উচিত শিক্ষা-৬: বইপড়ানি মাসি-পিসি মোদের বাড়ি এসো!

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 5 August 2017, 05:46 AM
Updated : 5 August 2017, 05:46 AM

"শীতকালে সকালবেলায় পুরনো বই, যেগুলো নতুন সিলেবাসের সঙ্গে মিলত, সেগুলো এপাড়া-ওপাড়ায় ঘুরে ঘুরে জোগাড় করতে হত। নতুন ক্লাসে ওঠার পর নতুন বইয়ের সিলেবাস পেতাম বটে, বইগুলো নতুন কেনা হত না। সেকেন্ড হ্যান্ড বই, আগের বছর যারা ওই ক্লাস থেকে পাস করে গিয়েছে, খুঁজে পেতে অর্ধেক দামে কিনতে হত তাদের কাছ থেকে। শুধু খেয়াল রাখতে হত বইগুলো 'ঘিয়েভাজা' অর্থাৎ অতি-ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গিয়েছে কি না।… তবে বাড়িতেই ওপরের ক্লাসের দাদা থাকলে নতুন বই পাওয়ার সম্ভাবনাটা এমনিতেই অনেকটা কমে যায়, ফলে দাদার ছোট হয়ে যাওয়া জামাজুতোর সঙ্গে আগের ক্লাসের বইয়ের উত্তরাধিকারও বহন করতে হয়েছে আমাকে।"

— অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শৈশবের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে টেকসই, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পাঠ্যবইয়ের কথা।

এই সময়ের অনেক অনেক দিন পরেও, সত্তর-আশির দশকে আমাদের ছাত্রজীবনের পাঠ্যবই পাশ্চাত্যের মানের ছিল না বটে, কিন্তু বর্তমানের পাঠ্যবইয়ের তুলনায় সেগুলো কয়েক গুণ বেশি টেকসই, সুন্দর এবং মানসম্পন্ন ছিল। স্বীকার করতেই হবে যে, কাগজের মান, বাঁধাই ও মুদ্রণের দিক থেকে বাংলাদেশের হাল আমলের পাঠ্যপুস্তক অতি নিম্নমানের।

আমাদের পাঠ্যপুস্তক রচয়িতারা বা শিক্ষাবিষয়ক নীতিনির্ধারকরা কি পাশ্চাত্যের বইপত্র কখনও খুলে দেখেন না? তারা কি চান না একই পাঠ্যপুস্তক একাধিক শিক্ষার্থী ব্যবহার করুক? বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে সেটাই বেশি স্বাভাবিক নয় কি? জাপান বা কানাডার মতো দেশে মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তকগুলো বহু বছর ধরে ব্যবহার করা যায়। লন্ডন, মন্ট্রিয়ল বা প্যারিসের পুরোনো বইয়ের দোকানে ত্রিশ বছর আগের পাঠ্যপুস্তকও কিনতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের পাঠ্যবই এক বছরও ব্যবহার করা যায় কিনা সন্দেহ।

অর্থের অভাবে বইয়ের মান বাড়ানো যাচ্ছে না– এই অজুহাত দেওয়া যাবে না। কারণ সবাই জানে, 'কোম্পানি কা বেশিরভাগ মাল দরিয়া মে' ঢালা হচ্ছে– আমাদের সবার চোখের সামনে। শুনেছি প্রতি বছর বাংলাদেশের কোটি কোটি প্রাথমিক শিক্ষার্থীকে যে বই সরবরাহ করা হয়, তার একটি অংশ ছাপা হয় দেশের বাইরে। এর একটা কারণ নাকি এই যে, মুদ্রিত কাগজ যেহেতু শিক্ষা-উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয় সেহেতু মুদ্রিত কাগজ আমদানি করার শুল্ক অমুদ্রিত কাগজ আমদানির তুলনায় কম।

কারণ যাই হোক, এর ফলে কমপক্ষে দুটি ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের। প্রথমত, মুদ্রণের কাজটা দেশের ছাপাখানায় না হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে; দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রীয় অর্থকোষে শুল্কের অর্থও কম জমা হচ্ছে। এর পেছনে প্রধান কারণ সম্ভবত বাণিজ্য। কারণ প্রতি বছর বই ছাপানো মানেই একাধিক গোষ্ঠীর টু-পাইস কামানো। তাতে জনগণ বা দেশের যত বড় ক্ষতিই হোক না কেন।

পাঠ্যবই আকর্ষণীয় হতে হবে– কী প্রচ্ছদে, কী বিষয়-বিন্যাসে, কী আঙ্গিকে। পাঠ্যবইয়ে প্রচুর সমুদ্রিত ছবি থাকতে হবে। আগে তো দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী। এমনভাবে রচিত হবে একেকটি পাঠ্যবই যাতে সেগুলো একজন পেশাদার শিক্ষকের স্থান অনেকটাই পূরণ করতে পারে। বিষয়বস্তু বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমে থাকবে দৈনন্দিন জীবন থেকে উদাহরণ, তারপর সংজ্ঞা। তারপর উদাহরণের সঙ্গে সংজ্ঞার সম্পর্ক দেখাতে হবে। উদাহরণে ছবি থাকলে ভালো হয়। আজকাল ডিজিটাল বইয়ে ভিডিও-অডিও ক্লিপ যোগ করাও অসম্ভব নয়।

পাশ্চাত্যের অনেক টেক্সট বুকে প্রতিটি পৃষ্ঠা উলম্বভাবে বিভক্ত থাকে। একদিকে (বাম বা ডানদিকে) থাকে টেক্সটের এক একটি পরিচ্ছদ; অন্যদিকে থাকে সেই পরিচ্ছদের সংক্ষিপ্তসার। একজন শিক্ষার্থী যত অলস, যত ফাঁকিবাজই হোক না কেন, কমপক্ষে সংক্ষিপ্তসারের উপর চোখ সে বুলাবেই। কথা বলার ভঙ্গিতে পাঠ্যবইয়ে আলোচনা এগিয়ে যাবে।

সক্রেটিসের মতো প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতেও পাঠ্যবই লেখা হতে পারে, যেখানে কাল্পনিক কোনো ছাত্র অপরিহার্য প্রশ্নগুলো করে যাবে একের পর এক এবং শিক্ষক মজলিশি ভঙ্গিতে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাবেন। প্রতিটি অধ্যায় বা উপ-অধ্যায়ের শেষে প্রশ্ন থাকবে। বইয়ের শেষে সেই প্রশ্নগুলোর সংক্ষিপ্ত উত্তর থাকবে এবং তদুপরি বলা হবে, কোন অধ্যায়ের কোন পরিচ্ছেদে একেকটি প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর পাওয়া যাবে।

যে কোনো বিষয় কমপক্ষে তিন ধরনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়: সিংহাবলোকন, বিহঙ্গাবলোকন, কীটাবলোকন। সিংহ যখন কোনো উপত্যকায় থাবা গেড়ে বসে বা দাঁড়িয়ে সম্মুখের অবারিত তৃণভূমির দিকে তাকায় তার নাম 'সিংহাবলোকন'। আকাশ থেকে পাখি যেমন করে নিচের দিকে তাকায়, তাকে বলা যেতে পারে 'বিহঙ্গাবলোকন'। একটি কীট যেমন করে সম্মুখস্ত বস্তু বা প্রাণির দিকে তাকায়, তার নাম দেওয়া যাক 'কীটাবলোকন'।

কোনো বিষয়ের দিকে বিহঙ্গাবলোকনে তাকালে– ধরা যাক উঁচু কোনো টাওয়ার থেকে নিচের শহরের দিকে বা দণ্ডায়মান অবস্থায় মাটিতে রাখা কম্পিউটারের মাদারবোর্ডের দিকে যদি তাকাই, তবে দৃশ্যটি খুবই জটিল একটি কাঠামো মনে হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কোনো জটিল কাঠামো কীটাবলোকনে ছোট ছোট অনুকাঠামোতে ভাগ করে দেখালে পুরো কাঠামো বুঝতে সহজ হয়, যদিও বিহঙ্গাবলোকনে বা সিংহাবলোকনে একটি বিষয়ের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক অন্য অনেক বিষয়ের সম্পর্ক ও সুষমা বোঝা যায়।

শিক্ষক বা পাঠ্যপুস্তক রচয়িতারা যদি এই তিন দৃষ্টিকোণ থেকে একেকটি বিষয় দেখতে শেখাতে পারেন শিক্ষার্থীদের, তবে সেটা উচিত শিক্ষায় অনেকখানি অবদান রাখবে।

উন্নত দেশগুলোতে গ্রন্থাগার হচ্ছে বিদ্যালয়ের অন্যতম অঙ্গ। কানাডা বা ফ্রান্সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা গ্রন্থাগারে নিয়ে যাওয়া হয় পুস্তক-পাঠে তাদের অভ্যস্ত করে তোলার জন্যে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে, বিশেষ করে কানাডায় প্রতিটি মিউনিসিপ্যালিটিতে একটি পাঠাগার রয়েছে। বাংলাদেশে কেন সেটা সম্ভব হবে না?

এক সময় বাংলাদেশের বেশিরভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজে একটি গ্রন্থাগার ছিল। সম্ভবত গ্রন্থাগারিকের একটি পদও ছিল অথবা কোনো শিক্ষক সামান্য সম্মানীর বিনিময়ে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব পালন করতেন। আশির দশক থেকে গ্রন্থাগারগুলো হারিয়ে গেছে এবং গ্রন্থাগারিকের পদটিও হয়তো বিলুপ্ত হয়েছে।

প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিককের পদটি ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ছোটখাট একটি পাঠাগার থাকলে ভালো হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃতপ্রায় শতবর্ষী পাঠাগারগুলো পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে। বাংলাদেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার-ব্যবস্থাপনা ও তথ্যবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। এই বিষয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্তরা ব্যাংকে কাজ করছেন, সরকারি আমলা হচ্ছেন বা এমন কোনো পেশা নিতে বাধ্য হচ্ছেন যার সঙ্গে অধীত বিষয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। গ্রন্থাগারিকের পদটি ফিরে এলে এই ডিগ্রিধারীদের উপযুক্ত কর্মসংস্থান হতে পারে।

গ্রন্থাগারে শুধু যে কাগজের বই বা পত্রিকা থাকবে এমন কোনো কথা নেই। ডিজিটাল যুগে গ্রন্থাগারের ধারণা বদলে গেছে। প্রতিটি গ্রন্থাগার হবে একেকটি তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র যেখানে বসে তরুণ-তরুণীরা অনলাইনে লেখাপড়া করবে, গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ করবে। বর্তমান যুগে গ্রন্থাগার নিছক বসে বসে কাগজের বই পড়ার জায়গা নয়, যদিও কাগজের বইয়ের আবেদন ও গুরুত্ব অবহেলা করা চলবে না। প্রতিটি জে লা ও থানা শহরে, ইউনিয়ন কাউন্সিলে, ওয়ার্ডে এ ধরনের একটি তথ্যকেন্দ্র থাকা যুগের দাবি। ডিজিটাল বাংলাদেশের শ্লোগানের সঙ্গে এই দাবি একান্ত সঙ্গতিসম্পন্ন।

এর মানে অবশ্য এই নয় যে, সব পাঠাগার সরকারকেই স্থাপন করতে হবে। ধনাঢ্য ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, পাড়ার সমিতি কেন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবে না? নির্বাচনের আগে এলাকার ভোটাররা প্রার্থীদের কাছে একটি তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে পারে। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি বাংলা অঞ্চলে অজানা নয়। ঢাকা বা কোলকাতার মতো শহরে তো বটেই, এমনকি মফস্বল শহরগুলোতেও এক সময় মহল্লায় মহল্লায় ব্যক্তি-উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগার ছিল। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার এই সংস্কৃতি বহাল ছিল আমাদের কৈশোরে অর্থাৎ সত্তর-আশির দশকেও।

মনে পড়ে, চট্টগ্রামের কুমিরা গ্রামে আমাদের বড় ভাইয়েরা এর-ওর কাছ থেকে বই ধার করে, নিজেদের বই দিয়ে সত্তরের দশকের শেষদিকে 'নজরুল-সুকান্ত পাঠাগার' স্থাপন করেছিলেন যা আমার নিজের মনন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা শুধু যে জনগণের মননের বিকাশ ঘটাবে তাই নয়, প্রকাশনা শিল্পের বিকাশেও এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশে স্নাতক পাস নাগরিকের সংখ্যা পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। অথচ বাংলাদেশে একেকটি বই ছাপা হয় তিনশ বা বড়জোড় পাঁচশ কপি। এত সীমিত সংখ্যক পুস্তক দিয়ে বাংলাদেশের প্রকাশনা কোনোমতেই শিল্পের মর্যাদা দাবি করতে পারে না।

৪৫৭১টি ইউনিয়ন কাউন্সিলে, ৪৯১টি উপজেলায় এবং ৩২৭টি পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে যদি অন্তত একটি করে পাঠাগার তথা তথ্যকেন্দ্র থাকে এবং সরকার যদি প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে অন্তত এই পাঠাগারগুলোতে বই কেনার জন্য অনুদান দেয় (এবং সেই অনুদানের টাকার সদ্ব্যবহার যদি হয়!) তবে বাংলাদেশের প্রকাশনা অচিরেই শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

প্রকাশনা শিল্পের বিকাশের সঙ্গে পাঠকের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং লেখক সৃষ্টির ব্যাপারটাও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বা গণগ্রন্থাগারে বসে কোনো গ্রন্থ নয়, বিসিএস গাইড বই পড়ে। অনেক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটা বিষয়ে ভর্তি হয় যে বিষয়ে ন্যূনতম আগ্রহও তার নেই। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা তাদের কোনোমতে যে কোনো একটা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে বাধ্য করে।

'তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই'– লেখাপড়া শিকেয় তুলে চাকরি নামক সোনার হরিণ ধরতে ব্যস্ত সবাই। ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রের সময় ও অর্থের এই অপচয় রোধ করার কথা শিক্ষার নীতিনির্ধারকেরা কেন ভাবে না? আপাতত বিসিএস নিয়োগ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ফলাফলের মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা যদি করা যেত, তবে শিক্ষার্থীরা হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় অধিকতর মনোযোগী হয়ে উঠত।

আজকালকার তরুণ-তরুণীরা কম্পিউটার-মোবাইল ইত্যাদি ডিভাইসে সারাক্ষণই কিছু না কিছু পড়ছে। অনেকে বৈদ্যুতিন ডিভাইসে বইও পড়েন। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে কমবেশি লিখছেনও অনেকে। ডিজিটাল যুগ আমজনতাকে পড়া ও লেখার অভ্যাসটা চর্চা করার সহজ সুযোগ করে দিয়েছে, যা অবশ্যই ইতিবাচক।

সুতরাং 'দাও ফিরে সেই গ্রন্থ, লও এ ডিভাইস' আমরা বলতে চাই না– বললেও কেউ শুনবে না। কিন্তু পাঠাভ্যাসের ক্ষেত্রে কাম্য অবস্থার তুলনায় আমরা যে বহুগুণ পিছিয়ে আছি সেটা তো স্বীকার করতেই হবে। বাংলাদেশে এমন বহু স্নাতক আছেন যারা বই দূরে থাক, দৈনিক পত্রিকাও পড়েন না। দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একাধিক স্নাতক আমাকে বলেছে, তারা সাহিত্য ঘৃণা করে!

ভাবা যায়?

বাংলাদেশের বহু বিজ্ঞান-স্নাতক এবং বিজ্ঞানের শিক্ষক জানেনই না 'বিজ্ঞান' কাকে বলে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্যেকার তফাৎটাই বোঝেন না অনেকে। এরা কোনো একটি বিষয় যুক্তিসম্মতভাবে বিচার করতে শেখে না, নানা আজগুবি গায়েবি গল্পে বিশ্বাস করে, এমনকি সহজে স্বর্গে যাবার মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে জঙ্গিবাদের দিকেও আকৃষ্ট হয়। বিভিন্ন সময় একাধিক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

এসব তথ্য কীসের শানে নজুল তা শিক্ষার নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখতে হবে। জ্ঞানের প্রতি, তথ্যের প্রতি, সাহিত্যের প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ সৃষ্টি করতেই যে শিক্ষা ব্যর্থ হয় বা ব্যর্থ হয় তাকে বিভিন্ন বুনিয়াদি কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে, তাকে কোনোমতেই উচিত শিক্ষা বলা যাবে না।

"ছেলেবেলায় প্রায়ই বেড়াতে আসতাম কলকাতায়, কখনও পিসির বাড়ি, কখনও মাসির বাড়ি। সেখানেও দুরন্তপনা শুরু করলেই বড়রা হাতে একটা বই দিয়ে বসিয়ে দিতেন, আর আমিও বই হাতে পেলে তাতেই ডুব মারতাম। পিসির বাড়িতে যে বিশাল লাইব্রেরিটা, সেটা ছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের, তিনি ছিলেন পিসেমশাইয়ের বাবা। তাঁর লাইব্রেরির বুক-শেলফগুলোর গলিঘুঁপজিতে আমরা লুকোচুরিও খেলতাম। খেলতে খেলতে কখন যে দলছুট হয়ে শেলফ থেকে বই টেনে নিয়ে দেখতে শুরু করতাম, তা নিজেও টের পেতাম না। অথচ বইগুলোর মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম করা দূরে থাক, ভাষার সরলার্থ করাই তখন অসাধ্য ছিল।

তবু বইগুলো আমাকে টানত, বইয়ের লেখাও আমাকে টানত, আমার শিশুমনের কৌতূহল ওই হরফের অক্ষৌহিণীর মধ্যে অজানা রহস্যের সন্ধান করে বেড়াত। আর ছবিগুলোতো গিলতামই। অজানা জায়গা আর জীবনযাত্রার ছবি দেখে ভাবতাম কোথায় এই সব দেশ, কেমন করে সেখানে যাওয়া যায়। শারীরিকভাবে সেখানে যেতে পারছি না, বইয়ের উড়ন্ত জাহাজ সেইখানে নিয়ে যেত মনকে।"

আমরা যদি আসলেই একটি জ্ঞানভিত্তিক এবং টেকসই উন্নয়নশীল সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে উঠে আসা এইসব 'বইপড়ানি' মাসি-পিসি এবং পাঠমনস্ক কিশোর-কিশোরীদের ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই।