মানবপাচার রোধে দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা

ফরহাদ আল করিম
Published : 30 July 2017, 06:01 AM
Updated : 30 July 2017, 06:01 AM

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মানব পাচার পরিস্থিতি অবনতি ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বছরের জুন মাসের শেষে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর মানব পাচারের বিশ্বব্যাপী একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যা 'ট্রাফিকিং ইন পারর্সনস (টিআইপি) রিপোর্ট ২০১৭' নামে পরিচিত। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কেও তথ্যউপাত্ত রয়েছে। মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ সফলতা দেখাতে পারেনি বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মতে, এই ক্ষেত্রে সফলতা দেখানোর পরিবর্তে বাংলাদেশ পূর্বের অবস্থান থেকে নিচে নেমে এসেছে।

মানব পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশ গত বছর যেখানে 'টায়ার টু'তে ছিল, কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি অবনতি ঘটে টায়ার নেমে টু-এর 'ওয়াচলিস্ট' বা নজরদারিতে থাকা দেশ হিসেবে অবস্থান করছে। কারণ, বাংলাদশে সরকার পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে মার্কিন এই দপ্তর মনে করে। বিষয়টি যদি সত্যি হয় তাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি দুঃসংবাদ, আবার উদ্বেগজনক বিষয়ও বটে।

মার্কিন এই প্রতিবেদনে মানব পাচারের পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী দেশগুলোকে তিনটি স্তর বা টায়ারে ভাগ করা হয়েছে। যেসব দেশ পাচার ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে, অর্থাৎ 'ট্রাফিকিং ভিকটিমস প্রোটেকশন অ্যাক্ট'-এর ন্যূনতম মান পূরণে সক্ষম হয়েছে তাদের 'স্তর একে' (টায়ার ওয়ান) রাখা হয়েছে। পাচাররোধে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ না নিতে পারলে উদ্যোগ গ্রহণকারীদের স্থান হয় দ্বিতীয় স্তরে। দ্বিতীয় স্তরকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: 'টায়ার টু' ও 'টায়ার-টু-ওয়াচলিস্ট'। সর্বশেষ অবস্থানে রয়েছে 'তৃতীয় স্তর' (টায়ার থ্রি)।

মানব পাচার বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা এবং একটি ঘৃণ্য অপরাধও বটে। পাচারের শিকার মানুষদের মানবাধিকার নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রতিবছর পাচারের শিকার হয়ে সারা বিশ্বে অনেক মানুষের জীবনে সর্বনাশ ঘটছে। জাতিসংঘের মাদকদ্রব্য ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) মানব পাচারের তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পাচারের শিকার প্রতি তিনজনের একজন শিশু। তারা অনেকেই যৌন নিপীড়ন ও জোরপূর্বক কায়িক শ্রম দিতে বাধ্য হয়। তাই এটাকে কেউ কেউ 'আধুনিক দাসত্ব' বলছেন।

ইউএনওডিসির মতে, সারা বিশ্বের কোথাও না কোথাও মানুষ নানাভাবে পাচারের শিকার হচ্ছে, অর্থাৎ পৃথিবীর কোনোস্থানেই মানুষ পাচারকারীর খপ্পর থেকে নিরাপদ নয়। জাতিসংঘের এই সংস্থাটির মতে, পাচারের শিকারের অধিকাংশ নারী ও শিশু (প্রায় ৭০ ভাগ)।

জাতিসংঘের মতে মানব পাচার হল:

"ভয় দেখিয়ে বা জোর করে অথবা কোনোভাবে জুলুম করে, হরণ করে, প্রতারণা করে, ছলনা করে, মিথ্যাচার করে, ভুল বুঝিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, অথবা যার উপরে কর্তৃত্ব আছে পয়সা বা সুযোগ-সুবিধার লেনদেনের মাধ্যমে তার সম্মতি আদায় করে শোষণ করার উদ্দেশ্যে কাউকে সংগ্রহ করা, স্থানান্তরিত করা, হাতবদল করা, আটকে রাখা বা নেওয়া।"

সংজ্ঞাটির ব্যাখা যা-ই হোক না কেন, এ কথা সত্যি যে নানাবিধ কারণে মানুষ নানাভাবে পাচারের শিকার হচ্ছে। চাকরির প্রলোভন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন, নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা বা বসবাসের ভালো পরিবেশ দেওয়ার কথা বলে একশ্রেণির মানুষ এই ছলচাতুরি করে পাচারের সুযোগ নেয়।

মানব পাচারের ভয়াল এই থাবা থেকে বাংলাদেশও কোনোভাবে নিরাপদ নয়। আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুরসংখ্যক মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে। কেউ বা পাচার হয়ে ফিরে কিছুদিন পরে ফিরে আসছে, আবার কেউ চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে রয়েছে। অনেক সময় সামাজিক লোকলজ্জার ভয়েও পাচারের শিকারের পরিবার ঘটনাটি জানায় না। ফলে ঘটনা আমাদের আর জানা হয় না, জানা যায় না কার মাধ্যমে এই সর্বনাশটি ঘটল।

প্রতিবছর কত মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ বছরে প্রায় এক মিলিয়ন (বা ১০ লাখ) মানুষ বাংলাদেশ থেকে পাচারের শিকার হয়েছে।

আমাদের দেশ থেকে সীমান্তপথে ভারতে অথবা সাগরপথে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে নিয়মিত পাচার হচ্ছে। মূলত নারী ও শিশুরা বেশি সংখ্যায় পাচারের শিকার হচ্ছে। কারণ, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার আলোকে তারা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বরাবরই স্বীকৃত। সাম্প্রতিককালে বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামেও পাচারকারীরা নতুনভাবে এই ঘৃণ্য অপকর্মটি করে যাচ্ছে যা থামানো দরকার।

আমাদের জনবহুল এই দেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুরসংখ্যক শ্রমিক বিভিন্ন পেশায় চাকরি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে এবং রেমিটেন্সের মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধ করছে। সরকারের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থাকায় বর্তমানে নারীরাও বিদেশে যেতে আগ্রহী হচ্ছে।

গত বছর প্রায় সাড়ে সাত লাখ নারী ও পুরুষ কর্মী দেশের সীমানা পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে গিয়ে চাকরিতে যোগ দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুরসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছে, কিন্তু তৃণমূলে অভিবাসী সেবাদানকারী নির্ভরযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় সঠিক তথ্য ও সহযোগিতা পেতে বিদেশগামীদের প্রায়ই মধ্যস্বত্বভোগীর উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে।

অপর্যাপ্ত বা ভুল তথ্য ও দালালের মিথ্যা আশ্বাসে পড়ে মানুষ যেমন বিভ্রান্ত হয়, তেমনি আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। সুতরাং নিরাপদ শ্রম অভিবাসন নিশ্চিতকরণে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা নিশ্চিত করতে হলে তৃণমূল পর্যায়ে সঠিক সেবাদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু সদিচ্ছা থাকলেও সরকারের পর্যাপ্ত সক্ষমতা না থাকায় সেবার মান মাঠ পর্যায়ে বিস্তৃত করাও সহজে সম্ভব হয় না। ফলে পাচারকারীরা মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগে সর্বনাশ করতে দ্বিধাবোধ করে না।

বিগত পাঁচ বছরের সংবাদপত্রের চিত্র থেকে জানা যায়, অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষকে প্রলোভন দিয়ে একশ্রেণির অসাধু মানবপাচারকারী সাগরপথে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাচ্ছে। আবার অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কেউবা ভূমধ্যসাগর বা অনুমোদিত নয় এমন ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে অর্থ ও জীবন দুটিই হারাচ্ছে।

এ বছর সাগরপথে অবৈধভাবে যেসব দেশের লোক ইউরোপে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ সেই তালিকার অন্যতম। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সমম্বয়ের কাজ করা সংগঠন প্রনটেক্সের মতে, শুধুমাত্র ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সেন্ট্রাল মেডিটেরেনিয়ান পথ দিয়ে সাত হাজার ৮৯৯ বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করেছে।

তুরস্কসহ অন্যান্য দেশে অনেক বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী বর্তমানে আটক রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এই অভিবাসনপ্রত্যাশীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বরাবর যেমন নিজের ক্ষতি করছে, তেমনি বিদেশে দেশের মানসম্মানও নষ্ট হচ্ছে।

বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে বিদেশে যাওয়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে এই রুটে মালয়েশিয়াগামীরা যেতে মরিয়া। বিশ্লেষকদের ধারণা, দারিদ্র্যতা, সরকারিভাবে বিদেশে ভালো চাকরির সুযোগ কম হওয়া, মালয়েশিয়া ইস্যুতে জিটুজি বা অন্যান্য চুক্তির কার্যকরিতা না থাকা, ভিসার অধিক দাম, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারির অভাব ও মানুষের সচেতনতার অভাবে বিদেশে যেতে এই ঝুঁকিপূর্ণ পথকে বরাবরই উৎসাহিত করছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার মতে, বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে গত চার বছরে অন্তত দেড় লাখ মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে। তাদের কেউ পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে, আবার কেউ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফিরে আনা হয়েছে যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু রয়েছে।

২০১৭ সালের শুরুতে সরকার 'মানব পাচার দমন ও সুরক্ষা আইন ২০১২' বাস্তবায়নের জন্য বিধি চূড়ান্ত ও তা প্রয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৫-২০১৭ সালে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার জন্য একটি রোডম্যাপ বাস্তবায়নের খসড়াও তৈরি করা হয়েছে।

তবে পাচারের বিরুদ্ধে এসবের কার্যকরিতা চোখে পড়ার মতো নয়, তাই হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি আশানুরূপ হয়নি। তবু আমরা আশাবাদী: আমাদের পরিস্থিতির শিগগিরই উন্নতি ঘটবে। ২০১২ সালে 'মানব পাচার দমন ও সুরক্ষা আইন ২০১২' হওয়ার পর গত পাঁচ বছরে পাচারকারীর বিরুদ্ধে সাড়ে তিন হাজার মামলা দায়ের হলেও খুব সামান্য পরিমানে বিচার হয়েছে, যা হতাশাজনক।

মানব পাচার রোধে প্রথমে যা দরকার তা হল, সামাজিক সচেতনতা তৈরি। সবাই যদি সচেতন হই তাহলে পাচাররোধ করা যাবে সহজেই। তাছাড়া যেসব আইন বা নীতিমালা রয়েছে সর্বশক্তি দিয়ে সেসবের প্রয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্রের পক্ষে আইন বাস্তবায়নে যাঁরা নিয়োজিত রয়েছেন তাদের সদিচ্ছা যদি থাকে তাহলে সহজে পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।

আমরা জানি পৃথিবীর কোনো আইন শতভাগ পরিপূর্ণ নয়। সময়ের প্রয়োজনে নতুন নতুন আইন প্রণীত হবে এবং হচ্ছেও। তবে সবার সদিচ্ছা আর সন্মিলিত উদ্যোগ মানব পাচারের মতো ঘৃণ্য আপরাধকে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলোপ করতে পারে। এ ছাড়া পাচারের শিকার হচ্ছে যারা তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতির হাত বাড়াতে হবে। আমাদের অনাদর বা অবহেলায় পাচারের শিকার কেউ যেন সমাজের মূলস্রোত থেকে হারিয়ে না যায় সেদিকে সদয় দৃষ্টি দিতে হবে।