চট্টগ্রাম একটি নদীর নাম

চৌধুরী শহীদ কাদেরচৌধুরী শহীদ কাদের
Published : 30 July 2017, 05:41 PM
Updated : 30 July 2017, 05:41 PM

"তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।"

['তিতাস একটি নদীর নাম', অদ্বৈত মল্লবর্মণ]

আমাদের চট্টগ্রাম নদী নয়, একটি নদীবন্দরের নাম। কর্ণফুলি নদী কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই শহরকে বলা হত বন্দর শহর। কালের বিবর্তনে এই বন্দর শহর কীভাবে বর্ষা মৌসুমে একটি নদীতে পরিণত হয়েছে সেটাই আমার লেখার মূল বিষয়। অবশ্যই গণমাধ্যমের কল্যাণে আপনারা এই বর্ষায় কমবেশি সবাই দেখছেন স্বপ্নের এই শহর কীভাবে নদীতে পরিণত হয়েছে।

এই নদীতে চলাফেরা করার জন্য চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ কর অফিস ইতোমধ্যে একটি নৌকা ক্রয় করেছে। অফিসের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কর দিতে আসা নাগরিকদেরও তারা সেবা দিচ্ছে। এই অফিস চট্টগ্রামের অফিসপাড়া হিসেবে খ্যাত আগ্রাবাদের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। তাহলে বুঝার চেষ্টা করুন ওই পাড়ার বাকি অফিসগুলোর হালহকিকত! এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত এই শহর প্রায় ৩০ বার নদীতে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় এত বেশি পানি এই শহরে জমছে যে, কর্ণফুলির জোয়ার-ভাটার সঙ্গে এই নদী নামক শহরেও জোয়ার-ভাটা হচ্ছে।

ফেসবুকে একজন ঠাট্টার ছলে লিখেছেন, একসময় চট্টগ্রামে কার গ্যারেজে কয়টা গাড়ি আছে, কোন ব্রান্ডের গাড়ি আছে এটা নিয়ে লোকজন বাহাদুরি করত। সময় বদলে গেছে। এখন বিএমডব্লিউর দিন শেষ। এ সময় কার বাড়ির সামনে কয়টা নৌকা আছে সেটা বিবেচনায় খান্দান নির্ণীত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম আমার স্বপ্নের শহর। এই শহরে আমার জন্ম। শৈশব-কৈশোরের সোনালি দিনগুলোর স্মৃতিমাখা আমার এই শহরে। আমাদের বেড়ে ওঠার সময় এই শহর আমরা অন্যভাবে দেখেছি। রাস্তার মাঝখানে আইল্যান্ডে রঙিন ফুল, শান্ত, পরিস্কার একটি নগরী। চট্টগ্রাম এত বেশি পরিচ্ছন্ন নগরী ছিল যে, এটি অভিহিত হয়েছিল হেলদি সিটি হিসেবে। সকালে দেখতাম সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি রাস্তায় পানি দিচ্ছে, যাতে রাস্তায় ধুলো না উড়ে। আমার চেনা সেই শহর বদলে গেছে ভীষণভাবে। শতবর্ষ আগের কথা বলছি না, মাত্র এক দশক কী দেড় দশক আগের চট্টগ্রামের কথা বলছি। এত অল্প সময়ে কীভাবে একটি শহর নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তার উজ্জল দৃষ্টান্ত চট্টগ্রাম।

বর্ষায় এটি যেমন নদীতে পরিণত হয়েছে, শীতে এটা পরিণত হয় ধুলোর নগরীতে। সারা বছর এই শহরের বুকে লেগে আছে ট্রাফিক জ্যাম। দখল হয়ে গেছে এর সমস্ত কিছু। নদী, খাল, নালা, ফুটপাত, খেলার মাঠ, পার্ক সব কিছু এক বিশেষ শ্রেণির দখলে চলে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৫ নম্বর জেটির পাশে কর্ণফুলির বিরাট একটি অংশ ভরাট করে নৌবাহিনী তাদের আলাদা জেটি গড়ে তুলেছে। দখল-বাণিজ্যে কেউ পিছিয়ে নেই। এই শহরের নষ্ট হওয়ার এই ধারা শুরু করেছিল মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। আর নষ্ট হওয়ার পূর্ণতা পেয়েছে বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছিরের হাতে।

দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার চিত্র। ঘণ্টাপ্রতি ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই এই শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তলিয়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দিষ্ট কোনো একটি কারণে নয়– সমন্বয়হীনতা, অতিবৃষ্টি, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার পাশাপাশি জোয়ারের পানি ঠেকানোর মতো কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় প্রায়ই পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে বন্দরনগরী। চাকতাই খালের উপরের অংশে প্রশস্ততা ৩৫ ফুট হলেও নিচের অংশে গিয়ে ১৫ ফুটে দাঁড়িয়েছে। চাকতাই খাল খননের নামে নগরীতে হরিলুট হয়েছে, নগরবাসী এর সুফল পায়নি। নগরীর পানি নিস্কাশনের ড্রেন, নালা, নর্দমা ও খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। অনেকগুলো স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের দখলে গিয়ে দালান-বিল্ডিং নির্মিত হয়ে নগরীর পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এ চক্র চাকতাই খাল খননে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ফলে নগরীতে একটু বৃষ্টি হলেই নিচু এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে।

অপরিকল্পিত নগরায়নও অনেকে জলাবদ্ধতার কারণ হিসাবে দেখছেন। তারা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ কোনো গবেষণা ছাড়াই চসিক খাল সংস্কারকাজে পানিতে টাকা ঢালছে। আর চউক প্রতিদিনই অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘরের নকশার অনুমোদন দিচ্ছে। ড্রেনেজ নিয়ে নেই কোনো ভাবনা। দুই যুগ ধরে দফায় দফায় পরিকল্পনাতেই সব সীমাবদ্ধ। গত ছয় বছরে চউক প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চসিকও বিভিন্ন খাতে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু এর সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী। উল্টো এখন দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কোনো কোনো প্রকল্প। এ নিয়ে চসিক ও চউকের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথাও বলছেন অনেকে। দুই সংস্থার কার্যক্রম ও পরিকল্পনা গ্রহণে সমন্বয়ের অভাব বর্তমানে চট্টগ্রামকে নদীতে পরিণত করেছে বলে অনেকেই বলছেন।

জলাবদ্ধতার দায়ভার কার?

এ নিয়ে নানামুখী বিতর্ক হতে পারে। তবে এর একমাত্র উত্তর, এর পুরো দায়ভার নগরপিতার। সিটি মেয়রকে পুরো দায়ভার নিতে হবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছিরউদ্দিন বলছেন, জলাবদ্ধতা সমস্যা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। মাননীয় নগরপিতা, আপনি দুই বছর সময় পেয়েছেন, এই দুই বছরে কী করেছেন এই উত্তরাধিকার সমস্যা মোকাবেলায়? আমার মতো চট্টগ্রামে শৈশব-কৈশোর কাটানো সাংবাদিক শরীফুল হাসান তাঁর ফেসবুক পেইজে লিখেছেন, "চট্টগ্রাম যখন পানিতে ডুবে থাকে তখন এই শহরের মেয়র কী করে স্বাভাবিক থাকেন? যেসব ছবি দেখে আমরা আঁতকে উঠি সেই ছবিগুলো কি তাকে স্পর্শ করে না?মাননীয় মেয়র, নগরের যথার্থ পিতা হলে আপনি কি ঘুমাতে পারতেন?"

প্রশ্নের অনেক উত্তর থাকতে পারে মেয়র মহোদয়ের কাছে। কিন্তু সাদা চোখে সিটি কর্পোরেশনের কোনো কর্মকাণ্ড নগরের এই আমজনতার কাছে ধরা পড়েনি।

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার পেছনে অনেকেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (চউক) দায়ী করছেন। শুধু রাস্তা নির্মাণ বা আবাসিক এলাকা তৈরিতেই ব্যস্ত চউক। ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পও গ্রহণ করা হয় সম্ভাব্যতা জরিপ ছাড়া। চউকের অনেক প্রকল্প জলাবদ্ধতার কারণ হচ্ছে। ফ্লাইওভারের কারণে পানি নিষ্কাশিত হতে না পারার ফলে কোনো কোনো অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

চট্টগ্রাম নগরের উন্নয়নে নিয়োজিত সরকারি সংস্থা বিশেষ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বন্দর কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় নেই। সমন্বয় না থাকায় তারা জলমগ্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে নিজেরা কতটা নির্দোষ সেটা প্রমাণে বেশি ব্যস্ত। সিটি মেয়র, সাবেক মেয়র, চউক চেয়ারম্যান সবাই বলছেন, মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হলে এই দুর্ভোগ কমবে। ভাই, তাহলে তাই করছেন না কেন?

জনগণের স্বার্থে একবার এক হোন, আমাদের এই কষ্ট থেকে বাঁচান। যে নগরে একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা নালায় পড়ে মারা যান সে নগরের একজন অভিভাবক পিতার অবশ্যই লজ্জা থাকা উচিত। বিবিসি বাংলার সংবাদে বলা হচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রামের জনগণের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। হতাশা একসময় ক্ষোভে পরিণত হয়। আর সেটা ক্ষোভে পরিণত হলে কী হয় সেটা ইতিহাস থেকে দেখে নিলে নগরের ইজারাদাররা ভালো করবেন।

শেষ করছি সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি গল্প দিয়ে। চট্টগ্রামের এক লোক বৃষ্টির পানির মধ্যে ড্রেনে পড়ে মারা গেলেন। তিনি স্বর্গে গিয়ে দেখলেন বিশাল এক দেয়াল। সেই দেয়ালখানা ঘড়িতে পরিপূর্ণ। তা দেখে মৃত লোকটি স্বর্গের দূতকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে এতগুলো ঘড়ি কেন?

স্বর্গের দূত: এগুলো হল মিথ্যা ঘড়ি। প্রত্যেক মানুষের জন্য একটি করে রাখা আছে। দুনিয়াতে থাকা অবস্থায় কেউ যদি একবার মিথ্যা কথা বলে তাহলে ঘড়ির কাঁটা একবার ঘুরবে, দুটি মিথ্যা কথা বললে দুইবার ঘুরবে। এভাবে যে যতবার মিথ্যা কথা বলবে তার ঘড়ির কাঁটা ততবার ঘুরবে।

মৃত ব্যক্তি: আচ্ছা, ওই ঘড়িটি কার?

স্বর্গের দূত: এটা মাদার তেরসার ঘড়ি। এটার কাঁটা একবারও ঘুরেনি,তার মানে তিনি জীবনে একটি মিথ্যাও বলেননি।

মৃত ব্যক্তি: আচ্ছা, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আর সিডিএতে যেসব রাজনীতিবিদ আছেন তাদের ঘড়িগুলো কই?

স্বর্গের দূত: দেখুন, সাধারণত বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের ঘড়িগুলো আমাদের অফিসরুমে থাকে। ওগুলো আমরা টেবিল ফ্যান হিসেবে ব্যবহার করি। কিন্তু চট্রগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আর সিডিএতে যেসব রাজনীতিবিদ আছেন তাদের ঘড়ির কাঁটাগুলো আমরা হেলিকপ্টার উড়ানোর কাজে ব্যবহার করি। ওগুলো এত জোরে ঘুরে যে অফিসিয়াল কোনো কাজে ব্যবহারের জো নেই।