ফরহাদ মজহার, বাম রাজনীতি এবং অপহরণের ‘সংস্কৃতি’

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 10 July 2017, 06:22 AM
Updated : 10 July 2017, 06:22 AM

১.
বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থার রাজনীতির নেতৃস্থানীয় 'তাত্ত্বিক গুরু', কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার হঠাৎ করেই 'অপহৃত' হয়ে সেদিন রাতেই আবার 'নাটকীয়ভাবে' ফিরে এসেছেন। মজহারের 'অপহরণের' বিষয়টি অনেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজস্ব দলীয় অথবা মতাদর্শগত আনুগত্যের নিরিখে বোঝার চেষ্টা করছেন।

ফরাসি দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, প্রত্যেক মানুষ স্বাধীনভাবে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করলেও, জন্ম-সময় থেকে প্রতি মুহূর্তে সে নানাভাবে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে। মানুষের জীবনের সবচেয়ে কঠিন শৃঙ্খল হল মতাদর্শগত শৃঙ্খল, অর্থাৎ কোনো বিশেষ মতাদর্শের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন। কোনো বিশেষ মতাদর্শের প্রতি এ আনুগত্যের ফলে কোনো ঘটনার নির্মোহ বিশ্লেষণের চেয়ে ব্যক্তি তার অনুসৃত মতাদর্শিক চশমা দিয়েই বিষয়টিকে বুঝতে চেষ্টা করে।

এ অানুগত্য এবং রাষ্ট্রের ও সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার ফলে যখন অপহরণ, গুম ইত্যাদি সংক্রান্ত কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তখন অপহরণ নিয়ে রাষ্ট্রীয় যে ব্যাখ্যা বা ন্যারেটিভ তার প্রতি জণগণের আস্থা বা বিশ্বাস জন্মে না। এ কারণে কোনো ঘটনার কোনো একটি ব্যাখা না দাঁড়িয়ে নানবিধ ব্যাখ্যা বা ন্যারেটিভের জন্ম হয়। ফলে যিনি 'অপহৃত' হয়েছিলেন তিনি ফিরে এসেও যদি এ ঘটনার বর্ণনা দেন, জনগণ সেটি গ্রহণ না করে নিজস্ব রাজনৈতিক আনুগত্য বা বিশ্বাসের নিরিখে এর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। ফরহাদ মজহারকে নিয়েও যে বিষয়টা এরকমই হবে সেটা সহজেই অনুমেয়।

২.
ফরহাদ মজহার নিজেকে মার্কসবাদী মনে করলেও বাংলাদেশে যাঁরা ডান এবং 'ইসলামপন্থার' রাজনীতি করেন তাঁরা মনে করেন মজহারের তাত্ত্বিক অবস্থান তাদের রাজনীতির বিকাশের জন্য সহায়ক। বর্তমান সরকারের নানাবিধ পদক্ষেপের ফলে জামায়াত এবং জঙ্গি বাদের রাজনীতি যখন অনেকটাই কোণঠাসা তখন 'ইসলামপন্থার' রাজনীতির পক্ষে সিভিল সমাজে যে কয়জন ব্যক্তি সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করছেন তাদের মধ্যে ফরহাদ মজহার নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য।

জামায়াতসহ 'ইসলামপন্থার' রাজনীতি যাঁরা করেন তাঁরা যে কথাগুলো কখনও প্রকাশ্যে বলেননি মজহার অবলীলায় অনেকটা যেন তাদের মুখপাত্র হয়ে সিভিল সমাজের বিভিন্ন ফোরামে এবং মিডিয়াতে সেই কথাগুলই ক্রমাগত বলে গেছেন; যদিও সে বলার মাঝেও রয়েছে স্ববিরোধীতা। একদিকে মজহারের কাছে সূর্য সেনসহ মুক্তিযোদ্ধারা সবাই 'সন্ত্রাসী' এবং মুক্তিযুদ্ধ ছিল 'সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম'; অপরদিকে, উসামা বিন লাদেনকে তিনি মনে করেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের একজন অগ্র সৈনিক এবং আফগানিস্তানের তালেবানরা তাঁর কাছে 'জাতীয় বীর'। পাশাপাশি জেএমবিসহ সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সাযুজ্য খুঁজে পান তিনি।

মজহারের এই রাজনৈতিক অবস্থানটি কি নতুন বা তিনিই কি এ ধারার প্রথম প্রবক্তা? অর্থাৎ নিজেকে মার্কসবাদী মনে করেও ইসলাম ধর্মীয় পরিভাষা ব্যবহার করে রাজনীতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তিনিই কি প্রথম শুরু করেছেন? পশ্চিম ইউরোপে জাত মার্কসবাদ যা কিনা নাস্তিক্যবাদী, বস্তুবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, সেই দর্শনের সঙ্গে ইসলামকে এক করে দেখার চেষ্টা কি আমাদের এ বাংলায় মজহারের হাত ধরেই শুরু হয়েছে?

৩.
অবিভক্ত পাকিস্তানে আমরা প্রথম নাস্তিক্যবাদী, বস্তুবাদী দর্শনের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত জীবনব্যবস্থা ইসলামকে এক করে দেখার প্রচেষ্টা লক্ষ করি জুলফিকার আলী ভুট্টোর 'ইসলামি সমাজতন্ত্র' স্লোগানের মধ্য দিয়ে। তৎকালীন বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার প্রবল প্রভাবের যুগে তিনি ইসলামি পরিভাষা ব্যবহার করে সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ভুট্টোর এ পরিভাষা ধার করে মাওলানা ভাসানীও ইসলামি সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিতে শুরু করেন এবং মুসলিম বাংলার দাবি তোলেন।

বস্তুত, বস্তুবাদী সমাজতন্ত্রের সঙ্গে আধ্যাত্মবাদী ইসলামের সম্মিলন সম্ভব কি না– এ প্রশ্ন তখনও বিভিন্ন মহলে উঠেছিল। তবে এ সম্পর্কে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে গণফোরাম নেত্রী বেগম নূরজাহান মুরশিদ আমাকে তাঁর সঙ্গে ভুট্টোর ব্যক্তিগত কথোপকথনের একটি ঘটনা বলেছিলেন। ভুট্টো নূরজাহান মুরশিদের সঙ্গে আলাপে 'ইসলামি সমাজতন্ত্র' সম্পর্কে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। মনযোগের সঙ্গে ভুট্টোর মতামত শুনে উনি উত্তর দিয়েছিলেন:

"It's neither Islam, nor socialism."

অর্থাৎ আপনার এ মতবাদ ইসলামও নয়, সমাজতন্ত্রও নয়। ইসলাম এবং সমাজতন্ত্রকে মিশিয়ে যে স্ববিরোধী রাজনীতি, সে সম্পর্কে নূরজাহান মুরশিদের বক্তব্য বোধহয় আজও প্রযোজ্য।

এ স্ববিরোধিতা শুধু ফরহাদ মজহারের ক্ষেত্রেই নয়, যাঁরা বাম রাজনীতি করেন– কিছু ব্যতিক্রম বাদে– তাদের প্রায় সবার মাঝেই দেখা যায়; যদিও এর প্রকাশের রূপ ও মাত্রা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। নাস্তিক্যবাদী চার্বাক দর্শনসহ বস্তুবাদী দর্শনের অস্তিত্ব প্রাচীন কাল থেকে বাংলায় থাকলেও বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এসব দর্শন সব সময় ছিল অতীব প্রান্তিক অবস্থানে। বাংলার জনমানসে সব সময় প্রভাব বিস্তার করে এসেছে ধর্মাশ্রিত, ভাববাদী দর্শন। ফলে এ সমাজ থেকে উঠে আসা কারো পক্ষে ইউরোপীয় বাস্তবতা জাত বস্তুবাদী দর্শন আত্তীকরণ করা খুব কঠিন।

অনেকেই বস্তুবাদী দর্শন জাত বাম রাজনীতির সামাজিক সাম্যতার ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হলেও কয়েক প্রজন্মচর্চিত ভাববাদী ধারণার সঙ্গে নিজ মনোজগতে এর এক ধরনের দ্বন্দ্ব অনুভব করেন। আর এ কারণেই জাসদের মেজর (অব.) জলিল, কবি আল মাহমুদকে বাম রাজনীতি সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে 'ইসলামপন্থার' রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়তে আমরা দেখেছি। আর যাঁরা মার্কসবাদ পরিত্যাগ করেননি তাদের প্রতিনিয়ত সমাজে, রাষ্ট্রে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত আচরণে এক ধরনের স্ববিরোধিতায় ভুগতেও আমরা দেখেছি।

এ স্ববিরোধিতা আমরা শুধু ফরহাদ মজহারের মাঝে নয়, আমরা এ স্ববিরোধিতা দেখি রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু বা সিপিবির মনজুরুল আহসান খানের মধ্যেও। এ স্ববিরোধিতা থেকেই বস্তুবাদী, বামপন্থী রাজনীতি করেও মেনন, ইনু হজ করেন, মনজুরুল উমরাহ পালন করেন। মেনন, ইনু ও মনজুরুল সেক্যুলার বাংলাদেশ দেখতে চান যেখানে রাষ্ট্র ধর্ম থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখবে। সেক্যুলার রাষ্ট্র দেখতে চাইলেও ব্যক্তিজীবনে এবং সামাজিক আচরণের তাঁরা কেউই সেক্যুলার নন, ফলে ব্যক্তিজীবনে তাঁরা কমবেশি ধর্ম পালন এবং পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ন্যূনতম হলেও ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে পরিচালনা করেন।

অপরদিকে একসময় চরমপন্থি কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে যুক্ত ফরহাদ মজহার অন্য বামপন্থি নেতাদের মতো রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার কথা বললেও নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে তাঁর চিন্তাধারার মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তিনি 'ইসলামপন্থি' নেতাদের মতো রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলামের জোরালো ভূমিকার কথা বলতে শুরু করেন।

জুলফিকার ভুট্টোর চিন্তা মজহারকে সরাসরি প্রভাবিত করলেও মজহারের ধারণার উৎস হচ্ছে সিরিয়ান দার্শনিক মিশেল আফলাকের আরব বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বাথ সমাজতন্ত্রের ধারণা। আফলাক নিজে একজন খ্রিস্টান হলেও তিনি মনে করতেন ইসলাম শুধুমাত্র ধর্ম নয়, এটি একইসঙ্গে জীবনাচরণ ও সংস্কৃতি। আরব বিশ্বে এ ইসলামকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। ফলে আরবের সমাজতন্ত্র ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রের মতো নাস্তিক্যবাদী সমাজতন্ত্র হবে না; বরং ইসলামের সঙ্গে সমন্বয় করেই আরবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরেই যে যে ধর্মের অনুসারীই হোন না কেন ইসলামের ভূমিকা মেনে নিতে হবে, কেননা এটিই হচ্ছে আরব সমাজের বাস্তবতা, যেমন খ্রিস্টীয় সংস্কৃতি ও জীবনাচারণ হচ্ছে ইউরোপীয় সমাজের বাস্তবতা। খ্রিস্ট ধর্মকে অস্বীকার করে ইউরোপে রাজনীতি করা যেমন অসম্ভব ব্যাপার তেমনি আরবে ইসলামকে পাশ কাটিয়ে তেমন কিছু করা সম্ভব নয়।

আফলাকের পাশাপাশি পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকাতে জন্ম নেওয়া উত্তর আধুনিকতাবাদ ও উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ তত্ত্ব মজহারের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে। এ চিন্তাবিদদের সবাই না হলেও একটা বড় অংশ ইসলামকে ধর্ম হিসেবে দেখার পাশাপাশি উপনিবেশবাদ এবং নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ হিসেবেও দেখেন। ফলে 'ইসলামপন্থার' রাজনীতি যাঁরা করেন তাদের প্রতি এসব চিন্তাবিদের একটা অংশের রয়েছে সহানুভূতিশীল সমর্থন। শুধু তা-ই নয়, পাশ্চাত্যবিরোধী যে কোনো কিছুকেই তাঁরা প্রগতিশীল মনে করেন। কিন্তু পাশ্চাত্য বিরোধিতার পাশাপাশি একশ্রেণির দল ও গোষ্ঠী ধর্মকে ব্যবহার করে যে নিপীড়ন, শোষণ ও নির্যাতন চালায় সে সম্পর্কে তাঁরা থাকেন উদাসীন।

নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের পর সিপিবিসহ বিভিন্ন বামপন্থি দল থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে যোগ দিতে থাকেন। কিন্তু যাঁরা যোগ দেননি মজহারসহ তাদের একটা অংশ উত্তর আধুনিকতা, উত্তর উপনিবেশিকতা এসব তত্ত্বের পরিভাষা ব্যবহার করে আফলাক এবং সাম্প্রতিককালের তালাল আসাদের চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বস্তুবাদী বাম চিন্তাধারার সঙ্গে ইসলামের একটা অদ্ভুত সমন্বয় ঘটিয়ে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার চেষ্টা করেন।

বস্তুত, এ ধরনের বিপরীতমুখী সমন্বয়ের চেষ্টার ফলেই মজহারসহ কারো কারো ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনাচরণ, তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং কর্মের মধ্যে বৈপিরত্য দেখা যায়। মজহারসহ কেউ কেউ এর ফলে রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলামের ভূমিকার কথা মাথায় রেখেও ব্যক্তিজীবনে এবং অনেকাংশে সামাজিক জীবনে সেক্যুলার জীবনযাপন করেন, অনেকটা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর মতো যিনি ধর্মের স্লোগান দিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেও ব্যক্তিজীবনে ছিলেন পাশ্চাত্যের জীবনাচরণ অনুসরণকারী, চরম সেক্যুলার। তেমনি মজহারকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে জানেন তাঁরা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে, ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে তাঁর মতো সেক্যুলার বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন আছেন।

উপরের আলোচনা অনুসরণ করে বাম রাজনীতিবিদদের মোটা দাগে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। এক গ্রুপে রয়েছেন মেনন, ইনু, মনজুরুলরা যাঁরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধর্মীয় অনুশাসনের অনেককিছু মেনে চলেন, কিন্তু রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে বিযুক্ত রাখতে চান। অপরদিকে ফরহাদ মজহার ব্যক্তিজীবনে সেক্যুলার হলেও আফলাক, তালাল আসাদ বা ভুট্টোর মতো রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে ইসলামের ভূমিকা দেখতে চান। লক্ষণীয় যে, এ দুপক্ষের কেউই ইসলামকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করে বস্তুবাদনির্ভর মার্কসবাদী রাজনীতি করতে পারেননি।

তবে দুই তরফের মধ্যে পার্থক্যের মূল জায়গাটা হচ্ছে যাঁরা সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা চান তাদের রাজনীতি সমাজে 'ইসলামপন্থার' রাজনীতির বিকাশে সহায়ক নয়। অপরদিকে ব্যক্তিজীবনে সেক্যুলার হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে যাঁরা ইসলামের ভূমিকা পালন দেখতে চান তাদের রাজনীতি সমাজে 'ইসলামপন্থার' রাজনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ইংরেজিতে যাকে 'Irony' বলে সেই 'Irony' হল সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই এ অঞ্চলে 'ইসলামপন্থার' রাজনীতির জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন– যেমন জিন্নাহ, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ফরহাদ মজহার– তাদের সবারই ব্যক্তিজীবন হয় সেক্যুলার না হয় পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত। বৈপরিত্য বা স্ববিরোধিতায় যে শুধু বামপন্থিরাই ভোগেন তা নয়, পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ধারার ডান রাজনীতি যাঁরা করেন তাদের মাঝেও স্ববিরোধিতা প্রবল।

৪.
সারা পৃথিবীর বামপন্থিদের মতো আমাদের দেশের বামপন্থিরাও একধরনের অদ্ভূত স্ববিরোধীতায় সব সময়ই ভোগেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব বাম রাজনৈতিক দল, এমনকি এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টিও মোটামুটি একই ভাষায় কথা বলে। বাম দলগুলির কথা শুনলে আমাদের অনেকের মাঝেই একধরনের নস্টালজিয়া কাজ করে, মনে হয় আমরা এখনও বুঝি সেই গত শতাব্দীর ষাট বা সত্তরের দশকেই বসবাস করছি।

সেই পাকিস্তান আমল থেকে আজ পর্যন্ত সবগুলো বাম দলই বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার অভাব অনুভব করেছে এবং গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার থেকেছে। কিন্তু কোনো বামপন্থিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ইউরোপে গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতার চর্চার বিষয়টি যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল, এ বিষয়ে কখনও কোনো বক্তব্য দিতে শোনা যায়নি। বর্তমানেও গণচীন, ভিয়েতনাম ও কিউবার একদলীয় অথবা উত্তর কোরিয়ার 'রাজতান্ত্রিক' সমাজতান্ত্রিক শাসনে বামপন্থি দলগুলো কোনো সমস্যা না দেখলেও বাংলাদেশে তাদের ভাষায় বুর্জোয়া দলগুলোরর শাসন কী পরিমাণ অগণতান্ত্রিক সে বিষয়ে তাঁরা অত্যন্ত সোচ্চার।

জন্মলগ্ন থেকেই বাম দলগুলো শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি এবং তাদের উপরে পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণের ব্যপারে খুবই সোচ্চার, কিন্তু গৃহশ্রমিকদের মুক্তির ব্যাপারে অদ্ভুতভাবে তাঁরা নীরব। তেমনি ফরহাদ মজহারসহ সব বামপন্থিই নীরব থেকেছেন স্তালিন এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্তালিন-পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নে বিরোধী মতের ব্যক্তিদের রাষ্ট্র কর্তৃক গুম, অপহরণ ও খুনের ব্যাপারে। কেউ কেউ মৃদুভাবে এ বিষয়ে স্তালিনকে সমালোচনা করলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা লেনিন যে এ ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্মদাতা– যে ব্যবস্থা কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই যে বিরোধী মতের মানুষদের গুম বা হত্যা করতে পারে, সে বিষয়ে তাঁরা থাকেন নিশ্চুপ। তেমনি তাঁরা চুপ থাকেন গণচীনের মাও সে তুং কর্তৃক বিরোধীদের দমন, নিপীড়ন ও হত্যার ব্যাপারে।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাইরে বিরোধীদের গুম, খুন এসবের অস্তিত্ব আমরা দেখি হিটলারের জার্মানি বা মুসোলিনির ইতালিতে। এমনকি পাশ্চাত্যের যে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অনেকে আদর্শ হিসেবে দেখেন, সে ব্যবস্থাও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হতে পুরোপুরি মুক্ত নয়। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, 'ওয়াশিংটনের পোস্ট' পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী এ বছর প্রথম পাঁচ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় পাঁচশত জন পুলিশ কর্তৃক বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়েছেন।

এ ধরনের বিচারবহির্ভূত গুম বা হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ যখন আসে তখন অনেকে পুলিশি রাষ্ট্রের কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতা হল পৃথিবীর সব রাষ্ট্রই হল পুলিশি রাষ্ট্র, পার্থক্য হল শুধু মাত্রাগত। প্রশ্নটা হল রাষ্ট্র এ পুলিশি ব্যবস্থাকে কতটা বৈধ ও আইনগতভাবে প্রয়োগ করবে বা রাষ্ট্রকে প্রয়োগ করতে জনগণ বাধ্য করতে পারবে সে জায়গাটিতে।

৫.
পাশ্চাত্যের উন্নত দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল পার্থক্য হল পাশ্চাত্যে যে মৌলনীতিসমূহের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সে নীতিসমূহ রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকার নানা আইনি ও ক্ষেত্রবিশেষে বেআইনি প্রক্রিয়ায় রক্ষা করার চেষ্টা করে। অপরদিকে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের মৌলনীতিসমূহ রক্ষার চেয়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট 'শালা, তালুই, বেয়াইদের' স্বার্থরক্ষা করার জন্য আইনি ও বেআইনি প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহারে অধিক উৎসাহিত হয়ে উঠে, যা পরিণতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুর্বল করে ফেলে।

এ বেআইনি প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহারের ফলে সেই খালেদা জিয়ার আমল বা তার আগে থেকেও রাষ্ট্র কর্তৃক বিরোধী নেতা-কর্মীদের গুম, খুন, অপহরণ আমরা দেখে আসছি। তেমনি এর পাশাপাশি বিভিন্ন 'অপরাধী' এবং সাধারণ জনগণকেও রাষ্ট্রযন্ত্রের বেআইনি বলি হতে আমরা দেখেছি। রাষ্ট্রযন্ত্রের এ ধরনের বেআইনি কার্যকলাপের সুযোগ আমরা বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীকেও নিতে দেখেছি।

রাষ্ট্রযন্ত্র বা অপরাধী গোষ্ঠী কর্তৃক যাঁরা অপহৃত হয়েছেন তাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে ফিরেও এসেছেন। কিন্তু ফিরে আসা সবারই এখন পর্যন্ত একই ন্যারেটিভ আর তা হল:

"তাঁরা অজ্ঞাত স্থানে ছিলেন এবং কারা তাদের অপহরণ করেছে এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।"

এ ধরনের ন্যারেটিভ এসেছে 'সাধারণ' যে মানুষটি অপহৃত হয়েছিল তাঁর কাছ থেকে এবং একইসঙ্গে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিনের কাছ থেকেও। এমনকি 'স্পষ্টবাদী' হিসেবে পরিচিত ফরহাদ মজহারের বক্তব্যও অন্তত এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত ওই একই রকম।

রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের বাইরের গোষ্ঠী যাঁরাই এ অপহরণগুলোর সঙ্গে যুক্ত তাঁরা অপহৃত ব্যক্তিদের জন্য একটি 'কমন ন্যারেটিভ' তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যার ফলে সালাউদ্দিন থেকে মজহার বা সাধারণ যে মানুষটি অপহৃত হয়েছিলেন সবাই ফিরে এসে একই ভাষায় কথা বলছেন।

কিন্তু জনগণ বিষয়গুলো অবলোকন করছে, তারা কিন্তু একটি ন্যারেটিভে কথা বলছে না। দলীয় বা মতাদর্শগত আনুগত্যের নিরিখেই জনগণ তাদের ন্যারেটিভ তৈরি করছে। ফলে যাঁরা কোনো না কোনোভাবে সরকার সমর্থক তাদের অনেকের কাছেই অপহরণের ঘটনাগুলো হল 'নাটক', আবার যাঁরা সরকারবিরোধী তাঁরা মনে করছেন এগুলো রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সরকারের কাজ। ফলে মজহারও যখন 'অপহৃত' হন তখনও আমরা 'অপহরণ' ও 'নাটক'– এ দুটি ন্যারেটিভই দেখতে পাই।

এ দুটি ন্যারেটিভের উৎসই হচ্ছে সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ডের 'সংস্কৃতি', যাকে রাষ্ট্র 'ক্রসফায়ার', 'বন্দুকযুদ্ধ' ইত্যাদি নামে 'বৈধতা' দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বস্তুত, এ 'সংস্কৃতি' থেকে পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছে অপহরণ বা গুমের 'সংস্কৃতি', ইতিমধ্যে যার বলি হয়েছেন শত শত ব্যক্তি। যাঁরা চিরতরে গুম হয়ে গেছেন বা যাঁরা ফিরে এসেছেন তাদের কারো গুম বা ফিরে আসা সম্পর্কে রাষ্ট্র কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা জনগণের কাছে দিতে পারেনি।

৬.
বস্তুত যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র কর্তৃক বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ডের 'সংস্কৃতি' বন্ধ না হবে এবং গুম বা অপহরণ সম্পর্কে রাষ্ট্র জনগণের সামনে কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হাজির করতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত 'অপহরণ' ও 'নাটক'– এ দুটি ন্যারেটিভই আমাদের শুনে যেতে হবে।

হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের 'সংস্কৃতি' থেকে সব সরকারই যেহেতু কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়েছে তাই কোনো সরকারই এ 'সংস্কৃতি' থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে না। এ 'সংস্কৃতি' থেকে রাষ্ট্র ও সরকার তখনই বেরিয়ে আসবে যখন রাষ্ট্র ও সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করা যাবে। দায় নিতে হবে জানলেই কোনো রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হিসেবে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে বা অপহরণের 'সংস্কৃতি' জারি রাখতে পারবে না।

'অপহরণ' ও 'নাটক' এ দুটি ন্যারেটিভ যদি আমরা আর শুনতে না চাই তাহলে যে প্রশ্নগুলি নিয়ে সিভিল সমাজ ও জনগণের জোরাশোরে আলোচনা শুরু করা উচিত সেগুলো হল: রাষ্ট্রের আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ এবং এর পাশাপাশি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে সব রকম সমালোচনা ও জবাবদিহিতার আওতাভুক্ত করা, গণতন্ত্র, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও জনকল্যাণের পরিপন্থী, নাকি সমালোচনা ও জবাবদিহিতা গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করে?

সমালোচনার কি একটা সীমা থাকা উচিত নাকি সীমাহীন সমালোচনার অধিকার থাকা উচিত? যদি সমালোচনা করার অধিকারে সীমারেখা টেনে দেওয়া হয়, সেটা কি গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে এবং সীমিত গণতন্ত্রের জন্ম দেবে নাকি সীমার মাঝে সমালোচনা করেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা সম্ভব?

৭.
উপরোক্ত প্রশ্নগুলি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজের। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবীরা অদ্ভুতভাবে হয় নিশ্চুপ থাকছেন নতুবা সরকার ও দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনেই ব্যস্ত থাকছেন।

পৃথিবীতে সেই জাতি সবচেয়ে দুর্ভাগা যে জাতির বুদ্ধিজীবী ও সিভিল সমাজ রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি অনুগত। নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রদর্শনকারীকে বুদ্ধিজীবী বলা যায় কি না, সে প্রশ্নও অবশ্য রয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমনি এক ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে বোধ হয় আমরা এখন যাচ্ছি, যখন দুয়েকজন ব্যতিক্রম বাদে পুরো বুদ্ধিজীবী ও সিভিল সমাজ রাষ্ট্র, সরকার ও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের একান্ত বাধ্যগতের ভূমিকা পালন করছে– খুব সম্ভবত কিছু পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মাথায় রেখে। আর এ আনুগত্যের ধারা যতদিন অব্যাহত থাকবে বিনাবিচারে খুন ও 'অপহরণের সংস্কৃতির' ধারা ততদিন চলতেই থাকবে।

ফরহাদ মজহারের 'অপহরণের' বা 'অপহরণের নাটকের' মধ্য দিয়ে এ ধারার ইতি ঘটবে না।