দেশহীন, নাম-গোত্রহীন: ছিটমহলবাসির লড়াই

শামীমা বিনতে রহমান
Published : 7 April 2012, 02:37 PM
Updated : 7 April 2012, 02:37 PM

গারাতি গ্রামে চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবি, যৌন নিপীড়নের আতঙ্ক সব সময়ই থাকে। এ কারণেই থাকে, কেউ আহত, নিহত বা ধর্ষণের শিকার হলে তাদের বিচার জানাবার কোন প্রশাসনিক জায়গা নেই। একেবারেই নেই এমন না, কাগজে-কলমে আছে, কোচবিহার জেলা। তবে ৬৪ বছর ধরে তাদের অস্তিত্ব ভারতের মানচিত্রে ছিট ছিট ফোঁটার মতোই রয়ে আছে। বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার সদর থানার হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের পাশে গারাতি, ভারতের ৭৮ নম্বর ছিটমহল। ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর রাতে সেখানে একটা ঘটনাই ঘটে। বাংলাদেশী জাতীয়তা পরিচয়ের এক ডাকাত, রমজান তার কিছু সহযোগিসহ সেখানে ডাকাতি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে এবং গণপিটুনিতে মারা যায়। ডাকাত রমজান আটকা পড়ে মারা যাওয়ার খবরের সঙ্গে সঙ্গেই ডাকাতের সহযোগিরা, যারা হাঁড়িভাসা ইউনিয়নেরই বাসিন্দা, তাৎক্ষণিক পুড়িয়ে দিল ১০২টি ঘর-বাড়ি। ১৭ অক্টোবর বিভিন্ন দৈনিকগুলাতে খবর হিসাবে আসে গারাতি ছিটমহলের ঘটনা। প্রথম আলো পত্রিকায় শিরোনাম ছাপা হয়েছিল, 'ভারতীয় ছিটমহলে বেশ কিছু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ'।

এ ঘটনা খবর হিসাবে দৈনিকগুলোতে খবর হওয়ায় প্রথম যে প্রশ্নটি সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে, সেটা হলো: এ ঘটনায় অপরাধী চিহ্ণিত হবে কিভাবে? শাস্তি হবে কি করে? কারণ যেখানটায় ঘটনা ঘটেছে, তা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডে হলেও গারাতি ছিটমহল ভারতের ভূখন্ড। কী পরিহাস!

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভৌগলিক সীমা-রেখায় নির্দিষ্ট জায়গার দায়িত্ব পালনে এটি বাংলাদেশের এখতিয়ারের বিষয় না। তাহলে? এই তাহলের প্রশ্নেই চলে আসে ছিটমহলের মানুষের দীর্ঘ সারি। ছন বা বেড়ার তৈরি ছোট ছোট ঘর। পুষ্টিহীন রোগা রোগা হাত-পা-শরীর, ফ্যাকাসে চোখ–যাদের কোন প্রধানমন্ত্রী নাই, প্রেসিডেন্ট নাই, 'আমাদের সেনাবাহিনী' বলে সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য গর্বে উল্লাস করে না অথবা ঘৃণায় থুথু ফেলে না। কারাগারের উঁচু দেয়াল ছাড়াই তারা অদৃশ্য কারাগারে বন্দী।


এই মানুষগুলা, অর্থাৎ, বাংলাদেশের ভেতর থাকা ভারতীয় ছিটমহলের মানুষগুলা বাংলাদেশী পরিচয় পাওয়ার জন্য এখন অনশন শুরু করেছে পঞ্চগড়ে। ২০ দিনের বেশী সময় ধরে এই বাংলায় আর ভারতের ওই বাংলায়, কোচবিহারের দিনহাটায় চলছে অনশন। অনেক দিন চলছে টানা অনশন, কিন্তু টনক নড়ছে না কারোই। প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে অদৃশ্য কারাগার থেকে ওদের মুক্ত হবার কি কোন পথ নাই?

এই ভাবনাই তল খুঁজতে গিয়ে উদ্ধার করে ১৯৪৭ সালের ভারত পাকিস্তান ভাগ পর্ব পেরিয়ে ১৯৪৯ সালের রেডক্লিফ মিশনের সমাধানের চেষ্টা, ১৯৫৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহওর লাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূনের চুক্তিতে পৌঁছার চেষ্টা। ১৯৭৪ এ ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে এসে প্রশ্নের সামনে অগ্রসরমান ভাবনা একটা স্টপেজ পায়।

গারাতি ছিটমহলের বাসিন্দা, গোলাম মোস্তফা, যিনি ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ শাখার একজন সদস্য,ছিট মহল বিষয়ক আলাপে জানালেন, '২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত ছিটবাসিরা ভারতের পঞ্চায়েতের কার্ড ব্যবহার করে নিয়মিত ভারতে আসা যাওয়া করতে পারতো। কিন্তু আমি বলবো তাদের শতকরা ৯০ ভাগই নিজেদের ভারতীয় ভাবে না। ভাববে কি করে! ভারত সরকারের কাছ থেকে সেখানকার নাগরিক হিসেবে কোন সুযোগ সুবিধি কি তারা পেয়েছে? পায় নি। বাংলাদেশের নাগরিক না হলেও জন্ম এখানে, বাপ-দাদার জন্ম এখানে, বড় হয়েছে এখানে। ওরা বাংলাদেশেই থাকতে চায়।'

সীমান্ত থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে গারাতি ছিটমহল। ছিটমহল নিয়ে রিপোর্ট করতে পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটের ছিটমহলগুলোতে গিয়ে আশ্চর্য এক শারীরিক অনুভূতি হলো। পঞ্চগড়ের বোদা থানার এলাকার দিকে, সীমান্ত থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে ৩৭ নম্বর ছিটমহল, শালবাড়ি ছিটমহলে গিয়ে মনে হলো পেছনে ফেলে আসা ঘাস, আর ছিটমহল বলে পরিচিত জায়গাটুকুর ঘাস, মাটি, গাছের পাতার রং কোথাও কোন তফাৎ নেই। তফাৎ নেই লজ্জা, সংকোচে ঠোঁট চেপে মাটির দিকে চোখ নামিয়ে ফেলা, উচ্ছ্বাস হাসি কোন কিছুতেই। আমার যেমন, আমাদের যেমন; ওদেরও তেমন। তফাৎটা হলো আমার চলা ফেরায় যে আত্মপরিচয় নিশ্চিত হবার যে নাগরিক অধিকার, সুবিধাগুলো আমাকে যতটা ঋজু করে, তার যে এক্সপ্রেশন আমার শরীর, চেহারায় আছে –তাদের তা নাই। ওদের জন্য কোন স্কুল, হাসপাতাল, থানা কোন কিছুই নেই। আদম শুমারীতে কোন নাম তো নেই-ই, ভোটার তালিকায়ও কোথাও তাদের নাম উঠে নাই। না কোচবিহারের প্রশাসনে, না পঞ্চগড়ের প্রশাসনে। একজন বললেন, 'রাস্তা বানানোর সময়, মাটি কাটার কামলার কামে গিয়া খাড়াইলে কয়, তোমরা ছিটের মানুষ। যাও যাও। তোমগো এনে কাম নাই।'
'হাসপাতালে গেলে একটু ধইরা তো দেখেই না, থানায়ও কোন বিচার নিয়া যাওন যায় না।'
এভাবেই তারা বাংলাদেশের ভূখন্ডের ভেতর থেকেই, ১৯৪৭ এর ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময় কোচবিহার আর রংপুর অঞ্চলের জমিদারদের উন্নাসিকতায় এখনও 'অপর' হয়েই আছেন। আত্মপরিচয় হীন আর দেশ হীন ।

খেয়াল করুন পাঠক, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে দুই দেশের ভূখন্ড সীমানা চিহ্ণিতকরণ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সমাধানই ছিল মূল কথা। একটি ভূমিকা, একটি উপসংহার, ৫টি অনুচ্ছেদ এবং ১৫টি উপ-অনুচ্ছেদ ছিল এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত। অনুচ্ছেদ-১ এবং ১২ নং উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো অতিসত্ত্বর বিনিময় করতে হবে। এর বাইরে থাকবে চুক্তিতে বর্ণিত ১৪ অধ্যায়ে উল্লেখিত ছিটমহলগুলো যাতে বাংলাদেশে যে বাড়তি এলাকাগুলো পড়বে তার জন্য কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করা যাবে না।

এই চুক্তির প্রথম অনুচ্ছেদের ১৪ উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং-১২ এর দক্ষিণ দিকস্থ অর্ধাংশ ও পার্শ্ববর্তী ছিটমহলগুলোর অধিকারি হবে, যে এলাকার পরিমাণ প্রায় ২.৬৪ বর্গমাইল এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলের অধিকারী হবে। বাংলাদেশের পানবাড়ী মৌজার (পাটগ্রাম থানা) সঙ্গে দহগ্রামকে সংযুক্ত করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে 'তিনবিঘা' নামে ১৭৮ দশমিক ৮৫ মিটার এলাকা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেবে।

চুক্তির দিনই বেরুবাড়ির মালিকানা স্বত্ব বুঝে নিয়েছে ভারত, যার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম এ্যামেন্ডমেন্টটি হয়। প্রথম সংশোধনী হওয়ার কারণে এখানে গুরুত্ব এবং আন্তরিকতা দুইটাই প্রকাশ পায় বাংলাদেশ সরকারের। অথচ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ গত বছরের সেপ্টম্বর মাসে এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রটোকল সই করে গেছিলেন। সেই অনুযায়ি দ্রুতই চুক্তি বাস্তবায়িত হবার কথা। কিন্তু এখন মনমোহনের দল কংগ্রেস, চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সীমানা নির্ধারনী সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব তাদের লোকসভায় উঠাতে পারছে না।

২০ মার্চ, ২০১২ বিবিসি বাংলা সার্ভিস অনলাইনে দিল্লী প্রতিনিধির রিপোর্ট ' ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে দুদেশের ছিটমহলবাসীরা অনশন পালন করছেন', রিপোর্টটিতে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মন্তব্য উল্লেখ করা হয়। মিস ব্যানার্জি কেন্দ্র সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, 'বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও সমঝোতা করতে গেলে কেন্দ্র সরকারকে আগে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কারণ আমরা বাংলাদেশটা ভাল বুঝি।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে চুক্তি বাস্তবায়নে বাগড়া দিচ্ছেন বিবিসির ওই রিপোর্টে তা বলা হয়। কিন্তু কেন তিনি বাগড়া দিচ্ছেন, তার সাথে ভারতের ইউপিএ সরকারের প্রধান শরীক কংগ্রেসের সাথে কী লেনদেন, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য কতটুকু নির্ভর করতে হয় তৃণমূলের সাথে-ওইসব হিসাব নিকাশ তো ছিটমহলবাসীর করার কথা না। ওদের একটাই দাবি: অনশনস্থলে ব্যানার করে লেখা, 'হয় নাগরিকত্ব নয় মৃত্যু।'

গত দেড় বছরে, অর্থাৎ, ২০১০ সালের শেষ কয়েক মাস থেকে এখন পর্যন্ত, ছিটমহলবাসীরা বেশ কিছু কর্মসূচি পালন করে ফেলেছে। এরমধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহীও কর্মসূচিও ছিল।

২৯ জানুয়ারি ২০১১ সালে কোলকাতার বর্তমান পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়, 'বাংলাদেশের ছিটমহলে উড়লো ভারতীয় পতাকা'। খবরটিতে বলা হয়: 'মঙ্গলবার সাধারণতন্ত্র দিবসে বাংলাদেশের পোয়াতুরকুঠি ছিটমহলে ভারতের জাতীয় পতাকা তোলা হয়। শুধু তাই নয়, মশালডাঙা, করলা, গোবরা ছড়া, বাকালির ছড়া প্রভৃতি বাংলাদেশী ছিটমহলগুলোতেও একইভাবে ভারতের জাতীয় পতাকা তুলে সাধারণতন্ত্র দিবস পালন করা হয়েছে। ওই ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা বলেন, স্বাধীনতার ৬৩ বছর পরেও ভারত বা বাংলাদেশ সরকার- কেউই ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেনি।… এই কাজ বেআইনি, কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদের ছেলেমেয়েরা পরিচয় ভাঁড়িয়ে ভারতের স্কুল, কলেজে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। ভারতীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার জন্য আমাদের ভুয়া ঠিকানা দিতে হয়। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা ভারতের অংশ হয়ে থাকতে চাই। সরকারের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতেই ২৬শে জানুয়ারি ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।'

আর বাংলাদেশ অংশে ভারতীয় ছিটমহলগুলাতে ২০১০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, বিজয় দিবসে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়েছে। পরের বছর ভাষা আন্দোলনের প্রতীক ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ পালন করা হয়েছে। বাতি নিভিয়ে দুই দিন নিজেদের অন্ধকারময় জীবনকে প্রতীকি হিসাবে উপস্থাপন করেছে। এখন আন্দোলন চলছে অনশন করে।

কোচবিহারে দাবি আদায়ে অনশনে থাকা ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক দিপ্তীমান সেনগুপ্ত, যার বাবা দীপক সেনগুপ্ত(প্রয়াত, কোচবিহারের সিতাই বিধান সভার বিধায়ক, ফরোয়ার্ড ব্লক) প্রথম এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন নব্বইয়ের দশকে; প্রশ্ন করেছিলাম: ২০ দিনের বেশি অনশন গড়িয়ে গেলেও সরকার তো কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, কি করবেন এখন?

বললেন, 'এতদিন অনশন করে ধৈর্য্য দেখালাম। কেন্দ্র সরকার বাজেট অধিবেশনে সংবিধান সংশোধন বিল আনবে বলেছে, আনে নি। বাংলাদেশ সরকারও ভারতের বিদেশ মন্ত্রকে একটা চিঠিও পাঠায় নি। এরপর যদি কোন ঘটনা ঘটে, তবে এর দায় দুই দেশের সরকারের।'( টেলিফোন সাক্ষাৎকার, ৭ এপ্রিল, ২০১২)

সমস্যাটি সমাধানে ভারত কেন আগ্রহী নয়? ভূমি জরিপ অধিদপ্তর, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিজিবি সদর দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে। এর আয়তন ৭ হাজার ১শ' ১০ দশমিক শূন্য ২ (৭১১০.০২) একর। আর বাংলাদেশের ভেতরে রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল, এর আয়তন ১৭ হাজার ১ শ ৫৮ দশমিক শূন্য ৫ (১৭১৫৮.০৫) একর। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ি ছিটমহলগুলা বিনিময় করলে ভারত যেটুকু বাড়তি জমি পাবে, বাংলাদেশ তার চেয়ে ১০ হাজার একর বেশি পাবে।

এ দিকটি ছাড়াও ছিটমহলগুলোকে অপরাধের কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহার করার বহু অভিযোগ রয়েছে। সীমান্ত ঘেঁষা সবগুলো ছিটমহল হওয়ায় এগুলোর বেশিরভাগই নারী, শিশু পাচারের রুট হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী থানায়, সীমান্ত থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে দাশিয়ারছড়া ছিটমহলটি ফেন্সিডিল, গাঁজাসহ অন্যান্য মাদকের পরিচিত ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে দীর্ঘদিন। অস্বীকৃত, অপ্রতিষ্ঠিত এসব কালোবাজারি ব্যবসায় মুনাফা অনেক বেশি। স্ব স্ব দেশের নাগরিক সুবিধা যথাযথভাবে পাওয়া এসব মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিকদলের উচ্চ পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে। এটাও একটা কারণ।

ভারত-বাংলাদেশ ছাড়া ছিটমহল সংক্রান্ত এমন সমস্যা রয়েছে অষ্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যাণ্ডেও। নিউজিল্যাণ্ডের সীমানার মধ্যে এমন কিছু এলাকা এখনও রয়ে গেছে যেগুলা অষ্ট্রেলিয়ার। কিন্তু দুই দেশের সরকারের সম্মতিক্রমে ওই ছিটমহলের বাসিন্দাদের দ্বিনাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, অষ্ট্রেলিয়া নিউজিল্যাণ্ড দুই দেশেরই পরিচয়পত্র রয়েছে তাদের। কিন্তু ভারত কিংবা বাংলাদেশ, কোনও দেশের সংবিধানেই দ্বিনাগরিকত্বের স্বীকৃতি নেই। আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে থাকা এই ছিটমহলবাসীর জন্য দ্বিনাগরিকত্ব দেয়ার উদ্যোগ কোনভাবেই আমাদের সংবিধানে যুক্ত হবার সম্ভাবনা নেই। কারণ ওইসব মানুষ অসম্ভব ক্ষমতাহীন। বিজয় দিবসে বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় ছিটমহলবাসি বাংলাদেশে পতাকা তুলে রাষ্ট্রদ্রোহী আচরণের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব সংকটকে সংবাদপত্রের শিরোনাম করলেও ভারত, দ্বিনাগরিকত্বের প্রস্তাবে যাবেই না। না যাক, ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ি বিনিময়টাই বাস্তবায়ন করুন। ইন্দিরা গান্ধী স্বাক্ষরিত চুক্তির আজও বাস্তবায়ন না হওয়া কি কংগ্রেসের রাজনৈতিক কমিটমেন্টের প্রতি শিশুদের ভেংচিকাটার মতো বুড়ো ভাঁড়ামি নয়? প্রধানমন্ত্রী মনমহোন সিং ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়নে মনোযোগী হোন।

চুক্তি ঝুলিয়ে রাখা, ছিটমহলবাসীকে দেশ সম্পন্ন মানুষ হিসাবে মর্যাদাবান করার অধিকার ঝুলিয়ে রাখা মানে চুক্তির প্রতি ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের 'বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্ক'র প্রতি দ্বৈত নীতির উচ্চকিত চর্চা।

শামীমা বিনতে রহমান: লেখক ও সাংবাদিক।