কেমন দাঁড়াল এবারের বাজেট

মুহম্মদ মাহবুব আলী
Published : 3 July 2017, 03:36 PM
Updated : 3 July 2017, 03:36 PM

২০১৭-১৮ অর্থবছর বাংলাদেশের জন্যে তাৎপর্যময়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান করতে জাতীয় বাজেটের ভূমিকা অনেকখানি।

গত ২৮ জুন সরকারপ্রধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনার পর অর্থমন্ত্রী জাতীয় বাজেটে বেশকিছু পরিবর্তন এনেছেন। লক্ষণীয় যে, সরকারপ্রধান একটি যৌক্তিক বক্তব্য রেখেছেন:

"কেউ কর ফাঁকি দিলে নিজে ঠকবেন।"

আসলে কর ফাঁকি দিয়ে বিত্তশালীরা অনেকক্ষেত্রেই পার পেয়ে যান। এর ফলে তারা সত্যিকার উন্নয়ন চান কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায়, গ্রিক জাতির সঙ্গে একটি জায়গায় আমাদের মিল আছে; তারাও কর দিতে চায় না, আমরাও কর না দেওয়ার জন্য নানা রকমের ফন্দিফিকির করে থাকি।

অবশ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই কর ফাঁকির 'রেওয়াজ' রয়েছে। কিন্তু বিখ্যাত ব্যক্তিই বলুন, ক্ষমতাসীনই হোক, কেউ কিন্তু কর ফাঁকি দিয়ে রেহাই পায়নি। বিওনবার্গ থেকে আরম্ভ করে স্টেফিগ্রাফের পিতাকেও কিন্তু কর ফাঁকির জন্যে শাস্তির আওতায় আসতে হয়েছে।

লক্ষণীয় যে, এবারের বাজেট যখন সংসদে পেশ করা হয় তখন রমজান মাস চলছিল। তারপরও আমি নয়টি প্রধান খাদ্যদ্রব্যের বাজার যাচাই করে দেখেছি যে, একমাত্র চালের মূল্য ছাড়া অন্য কোনো দ্রব্যের দাম পূরবর্তী বছরের তুলনায় বাড়েনি। এটি একটি ইতিবাচক দিক।

একদিকে হাওরে ধানের উৎপাদনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ধসকে কেন্দ্র করে যে ধরনের খাদ্য সংকট সৃষ্টির সুযোগ নিতে চেয়েছিল সুযোগ সন্ধানীরা, তারা তেমন সফল না হলেও দেশে পর্যাপ্ত চাল থাকা সত্ত্বেও মিল মালিক আর পাইকাররা একে অপরকে দোষারোপ করতে করতে চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

এটি আসলে একধরনের ওলিগপ্লিস্টিক নেচারের কার্টেল সিস্টেম। সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। ট্যারিফ হ্রাস করে ১০% করেছে; আমদানিকৃত পণ্য হিসেবে চাল অবশ্যই আমদানি হবে। কিন্তু দেশে পর্যাপ্ত চাল থাকা সত্ত্বেও যারা দ্রব্যের দাম বাড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এমনকি আমদানিকৃত চাল যেন সহনীয় পর্যায়ে বিক্রি করা যায় সে জন্য বেসরকারি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি টিসিবি ও বিএডিসিকে চাল আমদানি, বাজার পর্যবেক্ষণ ও তদারকির ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।

টিভিতে দেখাল, সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও হাওর অঞ্চলে কোনো কোনো এনজিও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঋণ আদায়ে সচেষ্ট রয়েছে। যেসব এনজিও মহাজনি কায়দায় ব্যবসা করে থাকে তাদের ব্যবসা করা থেকে বিরত রাখার জন্যে প্রয়োজনে নিবন্ধন বাতিল করা দরকার।

শেষ পর্যন্ত মানুষের সবচেয়ে বেশি চিন্তার খোরাক আবগারি শুল্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এক লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো ধরনের আবগারি শুল্ক থাকবে না। এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক হবে। পাঁচ লাখ টাকা থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত হবে পাঁচশ টাকা। আর দশ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক হবে ২,৫০০ টাকা। আর এক কোটি টাকার ঊর্ধ্বে এবং পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক হবে ১২,০০০ টাকা। পাঁচ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে হলে আবগারি শুল্ক হবে ২৫,০০০ টাকা।

ব্যাংক আমানতের উপর আবগারি শুল্কের এ পরিবর্তনে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রথম দুটো প্ল্যানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আবগারি শুল্কের চেয়ে কম রাখা হয়েছে, যেহেতু অর্থনীতি বড় হচ্ছে, মানুষের আয়প্রবাহ বাড়ছে।

ভ্যাট আইন আগামী দুবছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হল। এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক। ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন করতে গেলে যে বিষয়টি সর্বাগ্রে প্রয়োজন সেটি হল, ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের মধ্যে সততা। একই দ্রব্যের ট্যাগ পরিবর্তন করে উচ্চমূল্য রাখার প্রবণতা বাজারে দেখা যাচ্ছে।

একটি বাস্তব উদাহরণ দিই। একটি চেইন স্টোরে ম্যাগি পেস্তার দাম রাখা হচ্ছে ৮৫ টাকা। অথচ ধানমন্ডির অভিজাত বিপণীতে ওই একই পেস্তার ট্যাগে দাম লেখা আছে ৬০ টাকা। এ ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ অবশ্যই দরকার।

পাশাপাশি ভ্যাট আদায় করতে হলে যে ধরনের যন্ত্রপাতি লাগে– কী দামে ক্রয় করা হচ্ছে তা বোঝার ব্যবস্থা দরকার– সেটি পর্যাপ্তভাবে দেশে উৎপাদনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আবার ভ্যাট আইনে দ্রব্যের গুণগত মান অনুসারে অপ্রত্যক্ষ কর বসানো উচিত।

অর্থাৎ বিলাসী দ্রব্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য দ্রব্য, বেঁচে থাকার অবলম্বন ও সাধারণ দ্রব্য– এ চার ভাগে ভাগ করে ভ্যাট বসানো দরকার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের কথা চিন্তা করে ভ্যাট আইন দুবছরের জন্য স্থগিত করে একটি ইতিবাচক কাজ করেছেন। এটি নিয়ে সাধারণ মানুষ বেশ দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল। যদিও ব্যবসায়ীরা 'মায়াকান্না' করলেও শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই কিন্তু মূল্য চুকাতে হত। শেকসপিয়ারের সেই অমর বাক্য উচ্চারণ করছি:

"শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।"

আগামী দুবছরে এনবিআর ভ্যাট আইনকে আরো বাস্তবসম্মত এবং অধিকসংখ্যক দ্রব্যের উপযোগী করে তৈরি করবে– এ প্রত্যাশা রইল।

রাজস্ব আদায়ে যে ঘাটতি আছে তা সত্যিকার অর্থে বিত্তশালী ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর ও কর্পোরেট ট্যাক্সের মাধ্যমে আদায়ে এনবিআরকে সক্ষম ও উদ্ভাবনী কলাকৌশলের অধিকারী হতে হবে। প্রত্যক্ষ কর যত বেশি বৃদ্ধি পাবে ততই এনবিআর নিজেদের কাজে যেমন কৃতকার্য হবে তেমনি দেশের অগ্রযাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।

সমস্যা হল, যারা উচ্চবিত্তের অধিকারী তারা কিন্তু ঠিকমতো প্রত্যক্ষ কর দেন না; এটি যেমন ব্যক্তিপর্যায়ে তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অনেক সময়ে এনবিআরের সৎ কর্মকর্তারাও মনোবল হারিয়ে ফেলেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের প্রটেকশান দেওয়ার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের। ট্যারিফ কমিশনকে অবশ্যই এনবিআরের নিয়ন্ত্রাধীন থেকে বের করে এনে সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন করা উচিত।

ভ্যাট আইন দুবছরের জন্যে স্থগিত করে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে সরকার– এখানে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। বর্তমান 'বাজেট সেফটি নেট' বাড়ানো হয়েছে এটি একটি ইতিবাচক দিক। দলিত সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গ আর প্রতিবন্ধীসহ বয়স্কদের জন্য বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। তবে প্রতিবন্ধীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে সে জন্যে অবশ্যই স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

বাজেটে জনবান্ধব যেসব কার্যক্রম ছিল তা নিয়ে কিন্তু তেমন আলোচনা হয়নি। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংস্কার যত বেগবান হবে তত দেশের জন্যে মঙ্গল হবে। সরকার 'শিক্ষানীতি ২০১০' ঘোষণা করেছে যা একটি আদর্শ শিক্ষানীতি। অথচ এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে শিক্ষা আইন প্রয়োজন, তা গত দুবছর ধরে ঝুলে আছে। তেমনি 'এনভায়রনমেন্ট আইন' সময়ের বিবর্তনে সংস্কার করা বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়েছে।

ধ্যান বা যোগের উপর ভ্যাট রহিত করা একটি ইতিবাচক দিক। কেননা, স্বাস্থ্য ভালো থাকলে মানুষ কর্মক্ষম থাকবে। কম্পিউটার, মুঠোফোন এবং এসবের যন্ত্রাংশ দেশে তৈরি হলে তা ভ্যাটমুক্ত থাকবে বলে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেন। অবশ্য ১ জুলাই থেকে দেশি-বিদেশি সব ধরনের মোবাইল ফোন সেটের আমদানি ও সরবরাহের উপর ১ শতাংশ হারে সারচার্জ জারি করেছে এনবিআর। মাইক্রোসফট বাংলাদেশ লিমিটেড যেসব পণ্য বিনাশুল্কে আমদানি করে সেগুলোর উপর ভ্যাট থাকবে না। বরং দেশীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে সাবসিডি দেওয়া যেত।

প্লাস্টিক ও গ্লাসফাইবারে তৈরি কনটেইনার আমদানিতে কোনো ভ্যাট রাখা হয়নি, সোলার প্যানেলের উপর ১০% আমদানি শুল্ক শেষ পর্যন্ত তুলে নেওয়া হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক।

দেশে যাতে মোটর সাইকেল ও গাড়ি উৎপাদিত হয় সে জন্য জাপানি দূতাবাস ও নিটল নিলয়ের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী ফলপ্রসূ বক্তব্যের আলোকে কথা বলেছেন। তবে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ থাকলে ভালো হত। এদিকে তৈরি পোশাক খাতে উৎসে কর ১% বহাল রাখা হয়েছে। সবুজ কারখানার ক্ষেত্রে ১০% কর্পোরেট কর এবং অন্যদের ক্ষেত্রে ১২% নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে যেসব পোশাক মালিক দেশের বাইরে পোশাক কারখানা স্থাপন করছেন তাদের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা কম দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।

দেশীয় শিল্পের সংরক্ষণ ও বিকাশে আরও তৎপর হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুঁজিবাজার সম্পর্কে অন্তত শেষ দিনেও কিছু দিকনির্দেশনা অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রত্যাশা করা গিয়েছিল। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়নের জন্যে অবশ্যই উদ্যোক্তা তৈরির জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। এ জন্যে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের মাধ্যমে দেওয়া যেতে পারে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬টি কোর্স রয়েছে উদ্যোক্তা তৈরির জন্যে। আসলে বর্তমান যুগে উদ্যোক্তা তৈরি করতে হলে প্রয়োজনীয় অর্থ-শিক্ষা ও বরাদ্দ প্রয়োজন।

সম্প্রতি দেশে যে হারে ছেলেমেয়েরা পাস করে বেরচ্ছে সে তুলনায় চাকরির সুযোগ কম। বিবিএসের সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, ৮৭% কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয়। এদের প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোয় ধীরে ধীরে আনতে হবে। এ জন্যে একটি সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা দরকার। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন কাজ করে চলেছে। তবে এটি আরও বৃহত্তর পরিসরে কাজ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও হাওর অঞ্চলে পিকেএসএফের পার্টনার অগ্রানাইজেশন বাড়াতে হবে।

অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীভুক্ত বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের খোলনলচে পরিবর্তন করে ভিশন-মিশন ঠিক করা উচিত; এসডিজি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। ব্যাংকিংসহ আর্থিক খাতে দুর্নীতিমুক্ত করা এবং কর্মকর্তা কর্মচারীরা যাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে সেদিকে দিকনির্দেশনা কাম্য ছিল।

২০১৭-১৮ সালের বাজেটকে মোটা দাগে বলা চলে জনকল্যাণমূলক। যেসব ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা দূর হয়েছে। আর পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, বাজেট ঘোষণার আগে পুঁজিবাজার সম্পর্কে বলার সুযোগ সে সময়ে পাননি অর্থমন্ত্রী, দরকার হলে তিনি অর্থ উপদেষ্টার মাধ্যমেও কাজটি করতে পারেন।

রাজস্বনীতির সঙ্গে মুদ্রানীতি ও বৈদেশিক মুদ্রানীতির সুস্পষ্ট সমন্বয় দরকার। সম্প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে।