৬৮ বছরে আওয়ামী লীগের উত্থান-পতন

রণেশ মৈত্র
Published : 5 July 2017, 06:25 AM
Updated : 5 July 2017, 06:25 AM

২৩ জুন ছিল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী; এক অর্থে আওয়ামী লীগের বললে ভুল হবে, আওয়ামী মুসলিম লীগের। ২০১৭ সালের ২৩ জুনে এসে দলটি ৬৯ বছরে পদার্পন করল। প্রতিষ্ঠার ৭-৮ বছর পরেই দলটির নামের পরিবর্তন ঘটে– 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' থেকে 'আওয়ামী লীগ'।

দলটির প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের মধ্যে অনেকেই আজ জীবিত নেই। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং আরও অনেকে। মওলানা ভাসানী ও শামসুল হক বাদে প্রধান প্রধান নেতাদের যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এং তাতে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয় ১৯৭১ সালে, ৩ নভেম্বরে দেশের সামরিক-বেসামরিক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাদের বিদেশি দোসরদের সঙ্গে এক জোট হয়ে নির্মমভাবে রাতের অন্ধকারে হত্যা করে। তাই তাঁরা আজ নেই। বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্বের কেউই আজ বেঁচে নেই।

কিন্তু আওয়ামী লীগ আছে এবং শুধু তা-ই নয়, ক্ষমতায় আছে। ৪৬ বছরের বাংলাদেশের সাড়ে ১৮ বছর আওয়ামী লীগ শাসনক্ষশতায় অধিষ্ঠিত থাকল। তবে এ পর্যন্ত ১৭ বছর অতিক্রম করল, আরও দেড় বছর থাকবে, অতঃপর সাধারণ নির্বাচনে জনগণ স্থির করবে নতুন করে কারা ক্ষমতায় আসবে। যদি ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আরেক দফা জিতে আসতে পারে তবে এ দেশের রাজনীতিতে তা হবে এক ইতিহাস। কারণ, তারা সাড়ে ২৩ বছর দেশশাসন করার সুযোগ পাবে যার মধ্যে ২০ বছরের নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে এত দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার সুযোগ অতীতে কোনো দল বা নেতাই পাননি।

কিন্তু এগুলি আসলে বড় কথা নয়। বড় কথা হল, কীভাবে আওয়ামী লীগ এতটা শক্তি অর্জন করতে পারল যার ফলে দলটি বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে পারল, পারল দফায় দফায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে?

এককথায় যদি বলা যায়, তবে বলতে হবে, দলটির বিশাল এক ঐতিহ্য রয়েছে গণআন্দোলন করার এবং তাতে নেতৃত্ব দিয়ে সফলতা অর্জন করার। কিন্তু সর্বাধিক সাফল্য দলটির এসেছিল বঙ্গবন্ধু শখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে– যাঁর অসাধারণ যোগ্যতা ও অসম সাহাশিকতা সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল; জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিল।

কিন্তু এ দল সম্পর্কে বাঙালির মনে শুধুমাত্র শক্তিশালী প্রচারের মাধ্যমে এবং জাতির চেতনায় ইতিহাসনিষ্ঠতার অভাবে অনেক মিথ বা কল্পকাহিনিরও সৃষ্টি করা হয়েছে বাস্তবে যার অনেকটাই অসত্য বা অর্ধসত্য। যেমন ভাষা আন্দোলনের সমগ্রটাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘটার কাহিনি।

১৯৪৮ সালের মার্চে ভাষা আন্দোলনের শুরু। কিন্তু তখন তো আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী মুসলিম লীগ কোনোটারই জন্ম হয়নি। তবু এ আন্দোলনের সৃষ্টি হল যুব সমাজের নেতৃত্বে। এই যুব সমাজের প্রধান শক্তি ছিল পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের নেতৃত্বে। এই যুবলীগটি আজকের যুবলীগ নয়, যেটি আওয়ামী লীগের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন। এটির জন্মও তখন হয়নি।

১৯৪৮ সালেই পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হয় বামপন্থীদের উদ্যোগে শত পুলিশি বাধা-বিপত্তির মুখে গোপনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাধ্যমে। এই সংগঠন যারা গড়ে তোলেন তাদের অনেকেই ওই বছরের এবং বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃত নেতা। গাজীউল হক, আবদুল মতিন, অালি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, রাজশাহীর আতাউর রহমান, পাবনার কে জি মুস্তফা, আমিনুল ইসলাম বাদশা প্রমুখ।

এখন তাঁরা কেউই বেঁচে নেই, তবে পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক বর্তমানের প্রফেসর এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আজও বেঁচে আছেন। যুবলীগের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা সম্ভবত তাঁর পক্ষেই এখন সম্ভব। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী যুবলীগকে আজ দুঃখজনকভাবে পর্দার আড়ালে ঠেলে দেওয়া হয়েছে যা সত্য আড়াল করছে।

তবে মানতেই হবে সাধারণ যুব সমাজের ভূমিকা ছিল ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে অসাধারণ। একদিকে সরকারি-বেসরকারি বাধানিষেধ, দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে এবং গোপন ও প্রকাশ্য কাজের অপূর্ব সমন্বয় সাধন করে তাঁরা দেশের ভাষা-সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক ভাবধারা ও গণতান্ত্রিক চেতনা পুনরুদ্ধারে অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন।

আমিও যুবলীগে যোগ দিয়েছিলাম। ছিলাম আহবায়ক কিন্তু বেশি দিন কাজ করার সুযোগ পাইনি। কারণ, প্রাধান্য দিয়েছিলাম ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলা ও ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে।

অনেকে ভাবতে পারেন, আমি 'ধান ভানতে শিবের গীত' গাইছি। না, আদৌ তা নয়। ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়ে ক্ষুদ্র এক অংশ প্রয়োজনীয় বিবেচনায় সংক্ষেপে তা তুলে ধরলাম মাত্র।

আওয়ামী মুসলিম লীগ তাবৎ গণআন্দোলন গড়ে তুলেছে ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত, সন্দেহ নেই। কারণ, তখন মুসলিম লীগ ছাড়া কার্যত আর কোনো দলের অস্তিত্বই ছিল না। প্রবল সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কবলে পড়ে হিন্দুদের ব্যাপক দেশত্যাগের পরিণতিতে বিভাগ-পূর্ব আসাম্প্রদায়িক দলগুলির কাজের ক্ষেত্রে সৃষ্ট ভয়াবহ পূর্ণতার প্রেক্ষিতেই আওয়ামী লীগকে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। যদিও যথেষ্ট পরিমাণে সেই সাংগঠনিক শক্তি তখন পর্যন্ত আওয়ামী মুসলিম লীগের গড়ে ওঠেনি। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ ছিল আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন। তাদের নিয়েই আন্দোলনে যেতে হত।

কিন্তু বাহান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠার পরে একদিকে যেমন মুসলিম ছাত্র লীগের আবেদন ছাত্র সমাজের কাছে হ্রাস পেয়েছিল তেমনি ভাষা আন্দোলনের প্রধান প্রধান নেতা ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলায় সেটির আবেদন দ্রুতই ছাত্র সমাজের মধ্যে প্রদেশব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। তদুপরি বামধারার চেতনায় নতুন নেতা-কর্মীও ঝাকে ঝাকে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেওয়ায় প্রচণ্ড গতিবেগ সৃষ্টি হয় তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনে।

কিন্তু প্রকাশ্যে ছাত্র ইউনিয়নের অভিভাবক বা তার প্রতি বন্ধুসুলভ কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। এহেন পরিস্থিতিতে ছাত্র ও গণআন্দোলনের অধিকতর বিস্তৃতি ঘটানোর লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়নও ছাত্রলীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের বিশ্বস্ত সহযাত্রী হয়। এভাবে তখন থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগ যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নব উন্মেষ ঘটাতে সচেষ্ট ছিল তা সহজতর হয় ছাত্র ইউনিয়নের ওই ভূমিকার ফলে। ফলে ঘটতে থাকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে বামপন্থা উপাদানের অবিস্মরণীয় সম্মিলন।

আওয়ামী লীগের সর্বাধিক বড় অবদান গণতন্ত্রের সংগ্রামে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এবং সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ঐতিহাসকি বিজয়। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন এবং সব শেষে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান। আবার লক্ষণীয় যে, এ পর্যন্ত সব আন্দোলনে এক অসাধারণ সংশ্লেষ ঘটেছিল জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের সঙ্গে বামপন্থী শক্তির। ফলে উভয়েই লাভবান হচ্ছিল, দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি পিছু হটছিল।

আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত করা বা দলটির অসাম্প্রদায়িকীকরণ করার ক্ষেত্রে যেমন অবদান ছিল শেখ মুজিবর রহমানের তেমনই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন মওলানা ভসানী ও দেশের বামপন্থীরা। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৫৬ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে 'মুসলিম' শব্দটি তুলে দিয়ে 'আওয়ামী লীগ' নামকরণ করা হয়।

একই বছরে আতাউর রহমান খানের পূর্ব বাংলায় আওয়ামী নীঘ কায়ালিকান সরকার এবং কেন্দ্রে হোসেন শহীদ সাহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মাত্র ১২ জন দলীয় সাংসদ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান দলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। পূর্ববাংলার সরকারের সঙ্গে গণতন্ত্রী দলের মাধ্যমে বাম-প্রগতিশীল শক্তির সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ফলে বাংলাদেশ (ওই দলগুলির নিরন্তর প্রচেষ্টায়) অত্যন্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে গন্তব্য পথ নির্ধারণ করে নিতে পেরেছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার রাষ্ট্রীয় মৌল নীতিও সেভাবেই চূড়ান্তরূপে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যার দালিলিক প্রমাণ দলগুলির মেনিফেসটো, একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের ঘোষিত দিকনির্দেশনায় এবং বাহাত্তরের সংবিধানে বিধৃত হয়। গৌরবের চূড়ান্ত শিখরে আরোহন করল বাংলাদেশ ও তার নেতৃত্ব।

নেতৃত্বের ব্যপারটা বাস্তবতার নিরিখে আমাদের চিন্তা-চেতনায় থাকা দরকার। শৈশবে আওয়ামী মুসলিম লীগের যে বিকাশ ঘটাছিল তাতে বিশাল অবদান ছিল দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর। দরিদ্র-শোষিত মানুষের বিশেষত কৃষকের স্বার্থের অনুকূলে দৃঢ় ভূমিকা এবং সাম্রাবজ্যবাদবিরোধী ও সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ জনমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল।

কিন্তু ১৯৫৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করায় মওলানা ভাসানী ও আওয়ামী লীগের ভেতের ও বাইরে অবস্থানকারী বন্ধুসুলভ বামপন্থী শক্তিসমূহ ওই নীতির তীব্র বিরোধিতা করতে থাকেন এবং এরই একপর্যায়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বহু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী দল থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত 'নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে' গৃহীত সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী 'পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)' নামে পাকিস্তানব্যাপী বামধারার একটি প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক দলের জন্ম হয়। একমাত্র এই দলটিরই পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশেই বিস্তার ঘটেছিল মুসলিম লীগ ছাড়া। আওয়ামী লীগ অত্যন্ত শক্তিশালী দল হলেও তার বিস্তৃতি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ কথার সত্যতা ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে যথার্থভাবে প্রমাণিত হয়েছিল।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ববাংলার প্রায় সব কটি আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তান একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের কোনোটাতে একটি আসনও পায়নি।

অথচ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি খান আবদুল ওয়ালী খানের নেতৃত্বে বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে যথাক্রমে গাউস বখশ বেজেঞ্জোর নেতৃত্বে আফগানিস্তানে এবং খান আবদুল ওয়ালী খানের নেতৃত্বে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ন্যাপের সরকারও গঠন করেছিল। ওয়ালী ন্যাপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সমর্থন দিয়েছিল এবং সে কারণে সেখানকার অনেক নেতাকে ইয়াহিয়া সরকার কারারুদ্ধও করেছিল।

এভাবে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে চললেও, পূর্বেই বলেছি, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আদর্শিক চেতনায় দৃঢ় ছিল, জনতার ঐক্যও অটুট ছিল। বামপন্থীদের নীতিনিষ্ঠ অবস্থান এ কাজে আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড এক সহায়ক শক্তি হিসেবেও বিরাজ করছিল।

কিন্তু ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ও রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আদর্শগত ভয়ানক মতানৈক্যের সৃষ্টি হওয়ায় তার অভিঘাতে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মতো বাংলাদেশের সদ্য বিকাশমান বামপন্থী আন্দোলনেও মারাত্মক বিভক্তি ঘটে। এর ফলে দ্বিখণ্ডিত হয় ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি প্রভৃতি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বামপন্থী শক্তিগুলি ওই বিভক্তিজনিত দুর্বলতা বহুলাংশে কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হলেও তা প্রয়োজনমতো শক্তি সংগ্রহ করে আর দাঁড়াতে পারেনি।

এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ প্রধানতম ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হলেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যালীলার পর একদিকে যেমন দলটি আদর্শিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায় তেমনই তারা একটানা ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে লিপ্ত থাকলেও তার আদর্শিক অবস্থান ক্রমাগতই দুর্বল হতে থাকে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
আওয়ামী লীগ বিরোধী দলীয় অবস্থানে থাকাকালে ক্ষমতাসীন বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে দিব্যি জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়ে আওয়ামী লীগ। সেই আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদি হরতাল, সংসদ বর্জন চলে। দেশজুড়ে জামায়াতের সঙ্গে যৌথ সমন্বয় কমিটি গঠন করে আন্দোলনও করে। এভাবেই দলটি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ক্রমশ আদর্শচ্যুতির শিকারে পরিণত হতে থাকে।

এরপর জরুরি অবস্থার কারণে বা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক সৃষ্ট পরিস্থিতির নানাবিধ ধকল কাটিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আশাতীত বিজয় অর্জনে প্রচণ্ড আশাবাদের সৃষ্টি হয় দেশের সর্বস্তরের মানুষের মনে। ধারণা করা হল, আওয়ামী লীগ এখন নিজ শক্তিবলে বলীয়ান হওয়ার ফলে তার প্রতিশ্রুতি এবং বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি– যা ১৯৭২ সালে প্রণীত ও গৃহীত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সংসদে — তা পুনঃস্থাপন করা হবে।

কারণ, মাঝখানে বঙ্গবন্ধু হত্যারন পর প্রথমে জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনী এনে 'বিসমিল্লাহ' সংযোজন করেন, জামায়াতে ইসলামীসহ সব ধর্মাশ্রয়ী দলকে বৈধতা প্রদান করেন, অবৈধভাবে পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আজমকে বাংলাদেশে থাকার সুযোগ প্রদান করেন এবং অতঃপর হোসাইন মুহম্মদ এরশাদ অষ্টম সংশোধনী এনে 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' সংযোজিত করে বাহাত্তরের সংবিধানকে কলংকিত-কলুষিত ও পাকিস্তানিকরণ করেছিলেন। ২০০৮ সালে সংসদে তা সহজেই বাতিল করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে আসার পথটা সহজ হল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পথে হাঁটল না।

অতঃপর ভিন্ন এক মোকদ্দমার রায়ে হাইকোর্ট জিয়ার পঞ্চম ও এরশাদের অষ্টম সংশোধনী বাতিল ও বেআইনি ঘোষণা করলে এবং এর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আপিলে সুপ্রিম কোর্টও ওই রায় বহাল রেখে রায় দিলে সে রায় মোতাবেক ওই জিয়া-এরশাদের আবর্জনা বাতিল হয়ে গেলে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাদ বাকি সবাই তাকে অভিনন্দন জানাল।

কিন্তু আওয়ামী লীগ? তারা ওই রায়ের ভিত্তিতে কোনো গেজেট প্রকাশ না করে উল্টো পঞ্চদশ সংশোধনী নামক 'কুখ্যাত সংশোধনী' এনে দিব্যি জিয়া-এরশাদের সংশোধনীগুলি সংবিধানে পুনর্বহাল করে বাহাত্তরের চার রাষ্ট্রীয় মূল নীতিও নামকাওয়াস্তে এবং লোকের সামনে নিজেরা ধর্মনিরপেক্ষতাসহ বাহাত্তরের মূল সংবিধানে শ্রদ্ধাশীল এমনটি বোঝানোর ক্ষেত্রে তৈরি করল। কিন্তু কারও কি বুঝতে বাকি থাকল যে, সংবিধান ও রাষ্ট্রের ইসলামিকরণ, পাকিস্তানিকরণ দিব্যি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শুরু করা হল?

আজকের আওয়ামী লীগ যে কোনোমতেই বঙ্গবন্ধুর ও মুক্তিযুদ্ধের নীতি-আদর্শ সমুন্নত রেখে চলার আওয়ামী লীগ নয়, বরং তা আওয়ামী মুসলিম লীগের বা এমনকি তাদের চেয়েও আর্দশগতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল, তা আওয়ামী লীগের বহুবিধ কাজে প্রমাণিত হচ্ছে।

হ্যাঁ, এই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনা দু-চারটি দুঃসাহসী কাজ করে নিঃসন্দেহে প্রশংসার পাত্র হয়েছেন। যেমন: বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও তার রায় বাস্তবায়ন, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিচার ও তাদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায় বাস্তবায়ন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকা দিতে অস্বীকার করলে নিজস্ব অর্থে তা নির্মাণের প্রত্যয় ঘোষণা উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু এতে যা অর্জিত হবে গোলাম সেই ধান পোকায় খেয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও তো পাকাপাকি করা হচ্ছে। উগ্র ধর্মান্ধ হেফাজতে ইসলামীর দাবি মোতাবেক পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণের লক্ষ্যে তাদের নির্দেশিত পাঠ্যক্রম চালু করা, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে সাধারণ বিশ্ববিধ্যালয়ের সর্বোচ্চ মাস্টার্স ডিগ্রির মর্যাদা প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মত একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি ও সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে মাদ্রাসা শিক্ষাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। এর পরিণতি বাংলাদেশর জন্য যে কত ভয়াবহ রূপ নেবে তা বুঝতে আরও দশ থেকে ২০ বছর লেগে যেতে পারে। কিন্তু তখন আর শোধরাবার সুযোগ পাওয়া যাবে না।

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে ভাস্কর্য অপসারণ সংক্রান্ত হেফাজতের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন জেনেও তাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তা সরানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে যে বাঙালি সংস্কৃতিতে কুঠারাঘাতও করা হল। মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনাশ্রয়ীদের বিরোধিতা বিন্দুমাত্র আমলে না নিয়ে ভবিষ্যত বাংলাদেশের যে রূপরেখা আওয়ামী লীগ হাজির করছে তা রীতিমতো ভয়ংকর। যেন তাদের কমিটমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নয়, বরং জামায়াত-হেফাজত-জিয়া-এরশাদের প্রতি।

তাই ৬৮ বছরে এসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামক ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ দলটি আজ দ্রুত পেছন দিকে ধাবমান। বাঙালির, মুক্তিযুুদ্ধের, বঙ্গবন্ধুর, চার জাতীয় নেতার লালিত স্বপ্নকে আজ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পরিকল্পিতভাবেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

আওয়ামী লীগকে গ্রহণযোগ্য করে রাখতে হলে আপসকামিতা ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর পথে প্রগতির শক্তিগুলির সঙ্গে একত্রে লড়াইয়ে নামতে হবে– সাম্প্রদায়িকীকরণ ও পাকিস্তানিকরণ প্রতিরোধে। এ লড়াই ধর্মযুদ্ধতুল্য যাতে আপসের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

আশা করি দলটির নেতাদের ও কর্মীদের শিগগিরই বোধোদয় হবে। আত্মহননের পথ থেকেও আওয়ামী লীগ হয়তো সরে আসবে। অত্যাসন্ন ভয়াবহ বিপর্যয় থেকেও হয়তো রক্ষা পাবে বাংলাদেশ।