ধরিত্রী ঘণ্টা নিয়ে অন্ধকারে আমরা

মো. শরীফ উল্লাহ
Published : 31 March 2012, 12:08 PM
Updated : 31 March 2012, 12:08 PM

'এক ঘণ্টা অন্ধকার'- এ আর নতুন কী? 'আর্থ আওয়ার' এর উদ্যোক্তারা জানুক বা না জানুক, আমরা তো রাতের অনেকটা সময় অন্ধকারেই থাকি লোডশেডিংয়ের কল্যাণে। শনিবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে এক ঘণ্টা রাজধানী অন্ধকারের চাদরে ঢেকে থাকলে আমাদের তাতে কীইবা আসে যায়।

তাই আর্থ আওয়ার কর্মসূচি পালন করা নিয়ে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রস-রসিকতার কমতি নেই। নিজেদের দুর্গতি নিয়ে একটু ঠাট্টা করে দু:খটা যদি একটু লাঘব করা যায়, মন্দ কী? কিন্তু তাই বলে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে না পারা সরকার আর বিদ্যুৎ বিভাগ তাতে যোগ দেবে কেন?

জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ বিভাগের উপদেষ্টারা উঠে পড়ে লেগেছেন আমাদের 'আর্থ আওয়ার' গেলানোর জন্য। বৃহস্পতিবার দুপুরে বিদ্যুৎ ভবনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী শনিবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় নয় এমন সব ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগও একই আহ্বান জানিয়েছে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক বলেছেন, "আর্থ আওয়ার কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে জ্বালানি সংরক্ষণে কতটুকু সাফল্য আসবে, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, মানুষ বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবে। বিদ্যুৎসচিব আবুল কালাম আজাদের আশাবাদ, "আমরা প্রচার শুরু করেছি। আশা করছি সারা দেশেই এই কর্মসূচি পালিত হবে।"

এ যেন অভুক্তকে কম খাওয়ার পরামর্শ! দিনে-রাতে কয়েক ঘণ্টা তো এমনিতেই লোডশেডিং থাকে। কর্মসূচি যখন চলবে তখন এক ঘণ্টার লোডশেডিং দিয়ে দিলেই হবে। আমাদের আর অনুরোধ করার কি দরকার। দেশের মানুষ যদি সত্যি সত্যিই কর্মসূচি পালন করতে চায়, আর এর মধ্যেই যদি লোডশেডিং শুরু হয়, তাহলে এ অনুরোধটা কি আদেশে পরিণত হবে না? অনুরোধ করে, আহ্বান জানিয়ে এর পর তা চাপিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হবে?

এরপরও যদি পরামর্শটা ঠিকমতো দিতে পারতেন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা-মন্ত্রী-সচিব-কর্মকর্তা। মূল কর্মসূচি সম্পর্কে না জেনেই কত অনুরোধ-আহ্বান করে যাচ্ছেন তারা। উনারা বোধহয় 'আর্থ আওয়ার' কর্মসূচিটাকে লোডশেডিংয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন। উনারা বলছেন, ওই এক ঘণ্টা সব ধরণের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বন্ধ রাখতে, যা লোডশেডিংয়ের সময়ই কেবল সম্ভব। এ কথা শুনলে এ কর্মসূচির মূল উদ্যোক্তা আয়োজক ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর ন্যাচার (ডব্লিউডব্লিউএফ) বাড়াবাড়ি হচ্ছে ভেবে লজ্জা পেয়ে যাবেন।

আর্থ আওয়ারের যে কর্মসূচি তাতে কোথাও বিদ্যুৎ ব্যবহার বা সব বৈদ্যুতিক যন্ত্র বন্ধ রাখতে বলা হয়নি। বলা হয়েছে, এক ঘণ্টা শুধু বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ রাখতে। এটা একটা প্রতীকি কর্মসূচি। বিশ্বের বড় বড় সব শহরে রাত সাড়ে আটটায় বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে দিলে অন্ধকারের একটা আবহ তৈরি হবে। কর্মসূচি পেরুলেই দেখবেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া বিশ্বের বিভিন্ন শহরের উল্লেখযোগ্য স্থাপনাগুলোর ছবি চলে আসবে। আইফেল টাওয়ার, বাকিংহাম প্যালেস, গোল্ডেন গেইট ব্রিজ, সিডনি ওপেরা হাউজের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কর্মসূচির আগের ও পরের ছবি পাশাপাশি দেওয়া হবে। অন্ধকারাচ্ছন্ন শহরগুলোর ছবি তোলা হবে মহাশূন্য থেকেও। উজ্জ্বল আলো থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত হলে মানুষের মনে যে নাড়া পড়বে তার মাধ্যমে মনে করিয়ে দেওয়া হবে জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন হতে, পৃথিবীটাকে আরও বাসযোগ্য করতে মনোযোগী হতে। এজন্যই বাতি নেভানোর এত প্রতীকী আয়োজন।

অথচ আমাদের নীতি নির্ধারকেরা বলছেন সব ধরণের বৈদ্যুতিক যন্ত্র বন্ধ রাখার কথা। মাত্র ২০ ওয়াটের বাতি জ্বালিয়ে ২০০০ ওয়াটের এসি বন্ধ করে রাখলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে তবে তা আর্থ আওয়ার পালন করা হবে না। উনারা জ্বালানি সাশ্রয়ের কথা প্রতিদিন বলুক, ক্ষতি নেই, আর্থ আওয়ারের সঙ্গে জড়িয়ে এসব কথা বলছেন কেন বোধগম্য হচ্ছে না।

আর সরকার বা বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্পর্কে আমাদের সচেতন করা। কিন্তু আর্থ আওয়ারের মূল উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ সাশ্রয় নয় বরং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। কর্মসূচির মূল ওয়েবসাইটে গেলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। শুরুর দিকে বিশ্বের যেসব শহরে এ কর্মসূচি পালিত হয়েছে, সেসব শহরে তেমন একটা বিদ্যুৎ সংকটও নেই। তবে হ্যা, বাতি বন্ধ রাখলে তো কিছুটা সাশ্রয় হবেই। সেটাকে মূল কর্মসূচির গৌণ একটা ইতিবাচক দিক হিসেবে ধরা যেতে পারে।

আরেকটা কথা, সরকার বা বিদ্যুৎ বিভাগ বলছেন 'সারাদেশে' সব ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বন্ধ রাখার কথা। আর্থ আওয়ার কিন্তু শহর কেন্দ্রিক কর্মসূচি। সেখানে বলা হয়েছে 'সিটি চ্যালেঞ্জ' এর কথা। উল্লেখ করা হয়েছে শহরের সংখ্যার। আমাদের বিদ্যুৎ বিভাগ সারাদেশ সারাদেশ করছেন কেন বোঝা গেল না।

বিদ্যুৎ বিভাগ পত্রিকাগুলোয় 'ধরিত্রীকে রক্ষা করি, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে দেশ গড়ি' শীর্ষক একটি বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছে। সেখানে এইচ.এস.সি পরীক্ষার্থী ও অত্যাবশ্যক প্রয়োজন ব্যতীত বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে পৃথিবীর ‌১৩৫টি দেশের কোটি মানুষের সঙ্গে একাত্ম হতে অনুরোধ করা হয়েছে! বিশ্বের অন্যান্য দেশের বড় শহরগুলোর মানুষতো কেবল বাতি নিভিয়ে দেবে। আর্থ আওয়ার কর্মসূচিতেতো তাদের অন্য সব বৈদ্যুতিক যন্ত্র বন্ধ করতে বলেনি। তবে একাত্ম হব কিভাবে। আর ১৩৫টি দেশের হিসাবটা গত বছরের। এ বছর সম্ভবত ১৪৭টি দেশে তা পালন করার কথা রয়েছে। এখানেও এক বছর পিছিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ।

শুধু এটুকু লিখে আজকের মতো শেষ করতে পারলে খুশি হতাম। লিখতে হচ্ছে আরেকটা বিষয়েও। না বুঝে উল্টাপাল্টা কথা না হয় বলেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা। গণমাধ্যমগুলো কোথায় তা শুধরে দেবে, তা না, উল্টো নিজেরাই ভুল করছে। পত্রিকায় বলা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ে (!) আর্থ আওয়ার পালন করা হবে…. পাঁচ হাজার ৪১১টি শহরে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ (!) রাখা হবে। …. জ্বালানি সাশ্রয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতে ২০০৭ সালের ৩১ মার্চ থেকে প্রতিবছর এই দিনে (!) এ কর্মসূচি পালন করা হয়।

তাদের জ্ঞাতার্থে আবার বলছি… ১. 'জ্বালানি সাশ্রয়ে' আর্থ আওয়ার পালন করা হয় না। ২. এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয় না, কেবল অত্যবশ্যকীয় নয় এমন বাতি নেভানো হয়। ৩. প্রতিবছর ৩১ মার্চ তা পালন করা হয় না। পালন করা হয় প্রতিবছর মার্চের শেষ শনিবার, গত বছর তারিখটি ছিল ২৬ মার্চ, এ বছর ৩১ মার্চ, আগামী বছর যা হবে ৩০ মার্চ। বোঝা গেল ব্যাপারটা। জাতীয় দৈনিকগুলোর মতো কিছু টিভি চ্যানেল ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমও একই ভুল করছে।

আরেকটা অনুরোধ রাখব সাংবাদিকদের প্রতি। উপদেষ্টা-মন্ত্রী-সচিবরা যারা আমাদের আর্থ আওয়ারের নামে গত কয়েকদিন ধরে রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে বিদ্যুৎবিহীন থাকতে অনুরোধ করছেন তাদের ওপর নজর রাখুন। তাদের নিজেদের সংজ্ঞামতো আর্থ আওয়ারের কর্মসূচি তারা নিজেরাই পালন করছেন তো?

মো. শরীফ উল্লাহ: সাংবাদিক