সন্ত্রাসবাদ নয়, ভিন্নমত বিকশিত হোক

মারুফ রসূল
Published : 9 July 2017, 02:24 AM
Updated : 9 July 2017, 02:24 AM

সম্প্রতি ফরহাদ মজহারের উদ্ধার প্রসঙ্গে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাবিধ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে রহস্যের জট এখনও খোলেনি, কিন্তু আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে সুস্থভাবে উদ্ধার করে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।

তাঁকে অপহরণ করা হয়েছিল নাকি অন্য কোনো বিষয় এখানে কাজ করেছে, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। সুতরাং এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা কোনো কোনো গণমাধ্যমে ফরহাদ মজহার প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই 'ভিন্নমত দমন করা হচ্ছে'– এই মর্মে শঙ্কা বোধ করেছেন। তাদের শঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখার অবতারণা।

কেবল ভিন্নমতাবলম্বী নয়, রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সমাজে নানা ধরনের মতের চর্চা থাকবে, প্রশ্ন থাকবে, আলোচনা-সমালোচনা থাকবে– এটিই একটি সভ্য রাষ্ট্রের কাঠামো। ফরহাদ মজহারের বিষয়ে শুরু থেকেই রাষ্ট্রযন্ত্রের দিকে অনেকের অভিযোগের আঙুল তাক করা ছিল এবং এখনও আছে; এর মূল কারণ হল আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের চরিত্র।

তাঁকে উদ্ধার করা হয়েছে– এটা নিঃসন্দেহে স্বস্তির বিষয়, কিন্তু এর পেছনে কারা রয়েছে তা খুঁজে বের করা এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু প্রশ্ন হল ভিন্নমতের যে সংজ্ঞা, তার আলোকে ফরহাদ মজহারকে কি আমরা ভিন্নমতাবলম্বী বলব?

যাঁরা তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত তাঁরা নিশ্চয়ই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে খাবি খাবেন, কেননা তিনি মতের কোনো নির্দিষ্ট পথে কখনও স্থির থাকেননি। অনেকেই বলতে পারেন, সময়ের সঙ্গে মানুষের মতামত বদলাতে পারে, কিন্তু আদর্শ? সেটিও যখন সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় তখন নিরুপায় হয়ে আমাদের অভিধানের 'বর্ণচোরা' শব্দটির দ্বারস্থ হতে হয়।

ফরহাদ মজহারকে যারা 'ভিন্নমতাবলম্বী' হিসেবে দেখছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই 'ভিন্নমত' ও 'বিদ্বেষমূলক মত'-এর পার্থক্য তাঁরা বোঝেন না বা বুঝতে চান না। সবিনয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি। আমাদের সংবিধানে ব্যক্তির মত প্রকাশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে:

১. বাক প্রকাশের স্বাধীনতা (Freedom of Speech);
২. ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা (Freedom of Expression);
৩. চিন্তার স্বাধীনতা (Freedom of Thought) এবং
৪. বিবেকের স্বাধীনতা (Freedom of Conscience)।

একজন মানুষের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে এই চারটি বিষয়ের সমন্বিত রূপকেই বোঝায়। বলাই বাহুল্য, ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতা অসীম। তিনি যে কোনো বিষয়ে যে কোনো মাত্রা অবধি চিন্তা করতেই পারেন। কিন্তু যখন তিনি মৌখিকভাবে বা অন্য কোনো মাধ্যমে তা প্রকাশ করবেন, তখন চিন্তাটি কেবল তাঁর একার থাকে না, তা সমাজে বিস্তার লাভ করে। সে জন্যই বিবেকের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, কেননা একজন ব্যক্তির চিন্তার প্রকাশ কেমন হবে তা তাঁর বিবেকের ওপর নির্ভর করবে। মত প্রকাশের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রেও (১৯৪৮) এটি স্বীকৃত।

বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের (মৌলিক অধিকার) ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে এই অনুচ্ছেদে [৩৯(১)] সংবিধান কোনো শর্ত আরোপ করেনি। আবার ৩৯ (২)-এর দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে নাগরিকের 'বাক ও ভাব প্রকাশ' এবং 'সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা' কতগুলো শর্তের আলোকে নিশ্চিত করা হয়েছে। ৩৯ (১) ও ৩৯ (২) বিবেচনা করলে আমরা বুঝতে পারি নাগরিকের 'চিন্তা' ও 'বিবেকে'র স্বাধীনতা শর্তহীন কিন্তু 'বাক' ও 'ভাবে'র স্বাধীনতা শর্তযুক্ত। শর্তগুলো পরিষ্কার হওয়ার জন্য ৩৯(২) অনুচ্ছেদটি এখানে উল্লেখ করা হল:

"রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।"

২.
এবার ফিরে আসি ফরহাদ মজহারের প্রসঙ্গে। যাঁরা ফরহাদ মজহারের বক্তব্যকে 'ভিন্নমত' বলছেন, তাঁরা কি একবার ভেবে দেখবেন তাঁর বক্তব্যগুলো কতটা বিদ্বেষমূলক ও সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে উসকানিমূলক ছিল। ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল 'একাত্তর'-এর কার্যালয়ে বোমা হামলা চালানো হলে আহত হন দুজন গণমাধ্যমকর্মী– জাকারিয়া আকন্দ বিপ্লব ও আলমগীর হোসেন।

এ ঘটনার পর 'একুশে টেলিভিশন'-এর এক আলোচনা অনুষ্ঠানে ফরহাদ মজহার এই বোমা হামলাকে কেবল জায়েজই করেননি উল্টো আরও শক্তিশালী বোমা হামলার উসকানি দেন। ওই আলোচনার ভিডিও ফুটেজ ইউটিউবে রয়েছে।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালায়। এই ঘটনার পর ফরহাদ মজহার বলেছিলেন:

"বোমা হামলাকারীরা সন্ত্রাসী হলে মুক্তিযোদ্ধারাও সন্ত্রাসী।"

কী ধৃষ্টতা! তাঁর এই ভয়াবহ অপরাধের প্রমাণও রয়েছে তৎকালীন খবরের কাগজে।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে নির্মমভাবে হত্যা করে ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা। তখনও হত্যকারীদের পক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন ফরহাদ মজহার, অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে ব্যঙ্গ-তামাশা পর্যন্ত করেছেন। কোনো সৎ চিন্তাশীল মানুষের পক্ষে এগুলোকে 'ভিন্নমত' বলে সংজ্ঞায়িত করা কি সম্ভব?

গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে নারকীয় জঙ্গি-সন্ত্রাসের তাণ্ডব দেখেছে সারা পৃথিবী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এখনও বাংলাদেশকে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। সারা পৃথিবীর মানুষ যখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যূথবদ্ধভাবে কাজ করার চেষ্টা করছে, তখন ফরহাদ মজহার তাঁর বায়বীয় বুদ্ধিমত্তার জোরে ফিলিস্তিন, ইরাক-সিরিয়াকেন্দ্রীক নানা জগাখিচুড়ি তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। অবশ্য এর চেয়ে বেশি কিছু তাঁর কাছ থেকে আশা করা বাতুলতা মাত্র।

যাঁর চোখে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা 'সন্ত্রাসী', যাঁর রাজনৈতিক চেতনার শেষবিন্দু উগ্র ধর্মান্ধ সংগঠনের তাত্ত্বিক নেতার আসন, ব্লগার-লেখক হত্যাকে যে পাশবিক শব্দ চয়নে জায়েজ করে; তাঁর কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি যাঁরা আশা করেন, তাঁরাই বরং বোকার স্বর্গে বাস করেন।

সুতরাং ফরহাদ মজহারের বিদ্বেষমূলক ও সন্ত্রাসবাদী বক্তব্যকে যাঁরা ভিন্নমত বলছেন, তাঁরা কবে এই তত্ত্ব হাজির করবেন যে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ভূমিকা আসলে ভিন্নমতেরই নামান্তর। যে বিকৃত মানসিকতার লোকেরা ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করেন তাঁরাও তো তবে আপনাদের 'ভিন্নমতের পরীক্ষায়' পাস নম্বর পেয়ে যাবেন। এর আগেই বরং উচিত নয় কি নিজেদের সংশোধন করা?

যে কোনো পরিস্থিতিতে মনীষী ভলতেয়ারের বিখ্যাত উক্তিটি ‍উগরে দিয়ে এই যে ভিন্নমতের মোড়কে সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, অন্যকেও মেনে নিতে জোর-জবরদস্তি করছেন, তার পরিণতি কি ভালো হবে?

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই রাজনীতি 'মত' আর 'ভিন্নমত'-কে দুপাশে রেখে মধ্যবিন্দুতে দাঁড়িয়ে মজা লুটছে, তাহলেও আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আগে 'ভিন্নমত' ও 'সন্ত্রাসবাদ'– এ দুটোকে চিহ্নিত করা। তাহলে রাজনীতির ভেতরগত কূটকৌশলকেও আমরা আদর্শের ঐকতানে প্রতিরোধ করতে পারব।

ফরহাদ মজহার হয়তো অনেক কিছুই বলেছেন, যেগুলো কারও কারও ক্ষেত্রে ভিন্নমত, কিন্তু তিনি এমন অনেককিছুই বলেছেন, যেগুলো রাষ্ট্র, সংবিধান, বাংলাদেশের ইতিহাস এবং মানবিকতার প্রশ্নে সন্ত্রাসবাদী বয়ান। ফরহাদ মজহারের প্রসঙ্গে যাবতীয় সহমর্মিতা জানানোর আগে নিজের বিবেকের কাছে এই উত্তরটি দিয়ে আসবেন: আপনিও কি ফরহাদ মজহারের মতোই মুক্তিযোদ্ধাদের 'সন্ত্রাসী' মনে করেন?

৩.
নানা আলোচনা-সমালোচনার সঙ্গে এই বিষয়টিও অনেকের লেখায় উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গে অপমানসূচক ও সন্ত্রাসের উসকানি দিয়ে ফরহাদ মজহারের বক্তব্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কেন? এই প্রশ্নটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং যেহেতু ফরহাদ মজহার উদ্ধার হয়েছেন এবং তাঁর অন্তর্ধান বা অপহরণ যা-ই হোক সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছেন, সেহেতু এই আলোচনাটি এখন মুখ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।

রাষ্ট্র এত বছরেও ফরহাদ মজহারের সন্ত্রাসবাদী উসকানিমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি– এটা বাংলাদেশের নিদারুণ ব্যর্থতা। কিন্তু এতদিন ধরে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে এখন করা যাবে না, ব্যাপারটি নিশ্চয়ই তেমন নয়। সন্ত্রাসবাদ উসকে দেওয়ার অপরাধে বাংলাদেশের আইনে ফরহাদ মজহারের বিচার করা যেতে পারে।

রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারে আমরা যেমন সন্তুষ্ট, তেমনি তাঁর সন্ত্রাসবাদী ও উসকানিমূলক বক্তব্যের কোনো বিচার না হওয়াতেও ক্ষুব্ধ। তিনি নিঃসন্দেহে কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেন, কিন্তু সিংহভাগ ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসবাদ লালন করেন এবং তা তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরেই ছড়িয়ে আসছেন।

এর প্রতিবিধান না হলে ফরহাদ মজহারের মতো একজন 'বুদ্ধিবৃত্তিক দানব' তৈরিতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ব্যর্থতা যেমন দায়ী থাকবে, তেমনি তাঁর এই সন্ত্রাসবাদ ভিন্নমতের মোড়কে উপস্থাপন করার দায়ে ইতিহাস আমাদেরও ক্ষমা করবে না।