পশ্চিমবঙ্গে ভুয়া ডাক্তার ও স্বাস্থ্যসেবা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 18 June 2017, 04:16 PM
Updated : 18 June 2017, 04:16 PM

জাল ওষুধের কথা সবাই জানেন। জানেন জাল নোট, জাল সার্টিফিকেটের কথাও। কিন্তু জাল ডাক্তারের কথা সদ্য সামনে এসে গেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, যে রাজ্যটি পরিচালনা করেন বঙ্গেশ্বরী মমতা বন্দোপাধ্যায়। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার রোগীই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে 'ডেথ সার্টিফিকেট' নিয়ে ফিরতে হয়েছে।

শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, পাশের দেশ থেকে মাসে গড়ে ৩০০-৪০০ রোগী এসে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে নানা চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। পশ্চিমবঙ্গের এসব হাসপাতালের জাল ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় ৫০০।

দিল্লির মেডিক্যাল কাউন্সিল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এই জাল ডাক্তাররা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে প্রকৃত ডাক্তাররা হিমশিম খাচ্ছেন।

বাংলাদেশের রোগীরা কি আর এই রাজ্যে নাম-ডাকওয়ালা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসবেন? এর বিকল্প উপায় কী তা খোঁজার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কোনো চিন্তার কথা শোনা যায়নি। বরং তাঁর বাড়ির কুকুরের 'ডায়লেসিস' করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল এসএসকেএমে। জাল ডাক্তার ধরা পড়েছে রুরি, বেলভিউ, অ্যাপলোর মতো নামি হাসপাতালেও। কী ঘটছে তা একবার দেখা যাক।

পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক জাল ডাক্তার নিয়ে যে তীব্র চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে সে ব্যাপারে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না সিআইডি এবং রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তকারীরা। পারছেন না, তার কারণ জাল ডাক্তার ইস্যুতে মুখ্যমন্ত্রীর মন এখন পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেননি তারা। গত এক মাস ধরেই রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা জাল ডাক্তারদের খবর প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু এতদিনেও শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস বা খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি। ফলে তাঁর ও শাসক দলের 'লাইন' বুঝতে না পেরে মাঝপথেই আটকে রয়েছেন তদন্তকারীরা। রাজ্যে প্রায় ৫০০ ভুয়া ডাক্তার রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি সিআইডি এবং রাজ্য পুলিশের তদন্তকারীদের হাত-পা বেঁধে রেখেছে, তা হল ধৃত জাল ও ভুয়া চিকিৎসকদের প্রায় সবাই কমবেশি শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে সর্বশেষ ধরা পড়া বেলভিউ হাসপাতালের চিকিৎসক নরেন পান্ডে তৃণমূলের বেশ বড় মাথা। তৃণমূলের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন, তার রূপরেখা ও ব্যবস্থাপনায় তিনি যথেষ্ঠ উচ্চস্থানে বিরাজ করছেন। তার ক্ষমতা ও প্রভাব নিয়ে ভালোরকমই ওয়াকিবহার রয়েছেন পোড় খাওয়া তদন্তকারীরা। কিন্তু এই হাত যে কতটা লম্বা হতে পারে, আর কতটা পৌঁছে যেতে পারে তা এখনও আন্দাজ করতে পারছেন না তারা।

ধৃত ভুয়া চিকিৎসক নরেন পান্ডের প্রভাব এতটাই যে আইএমএর শিক্ষা শিবির 'একাডিমা ২০১৭'-তে বক্তাদের তালিকা থেকে তার নাম বাদ গেলেও সভার কার্ড থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারেনি উদ্যোক্তারা। শেষ পর্যন্ত অন্য চিকিৎসকরা বয়কট করায় শিবিরটাই বাতিল করে দিতে হয়। অভিযোগ: এই নরেন পান্ডের সাঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প নিযে আলোচনা করা হত মন্ত্রী-স্তর থেকে। তৃণমূলের এক প্রভাবশালী চিকিৎসক নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বর্তমানে সিআইডি হেফাজতে রয়েছেন তিনি।

আরও একটি বিষয়, যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত গোযেন্দা বিভাগ, তা হল এই তদন্তটা কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারা যাবে, বা আদৌ পারা যাবে কি না। এমনিতে সিআইডি এবং কলকাতা তথা রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দাদের কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতা যথেষ্টই ক্ষুরধার। কিন্তু তৃণমুল কংগ্রেসের আমলে একাধিকবার দেখা গিয়েছে, তদন্তকারীরা একটা ক্ষেত্রেও মুখ্যমন্ত্রী বা শাসকদলের ইচ্ছের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে তদন্ত করে উঠতে পারেনি। তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার।

শাসক দলের নির্দেশ উপেক্ষা করে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে হয় তাদের আচমকাই থেমে যেতে হয়েছে কিংবা উপযুক্ত ফল ভোগ করতে হয়েছে। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দুঁদে অফিসার দময়ন্তী সেন।

তবে রাজ্যের প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তা এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটা এমনই একটা বিষয় যেখানে তদন্তকারীরা পিছু হটতে পারবেন না। স্বাস্থ্যের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত এই বিষয়টি যতদিন যাবে ততই প্রকট হতে থাকবে। সেক্ষেত্রে অভিযোগের তির উঠবে তদন্তকারীদের দিকেই। কেন বিষয়টি জানাজানি হওয়া সত্ত্বেও তারা হাত গুটিয়ে বসেছিলেন?

এমনই একটা পরিস্থিতিতে সিবিআই চাইছে জাল ও ভুয়া চিকিৎসক কাণ্ডে তাঁদের বিনা বাধায় এগোতে দেওয়া হোক। সামনের প্রতিবন্ধকতা এড়াতে আটঘাঁট বেঁধেই এগোতে চাইছেন তদন্তকারী অফিসাররা। সে কারণেই কয়েকদিন আগেই দতন্ত চালিয়ে যাওয়া হবে কি না জানতে চেয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ করপুরকায়স্থর কাছে চিঠি ও রিপোর্ট পাঠিয়েছে সিবিআই।

তাতে বলা হয়েছে, মারাত্মক জায়গায় চলে গিয়েছে কলকাতার চিকিৎসাব্যবস্থা। যে হারে জাল চিকিৎসক বেরচ্ছে, তাতে ধরা পড়লে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তির ওপর জোর ধাক্কা আসতে পারে। তাই এই তদন্ত আদৌ চালিয়ে যাওয়া হবে কি না, তা ডিজির সঙ্গে কথা বলে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিতে চাইছে সিআইডি। এদিকে ভুয়া চিকিৎসক ধরতে সিআইডির সাহায্য চেয়েছে ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিলও। কারণ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নথিপত্র সিআইডির কাছেই রয়েছে।

রোজই কয়েকজন করে ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়ার নৈমিত্তিক তালিকায় গত কয়েকদিনে যুক্ত হয়েছে আরও অন্তত পাঁচজনের নাম। এক. বারুইপুরের ইজাজ আহমেদ, দুই. দক্ষিণেশ্বরের তিক চক্রবর্তী, তিন. দক্ষিণেশ্বরেরই আরেক ভুয়া ডাক্তার বি জোয়ারদার, চার, হাওড়ার এম আর মল্লিক এবং পাঁচ. কলকাতার ফুলবাগানের এক নার্সিংহোমের জে পি আগরওয়াল।

তদন্ত যত এগিয়েছে তত লম্বা হয়েছে রাজ্যের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ভুয়া চিকিৎসকদের তালিকা। জাল চিকিৎসকদের খুঁজে বের করতে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করল সিআইডি। এই দলের মাথায় রয়েছেন সিআইডির ডিআইজি (অপারেশনস)।

গত ১৩ জুন তদন্তকারী অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকের পর এই বিশেষ দলটি গঠন করেছেন সিআইডির কর্তারা। বর্তমানে একজন সিএসপির নেতৃত্বে সিআইডির আর্থিক অপরাধ দমন শাখার অফিসাররা এই ঘটনার তদন্ত করছিলেন। ওই দিনের পর সিআইডির বাছাই করা গোয়েন্দাদের নিয়ে দুটি আলাদা দল গঠন করা হয়েছে। একইসঙ্গে গোটা দেশেও এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছে। দেখা গিয়েছে, সারা ভারতে বেশির ভাগ জাল ডাক্তার এসেছে পশ্চিমবঙ্গ থেকেই।

কলকাতার অলটারনেটিভ মেডিক্যাল কাউন্সিল নামে একটি প্রতিষ্ঠানে হানা দেন সিআইডি অফিসাররা। রোজই রাজ্যজুড়ে ভুয়া ডাক্তারের আরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। নিমতার অশিতাভ বসু স্মৃতিরক্ষা কমিটির চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে তিন চিকিৎসককে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে একজন আবার নামের পাশে 'এমডি' লিখতেন। বাকি দুজন রেজিস্ট্রেশন নম্বরই দেখাতে পারেননি। ঐ চিকিৎসাকেন্দ্রের কর্ণধার পুলক পাল বলেছেন: "আমাদের এখানে ইউজিসি ও এক্সরে করতে পাঠান অনেক চিকিৎসক। যাদের প্রেসক্রিপশন দেখলে বোঝাই যায় না তারা কিসের পরীক্ষা করতে বলেছেন।"

উল্লেখ্য, ধৃত ভুয়া চিকিৎসক অজয় তেওয়ারি প্রথমে বিমান চালকের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তারপর সাত বছর কলকাতার হোমিওপ্যাথি কলেজে পড়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১৭ আগস্ট ভুয়া ডিগ্রি দেখিয়ে কোঠরি মেডিকেল সেন্টারে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি গোবিন্দ খটিক রোডে একটি হোমিওপ্যাথি কলেজে ভর্তি হন। রেগুলার পরীক্ষার্থী হিসেবে পাস করতে পারেননি তিনি। সাত বছর ধরে বিভিন্ন কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন ১৯৯৬ সালে।

আলিপুরের পাশাপাশি তালতলার একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন অজয়। এছাড়াও খিদিরপুরের বাবুবাজার, পাহারপুর রোড, গার্ডেনরিচ করুটোলা এবং সিআইটি রোডের ফিলিপস মোড়ে তার চেম্বার ছিল। আইজলের এক চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করতেন তিনি।

হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে দিব্যি ডাক্তারি চালিয়ে গেছেন ইজাজ আহমেদ নামে এক জাল ডাক্তার। তাকে বারুইপুর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি তার নামের পাশে 'এমবিবিএস' ডিগ্রি লিখে দিব্যি ডাক্তারি চালিয়ে গেছেন। গত তিন বছর ধরে নিজেকে এমবিবিএস পাস চিকিৎসক হিসেবে দাবি করে আসছিলেন এই ইজাজ। জেনারেল মেডিসিন ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কয়েকদিন ক্লিনিকে দিব্যি চলছিল প্র্যাকটিস। পুলিশের দাবি বৈধ রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়াই প্র্যাকটিস চলছিল।