‘রাজকুমারী হাসিনা’ ও মজহারনামা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 8 July 2017, 04:17 AM
Updated : 8 July 2017, 04:17 AM

কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার আমাদের দেশে এক আলোচিত চরিত্র। নানা সময়ে তিনি তাঁর লেখালেখি ও ভূমিকার কারণে আলোচিত হয়েছেন। সর্বশেষ আলোচিত হয়েছেন 'অপহরণ' ঘটনায়। তিনি আকস্মিকভাবে 'অপহৃত' হন। রহস্যাবৃত এই অপহরণের ঘটনা নিয়েও অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

ঘটনাটিকে 'অপহরণ নাটক', 'গুম', 'স্বেচ্ছানির্বাসন', 'নিখোঁজ' ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করা হয়েছে। আশার কথা হল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং তিনি সুস্থ আছেন। তাঁর রহস্যাবৃত অপহরণ হওয়ার বিষয়টি তদন্তাধীন। তদন্তের মধ্য দিয়ে আসল ঘটনা বের হয়ে আসুক এটাই প্রত্যাশা।

এই অপহরণের ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফরহাদ মজহারকে নিয়ে ব্যাপক লেখালেখির কারণে নতুন প্রজন্মের অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, ফরহাদ মজহার লোকটা কে? কেন তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতি হচ্ছে? লেখাপড়াবিমুখ বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই ফরহাদ মজহার একজন অপরিচিত ব্যক্তি। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। আমরা যারা নানাভাবে মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত, দেশের শিল্প-সংস্কৃতি-রাজনীতির কিছুটা হলেও খোঁজ-খবর রাখি, আমরা হয়তো ফরহাদ মজহারকে চিনি। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ফরহাদ মজহারকে চিনবে না–এটাই স্বাভাবিক। নতুন প্রজন্ম অবশ্য ক্রিকেট দলের সদস্য, শোবিজ-তারকা আর লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছাড়া তেমন কাউকে চেনে বলেও মনে হয় না!

সম্প্রতি আমাদের বন্ধুবান্ধবদের ঘরোয়া আড্ডায় কথা হচ্ছিল ফরহাদ মজহারকে নিয়ে। আড্ডায় যেমনটা হয়, অনেকেই ফরহাদ মজহারের বিপক্ষে ক্ষোভ ঝাড়ছিলেন। ক্ষণে ক্ষণে ভোল, মত ও বিশ্বাস পাল্টানো ফরহাদ মজহার নিজেই যে এমন একটা 'অপহরণ নাটক' সাজাতে পারেন– এমন কথাও বলছিলেন কেউ কেউ। আবার অনেকেই জোর দিয়ে বলেছেন, সরকার বা সরকারের কোনো এজেন্সি ছাড়া বর্তমান বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটানো অসম্ভব! তবে এ ধরনের ঘটনা যেই ঘটাক না কেন, তা যে খুবই গর্হিত ও নিন্দনীয় এবং অবিলম্বে প্রকৃত সত্য বের করা সরকারের কর্তব্য এ ব্যাপারে আড্ডার সবাই একমত পোষণ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার কারণে এবং কিছুটা পাঠাভ্যাস থাকার কারণে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনু মুহান্মদ, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, সলিমুল্লাহ খান, ফরহাদ মজহার প্রমুখের লেখা ও চিন্তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ফরহাদ মজহার বরাবরই ছিলেন আমাদের আলোচনা ও তর্কের অন্যতম বিষয়। আমরা কয়েকজন ছিলাম, যারা তাঁর কবিতা ছাড়া অন্য লেখালেখি বা চিন্তার প্রতি খুব একটা অনুরাগী হতে পারিনি। তবে কেউ কেউ ছিলেন তাঁর প্রতি ভীষণ অনুরক্ত!

তবে তাঁর প্রতি আমাদের বন্ধুদের কারো মধ্যেই তেমন ক্ষোভ বা অশ্রদ্ধা দেখিনি। কালপরিক্রমায় দিন যত গড়িয়েছে, তিনি লেখালেখির মাত্রা বাড়িয়েছেন। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে ভাবান্দোলন, সেখান থেকে জামায়াত-হেফাজতের পক্ষে কাছাখোলা ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পর, সত্যি বলছি, তাঁর প্রতি আমাদের বন্ধুবান্ধবদের একটা বড় অংশের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। আর গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের বিপক্ষে, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে, জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের সমর্থনে ওকালতি শুরু করার পর, বলতে দ্বিধা নেই, এই লোকটির প্রতি ক্ষুব্ধই হয়েছি!

আমি মনে করি, ফরহাদ মজহারকে নিয়ে আমাদের সমাজে একটা 'মিথ' তৈরি করা হয়েছে। মিথটি হচ্ছে, তিনি খুবই জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান ও অত্যন্ত উঁচুস্তরের একজন বুদ্ধিজীবী। তাঁর লেখা, চিন্তা কেউ যুক্তি দিয়ে সমালোচনা করতে পারে না। সেই যোগ্যতা এ দেশে কারোর নেই। তাই তাঁকে গালাগাল ও ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়। তিনিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দার্শনিক এবং একমাত্র মৌলিক বুদ্ধিজীবী!

ফরহাদ মজহারের ভাবশিষ্যদের মাধ্যমে উল্লিখিত কথাগুলো অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এতবার উচ্চারিত হয়েছে যে, অনেকে তা বিশ্বাসও করেন! যাঁরা যুক্তি দিয়ে তাঁর চিন্তার অসংলগ্নতা, বিভ্রান্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, শেষ পর্যন্ত তা কলকে পায়নি। মজহারভক্তরা তারস্বরে বলে উঠেছেন: ওগুলো কিছুই হয়নি, অপযুক্তি, ব্যক্তিগত আক্রমণ!

এভাবেই ফরহাদ মজহার বাংলাদেশে ছোট্ট একটি পরিমণ্ডলে 'মিথ' হয়ে উঠেছেন!

চিন্তার বৈপরীত্য, ক্ষণে ক্ষণে ভোল পাল্টানোর কারণে ফরহাদ মজহার একজন সামাজিক উৎপাতে পরিণত হয়েছেন। তিনি নিজেকে 'বাঙালি' মনে করেন না। তিনি বলেছেন:

"বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা পরিগঠনের মধ্যে শুধু নয়, ছিল নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণায়, তথাকথিত 'সমাজতন্ত্রে' এবং নিরন্তর এক যুদ্ধংদেহি মনোভঙ্গির চর্চায়। ফ্যাসিবাদ মজুদ ছিল আমাদের সেই সকল ধ্যান, ধারণা, আকাঙ্ক্ষা ও আবেগের মধ্যে যাকে আমরা কোনোদিনই সন্দেহ করিনি, সন্দেহ করতে শিখিনি।"

(৭ জুন ২০০৮, দৈনিক 'নয়া দিগন্ত')

মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও রয়েছে তাঁর 'ভিন্ন পাঠ'! মীমাংসিত বিষয়কে বিতর্ক ও বিভ্রান্তির চোরাবালিতে স্থাপনে সিদ্ধহস্ত মজহার লিখেছেন:

"মুক্তিযুদ্ধ এখনও আমাদের অধিকাংশের কাছে দুই নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায় 'বাঙালি' বনাম 'পাঞ্জাবি'র লড়াই।"

একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর বাঙালিদের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করাকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। বলেছেন:

"এই অস্ত্র ধারণের কারণে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।"

তাঁর মতে, 'যুদ্ধের চেয়ে একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর প্রতি বে-ইনসাফি এবং নির্যাতিতের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইত্যাদি রাজনৈতিক প্রশ্নই ছিল মুখ্য।' অস্ত্রের চেয়ে তাঁর মতে, 'নৈতিক শক্তিটাকে বড় করে দেখা দরকার ছিল।'

এসব বোলচালের মধ্য দিয়ে তিনি একটি বিভ্রান্তির জাল তৈরি করতে চান। এটাকে অবশ্য এ কালের ফ্যাশনও বলা যায়। প্রতিষ্ঠিত স্বীকৃত বিষয়কে অস্বীকার করে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির এই ফ্যাশনকেই তিনি ও তাঁর কিছু শিষ্য বেছে নিয়েছেন। বোমা হামলা চালিয়ে যে জঙ্গিরা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে নিরীহ মানুষ হত্যার মিশন নিয়েছে, সেই বিপথগামীদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনা দিয়েছেন। বলেছেন: বোমা হামলাকারীরা সন্ত্রাসী জঙ্গি হলে মুক্তিযোদ্ধারাও সন্ত্রাসী জঙ্গী! কিছু লোক, যারা তাঁর অন্ধভক্ত, তাঁরা তাতেও বাহবা দিয়েছেন!

তাঁর অনুরাগীরা ব্যাপকভাবে উচ্ছ্বসিত 'এবাদত নামা', 'মোকাবেলা', 'ভাবান্দোলন' এবং 'নির্বাচিত প্রবন্ধ' নিয়ে। কী আছে এসবের মধ্যে?

ভক্তরা বলছেন, জ্ঞান আছে, পাণ্ডিত্য আছে, দর্শন আছে! তাদের মতে, 'পাশ্চাত্যের সর্বসাম্প্রতিক ভাষা দর্শন, নির্দিষ্টভাবে বললে দেরিদীয় ডিকন্সট্রাকশন ('এবাদত নামা'), সৃজনশীল মার্কসবাদ ('মোকাবেলা'), নদীয়াকেন্দ্রিক বিকশিত ভাবচর্চাকে দায়সহ চিহ্ণায়ন ('ভাবান্দোলন') এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনে ইসলামকে অর্গানিক উপাদান হিসেবে স্থানিকায়নের ('নির্বাচিত প্রবন্ধ') মতো প্রচেষ্টাগুলো একেবারেই ইউনিক।'

কিন্তু সত্যিই কি তা-ই? হালের পাশ্চাত্য দর্শন আর ধ্যান-ধারণার বাংলা রূপান্তর ছাড়া তিনি সত্যিই কী মৌলিক কিছু করেছেন? এডওয়ার্ড সাইদের 'ইসলাম দর্শন'-কে তিনি তাঁর মতো করে রূপ দিয়েছেন। এর বাইরে বিভ্রান্তি আর অপযুক্তি ছাড়া আদতেই কিছু আছে কি?

তবে মিশেল দেয়ার বিদ্যায় তিনি অসাধারণ পারঙ্গম মানতেই হবে। তিনি শ্রীচৈতন্য, লালন এবং রাজনীতির মার্কসকে একটা পাটাতনে ফেলে গড় করে 'ভাবান্দোলন' গ্রন্থে তা উপস্থাপন করে যেভাবে বাহবা কুড়িয়েছেন, তা অবশ্যই 'ইউনিক'!

এখানে একটা কথা কবুল করা ভালো যে, ফরহাদ মজহারের লেখার প্রকরণ এতটাই বিরক্তিকর এবং আকারে তা এত দীর্ঘ হয় যে পড়ার ধৈর্য থাকে না প্রায়ই। দ্রুতই বিষয় থেকে বিষান্তর। এক কথাকে ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে নানা বাক্যে বিন্যাস! তাঁর 'ভাবান্দোলন' পড়ার সময় মনে হয়েছে, যেন পুষ্ট পাট ক্ষেতে হাঁটছি! এই বইয়ের কিছুদূর পড়ার পর মনে হয়েছে, আগের প্যারায় যেন কী ছিল, মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছে নিজেকেই জিজ্ঞেস করতে হয়েছে, শুরুটা যেন কী দিয়ে হয়েছিল? লেখার বিষয়বস্তুটা যেন কী? এবং রবার্ট ব্রুশের মতো অপার ধৈর্য নিয়ে লেখার শেষ পর্যন্ত পড়া হলে মনে হয়েছে, তিনি আসলে কী বলতে চাইলেন?

সৈয়দ মুজতবা আলীকে নকল করে বলা যায়: "মালুম হল যে কিছুই মালুম হল না!"

তুলনামূলকভাবে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ফরহাদ মজহারের কলামগুলো সুখপাঠ্য। তবে তা চিন্তা প্রমোট করার চেয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে বেশি নিবেদিত! তাঁর অধিকাংশ লেখাই মনে হয়, অনেকগুলা বিচ্ছিন্ন বিষয় পাশাপাশি সাজিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফরহাদ মজহারের লেখা পড়তে গেলে ক্লান্তি আসে। মাঝে মাঝে মনে হয়, তাঁর লেখার উদ্দেশ্যই বুঝি সেটা। লোকজনকে 'থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়' বলে বলে ক্লান্ত করে তারপর সুযোগ মতো আলগোছে নিজের ধান্ধার কথাটা বলা।

আমি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত, আবুল ফজল অনূদিত উইল ডুরান্টের 'দর্শনের ইতিকথা' এবং ফরহাদ মজহারের দর্শনবিষয়ক লেখা পাশাপাশি রেখে পাঠ করে দেখেছি, ডুরান্ট কী বলতে চান তা স্পষ্ট, আর ফরহাদ মজহারের বক্তব্য অসংলগ্ন ও অস্পষ্ট! হয়তো তিনি বিরাট জ্ঞানী, আমি বিশাল মূর্খ, কিন্তু দুঃখিত, লেখক হিসেবে তাঁকে বড়ই ব্যর্থ (যে পাঠককে বোঝাতে পারে না) এবং ব্যক্তি হিসেবে মতলববাজ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি!

তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পেরেছেন তাঁর বিভিন্ন রচনা দিয়ে। এক সময় তিনি 'মার্কসবাদ পাঠের ভূমিকা, প্রস্তাব' লিখেছিলেন। আবার 'নাস্তিক' হিসেবে মৌলবাদীদের 'হিট-লিস্টে'ও তাঁর নাম নাম ছিল। 'নাস্তিকদের তালিকা'বিষয়ক এক ব্লগে ফরহাদ মজহার সম্পর্কে লেখা: এই লিস্টে উনার নাম দেখে অনেকেই চমকে গেছেন! তাই না? আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারণে অনেকে তাঁর আসল পরিচয় জানে না। একসময় তিনি ছিলেন একজন কুখ্যাত ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক, বর্তমানে তাঁর ভূমিকা বেশ রহস্যজনক। তিনি এখন আর আগের মতো নাস্তিকতা প্রচার করে বেড়ান না, বরং ইসলামপন্থীদের পক্ষাবলম্বন করে কলাম লেখেন, বিবৃতি দেন। কিন্তু সেটা যতটা না আদর্শগত কারণে তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক কারণে। তিনি এখনও নাস্তিক আছেন নাকি তওবা করে মুসলমান হয়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

নব্বইয়ের দশকে 'এবাদতনামা' নামে একটি ইসলাম বিদ্বেষী কাব্যগ্রন্থ লিখে তিনি বেশ বিতর্কিত হয়েছিলেন। কয়েকটা লাইন উল্লেখ করছি:

"বিবি খাদিজার নামে আমি এই পদ্যটি লিখি, বিসমিল্লাহ কহিব না, শুধু খাদিজার নাম নেব। নবীজির নাম? উহু, তার নামও নেব না মালিক শুধু খাদিজার নাম-দুনিয়ায় আমি সব নাম ভুলে যাব তোমাকেও ভুলে যাব, ভুলে যাবে নবীকে আমার।"

তাঁর আরেকটা কবিতা আরও মারাত্মক: "দুনিয়া রেজিস্ট্রি কর, তিলেক হিম্মত নাই আধা ছটাকের নাই তেজ সাত আসমানে প্রভু খোদাতা'লা হয়ে বসে আছ মুখে খালি কহ শুনি দুনিয়ার তুমিই মালিক অথচ মালিক অন্যে, অন্যে কহিতেছে তারা খোদা মালিক এ জমিনের-প্রত্যেকেই তোমার শরিক তোমার শরিক নাই এই কথা তবে কি বোগাস? এদের দলিল যদি মিথ্যা হয় যাও আদালতে উকিল ধরিয়া করো দুনিয়া রেজিস্ট্রি নিজ নামে!"

(http://www.rajibkhaja.com/2015/03/nastik-list.html)

দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও তিনি বরাবরের মতোই রাজনীতির আঙ্গিনাতেই শয্যা পেতে আছেন। ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশে আনসার বিদ্রোহের সমর্থনে তাঁর নিজের পত্রিকা 'পাক্ষিক চিন্তা'য় একটি নিবন্ধ রচনা করে কারাবন্দি হন। তিনি আনসার বিদ্রোহে 'শ্রেণিসংগ্রাম'-এর মৌলিক উপাদানগুলো লক্ষ করেছিলেন! এরপর বেগম খালেদা জিয়া দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হলে তিনি সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে চীন সফর করে এই 'পাপের প্রায়াশ্চিত্য'ও করেছিলেন!

ফরহাদ মজহার বিএনপির ডান-ঘেঁষা রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন এককালে। আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আঁতাতকে কচুকাটা করেছেন তাঁর কলামগুলোতে। সেই ফরহাদ মজহার হেফাজতের মহাসমাবেশের মঞ্চে উপস্থিত হয়ে আলো ছড়ান!

বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদের বিস্তার রোধে যে মুহূর্তে খুব জরুরি ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত, ফরহাদ মজহার তখন 'মাদ্রাসার এতিম ছাত্রদের' নিয়ে স্বপ্ন দেখেন মার্কিন আগ্রাসন প্রতিরোধ করার। আর এরই সূত্রধরে, যে ব্যক্তি নারীমুক্তির জন্য উদ্বিগ্ন, প্রবর্তনা, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার মতো প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছেন, তিনি সরকার ঘোষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে 'সম্পদে নারীর সমঅধিকার' দানকে উসকানিমূলক বলে প্রচার করেন! তাঁর 'এবাদতনামা' তিনি নিজেই উল্টোদিক থেকে পাঠ শুরু করেছেন যেন!

ফরহাদ মজহার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নামে মৌলবাদকে ধারণ করেছেন, মৌলবাদকে উৎসাহিত করছেন এবং মৌলবাদের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছেন প্রচারমাধ্যমে। শুধু তা-ই নয়, তিনি মনে করছেন, যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী তাঁরা বুশ-ব্রাউনের এজেন্ট। ফরহাদ মজহারের ভাষায়,

"এদের ধর্মনিরপেক্ষ বলা আর গলায় সাপকে ফুলের মালা বলা একই কথা।"

বাম মতাদর্শকে তিনি পচনশীল মনে করছেন এবং কাল্পনিক প্রতিপক্ষ দাঁড় করে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন– সেটি তাঁর অসংখ্য চিন্তার বৈপরিত্যের নমুনামাত্র। এমন ব্যক্তিকে একজন সুযোগসন্ধানী কুচক্রী ব্যক্তি ছাড়া কী-ই বা বলা যায়?

২.
ফরহাদ মজহারকে বোঝার জন্য তাঁর 'রাজকুমারী হাসিনা' বইটি পাঠ করতে হবে। এ বইয়ে তিনি 'দ্বিতীয় খণ্ড সাঁটলিপি প্রকাশের ছুঁতোয় কিছু বাড়তি কথা' শীর্ষক ভূমিকায় লিখেছেন:

"'রাজকুমারী হাসিনা: রাজনীতির প্রতীকী ও ঐতিহাসিক বিরোধ' খণ্ডটি প্রকাশের পরিকল্পনার সময়েই মনে হয়েছিল একটু ধীরে সুস্থে বের করব। এর কারণ হল, আমার আশা ছিল একটু সময় নিলে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের ভালো কিছু দিক আমাদের চোখে পড়বে এবং এই ভূমিকাপত্রে সে কথা খুশি মনে লেখা যাবে। আমি যে এই রকম আশা করেছিলাম সে কথা খোলাসা করেই বললাম। জানি, আমার 'সমাজতন্ত্রী' বা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বন্ধুরা আমার চামড়া আর আস্ত রাখবেন না। আওয়ামী লীগের ওপর আশা! এটা কী হয়!"

এরপর তিনি আরও কয়েকটি দীর্ঘ প্যারা লিখে মন্তব্য করেছেন যে: "…আমি আওয়ামী লীগের ওপর কিছু ভরসা করেছি। এটা অস্বীকার করব না।"

আওয়ামী লীগের ওপর ভরসার কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন:

"আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা অন্তত মুখে বলে। ইতিহাসের সাধারণ গতিমুখ এই দিকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থটাও এখানে। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি গরিব মেহনতি জনগণের জন্য ক্ষতিকর। এটা কে না জানে। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে কী তা নিয়ে অনেক কথা বলা যেতে পারে। সে প্রসঙ্গ থাকুক। কারণ রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করতে হবে এই ন্যূনতম রাজনীতিটুকু আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। এতেই আমাদের চলবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগ আছে।

"…এই অভিযোগ সত্ত্বেও আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা একটা রাজনৈতিক আদর্শ আকারে গৃহীত। আমি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগের অনেককেই চিনি এবং জানি যাঁদের অন্তত এই প্রশ্নে দোনামনা দেখিনি। বিশেষত তাঁরা এটাও জানেন যে, এটাই আওয়ামী লীগের শক্তির জায়গা। অন্য কোনো লক্ষ্য আওয়ামী লীগ যদি ত্যাগও করে তবু রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ নিজের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যে লড়ে। আমার এই বিশ্বাসের আরও একটি কারণ হচ্ছে আওয়ামী লীগ একটি অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল। সামরিক বাহিনীর সমর্থনে বা ওপর থেকে ক্ষমতার আঙুল নাচিয়ে এই দলটির জন্ম হয়নি।"

লিখেছেন: "আমি মনে করেছি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতিটুকু যদি আমরা পাই তাহলেই যথেষ্ট।"

তারপর তিনি 'শ্রেণিগতভাবে আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার দৃঢ় কোনো মিত্র' না হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ভরসার তিন-তিনটি কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। আবেগদীপ্ত কণ্ঠে এক পর্যায়ে ফরহাদ মজহার লিখেছেন:

"আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতির ওপর ভরসা করে আমি ভুল করেছি কি না সেটা আমি এখন আর নিজে বিচার করব না। সেই বিচারের ভার আমি আওয়ামী লীগকে যারা অপছন্দ করে বা যারা আওয়ামী লীগের দুশমন তাদের মুখেও শুনতে চাই না। কারণ তাঁরা সত্যি কথা বলবেন না। আমি শুনতে চাই আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছে।

"আওয়ামী লীগের কর্মী, যাঁরা ছেঁড়া কাপড় পরে, না খেয়ে, কোনো রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার চেষ্টা না করে, পারমিট পাওয়ার আশা না করে, আবছা হলেও একটা আদর্শের জন্য এই দলটি করেন। আসলেই আমি কি ভুল করেছি? আসলেই কি আওয়ামী লীগের ওপর ভরসা করে নিজে একটা মহা স্টুপিড বনেছি? আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আমি সমাজতন্ত্র চাই না, এমনকি গণতন্ত্রও চাই না, কারণ এর একটিও আওয়ামী লীগ দিতে পারবে না। দিতে পারত বলে আমি কখনও বিশ্বাসও করিনি। শুধু চাই রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করা হোক। এটা আওয়ামী লীগ পারবে বলে ভরসা করেছি।"

যে ব্যক্তি আওয়ামী লীগকে এত বড় সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তিই পরবর্তীকালে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের মধ্যে খোঁজেন সমাজ বিপ্লবের দিশা! তিনি বলেছিলেন, ইতিহাসের সাধারণ গতিমুখ ধর্ম নিরপেক্ষতার দিকে, সেই গতিমুখ কি তবে বদলে গেছে?

হ্যাঁ, ফরহাদ মজহার ও দোসররা সেই গতি পাল্টে দিয়েছেন। তাঁরা এখন গরিব খেটে খাওয়া মানুষের সন্তান মাদ্রাসা ছাত্র এবং ইসলামের মধ্যেই সমাজের সব নিদান দেখতে পান।

রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হিসেবে ফরহাদ মজহার প্রথমে শ্রেণিসংগ্রামবাদী হলেও পরবর্তীকালে তিনি জিহাদের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন লেখায় তিনি শ্রেণিসংগ্রামের মর্মবস্তু অন্তর্ভুক্ত না করেই জিহাদের সঙ্গে শ্রেণিসংগ্রাম অভিন্ন করে দেখাচ্ছেন।

মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা কোনো ধর্মের শেকড় ধরে বেড়ে ওঠেনি সেটাকে অস্বীকার করে বাংলাদেশি মুসলিম জাতিয়তাবাদী চেতনার সম্প্রসারণ চাইছে ফরহাদ মজহারের 'ভাবান্দোলন'। তাঁর মতে:

"বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইসলামবিরোধী অথচ আবার ঔপনিবেশিক কোলকাতার উচ্চবর্ণের অভিজাত ও মধ্যবিত্তের হাতে গড়ে ওঠা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কোনো প্রকার ঐতিহাসিক ও ভাবগত পর্যালোচনা ছাড়া তৈরি জামার মতো নিজের গায়ে তুলেছে।"

ফরহাদ মজহার স্পষ্ট করেই বলেছেন যে: "বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটা ইসলামবিরোধী সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ।"

ফরহাদ মজহার তাঁর লেখা ও কথাবার্তায় একধরনের 'মাল্টিলেয়ার ডিফেন্স সিস্টেম' মোতায়েন করেন। প্রতিটা লেখায় তিনি নানা রকমের কথাবার্তার একটা ধোঁয়াশা তৈরি করেন। কয়েকটা দৃশ্যত নির্দোষ কথার ফাঁকে উনার ককটেল মতবাদ সহজিয়া– সাম্যবাদের দাওয়াই সেট করে দেন। এ ধরনের কাজ-কারবার বুদ্ধিবৃত্তিক অসততাও বটে। যারা সব সময়ে 'তর্ক' তুলে বাতচিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তাদের কাছে এ ধরনের নেতিবাচক পদ্ধতি মুখরোচক হতে পারে। হয়েছেও!

অতি উগ্রবাদীরা যখন সমাজতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তখন তাঁরা নিজের পরাজয়ের গ্লানি মুছতে ধর্মের আশ্রয়ে আসার চেষ্টা করেন। ইসলামের নামে ফরহাদ মাজহারও যেন তাঁর পুরনো ব্যর্থতা ভুলতে চাইছেন। মানুষকে বিপথগামী করা তাঁর নেশা। তিনি সবকিছুর অপব্যাখ্যা দিতে পারেন। তাঁর চিন্তা ও তৎপরতার সবেচেয়ে ক্ষতিকর দিক এটাই; শক্তির দিকও সম্ভবত এটাই!

পরিশেষে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসকে নিয়ে একটি প্রচলিত গল্প দিয়ে শেষ করব।

চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসকে জব্দ করতে একদিন এক লোক এসে তাঁকে বললেন: "আপনি কি পাশের গ্রামের শেনজুর নাম শুনেছেন?"

কনফুসিয়াস খানিক ভেবে বললেন, "না তো! কেন, তিনি কী করেছেন?"

এবার আগন্তুক বলল: "তিনি তো অনেক বিখ্যাত মানুষ। সবাই তাঁর নাম জানে! আপনি কেমন জ্ঞানী যে তাঁর নামই জানেন না? সে পাটখড়িতে আগুন ধরিয়ে বিড়ির মতো টান দেয়। তারপর সেই ধোঁয়া নাক-কান-চোখ দিয়ে বের করেন! সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার!

কনফুসিয়াস মনোযোগ দিয়ে আগস্তুকের বক্তব্য শুনলেন। এবার তিনি প্রশ্ন করলেন: "আচ্ছা, তিনি যে নাক-কান-চোখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে সে ধোঁয়ায় কি ভাত রান্না করা যায়?"

আগন্তুক বলল: "না!"

কনফুসিয়াস: "কোনো কিছু গরম করা যায়?"

আগন্তুক: "না!"

কনফুসিয়াস: "সেই ধোঁয়া কারও কোনো উপকারে লাগে?"

আগন্তুক: "না!"

এবার কনফুসিয়াস আগন্তুককে উদ্দেশ করে বললেন: "যে বিদ্যা বা কৃতিত্ব কারও কোনো উপকারে লাগে না, সেটা না জানলে কোনো ক্ষতি নেই!"

[বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ২০১৬ সালের ৩১ জুলাই  মাসুদ রানার 'ভাবান্দোলন ও জিহাদ: বিভ্রান্তির স্বরূপ সন্ধান'শিরোনামে প্রকাশিত লেখার সঙ্গে হুবহু মিল থাকা অংশ বর্তমান লেখা থেকে সরিয়ে ফেলা হল]