মন্ত্রিসভায় রদবদল : গুজব নাকি সম্ভাবনা ?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 29 July 2017, 06:38 PM
Updated : 29 July 2017, 06:38 PM

কদিন ধরে মন্ত্রিসভায় রদবদলের একটি গুজব বা সম্ভাবনার কথা বাতাসে ভাসছে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে স্পেকুলেটিং নিউজ ছাপা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সাংবাদিকদের কাছে এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেননি।

মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভার রদবদল প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার ও ইচ্ছাধীন। আবার রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থায় এটা রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার ও ইচ্ছাধীন। সব দেশেই মন্ত্রিসভায় রদবদল একটি স্বাভাবিক ঘটনা। সরকারপ্রধান চাইলে ও সরকারের কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য সহায়ক মনে করলে যে কোনো মুহূর্তে মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন করতে পারেন। মন্ত্রিসভায় রদবদল তাই কোনো বড় খবর নয়। কিন্তু আমাদের দেশের মিডিয়ায় অনেক সময় অনেক গুরুত্বহীন খবর গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ খবর অসাধরণ হয়ে ওঠে।

কোনো কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টির খবর বের হয়েছে এবং এই পদে জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নিয়োগের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। খবরটি ওবায়দুল কাদের অস্বীকার করছেন। সেটাই করার কথা। খবরটি যে সংবাদকর্মীর মস্তিষ্কজাত, তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। আর যাই হোক, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টির কথা কারও কল্পনায়ও আনা বা আসা উচিত নয়। দেশে এখন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে সক্রিয় এবং দক্ষ ও যোগ্য মন্ত্রী আর একজনও নেই। কাজের চাপ থাকলেও তিনি তা সামাল দেন অত্যন্ত সুচারুরূপে। প্রধানমন্ত্রীর কাজ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বরং অন্য মন্ত্রীরা কোনো সমস্যায় পড়লে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ বা হস্তক্ষেপেই তার দ্রুত সুরাহা হয়।

প্রধানমন্ত্রী ক্লান্তবোধ করছেন বা তাঁকে সহযোগিতার জন্য কেউ থাকলে ভালো হয়– এমন কথা শোনা যায়নি। শোনা যাবে বলেও মনে হয় না। তাহলে বেহুদা উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা বা গুজব কেন? কারও মনে যদি এমন কোনো বাসনা থেকেও থাকে তাহলে তা এখনই ঝেড়েমুছে ফেলা উচিত। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে উপ-প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উপযুক্ত লোকটি কে?

সবদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে রকম তীক্ষ্ণ নজর, মন্ত্রিসভার অন্য কোনো সদস্যের সে রকম আছে বলে কোনো ঘটনা থেকেই প্রতীয়মান হচ্ছে না। সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়।

ঘটনা– ১

বরগুনার ইউএনও গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগে ৫ কোটি টাকার মানহানির মামলা, তার বিরুদ্ধে আদালতের সমন জারি, আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন প্রার্থনার পর তা না-মঞ্জুর, তাকে জেলে প্রেরণ– এই সমস্ত বিষয়ই ছিল আইন ও কর্তৃত্ববহির্ভূত।ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রচারের পর সবার আগে সক্রিয় হওয়া দরকার ছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের। কারণ তারিক সালমন একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। আইন মন্ত্রীরও এখানে সক্রিয়তা প্রয়োজন ছিল। কারণ বরিশালের বিচারক মো. আলী হোসাইন ওই মামলা গ্রহণ, সমন জারি, জামিন না-মঞ্জুর ইত্যাদি কোন আইনবলে করেছেন, সেটা জানা বা দেখার দায়িত্ব তাঁর ছিল।

দেখা গেল, তারিক সালমনের ব্যাপারে সবার আগে সক্রিয়তা দেখালেন মানীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি নজরে না নিলে কি তারিক এত সহজে রেহাই পেতেন? প্রশাসন ক্যাডারে অসন্তোষ দেখা দেওয়ার আগেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ায় রক্ষা হয়েছে।

এই ঘটনায় বরিশাল ও বরগুনার দুই ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। জনপ্রশাসন বিভাগের মাঠ প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব মাকসুদুর রহমান পাটোয়ারীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন পুলিশ সদস্যকেও ক্লোজড করা হয়েছে। কিন্তু যে বিচারক আইন মান্য না করে এত কিছু করলেন, তার কিছু হবে না? দেখা যাক এ ব্যাপারে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট কী করেন।

তবে প্রধান বিচারপতি ওই মামলার নথি তলব করার পর বরিশালের বিচারক মো. আলী হোসাইন অসত্য ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তারিক সালমনের জামিন নাকি না-মঞ্জুর করা হয়নি। অথচ প্রকাশ্য কোর্টেই তিনি না-মঞ্জুরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি বুঝে তিনি অবস্থান পরিবর্তন করছেন। তার নৈতিক অসততার দুয়েকটি খবর গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে।

ঘটনা– ২

তিতুমীর কলেজের একজন ছাত্র মো. সিদ্দিকুর রহমানের ঘটনায়ও প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত ছিল শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। কিন্তু না, এখানেও সেই প্রধানমন্ত্রীকেই এগিয়ে আসতে হল। তিনি ছাড়া তাঁর মন্ত্রিসভায় সংবেদনশীলতা আর কজনের আছে সেটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়।

সিদ্দিকুর আহত হবার পর প্রধানমন্ত্রীর সমবেদনার বাণী নিয়ে হাসপাতালে যান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক–সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি সিদ্দিকুরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি খরচে বিদেশে পাঠানোর কথা জানান। এরপর অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ হাসপাতালে গিয়ে সিদ্দিকুরকে সহানুভূতি জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাসপাতালে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারেননি। যদিও পুলিশের ছোঁড়া টিয়ার শেল লেগে সিদ্দিকুরের দুটি চোখই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সিদ্দিকুরকে চেন্নাই পাঠিয়েছে।

এসবই হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর তাগিদে। একেবারে শিশুকালে পিতৃহারা, অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান সিদ্দিকুরের চোখের আলো যদি না ফেরে তাহলে কী হবে তার পরিবারের অবস্থা? এখানেও কি প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি ছাড়া কোনো উপায় হবে?

প্রয়োজন বিবেচনা করেই সাধারণত সরকারে, প্রশাসনে পদ সৃষ্টি করা হয়। এই প্রয়োজন হতে পারে রাজনৈতিক অথবা অন্য কোনো। ভারতে এখন উপ-রাষ্ট্রপতি আছেন, কিন্তু উপ-প্রধানমন্ত্রী নেই। নরেন্দ্র মোদী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন কোনো উপ-প্রধানমন্ত্রীর দরকার হয় না। কোনো কারণে কখনও দুর্বল প্রধানমন্ত্রী হলে কিংবা জোটগতভাবে সরকার গঠিত হলে পাওয়ার ব্যালেন্সের প্রয়োজনে উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ তৈরি হয়েছে। ভারতে এমন হয়েছে।

বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের সময় একজন উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এরশাদও সেটা রেখেছিলেন। সেটা ছিল সামরিক শাসকদের বেসামরিক মুখোশের প্রয়োজনে। গণতান্ত্রিক শাসনে উপ-রাষ্ট্রপতি পদে আর কাউকে প্রয়োজন হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর সময় সেনাবাহিনীতে উপ-প্রধানের পদ তৈরি করা হয়েছিল মূলত জিয়াউর রহমানের কথা মাথায় রেখে। শফিউল্লাহ সেনাপ্রধান, জিয়া ছিলেন উপ-প্রধান। তারপর আর সেনাবাহিনীতে উপ-প্রধান প্রয়োজন হয়নি। যদিও তারপর ক্রমাগত বাহিনীর লোকবল ও অন্যান্য শক্তি বেড়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টির কথা বিবেচনাযোগ্য হলেও হতে পারে, কিন্তু উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ কোনোভাবেই নয়।

এবার আসা যাক মন্ত্রিসভায় রদবদলের প্রসঙ্গে। আগেই বলছি, এটা হতেই পারে এবং হওয়া উচিত। আমাদের দেশে একবার কেউ মন্ত্রী হলে আর সহজে তার পদ যায় না। অথচ মন্ত্রিসভাটি দুর্নীতিমুক্ত, বিতর্কহীন ও গতিশীল রাখতে হলে রদবদল একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। মন্ত্রীরা যখন তার চাকরি স্থায়ী মনে করেন তখনই বেপরোয়া হয়ে উঠেন। দুচারজন মন্ত্রীর খারাপ কাজের দায় গিয়ে চাপে পুরো মন্ত্রিসভা ও সরকারের ওপর।

আমাদের বর্তমান মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ আছে। দুর্নীতি-স্বজনপোষণ-দলীয় কর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণ ছাড়াও অযোগ্যতার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না, অফিস যেতে পারেন না এমন মন্ত্রীও আছেন। কেন তাদের রাখা হচ্ছে, তারা সরকারের কোন উপকারে আসছেন, তাদের জন্য সরকারি দলই-বা কোথায় কতটুকু লাভবান হচ্ছে সেটা অনেকের কাছেই পরিষ্কার না হলেও তাদের মন্ত্রীর চাকরি বহাল আছে। গাড়ি-বাড়িতে পতাকা উড়িয়ে তারা সুখভোগ করছেন।

কিন্তু দেশ, সরকার, দল ও দেশের মানুষের তাতে কী উপকার হচ্ছে?

সব দিক বিবেচনা করেই মন্ত্রিসভার সংযোজন-বিয়োজন এখন জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষকরাও মনে করছেন। সরকারের সামনে কঠিন সময় আসছে। বিএনপির দিক থেকে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ দেখা না দিলেও অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করছে বা করবে। তাই সরকারের দুর্বল বা নড়বড়ে খুঁটিগুলো সরিয়ে তুলনামূলক সবল-শক্ত খুঁটি লাগানো দরকার।

এমন তো নয় যে, বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগে যোগ্য-উপযুক্ত লোকের আকাল পড়েনি। তাই প্রধানমন্ত্রীর এখন মোহমায়া ছেড়ে শক্ত মনে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। যত দিন গড়াবে পরিস্থিতি তত অন্যদিকে মোড় নেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।

মন্ত্রিসভায় রদবদলের গুজব বা জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়ে এটা সত্যে পরিণত হওয়া এখন অনেকটা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগে নিশ্চয়ই আরও অনেকে আছেন যারা মন্ত্রিসভায় জায়গা পেলে অপবাদমুক্ত থেকে কাজ করতে পারবেন বলে মনে করা হয়। তবে কেউ কেউ এটাও বলতে পারেন যে, শেখ হাসিনার চেয়ে আওয়ামী লীগের ভালো-খারাপদের আর বেশি চেনেন কে? অন্যরা দেখেন বাইরে থেকে্। শেখ হাসিনা দেখেন ভেতর থেকে, উপর থেকে, সামগ্রিকভাবে। তাঁর হাতে সবার আমলনামা আছে।

তাই তিনি তার বিবেচনাবোধের সর্বোত্তম প্রয়োগ ঘটিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে হবে আর কাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে এটা করতে তিনি আরও সময় নেবেন কি না দেখার বিষয় সেটাই।