আমাদের কালের নায়ক মিনার মাহমুদ

মাসুক হেলাল
Published : 3 April 2012, 03:49 PM
Updated : 3 April 2012, 03:49 PM

আশির দশকের শুরুতে মিনার মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আমাদের বন্ধু। সুদর্শন তরুণ। গল্প লেখে, ছবি তোলে। আমাদের সেই দলটা বড়সড় ছিলো। মঈনুল আহসান সাবের, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মিশুক মুনীর, রেজা সেলিম, তুষার দাশ, আলী রিয়াজ, আবিদ রহমান, মঈনুস সুলতান, মঈনুদ্দীন খালেদ, ফারুক মইনুদ্দীন। দলে-বলে আড্ডা হতো হাকিম চত্বরে। সবাই লেখালেখির সাথে জড়িত।

১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় মিনার মাহমুদের কিছু রিপোর্ট সাড়া ফেল দেয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট 'অপারেশন মংলা'। একসময় বিচিত্রার সম্পাদকের সাথে মতবিরোধ হয় তাঁর। ১৯৮৭ সালে 'বিচিত্রা' থেকে বেরিয়ে 'সাপ্তাহিক বিচিন্তা' বের করেন। সেখানে আমি পত্রিকাটি সাজানোর দায়িত্বে ছিলাম, কাভারের কার্টুনটিও আঁকতাম। পত্রিকাটি নিজের মতো সাজিয়েছি, মিনার কোনোদিন কোনো কাজে কোনো রকম প্রশ্ন তোলেন নি। মিনার মানুষের মতামতকে খুব গুরুত্ব দিতেন। মিনার বিচিন্তায় জড়ো করেন একদল তরুণ কর্মী। এই দলের যাদের থাকা-খাওয়ার জায়গা ছিলো না, তাদের জন্য বিচিন্তা অফিসের দোতলায় থাকার জায়গা করেন মিনার। একটা চৌকি, মশারি, লেপ-তোষক আর ডাইনিংয়ের খাওয়া ফ্রি; সাথে একটা ব্যাগ ও টেপ রেকর্ডার। এই সংবাদকর্মীর দলটা সংখ্যায় ছিল ৫০-৬০ জন। সবাই কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। এই তরুণরাই পত্রিকাটির লেখা, প্রুফ, ছাপা, বন্টনসহ সব কিছু করতো। সেই সময় বেশ কয়েকজন ছিলো স্কুলের ছাত্র। মিনার তাদেরকেও 'আপনি' বলে সম্বোধন করতেন। স্কুলপড়ুয়াদের কে কখন অফিসে এসেছে, বাসায় গেল কিনা, প্রয়োজনে পাশের বাসায় ফোন করে খবর নিতেন। এই ছিলেন মিনার মাহমুদ। এই তরুণ কর্মীদের নিয়ে শুরু হয় বিচিন্তা পত্রিকাটি। কিছুদিনের মধ্যেই পত্রিকাটির সার্কুলেশন এক লাখ ৩৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়।


আশির দশকে যে সমস্ত তরুণ সাংবাদিকতায় আসতে চাইছিলেন, মিনার মাহমুদ হয়ে উঠেন তাদের স্বপ্নের নায়ক। তার স্মার্ট রিপোর্টিং, ঝকঝকে গদ্য সবার নজর কাড়তো। মিনারের নতুন কিছু করার খুব আগ্রহ ছিল। তরুণরা নতুন যা কিছু করতে চাইতো মিনারের তাতে সায় ছিলো। কোনো তরুণ হয়তো মিনারকে কোনো স্টোরির আইডিয়া দিল, মিনার তা লুফে নিত। মিনার তাকে ক্যামেরা, টেপরেকর্ডার বের করে দিয়ে দিতেন সাথে সাথে। দিতেন দুই আড়াই হাজার টাকা অগ্রিম। ঐ ছেলেটির হয়তো আর পাত্তা নেই। চার-পাঁচ মাস পর মিনারের সাথে দেখা হলে সে বললো, মিনার ভাই রিপোর্টটা তো লিখতে পারিনি আর টাকাটাও খেয়ে ফেলেছি। মিনার অট্টহাসি দিয়ে তরুণটির পিঠ চাপড়ে বললো, 'গুড'। এই ছিল মিনার মাহমুদ। এই বিশাল হৃদয়ের মানুষ মিনার মাহমুদ।

বন্ধুদের নিয়ে থাকতে পছন্দ করতেন মিনার। ১৯৮৩-৮৪ সালের কথা, মিনার তখন গল্প লেখে, ছবি তোলে। আমাদের বন্ধু তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর শিল্পী এস এম সুলতানের উপর তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন। নড়াইলে শিল্পী সুলতানের বাড়িতে সুটিং হবে; আহমদ ছফা, মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদ, মিনার মাহমুদ দলে-বলে নড়াইলে যাই। সেখানে পাঁচ-ছয় দিনের মতো থাকি, সুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে শিল্পী সুলতানকে নিয়ে চিত্রা নদীতে নৌকা ভ্রমণে যাই। সুলতান ভাই বাঁশি বাজান নৌকায় বসে। আশপাশের গ্রামেও শিল্পী সুলতানের সাথে ঘুরে বেড়াই। মিনার, মিশুক ছবি তোলে। সেখানে মিশুক ও মিনার একটি বিশাল আকৃতির মটকা আবিষ্কার করেন। যেটির বয়স ৩০০-৪০০ বছর, একটি বাড়ির উঠানো পড়ে আছে। মিশুক মুনীর তখন জাদুঘরে চাকরি করতো। অতএব মিশুক, মিনার এটাকে চাঁদা তুলে কিনে ফেললো। দুজনের যুক্তি, এই সম্পদটি হেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হবে। যন্ত্রণা কাকে বলে! এই বড় মটকাটি বাসের ছাদের উপর বসিয়ে তারেক মাসুদ, আহমদ ছফা, মিনার মাহমুদ, মিশুক মুনীর ও আমি ঢাকায় ফিরি। মটকাটি ঢাকা জাদুঘরে জমা দেয়া হয়।

যে রিপোর্টটির জন্য বিচিন্তা বন্ধ হয় সেটির প্রচ্ছদ কাহিনীর নাম ছিল 'গণঅভ্যুত্থান দিবসে গণহত্যা এবং নীরোর বাঁশী', আমার আঁকা ছিল কার্টুনটি, প্রচ্ছদকাহিনীটি চট্টগ্রামের শহীদুল ইসলাম বাচ্চুর লেখা। স্বৈরশাসক এরশাদ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। মিনার মাহমুদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়। মিনার দীর্ঘ সময় কারাগারে ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে তরুণদের নিয়ে ১৯৯১ সালে আবার বিচিন্তা বের করেন। আবার একটি রিপোর্টের জন্য পত্রিকাটি ঝামেলায় পড়ে। একসময় মিনার আমেরিকা প্রবাসী হন। দেড় যুগ আমেরিকায় কাটান। মাঝেমাঝে আমেরিকা থেকে মিনার ফোন করতেন। দেড় যুগ পর মিনার আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন ২০১০ সালে। আবার বিচিন্তা বের করেন। আবার বন্ধ হয়ে যায়। এসব নিয়ে ফোনে মিনারের সাথে কথা হয়েছে। কোনো একটা টিভি চ্যানেলে কাজ করার কথা ছিলো। পড়ে আর সে চ্যানেলে যাননি মিনার। সেখানে মিনারের তৈরি বিচিন্তার এক সাংবাদিকই মিনারকে সেই চ্যানেলে ঢুকতে বাঁধা দিয়েছেন। এরকম অনেকগুলো ঘটনার শিকার হয়েছেন মিনার। বিভিন্ন লোকের মুখে শোনা কথা, এসব কথা মিনার আমাকে বলেননি। মিনার মাহমুদকে যারা চেনেন, তারা জানেন মিনার কতটা শক্ত মনের মানুষ ছিলেন। আমি তাকে কখনো ভেঙ্গে পরতে দেখিনি। কত বার কত রকমের ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে মিনার এগিয়ে গেছেন। মিনার আত্মঘাতি হবেন আমি মানতে পারছি না।

মৃত্যুর ১৫ দিন আগে মিনারের সাথে শেষ দেখা হয় ফার্মগেটে, আধ ঘন্টার মতো একত্রে ছিলাম। তারও দু-একদিন পর মিনার আবার ফোন করে উত্তরায় যাওয়ার জন্য। আমার মা অসুস্থ মিনারকে জানাই। তখন কথা হয় রোববার ১ এপ্রিল আমার ডে অফের দিন উত্তরায় মিনারের সাথে দেখা করবো। বৃহস্পতিবার কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে মাকে কবর দিয়েছি কিছুক্ষণ আগে, তখন সাংবাদিক রুহুল গনি জ্যোতি ফোনে জানায়, মিনার মাহমুদের লাশ হোটেল রিজেন্সি থেকে বের করেছে পুলিশ। তারপর বিচিন্তার অনেক বন্ধু ফোনে খবরটা দেয়। মিনারের সাথে আর আমার দেখা হল না, আর হবেও না। মিনার আপনি ভালো থাকবেন।

মাসুক হেলাল: চিত্রশিল্পী ও লেখক।