মেয়ে শিশুর সুরক্ষা

সরকার জাবেদ ইকবাল
Published : 2 July 2017, 04:44 AM
Updated : 2 July 2017, 04:44 AM

নির্দিষ্ট কোনো একটি মেয়ে শিশুর সমস্যার ক্ষেত্রে মতামত দেওয়ার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা আলোচনা করা দরকার। তা না হলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকতে পারে।

কোনো একটি বিশেষ সমস্যা সব শিশুর ক্ষেত্রে একই অর্থ বহন করবে– এমন কথা নেই। অর্থাৎ সমস্যার কারণ ভিন্ন হতে পারে, আবার শিশুর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সমাধানের প্রক্রিয়াও ভিন্নতর হতে পারে। এমনও দেখা গেছে শিশুর কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা মা-বাবার মধ্যে।

এক ভদ্রলোক তার চার সন্তানকে নিয়ে ছুটে গেলেন ডাক্তারখানায়। প্রত্যেকটি শিশুর নাক দিয়ে সর্দি ঝরছে। সব দেখেশুনে ডাক্তার সাহেব কোনো ওষুধ না দিয়ে প্রেসক্রিপশনে লিখলেন: 'Remove the refrigerator from your house.'

আপনি রাত জেগে টিভি দেখবেন, আর ১০টা বাজলেই শিশুকে বলবেন, 'ঘুমাতে যাও'– এটা হতে পারে না। এক্ষেত্রে আপনাকেও ১০টার সময় ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। শিশুকে বিভ্রান্ত না করার প্রয়োজনে এবং তার সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশের স্বার্থে শিশুর সঙ্গে কথায় ও আচরণে মা-বাবার সৎ থাকা একান্ত জরুরি।

কোনো একটি সমস্যার বিষয়ে মা-বাবাকে পরামর্শ দেওয়ার আগে পুরো প্রেক্ষাপটটি দেখে নেওয়ার দরকার হয়, যেমন: শিশু বিকাশ এবং প্যারেন্টিংয়ের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে মা-বাবার জানার স্তর ও চর্চা, পারিবারিক সংস্কৃতি, ঘরের ভৌত পরিবেশ, প্রতিবেশী-পরিবেশ, শিশুর নিরাপত্তা-ঝুঁকিসমূহ এবং প্রাসঙ্গিক আরও কিছু বিষয়– যেমন: মা-বাবার মধ্যে সম্পর্কের ধরন/আন্তরিকতা ইত্যাদি– যেগুলো শিশুর মানসিকতায় ব্যাপক প্রভাব রাখে।

ধরা যাক একটি মেয়ের নাম অনন্যা। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। অনন্যার পরিবারে একটি সুস্থ-সুন্দর শিশুর বিকাশ-উপযোগী পরিবেশ বিরাজ করছে যেখানে অনন্যা নির্ভয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠছে। কাজেই আপাতদৃষ্টে অনন্যার মধ্যে কোনো সমস্যা চোখে পড়ার কথা নয়। ওকে যেভাবে সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে তা অব্যাহত রাখতে হবে, চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তবে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কিছু বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। কথাগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে, এগুলো অনন্যার ক্ষেত্রে অবধারিত বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।

অনন্যা ঘরে স্বচ্ছন্দ, বিদ্যালয়ে নয় কেন? শিক্ষকরা ওকে পছন্দ করে, কিন্তু বিদ্যালয়ে ওর কোনো প্রিয় বন্ধু নেই কেন? এগুলো বিভিন্ন কারণে হতে পারে, এগুলোর ব্যাখ্যায়ও বিভিন্নতা থাকতে পারে। সাদামাটা চোখে সবকিছু ঠিক আছে। তবে বিভিন্ন রকম মনোসামাজিক (সাইকোসোশাল) সমস্যাগুলোকে একপাশে রেখে শিশু নিপীড়নের (চাইল্ড অ্যাবিউজ) বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হতে পারে, যে ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অধিকতর বিপদাপন্ন (ভালনারেবল)।

চট করে শুধু বড়দের প্রতি অঙ্গুলি-নির্দেশ করা ঠিক হবে না; ঘটনাটি বন্ধুমহল থেকেও ঘটে থাকে। বড়দের দিক থেকে হলে সমস্যাটি এই যে, তারা কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ (এভিডেন্স) রাখেন না এবং 'আদর' করার অজুহাতে অভিযোগ থেকে সহজেই বেরিয়ে আসতে পারেন। গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে শিশুদের 'বললে মেরে ফেলব' কিংবা 'তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না' ইত্যাদি বলে শাসানো হয়ে থাকে।

তবে এ রকম ক্ষেত্রে শিশুর চেহারায় এবং আচরণে তা প্রকাশ পাবে। অনন্যা যেহেতু ঘরে হাসিখুশি এবং কাজিনদের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত হয়ে যায়, সেহেতু ওর ক্ষেত্রে কোনো গুরুতর সমস্যা হয়েছে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। তবে সাধারণ সমস্যাগুলোর বিষয়ে সাবধানতার সঙ্গে খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে।

মনে রাখা জরুরি, অতিরিক্ত সন্দিহান ও উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজন নেই, এতে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে। যেমন: কোনো একটি অপরাধ বিষয়ে অতিরিক্ত সন্দেহ প্রকাশ এবং শাসানোর ফলে অনন্যা সত্যি সত্যিই একদিন সেই অপরাধটি করে বসতে পারে।

সব শিশুর শেখার ধরন ও প্রকাশভঙ্গি এক রকম নয়। কোনো কোনো শিশু শ্রেণিকক্ষে 'স্যার আমি বলি, স্যার আমি বলি' বলে অস্থির করে ফেলে। আবার, কোনো কোনো শিশুকে হাজারবার প্রশ্ন করেও উত্তর পাওয়া যায় না, কিন্তু পরীক্ষার খাতায় সেরা নম্বর পাওয়ার মতো উত্তর লিখে দিয়ে আসে। কাজেই অনন্যা 'ক্লাসে চুপচাপ'– এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আগে বুঝতে হবে অনন্যার শেখার ধরন ও প্রকাশের প্রক্রিয়াটি কেমন।

গল্প বলার মাধ্যমে শিশুকে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টি খুবই ভালো। তবে কখনও শিশুকে গল্পের মূল বক্তব্যটি বলা যাবে না। কেননা, শিশুরা তত্ত্ব (থিওরি) পছন্দ করে না, ওরা প্রয়োগ (অ্যাপ্লিকেশন) দেখতে চায় এবং সেটাই বিশ্বাস করে।

জন্মের পর থেকে তিন বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে 'আমি-কেন্দ্রিকতা' (Me centeredness) ভীষণভাবে কাজ করে। ওরা সবকিছুকেই নিজের সম্পদ মনে করে এবং আগলে রাখতে চায়। এ ক্ষেত্রে অনেকেই আমরা ভুল করে কোনো শিশুকে 'হিংসুক' বা 'স্বার্থপর' বলে চিহ্নিত করে ফেলি। তিন বছর পার হলে শিশুর সঙ্গে খেলনা ভাগাভাগি করে খেলা, বন্ধুদের চকোলেট/বিস্কুট দেওয়া, আরেকটু বড় হলে বাজারে নিয়ে গিয়ে দোকানে টাকা লেনদেন করানো, দানবাক্সে টাকা ফেলা ইত্যাদি নানা উপায়ে শিশুর মধ্যে 'ত্যাগের মানসিকতা' ও অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে।

তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে অধিকতর কৌশলী হওয়ার প্রয়োজন হবে যাতে শিশু কোনোভাবেই বুঝতে না পারে যে তাকে 'শেখানো' হচ্ছে। অনন্যার বয়সের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ লেনদেনমূলক কাজগুলো ওর হাত দিয়েই করাতে হবে। এটা বড় কোনো সমস্যা নয়। আশা করা যায়, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

অনেক মা-বাবা বিশেষত মায়েরা খুব অল্প বয়স থেকেই মেয়ে শিশুর ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে দেখলে অনেক মা-ই কন্যাকে সেখান থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসেন। উপরন্তু এই বলে শাসান: 'কতদিন না বলেছি ছেলেদের সঙ্গে খেলবে না?' কিন্তু এটা যে কত বড় ভুল তা অনেক মা-ই বুঝতে চান না।

শিশুরা নারী-পুরুষের পার্থক্য বোঝে না। একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত তাদের মধ্যে যৌনতাবোধ কাজ করে না। আমরাই সেই পার্থক্যগুলো ওদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই। আর তখন থেকেই সূত্রপাত ঘটে অপরাধ প্রবণতার। ওদের যদি শিশুকাল থেকেই খোলামনে মিশতে দেওয়া যায় তাহলে কখনও তাদের মধ্যে অপরাধবোধ সৃষ্টি হবে না, বরং বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্কের কারণে ওদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে এবং ধীরে ধীরে পরস্পরের সম্ভ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখবে।

মোদ্দা কথা হল, আমরা যদি আমাদের আচার-আচরণের মাধ্যমে ওদের মধ্যে নৈতিকতাবোধ তৈরি করে দিতে পারি তাহলে ওই নৈতিকতাবোধ ওদের নিয়ন্ত্রণ করবে; পাহারা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন হবে না।

আবারও বলছি, আমাদের আচরণের মাধ্যমে শিশুদের মনে সেই বিশ্বাস তৈরি করতে হবে; হেদায়েতের মাধ্যমে নয়। অর্থাৎ সন্তানকে সুপথে পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের সুপথ-অনুসারী হতে হবে; এর কোনো বিকল্প নেই। তবে হ্যাঁ, বাইরের পরিবেশের উপর আমাদের কোনো হাত নেই। সেক্ষেত্রে মেয়েদের বেলায় সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে।

তবে নিজস্ব পরিমণ্ডলে পারিবারিক পরিবেশে অনন্যাকে তথা অনন্যাদের স্বাধীনভাবে মিশতে দিন। এটা তার/তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করবে এবং স্বাধীন চিন্তাভাবনা ও সুন্দর আচরণে অভ্যস্ত করে তুলবে।