরকার ইতোমধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যদি অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি চলমান থাকে তাহলে হয়তো কিছুটা ফাঁকিজুকি কমতে পারে।

বাঙালি মেধাবী জাতি। মেধা বাঙালির কম নেই। কিন্তু সমস্যা হল, আমরা সেই মেধা ইতিবাচক কাজে প্রয়োগ করব নাকি নেতিবাচক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করব। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সরকার যত শুভ উদ্যোগ নিক না কেন, আমাদের অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

একদল অভিভাবক-শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কোচিং ব্যবসায়ী আমাদের দেশের ভালো শিক্ষার মানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে। তার উপর আছে আরেক শ্রেণির বেনিয়া যারা সার্টিফিকেট বিক্রি করে। আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে অনেকেই বেঁচে যাচ্ছে। অথচ এই বেনিয়াদের জন্য একজন ছাত্র বা ছাত্রীর জীবনে অন্ধকার নেমে আসতে পারে। অজ্ঞাত কারণে সার্টিফিকেট বিক্রির সঙ্গে জড়িত বেনিয়ারা বারবার বেঁচে যায়। অথচ তাদের কারণে কত পরিবারে হাহাকার নেমে এসেছে; জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে যদি সার্টিফিকেট ব্যবহার করতে না পারে তাহলে ওই ছেলে বা মেয়ের জীবন তো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে।

সনদবাণিজ্যের ওস্তাদরা কত ভয়ংকর যে অন্যায় করেও তারা পার পেয়ে যায়। সরকার এখন পর্যন্ত দেশে কোনো স্টাডি সেন্টারের পারমিশন দেয়নি। তারপরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ক্ষমতার দাপটে এখনও স্টাডি সেন্টার চালু রেখেছে। কতিপয় বেনিয়ার পাশাপাশি কিছুসংখ্যক শিক্ষাবিদও এখানে রোজগারপাতি ভালোই করছেন। তাঁরা দেশের প্রচলিত আইন অমান্য করে চলেছেন।

এ দিকে আমাদের যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাদের উপর আগামীদিনের জাতি গঠন ও পরিচালনার ভার পড়বে, তা আসলে তাদের শিক্ষার মান ও উৎকর্ষের সঙ্গে জড়িত। যতই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ নিক না কেন, যতদিন জাতিগতভাবে বুঝব না যে নকলকারী, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী আর সনদ বাণিজ্যকারীরা দেশের ক্ষতির কারণ, ততদিন কিন্তু গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি হবে তৈলাক্ত বাঁশের মতো, পাঁচ হাত উপরে উঠলে ছয় হাত নিচে নামবে। অথচ আমাদের ছাত্রছাত্রীরা বিদেশে আইইএলটিএস, টোয়েফেল, স্যাট, জিআরই, জিমেট ইত্যাদি দিয়ে প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে। দেশের পুরনো চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে। আবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১০ থেকে ১৫টি বেশ ভালো করছে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে হয় না বরং সময়ের ব্যবধানে পাঁচটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। এবং এ ক্ষেত্রে অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি রয়েছে শিক্ষার্থীদের উপযোগী এবং তাদের কেন্দ্র করে পাঠ ও পঠনের ব্যবস্থা করা, গবেষণাকর্ম সম্পাদন করা, সামাজিক উন্নয়নে সংযুক্ত হওয়া এবং আন্তর্জাতিকীকরণ করা। আসলে এসব পদক্ষেপ কিন্তু সরকার গ্রহণ করেছে। আর গুণগত মান নির্ভর করে থাকে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর।

আমাদের দেশে যখন আইবিএ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয় কিংবা বুয়েট থেকে পাস করে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিএসসিসহ নানা বিষয়ে পাস করে তাদের মান কিন্তু খারাপ নয়। কিন্তু আমরা যে গোড়ায় গলদ রাখছি: দেশের প্রতি অবিশ্বস্ত ও অর্থলোভী একটি চক্র কেবল টাকা বানানোর পাঁয়তারায় দেশের বদনাম করে চলেছে।

বাণিজ্যিকিকরণে কেবল দেশ নয় বিদেশ থেকেও নানা উছিলায় ব্যবসা করার নাম করে এ দেশে আসছে। আমাদের দেশের সরকারপ্রধান উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি করতে চাইছেন। উদ্যোক্তা তৈরির জন্য আইএলও থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন দেশে ফাউন্ডেশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নানামুখী কোর্স রয়েছে।

এখন এ দেশেও জানুক বা না জানুক কিংবা এ দেশের ব্যবসাপদ্ধতির সঙ্গে কোনো ধরনের মিল না থাকলেও ইংরেজরা যেমন বিনা পয়সায় চা খাইয়ে এককালে চা খাওয়ার নেশা ধরিয়েছিল, তেমনি কোচিংয়ের নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এ প্রয়াস অবশ্যই বন্ধ করা দরকার।

আমাদের দেশে ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরির জন্য বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ বিদেশ থেকে যেভাবে টাকার বিনিময়ে কিংবা ফ্রি পড়ানোর নাম করে এ দেশে ব্যবসা গড়তে চাইছে, সে ক্ষেত্রে বেনিয়াদের হাত থেকে সাবধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। উদ্যোক্তা গঠনের জন্যে যা যা করণীয় বিজনেস ইনকিউবেটর স্থাপন থেকে শুরু করে কিংবা যেভাবে অর্থ পেতে পারে, উদ্যোম উদ্ভাবনী, সৃজনশীল পদ্ধতির বিকাশ ঘটাতে পারে, সেদিকে পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়েছে।

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস সৎ পরীক্ষার্থীদের উপর বাড়তি স্নায়ুবিক চাপ সৃষ্টি করে থাকে। পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি ভর্তি পরীক্ষাতেও এ ধরনের প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। এমনকি চাকরির পরীক্ষাতেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার গুজব রটে। ফলে দেশে অনেক বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। যারা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার।

পরীক্ষা পদ্ধতিতে আসলে পরিবর্তনশীলতা দরকার। 'কন্টিনিউস অ্যাসেসমেন্ট প্রসেস' গ্রহণ করা দরকার। আসলে একসময়ে ভালো নোট বই ছিল যার কারণে ছাত্রছাত্রীদের কোচিংয়ে যাওয়ার দরকার হত না। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন কোচিং-বাণিজ্য এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, স্কুল-কলেজে মূলত খুব কম পড়ালেখা হয়। মানসম্পন্ন ছাত্রছাত্রী যদি সততার সঙ্গে পরীক্ষা দেয় অবশ্যই ভালো ফল করবে– এ আত্মবিশ্বাস তাদের মধ্যে প্রোথিত করতে হবে। এটির দায়িত্ব পরিবার ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।

অনেক নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যারা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যে আলোক-উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে তার স্ফূরণ না ঘটিয়ে বরং কীভাবে অধিকতর নম্বর পাওয়া যায়, স্কুল-কলেজের আরও সুখ্যাতি ঘটে, সেদিকে ছুটছে। নকলের কারণে মেধার উৎকর্ষ যেমন বিনষ্ট হয় তেমনি সৃজনশীলতার অপমৃত্যু ঘটে। উদ্ভাবনী শক্তিবিহীন হয়ে পড়ে পরীক্ষার্থী।

তোতাপাখির মতো মুখস্থ বিদ্যা আর নকল করার মনমানসিকতা ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে যা 'গ্র্যাসাম ল'-এর মতো, খারাপ টাকা ভালো টাকাকে দূর করে দেয়। অথচ সব ছাত্রছাত্রী কিন্তু এ অপকর্মের জন্য দায়ী নয়। আমাদের সময়ে বি.জি. প্রেস থেকে হত, আর এখন নৈতিকতাহীন কতিপয় শিক্ষক, বেনিয়া, অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীর একাংশ এ অব্যবস্থার জন্য দায়ী।

এ ঘৃণিত কর্মের বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত সময়োচিত পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে। আসুন, নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধ করি, জানাই কঠোর প্রতিবাদ।