আরও এক নতুন জোট?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 16 July 2017, 04:28 AM
Updated : 16 July 2017, 04:28 AM

নির্বাচনের ঢোলে চাটি পড়েছে। থাক না দেড় বছর বাকি, তাতে কী? আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে দোষ কী? পরীক্ষার আগের রাতে চুটিয়ে পড়লেই ভালো রেজাল্ট আশা করা যায়? আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। আমাদের রাজনৈতিক মহলেও নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

শাসক দল আওয়ামী লীগ একদিকে দল গোছাতে মাঠে নেমেছে, অন্যদিকে নজর রাখছে অন্য দল, জোটের দিকে; তারা কে কী করছে। ১৪-দলীয় জোটের পরিধি বাড়ানোর চিন্তাও আওয়ামী লীগের আছে। দু-চারটা ইসলামি দলের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তাও হয়েছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধবাদীরা 'ধর্ম' কার্ড ব্যবহার করে যাতে বেশি সুবিধা করতে না পারে সে জন্য ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা চিহ্নিত দু-চারটি দলকে সঙ্গে রাখার পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের রয়েছে বলে মনে হয়। হেফাজতে ইসলামী নামের হঠাৎ প্রভাববিস্তারী শক্তির সঙ্গেও একধরনের আপস-সমঝোতার পথে হাঁটছে আওয়ামী লীগ।

অন্যদিকে শাসক দলের অন্যতম প্রতিপক্ষ বিএনপিও বসে নেই। তারাও তলে তলে নিজেদের প্রস্তুত করছে। ২০-দলীয় জোটে নতুন শরিক জোটানোর টার্গেট বিএনপির আছে। কারা বিএনপির নতুন মিত্র হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। রাজনীতিতে বিএনপি খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। জোটসঙ্গি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়েও রয়েছে বিএনপির উদ্বেগ। জামায়াত আইনি জটিলতায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তাই নির্বাচনে জামায়াতের খুব আগ্রহ থাকার কথা নয়। আবার দলের শীর্ষ নেতারা যুদ্ধারপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসিতে ঝুলেছেন। আরও দু-চারজনের সামনেও দড়ি ঝুলছে।

আত্মরক্ষা এখন জামায়াতের প্রধান কাজ। জাময়াত তার স্বার্থ বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে। বিএনপির সঙ্গে থাকা নাকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলঝুল করে চলাই হবে জামায়াতের জন্য লাভজনক, সে হিসাবনিকাশ করেই তারা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবে। জামায়াতের মতিগতি বুঝতে না পেরে বিএনপির মধ্যে বাড়তি টেনশন আছে।

জামায়াতের সঙ্গত্যাগের একটি চাপও বিএনপির ওপর আছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে দাবিদার বিএনপির মিত্রতা নিয়ে বিএনপি-দরদিদের একধরনের অস্বস্তি আছে। বিএনপি যদি সে অস্বস্তি দূর করতে চায় তাহলে তাকে শূন্যস্থান পূরণের জন্য নতুন মিত্র খুঁজতে হবে। সে লক্ষ্যে বিএনপি সচেষ্ট রয়েছে। তবে বিএনপি যাদের দিকে হাত বাড়াতে চায় তারা আবার এক নতুন উদ্যোগে শামিল হয়েছে।

গত ১৩ জুলাই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির প্রধান নেতা আ স ম আব্দুর রব তাঁর উত্তরার বাসভবনে সমমনা আরও কয়েকটি দলের নেতাদের সন্ধ্যায় চায়ের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই দাওয়াতি বাসায় পুলিশ হাজির হয়ে বেরসিকের মতো কাজ করেছে। পুলিশ একটি গুরুত্বহীন বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

রবের আমন্ত্রণে তাঁর বাসায় গিয়েছিলেন বিকল্প ধারার সভাপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, তাঁর পুত্র মাহী বি চৌধুরী, বাসদের খালেকুজ্জামান, বজলুর রশীদ ফিরোজ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী ও আ হ ম শফিউল্লাহ, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না ও এস এম আকরাম। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক ও বহ্নিশিখা জামালী, জেএসডির আব্দুল মালেক রতন। সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারও উপস্থিত ছিলেন। দাওয়াত পেয়েও যাননি গণফোরামের ড. কামাল হোসেন, সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী।

উপস্থিত নেতারা অনানুষ্ঠানিক ওই বৈঠকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির বাইরে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির বলয় তথা একটি নতুন জোট গঠনের ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে তাঁরা একমতও হয়েছেন। এ নিয়ে তাঁরা আরও বৈঠক করবেন, কথা বলবেন।

এই উদ্যোগ নতুন নয়। এরা অনেকদিন থেকেই সলতে পাকানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। রস জ্বাল দিচ্ছেন কিন্তু গুড় জমাট বাঁধছে না। আগামী নির্বাচনের আগে বাঁধবে বলে মনে হয় কি? যেসব দল নতুন জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে তাদের একক ও সম্মিলিত শক্তি এতই কম যে তা প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার বাইরে যাওয়ার জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। নামসর্বস্ব দলের জোট রাজনীতিতে জট তৈরির ক্ষমতাও সম্ভবত রাখবে না।

নির্বাচনের আগে নিজেদের ওজন বাড়ানোর জন্যই এই নতুন জোট গঠনের উদ্দেশ্য বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, এঁদের কেউ কেউ গায়ে-গতরে দশাসই হলেও শক্তি-সামর্থের দিক দিয়ে একেবারেই পলকা। এঁদের নিজেদের জ্বলে ওঠার ক্ষমতা নেই। তবে অন্যকে জ্বলে উঠতে হয়তো কিছু সহায়তা করতে পারেন। রাজনীতি থেকে যখন এঁদের অনেকেরই অবসর নেওয়া উচিত, তখন তাঁরা বিকল্প জোট গড়তে মাঠে নামছেন।

মানুষ আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতি যদি বিরূপ হয়েও থাকে তবু এঁদের প্রতি সদয় হবে এমন ধারণা তাদের হল কীভাবে? মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এঁরা কি রাজনীতির প্রধান দুই ধারার বাইরে একটি নতুন ধারা, নাকি দুই ধারার কোনো একটিতে ভিড়ে যাওয়ার ট্রানজিট রুট? তাঁরা কোনো তরফ থেকে ডাকের অপেক্ষা করবের, নাকি নিজেরা কিছু একটা করে দেখাবেন? এঁদের অনেকেরই 'ট্র্যাক রেকর্ড' এত ভালো যে মানুষ পারলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়!

এই নেতাদের কারো পক্ষেই এককভাবে নির্বাচন করে জিতে আসা সম্ভব নয়। এখন থেকে আরও আগে, যখন তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল ছিল, তখনও নির্বাচনে জেতার রেকর্ড তাদের অনেকের নেই। এমনকি নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়েও তীরে পৌঁছুতে পারেননি। এখন শেষবেলায় সলতে পাকিয়ে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতে পারবেন বলে মনে হয় না।

আ স ম রবের উদ্যোগ আমাদের রাজনীতির বৃত্ত ভাঙতে সহায়ক হবে বলে মনে করে যদি উচ্ছ্বসিত হতে পারতাম তাহলে খুশি হতাম। কিন্তু সেটা পারছি না বলে দুঃখিত। এসব বলে আমি অবশ্যই এই নেতৃবৃন্দকে মোটেও অসন্মান করছি না। এদের অনেকেই জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে দেশের জন্য অবদান রেখেছেন। তাঁরা অবশ্যই শ্রদ্ধেয়জন। ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য, খ্যাতিমান আইনজীবী। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কীর্তিমান হয়ে আছেন। কিন্তু শুনতে ভালো না লাগলেও সত্য এই যে, তিনি আর নিজেকে অতিক্রম করতে পারছেন না। তাঁর কাছ থেকে যারা এখন নতুন কিছু আশা করছেন, তাদের আশাহত হওয়ার বেদনা নিয়েই সময় কাটাতে হবে।

আ স ম আব্দুর রব ছাত্র আন্দোলনের ডাকসাইটে নেতা। তিনিও বঙ্গবন্ধুর স্নেহসান্নিধ্য পেয়েছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে আছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি রাজনীতিতে এত ডিগবাজি খেয়েছেন যা মানুষের মনে বিরক্তিকর ঠেকেছে।

ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী একজন স্বনামপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তাঁকে রাজনীতিতে আনেন। তাঁর একটা ভালোমানুষি ইমেজ ছিল। তাঁকে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদাই আবার তাঁকে বিতাড়িতও করেন। তারপর রাজনীতিতে নেমে খেই হারিয়ে ফেললেন। এখন তিনি না ঘরকা না ঘাটকা।

কাদের সিদ্দিকীর ব্যাপারেও একই কথা। মুক্তিযুদ্ধে বড় ভূমিকা পালন করে এখন যুদ্ধ শেষের পাওনা আদায়ে ব্যস্ত। দাড়িপাল্লায় না মেপে নিজের ওজন সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে তিনি রাজনীতির ময়দান কাঁপাতে গিয়ে নিজেই এখন কাঁপুনির মধ্যে আছেন।

খালেকুজ্জামান মানুষ হিসেবে মন্দ নন। কিন্তু তিনিও বুঝতে পারেন না যে মুখস্থ তত্ত্ব কপচে কমবয়সীদের মোহিত করা গেলেও রাজনীতিটা তো আর ছেলেমানুষি ব্যাপার নয়। মানুষ তত্ত্ব বুঝতে পারছে কি না সেটা না বুঝে রাজনীতি করে তিনি কেবলই নিজের ক্লান্তি বাড়িয়ে চলেছেন।

মাহমুদুর রহমান মান্নাও ছাত্র আন্দোলনের 'আইকন'। ডাকসুতে বারবার জেতাটাই সম্ভবত তাঁর জন্য কাল হয়েছে। ভেবেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে যখন 'হিরো' তখন আমপাবলিকের কাছে 'হিরো' হওয়া এমনকি কঠিন। এদল ওদল করে মান্না এখন নাগরিক ঐক্যে। দেখা যাক, তিনি নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন কি না।

এঁরা প্রত্যেকেই আসলে নিজ নিজ সুনামের সঙ্গে নিজেরাই সুবিচার করতে পারেননি। তাই মানুষও আর তাদের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয়।

যাদের অবস্থান বা উপস্থিতি নিজ নিজ বাসাবাড়িতে, জনসমর্থন তলানিতে, কারো কারো ব্যক্তিগত ভূমিকা বিতর্কমুক্ত নয়, তারা জোট বানিয়ে ডাক দিলেই মানুষ পিঁপড়ের মতো সার বেঁধে তাদের দিকে ধাবিত হবে– এমন বিশ্বাস তাদের মধ্যে হল কীভাবে?

তবে মিডিয়ার মনোযোগ তাঁরা পাবেন। আমাদের দেশের রাজনীতির 'ডেড হর্স'রা বেঁচে থাকেন গণমাধ্যমের বদান্যতায়। আ স ম রবের বাসায় ইনফরমাল বৈঠক করতে গিয়েও এমন কয়েকজন নেতা মিডিয়ার আকর্ষণ পেয়েছেন। আর সেটা পেতে সহায়তা করেছে আমাদের চৌকশ পুলিশ বাহিনী। কী প্রয়োজন ছিল রবের বাসায় গিয়ে অহেতুক ঝামেলা বাঁধানোর?

যে পুলিশ কর্মকর্তা এই নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি কি সরকারের ভালো করলেন, না খারাপ করলেন? যাঁরা ডাক দিলে তাদের আত্মীয়স্বজনেরাও রাস্তায় বেরিয়ে আসবেন না (কারণ, তারা কেউ রাজনীতি করেন না) তাদের একটি ঘরোয়া ব্যাপারে নাক গলাতে গিয়ে অতিউৎসাহী পুলিশদল সরকারকে অকারণ সমালোচনার মুখে ফেলে কার্যত ওই নেতাদের পক্ষেই কাজ করেছে।

নেতারা বলার সুযোগ পেয়েছেন যে, সরকার তাদের জোট গঠনের উদ্যোগে ঘাবড়ে গেছে। তাই পুলিশ পাঠিয়ে বৈঠক ভণ্ডুল করতে চেয়েছে। সত্যি কি তাই? সরকারের উচিত হবে বিষয়টি পরিষ্কার করা। পুলিশ যদি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া রবের বাড়ি গিয়ে থাকে তাহলে বাড়াবাড়ি করা পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আর যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এমন নির্দেশ দিয়ে থাকে, তাহলে সেই ঊর্ধ্বতনকেও অবিলম্বে অধঃস্তন করা উচিত।