অটিজমকে জয় করতে হবে

সায়মা হোসেন পুতুল
Published : 2 April 2012, 03:39 PM
Updated : 2 April 2012, 03:39 PM

পঞ্চম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের এই মহতী অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আপনাদের সাথে সরাসরি থাকতে না পারার জন্য দুঃখিত। তবে আজকের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার অনুভূুতি ও ভাবনাসমূহ ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত।

আপনারা জানেন, অটিজম হল একটি ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যা। সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল (সি ডি সি) এর তথ্য অনুসারে আমেরিকাতে প্রতি ৮৮ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত। তবে এর মধ্যে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের আক্রান্তের হার অনেক বেশী। যেমন প্রতি ৫৪ জন ছেলের মধ্যে একজন এবং ২৫২ জন মেয়ের মধ্যে ১ জন অটিজমে আক্রান্ত যা সম্মিলিতভাবে ডায়াবেটিস, এইডস, ক্যান্সার, সেরিব্রাল পলসি, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, ডাউন সিনড্রোম এ আক্রান্ত শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি। গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ বাংলাদেশে যা গ্যাপ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে গ্যাপ স্বউদ্যোগে পুরানো বাধাগুলো অতিক্রম করে নতুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এজন্য আপনাদের অকুুণ্ঠ সমর্থনের জন্য আমি গ্যাপ বাংলাদেশের ন্যাশনাল এ্যাডভাইজারি কমিটির চেয়ার হিসেবে আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

বর্তমানে গ্যাপ বাংলাদেশ প্যারেন্টস এবং প্রফেশনালদের সমন্বয়ে অ্যাওয়ারনেস এন্ড অ্যাডভোকেসি, এডুকেশন, সার্ভিস এবং রিসার্চ এই চারটি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। খুব শীঘ্রই Interministerial Taskforce Ges Inter Organizational Implementation Taskforce গঠনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের প্রতিনিধিদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে গ্যাপ বাংলাদেশের কার্যক্রমকে আরো সম্প্রসারিত করা হবে।

আজকে আমি আপনাদেরকে অবহিত করতে চাই যে গ্যাপ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে কী কী কাজ করেছে। আমাদের টাস্কফোর্সের সদস্যগণের স্বতঃপ্রনোদিত সহায়তা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের সিচ্যুয়েশন এনালাইসিস ডকুমেন্ট তৈরি করেছি। এই ডকুমেন্টে অটিজম এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ বিষয়ে আমাদের বর্তমানে সম্পদ কী আছে এবং কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা চিহ্নিত করেছি এবং এর সম্ভাব্য সমাধানের সুপারিশ করেছি। আমরা শিশুদের জন্য অটিজম স্পিকস থেকে প্রণীত কমিউনিটি টুলকিটের বাংলা অনুবাদ করেছি। এটি আমাদের প্যারেন্টস, টিচার এবং সার্ভিস প্রোভাইডার অর্থাৎ যারা এই জনগোষ্ঠীকে সেবা দিয়ে থাকেন তাদের জন্য একটি সহায়ক টুলস্ হিসেবে কাজ করবে।

গত ২৫ জুলাই অটিজম বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ১১টি দেশের অংশগ্রহণে সর্বসম্মতভাবে ঢাকা ঘোষণা করা হয় যা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য একটি মাইল ফলক। এ সম্মেলনে শিশুদের মনঃস্বাস্থ্য সেবায় শুধু আঞ্চলিকভাবেই নয় বিশ্ব জুড়ে আমাদের পারস্পারিক সহযোগিতা ও সমন্বিত প্রচেষ্টার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এসকল শিশু ও তাদের পরিবারের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমাদের সক্ষমতাকে আরো বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে নাগরিক হিসেবে তাদেরও রয়েছে সমঅধিকার। এ বিষয়ে সকলের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিশেষতঃ আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। তাদের দক্ষতা এমনভাবে বৃদ্ধি করতে হবে যাতে প্রাইমারি থেকে টারসিয়ারি লেভেল পর্যন্ত সকলকে সমন্বিতভাবে সেবা প্রদান করা যায়। এ উদ্দেশ্যে আমাদের মানব সম্পদ ও অর্থ সম্পদের সুষম বন্টন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্য সম্পাদন করতে হবে।

আমাদের আরো মনে রাখতে হবে এই শিশুদের পারিবারিক এবং সমাজ জীবনে সমভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। এজন্য পরিবার, বাড়ী এবং স্কুলে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। উন্নত সেবার মানদ- নির্ণয় এখন অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং সমাজসেবা সেক্টরসমূহের সঙ্গে পেশাজীবী, অ্যাডভোকেট এবং পরিবারের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।

এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায় বাংলাদেশেও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবলিটিজ, অটিজম এবং শিশুদের মনঃস্বাস্থ্যের বিষয়ে ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এমনকি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মধ্যেও রয়েছে। এছাড়া যে সকল কর্মকর্তা অটিজম বিষয়ক নীতিনির্ধারণের বিষয়ে সম্পর্কিত রয়েছেন তাদেরও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। আমি মনে করি প্রতিবন্ধিতার ইতিহাসে বাংলাদেশ এখন যুগসন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে। বিশেষ করে আমাদের এই জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়ন এবং পরিবর্তনের জন্য আমাদের যথোপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এখন জরুরী। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি বাস্তবমুখী পরিকল্পনাসমূহ গ্রহণ করতে হবে এবং তা যাতে স্থায়ীত্ব পায় সে দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।

অতএব আসুন আজ আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই যে, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করব। আর এই সোনার বাংলাকে প্রতিটি মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলব।

(অটিজম সচেতনতা দিবসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সায়মা হোসেন পুতুলের পাঠানো এই লিখিত বক্তব্যটি পাঠ করা হয়।)
সায়মা হোসেন পুতুল: শিশুমনোবিদ।