তেলবাজির মানচিত্র

মুনতাসীর মামুন
Published : 27 July 2017, 04:29 AM
Updated : 27 July 2017, 04:29 AM

১.

এক শতাব্দী আগে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী 'তৈল' নামক রচনায় লিখেছিলেন:

"তৈল যে কী পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাঁহাদের মতে, তৈলের অপর নাম স্নেহ। বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর, অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠাণ্ডা করে, তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কি সে পারে।"

"সংস্কৃত কবিরা ঠিকই বুঝিয়াছিলেন। যেহেতু তাঁহারা সকল মনুষ্যকেই সমানরুপে স্নেহ করিতে বা তৈল প্রদান করিতে উপদেশ দিয়াছেন। বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।

তিনি আরও লিখেছেন:

"যে তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে। আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, মাপে না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে…।"

সুতরাং তেলবাজি নতুন কিছু নয়, প্রাচীন আমল থেকেই চলছে। আমাদের দেশে ১৯৪৭ থেকে যত সরকার এসেছে সবাই তেলবাজি করেছেন। এ কে ফজলুল হকের মতো নেতাও গোলাম মোহাম্মদের মতো আমলাকে বরণের জন্য মালা হাতে তেজগাঁও এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজনীতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত থেকে আমলাতন্ত্র– তেলবাজি ছিল, আছে, থাকবে।

রাজনীতিবিদদের তেল না দিয়ে দেখুন, চলার পথ অমসৃণ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন উপাচার্যের টেবিলে হাজিরা দেবেন, যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাবেন। আাদালত, আরে বাস, যার সম্পর্কে এখন কথাই বলা যায় না যদিও তা চলে আমাদের টাকায়। আইয়্বুব খানের বিরুদ্ধে, ইয়াহিয়া খান, জিয়া খান, এরশাদ খানদের বিরুদ্ধেও একসময় কথা বলা যেত না।

বছর খানেক আগে জনকণ্ঠ সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদককে প্রধান বিচারপতি সমন পাঠালেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাঘা বাঘা উকিল, যাদের আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা মনে করেন আইনের জাহাজ, তাদের কাউকে পাওয়া গেল না নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। অনেককে দেখলাম 'ব্যস্ততা আছে' বলে সটকে পড়লেন। কারণ সবাইকে উচ্চ আদালতে যেতে হয় নানা বিষয়ে। আর স্বদেশের ওপর স্বয়ং প্রধান বিচারপতি ক্ষুদ্ধ!

অবশ্য অনেক চেষ্টার পর একজনকে পাওয়া গিয়েছিল। মামলা চুকেবুকে যাওয়ার পর, স্বদেশের এখন আওয়ামী নেতা ও উকিলদের সঙ্গে মহব্বত প্রগাঢ়– আমাদের টেলিফোন ধরার ফুরসৎও তাঁকে কেউ দিচ্ছে না।

এই যে বেচারা সালমন তারিক, ইউএনও, তাকে যেদিন আদালতে ডেকে পাঠানো হয়, সেদিন আদালতে গিয়ে দেখেন তার পক্ষে দাঁড়াবার কেউ নেই। মোটামোটা বিড়ালরা সব সাজু মিয়ার পক্ষে। ৫০ জন আওয়ামী আইনজীবী এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক সাজুর পক্ষে। প্রাক্তন সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতাদের দাপটে আদালত কাঁপছে। আদালত কী করেছিলেন তা সবার জানা।

যখনই শোনা গেল সাজু মিয়ার কাজে প্রধানমন্ত্রী নাখোশ, তখনই দেখা গেল সালমন অত্যন্ত ভালো কাজ করেছেন। কেউ তাকে হেনস্থা করেনি, মোটা বিড়ালরা সাজুকে ত্যাগ করেছে আর আইনজীবীরা বিনা ফিতে সালমানের পক্ষে লড়তে প্রস্তুত।

তেলবাজি এখন সীমা অতিক্রম করছে। তেল কেউ রুখতে পারে না, কিন্তু তা সীমা অতিক্রম করলে সমাজ-রাষ্ট্রে সংকট ঘনিয়ে আসে। চুলে তেল খানিকটা মাখুন, পরিপাটি লাগবে। তেলে চুল ছড়িয়ে নেন, দেখেন কেমন লাগে। ভাগ্যিস প্রধানমন্ত্রী সাজু মিয়াদের তেলে পিছলে যাননি। গেলে মহাকেলেঙ্কারি হত সন্দেহ নেই।

বাধ্য হয়্ইে বলতে হয়, তেলে সবার পা হড়কে যায়, প্রধানমন্ত্রীর যায়নি। সে কারণেই এখনও সবার আস্থা তাঁর ওপর।

২.

একজন ইউএনওকে নিয়ে যা ঘটল তা ঘটার কথা ছিল না, কিন্তু ঘটেছে। এর কারণ নির্লজ্জ তেলবাজি ও ভয়। প্রজাতন্ত্রে এখন বিভিন্ন সামন্তপ্রভুর সৃষ্টি হয়েছে। এই সামন্তপ্রভুদের মধ্যে আছেন জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, ছাত্রসংগঠন ও আরও অনেক কিছু। এই সামন্ত প্রভুরা এ ধরনের কাজ নিয়তই করছেন কিন্তু সব সংবাদ হয় না, সেলফ সেন্সরশিপ ও মফস্বলে সামন্তপ্রভুদের ভয়। শহরের সাংবাদিকরা এ থেকে অনেকটা মুক্ত। সম্মিলিতভাবে এরা প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব খর্ব করছেন। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না থাকলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কতটুকু থাকত সন্দেহ রয়েছে।

এ সব ঘটনা সামনের নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না তা ভাবা ভুল। যে ঘটনা ঘটেছে তাতে প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ না করলে বিষয়টা সরকারের জন্য ভাবমূর্তি-বিনাশক হয়ে উঠত।

ইউএনও সালমন তারিক, শুনেছি ইংরেজির ছাত্র, কবিতা লেখেন, ছিমছাম তরুণ, যিনি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন ও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে প্রজাতন্ত্রের হয়ে কাজ করতে চাইতেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি সরকার না প্রজাতন্ত্রের এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল জনতার মঞ্চের সময়। সে সময় সিভিল সার্ভিসের নেতা ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর ঘোষণা করেছিলেন, সরকারি কর্মচারি তারা, সরকারের নির্দেশ শুনবেন, কিন্তু তা প্রজাতন্ত্রের স্বার্থের বিরোধী হলে তারা প্রজাতন্ত্রের স্বার্থ দেখবেন। আওয়ামী লীগ তখন এই যুক্তি সমর্থন করেছিল।

এর অনেক আগে, ন্যুরেমবার্গ বিচারের সময় যুদ্ধাপরাধীরা বলেছিলেন, তারা দোষী নন। কারণ তারা ওপরঅলার নির্দেশ মেনেছেন। বিচারকদের যুক্তি ছিল, সে নির্দেশ যদি মানবতাবিরোধী হয় তাহলে তা মানতে তারা বাধ্য নন। মানবতা দেখা তাদের স্বার্থ।

ইউএনও গাজী তারিক স্পষ্টভাবেই তাকে হেনস্থার কারণ বর্ণনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার পক্ষে না থাকলে তিনি মুখ খুলতেন কিনা সন্দেহ বা চাকুরিজীবনের শুরুতে এমন হেনস্থা বা অপমানও যে তিনি মানতে পারছেন না তা-ও সত্য। এ ধরনের অপমান ব্যক্তিকে মরিয়া করে তোলে। তখন তার মনে হয়, যা হবার হবে।

তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে অনেকগুলি নাম এসেছে। এসব নামের মধ্যে সেরনিয়াবাত নামটি সবার পরিচিত ঠেকেছে। এরা কি সেরনিয়াবত পরিবারের কেউ? জানি না। তবে এখানে একজন সংসদ সদস্যের নাম এসেছে চাচা হিসেবে। তাতে মনে হয় যাদের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে সেরনিয়াবাত পরিবারের, সে সূত্রে প্রধানমন্ত্রীর। পত্রিকার খবর উদ্ধৃত করছি:

"চরম হেনস্থার শিকার ইউএনও গাজী তারিক সালমন নিজ মুখেই বলেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। বলেন, দায়িত্বে থাকার সময় প্রভাবশালী মহলের অনেক অপকর্মে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি কোনো ঠিকাদার বা জনপ্রতিনিধির অন্যায় মেনে নিইনি। আর পরীক্ষা শেষ সময়ে সরকারি গৌরনদী কালেজের শিক্ষার্থী ও আগৈলঝাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের পুত্র আল রাজিন ওরফে পিয়াল সেরনিয়াবাতকে নকল করার দায়ে আমি বহিষ্কার করেছিলাম। তখন পিয়াল স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ তার চাচা পরিচয় দিয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। এ ঘটনায় পিয়ালকে ছয়মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড ও নকলে সহযোগিতা করার জন্য কলেজের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী নারায়ণচন্দ্র সরকারকে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। তখন থেকেই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েক নেতা ক্ষিপ্ত ছিল আমার ওপর যার বার্হিপ্রকাশ ঘটেছে মিথ্যা অপবাদের মাধ্যমে। তবে তিনি তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরঋণী।''

[দৈনিক জনকন্ঠ, ২৩ জুলাই ২০১৭]

তার বিরুদ্ধে ক্ষোভের করাণ শুধু এ ঘটনাই নয়। তিনি আগৈলঝাড়ায় ছিলেন আট মাস। তখন ওই প্রভাবশালী মহলের অনেক অপকর্মে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলে জানান। তিনি কোনো ঠিকাদার বা জনপ্রতিনিধির অন্যায় মেনে নেননি। এমনও হয়েছে যে, কাজ ঠিকমতো না হওয়ায় তিনি দুই কিস্তির টাকা দিয়ে বাকি টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তারাই ইউএনওকে আগৈলঝাড়ায় থাকতে দেননি বলে জানান। এরপর বরগুনা সদরে বদলি হয়ে গেলে ঘটনার তিন মাস পর তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হল। তারিক মনে করেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে মামলা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন এটাই অত্যন্ত কষ্টের বিষয়।

এ ক্ষেত্রে তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। আসলে প্রধানমন্ত্রীর 'ভিশন' কার্যকর করার জন্য এ ধরনের কর্মকর্তাদেরই প্রয়োজন।

জনাব হাসনাত আবদুল্লাহ হয়তো এসব কিছুই জানেন না। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এরকম পরিচয় অনেকেই দেন এবং আমরা তাতে ভয় পাই। এ ক্ষেত্রেও খুব সম্ভব সেরনিয়াবাত ও আবদুল্লাহ নামটি ভয়ের সৃষ্টি করেছিল। মূল পরিবারের সদস্যরা তা জানুন না জানুন। এ কারণেই, ঘটনাটি সবাই জেনেও কিছু করতে চাননি বরং গর্হিত কাজ করেছেন, যদি প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন এ কথা ভেবে। যারা এগুলি করেন ও করান তারা বিষয়টি জানেন এবং যারা এগুলি করেন তাদের মনে হয়, এতে বোধহয় প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর পরিবারের নিকট সদস্যরা খুশি হন।

আমার মতো হরিজনের সব কথা জানার কথা নয়, কিন্তু যতদূও জানি এবং দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা এগুলি পছন্দ করেন না। যেমন, প্রশাসনে চিহ্নিত অনেক বিএনপি-জামায়াত সমর্থক কর্মকর্তা সহজেই প্রমোশন পেয়ে উচ্চ পদ পেয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক হিসেবে। এ রকম উদাহরণ আমিই দিতে পারব। এগুলি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা দেখান ও বলেন যে, তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি।

প্রধানমন্ত্রীর এসব জানার কথা নয়। সম্ভবও নয়। কিন্তু ক্ষোভটা বাড়ে সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে।

যখন এ ঘটনা ঘটে তখন অনেকে বলেছেন, নিশ্চয়ই যিনি মামলা করেছেন তিনি বিএনপি-জামায়াতঘেঁষা যাদের দলে আনা হচ্ছে। এ অভিযোগের সত্যতা আমার পক্ষে নিরুপণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছেন, মামলা দায়েরকারী পাঁচ বছর আগেও আওয়ামী লীগে ছিলেন না। দলের ভেতরে ঢুকে পড়া এই 'অতিউৎসাহীরাই' এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, এই চাটুকাররাই আমাদের ক্ষতি করছে।

তিনি এই ঘটনার পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেছেন। প্রথমত, এই অফিসারের বিরুদ্ধে হয়তো তাদের ক্ষোভ ছিল। তাকে অপমানিত করা ছিল তাদের লক্ষ্য। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সার্ভিসের মধ্যে একটি অসন্তোষ সৃষ্ঠি করা। তৃতীয়ত, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা। তাঁর ভাষায়, "পুলিশ যে ব্যবস্থা করেছে এই ছেলেটির (ইউএনও) সঙ্গে, যেভাবে তাকে নিয়ে গেছে, এ নিয়ে আমি ওখানকার ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার এদের প্রত্যেককে দায়ী করব। এদের বিরুদ্ধেও আমাদের বোধহয় ব্যবস্থা নিতে হবে।"

তাঁর এ বক্তব্যে খুশি হয়েছেন ভুক্তভোগীরা ও সাধারণ মানুষ।

৩.

প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, প্রজাতন্ত্রে উর্দ্ধতন কর্মকর্তারাও ইউএনওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কিনা। করে থাকলে কেন করেছেন? কারণ অন্য কিছু নয়, স্রেফ তেলবাজি। তারা ভেবেছেন ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিলে কর্তারা খুশি হবেন, জনপ্রতিনিধিরাও। ইয়াহু, তখন আর পায় কে!

পত্রিকার খবরে দেখলাম, আলোচিত ওই কার্ড ছাপার পর কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ওই কার্ড নিয়ে কেবিনেট ও বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারকে বিষয়টি জানান। কমিশনার জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামানকে ইউএনওর কাছ থেকে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা নিতে বলেন। জেলা প্রশাসক তখন ইউএনওকে শোকজ করে ব্যাখ্যা নিয়ে বিভাগীয় কমিশনারকে পাঠিয়ে দেন।

জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগকারী ওই 'গুরুত্বপূর্ণ' ব্যক্তির নাম জানাতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো বিভাগীয় কমিশনার আমাকে জানাননি। ওদিকে বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউস টেলিফোনে সাংবাদিকদের বলেন, "কোনো লিখিত অভিযোগ নয়, পার্টিও লোকজন আমার কাছে অভিযোগ করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারে নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। তাই আমি ডিসিকে বলেছিলাম ইউএনওকে শোকজ করতে।"

'গুরুত্বপূর্ণ' ব্যক্তির নির্দেশে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। 'গুরুত্বপূর্ণ' ব্যক্তির নাম করা হয়নি। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ওই 'গুরুত্বপূর্ণ' ব্যক্তি অভিযোগ জানতে পারেন এবং তা ঠিকও হতে পারে, কিন্তু ঘটনা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব যে কর্মকর্তাদের ওপর। ওই যে বললাম, ভয়। 'গুরুত্বপূর্ণ' ব্যক্তির কথা না শুনলে তো অনেক কিছুই হতে পারে।

একজন শিশু কীভাবে ছবি বিকৃত করতে পারে? টিভিতে ছবিটি দেখেছি, আমার কাছে বিকৃত মনে হয়নি। চিত্রকলা তো ফটোগ্রাফি নয়। চিত্রকলায় ব্যক্তির প্রতিকৃতি হুবহু আঁকা হয় না। কিন্তু একানে নন্দনতত্ব নিয়ে আলোচনা করার দরকার নেই। নন্দনতত্ব যারা বোঝেন না, তাদের কাছে এসব বিষয় প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ বঙ্গবন্ধু এখানে ব্যবহৃত হয়েছেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, তিনি এখন ব্যবহৃত হন ব্যবসার কাজে, দলে তেলবাজির কাজে। অথচ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর বোন শেখ রেহানা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পর্যন্ত জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর নাম যেন এসব কাজে ব্যবহৃত না হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নাম ব্যবহার চলছেই। বঙ্গবন্ধু বললেই সব মাফ।

বিএনপি-জামায়াত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সবার কাছেই বঙ্গবন্ধু এখন পূজ্য। কিন্তু আদতেই কি তা সত্য? বিএনপি আমলে এত বঙ্গবন্ধুভক্ত চোখে পড়েনি তো। এর কারণ, বিষয়গুলি দল বা সরকার যা ভালোভাবে মনিটিরিং করেনি, বরং প্রশ্রয় পেয়েছে এসব।

আমরা কেমন ভয় পাই তার একটি উদাহরণ দিই। খুলনায় আমরা গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছি। তার অধীনে একটি কোর্স পরিচালিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক। যারা পড়ান তার বাংলাদেশে নিজ নিজ ক্ষেত্রে পরিচিত। পাঠক্রমের শর্ত অনুসারে থিসিস সাবমিট করতে হয়। আমরা কোর্সটির অ্যাফিলিয়েশনের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু ইন্সটিটিউটের অ্যাফিলিয়েশনের জন্য আবেদন করি। যেহেতু এটি মুক্তিযুদ্ধ-সম্পর্কিত কোর্স সে জন্য বঙ্গবন্ধু ইন্সটিটিউটের অ্যাফিলিয়েশনই যথার্থ মনে হয়েছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রথম আমলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়। আমি ছিলাম যার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। বিএনপি আমলে এটির মৃত্যু হয়। পরে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ইন্সটিটিউট করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল এটি অনুমোদন করে। কিন্তু নির্বাহী পরিষদের তিনজন তা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ হিসেবে বলা হয়, খুলনা কোর্স এখানে কেন অ্যাফিলিয়েটেড হবে?

এর মধ্যে একজন, অধ্যাপক শরিফ এনামুল কবির, যিনি দীর্ঘদিন সরকারি পদে আছেন, আর একজন এমপি ও আন্যজন ব্যবসায়ী। তাঁরা আত্মীয়। শিক্ষার্থী এবং আমরা সবাই হতাশ হয়ে পড়ি। প্রতি পদক্ষেপে বাধা দিলে মানুষ কীভাবে কাজ করবে? একদিন এইচ টি ইমামের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। বেশ কিছুদিন পর তিনি জানান, যারা প্রত্যাখ্যান করেছেন তারা রাজি নন অ্যাফিলিয়েশন দিতে। এরা সবাই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও বাহক। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় কথা নাই-বা বললাম!

বিষয়টি নিয়ে উপাচার্য বা আমরা ভয়ে আর কোনো চেষ্টা করিনি, যদি প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন। তিনি ক্ষুব্ধ হলে পুরো দল ক্ষুব্ধ হবে। দল ক্ষুব্ধ হলে সরকার ক্ষুব্ধ হবে। তখন এই ছোট বাংলাদেশে আমরা যাব কোথায়?

এ রকম ছোট ছোট ঘটনা, ছোট ছোট ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে দল বা সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারপ্রধান এগুলি জানেন না। জানার কথাও নয় তাঁর। অথচ মুক্তিযুদ্ধের কাজে তিনি বাধা দেন না, বরং উৎসাহ দেন। খুলনায় যখন গণহত্যা জাদুঘরের কাজ করছি চাঁদা তুলে, তখন তিনি তা শুনে আমাকে বলেছিলেন, "নতুনভাবে তৈরি কর, আমি সাহায্য করব।"

সাহায্য পাই না পাই, এ কথা শুনেই মন ভালো হয়ে যায়, উৎসাহ বাড়ে।

৪.

বরিশাল-কাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবিটি দেখে বলেছেন, এটিতে বিকৃত করার মতো কিছু করা হয়নি। আর ইউএনওর বিষয়ে বলেছেন, এই অফিসারটি রীতিমতো পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। প্রধানমন্ত্রীর মক্তব্য শোনার পর সবাই বুঝে যান যে, তেলবাজিতে তিনি সন্তুষ্ট হননি। ফলে ঘটনা অন্যদিকে প্রবাহিত হয়। মামলাকারি সাজু সাসপেন্ড হন।

প্রশ্ন জাগে, অনুমোদন ছাড়া যেখানে গ্রেফতারের অধিকার নেই, পুলিশ বা বিচারালয় গ্রেফতার ও বিচার করেন কীভাবে? তারাও তেলবাজি করছিলেন। আইন ভাঙ্গার জন্য যদি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে এসব ঘটনা আরও ঘটবে।

এর নিট ফল কী হল? প্রধানমন্ত্রী যা চাচ্ছেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু আদর্শ হয়ে উঠুক তাতে বিঘ্ন ঘটল। ভয়ে এখন অনেকে আকঁতে চাইবেন না, লেখালেখির আগেও ভাববেন। কারণ কে কখন 'জাতির পিতার অবমানন্য' মামলা করে বলা তো যায় না। সব ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর নজরে পড়বে না, নজরে আনা যাবেও না।

ঘটনায় ছাত্রলীগের কথা এসেছে। ছাত্রলীগের কথা সবসময় মিডিয়াতে আসছে এবং কোনো সংবাদই ইতিবাচক নয়। তারাও এক সামন্তপ্রভুতে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এদের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে অনেকবার বলেছেন, কিন্তু কিছুই হয় না। তারা এতটাই শক্তিশালী যে, কাদেরের মতো ক্ষমতাবানও তাদের কাছে অসহায়।

তাদের সব কর্মকাণ্ড পত্রিকায় আসেও না। তবু প্রতিদিনের সংবাদপত্র ঘাটলে কমপক্ষে তিন-চারটি এমন সংবাদ পাবেন। একটি ঘটনার কথা বলি।

মাস দুয়েক আগে কুষ্টিয়ায় দেখা হল শামসুজ্জামান খান এবং ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও উপ-উপচার্যের সঙ্গে। অসুস্থ শরীরে খান এসেছেন শিক্ষক নির্বাচনের একটি সভায়। উপচার্য জানালেন, সভাটি হবে না। কারণ ছাত্রলীগ বলেছে, এটি এখন করা যাবে না। চ্যান্সেলর কি বলেছেন ছাত্রলীগের কথা শুনতে হবে? বলেননি। কিন্তু তাঁরা ভয় পেয়েছেন। ছাত্রলীগ কখন কী করবে ঠিক নেই। ভিসি ও প্রোভিসিকে বহু কষ্টে অর্জিত পদ ছেড়ে দিতে হতে পারে।

এগুলি কী কাম্য?

নাম ভাঙ্গানো কী রকম চলে তার উদাহরণও দেওয়া দরকার। আমাদের জাদুঘরের জন্য চার-পাঁচটি কম্পিউটর কেনার দরকার। টেন্ডারের শেষ দিন কয়েকজন এসেছেন টেন্ডার জমা দিতে। এমন সময় যুবলীগের একজন হর্তাকর্তা ঢুকলেন। অন্যরা তখন পালাল। টেন্ডার কমিটি পরে আবিষ্কার করে যে, যুবলীগ নেতার কাগজে জালিয়াতি রয়েছে। ফলে সেটি বাতিল হয়ে যায়। গত বছর আমরা কম্পিউটার কিনতে পারিনি। আমাদের কাজকর্ম প্রায় বন্ধ।

খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি কারা এটি করাল। আমাকে বলা হল, বাগেরহাটের সংসদ সদস্য যিনি আত্মীয়, তার ভাই যিনি যুবলীগ নিয়ন্ত্রণ করেন– তার নির্দেশেই সব হয়। বললাম, এটি হতে পারে না, আর এত সামান্য টাকার জন্য তিনি হাত ময়লা করবেন না। তিনি যদি জানেন এটি আমাদের প্রতিষ্ঠান তাহলে সেখানে কাউকে হাত দিতে দেবেন না।

সেই সংসদ সদস্য হয়তো জানেন না তার নামে কী রকম চাঁদাবাজি চলছে। আবার উল্টোটাও আছে। এরকম ঘটনাও অনেক ঘটছে। এগুলি সবাই যেন মেনে নিয়েছেন। উচ্চবাচ্য করেন না এসব নিয়ে।

এতে দলের ভাবমূর্তির উন্নতি কিন্তু হচ্ছে না। আমরা বুঝতে অক্ষম, স্থানীয় নেতারা এগুলি জানেন, কেন্দ্রীয় নেতারাও জানেন, অন্তত বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের এগুলি জানা উচিত। কিন্তু তারা ব্যবস্থা নেন না। নির্বাচনে আমরা জিতবই এ রকম বিএনপিসুলভ মনোভাব কাম্য নয়।

৫.

কয়েক সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী আরেকটি মন্তব্য করেছেন যা অনেকেই পছন্দ করেছেন। নিরাপত্তারক্ষীদের এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, নিরাপত্তার নামে তাঁকে যেন মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা না হয়। বিষয়টি সত্যি এবং গুরুত্বপূর্ণ। এদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর মূল কাজই হল যাকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং তার গতিবিধি কর্মকাণ্ডে আধিপত্য বিস্তার করা যাতে তারাও ক্ষমতার একটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তাদের কর্মপরিকল্পনা ও কর্ম মনিটরিং করা উচিত।

আমরা প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাঁকে অন্ধকার ঘরে রাখা হবে, তিনি পথে নামলে দীর্ঘক্ষণ পথঘাট বন্ধ থাকবে আর মানুষজন শাপ-শাপান্ত করবে। প্রথমবার কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সিভিল সমাজের বিভিন্ন গ্রুপের যোগাযোগ ছিল। এখন তা প্রায় নেই। আমরাও এখন অনেক অনুষ্ঠান যেতে ভরসা করি না। একবার একটি চা-চক্রে সৌজন্য দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে কুশল জিজ্ঞেস করছিলেন। এমন সময় এক রক্ষী আমার কোমরে গুঁতো দিয়ে বললেন, "সরেন সরেন।"

ঐ নিমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী কি তাঁর শত্রুদের আমন্ত্রণ করেছিলেন? যারা আমন্ত্রিত তাদের শত্রু ভাবার কারণ কী? কারণ তেলবাজি। তারা দেখাতে চান তারাই একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর রক্ষক ও ক্ষমতাধর। এদের অসৌজন্যমূলক আচরণ কিংবদন্তীতুল্য। অথচ আপনারা সবাই জানেন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু, একজন রাষ্ট্রপতি, একজন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, একজন প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা– আমন্ত্রিত অতিথিরা নয়।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সিভিল সমাজের যোগাযোগ না থাকলে প্রধানমন্ত্রীর রক্ষীদের এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কিছু আসে যায় না। সিভিল সমাজেরও তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, খালেদা জিয়া যে হারলেন এবং তারপরও কলকে পাচ্ছেন না তার একটি কারণ, সিভিল সমাজের প্রভাবশালী গ্রুপগুলির সমর্থন তিনি পাননি।

বঙ্গবন্ধুর ছবি বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী ও দল ত্বরিৎ ব্যবস্থা নেওয়ায় ক্ষতি কমেছে এবং যারা লেখেন বা আকেঁন তারা স্বস্তি পেয়েছেন। তবে তারা আর লিখবেন বা আকঁবেন কিনা সেটি পরের বিষয়।
এখন দেখা যাবে, তারিক সালমনের ব্যাপারে কেউ কিছু করেননি, জনপ্রতিনিধি ও কর্তারা কিছু জানেন না। শুধু তাই নয়, আরও কিছুদিন পর বলা হবে, এ রকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। কিন্তু প্রযুক্তি এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে যে, ভুলতে চাইলেও সব কিছু ভুলতে পারবেন না, ভুলতে দেওয়া যাবে না।

এ ধরনের দৌরাত্ম্য সব দলেই আছে। আগেও ছিল, এখনও থাকবে। এগুলি নিয়েই আমাদের থাকতে হবে। দল ও সরকার যদি এসবে প্রশ্রয় না দেয় তাহলে সুশাসনের পারদ উপরে উঠবে। প্রশ্রয় দিলে নামবে। মুশকিল হল, শেখ হাসিনার ইমেজ এখন এমন হয়েছে যে, এ ধরনের ঘটনা ঘটলেই সেটি তিনি জানুন না জানুন সবাই এক বাক্যে বলে: বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে আমরা এটি আশা করি না।