বাজেটের ভালো-মন্দ পরিমাপের উপায় কী?

সাব্বির আহমেদ
Published : 19 June 2017, 05:17 AM
Updated : 19 June 2017, 05:17 AM

প্রতি বছর জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা হলে এর পক্ষে ও বিপক্ষে নানা মন্তব্য আসে গণমাধ্যমে। বাজেট যেহেতু সরকার দেয়, বিরোধীদলের সেহেতু একটা চরম বিরোধী অবস্থান নিতে হবে। তারা বলবে এই বাজেট গণবিরোধী, এই বাজেট লুটপাটের সুবিধা করার জন্য হয়েছে ইত্যাদি।

সরকার বাজেট দিয়েছে বলে সরকারি দলের লোকেরা এই বাজেটকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো বাজেট, গণমুখী বাজেট ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করতে থাকবে।

এর মাঝখানে আছে আরেক দল: 'স্বঘোষিত' সুশীল সমাজ। এদের একটা মন্তব্য আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে শুনতে পাচ্ছি, তা হল–

"এই বাজেট উচ্চাভিলাষী, এই বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।"

এছাড়া তারা যা বলেন তার সবকিছুই থাকে ব্যবসায়ীদের ও সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে। এ কথা বলার জন্য সুশীলেরা বাজেটের পরের দিন একটা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। যেটা টেলিভিশনে 'লাইভ' দেখানো হয়। সরকারও একটা সংবাদ সম্মেলন করে সমালোচনার জবাব দেওয়ার জন্য।

সংসদের বিরোধী দলের আনুষ্ঠানিক বাজেট প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে না। ব্যবসায়ীরা এক-দুইদিন পরে সংবাদ সম্মেলন করে আকাশকুসুম দাবি করেন। বিএনপি নেতারা বাজেট প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে কিছু উড়ো কথা বলেন, বেশ দেরিতে একটা সংবাদ সম্মেলন করে অফিসিয়ালি বাজেট প্রতিক্রিয়া দেন। এই হচ্ছে আমাদের একালের বাজেট সংস্কৃতি।

আশির ও নব্বইয়ের দশকে সংসদে বাজেট উপস্থাপনের পর পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে শহরে শহরে মিছিল বের করত সরকার ও বিরোধী দলের লোকেরা। তখনকার বক্তব্য এখনকার থেকে ভিন্ন কিছু ছিল না। বাজেটে যা-ই বলা হোক না কেন সরকারি দল তার পক্ষে এবং বিরোধী দলসমূহ তার চরম বিপরীতে বক্তব্য রাখত।

এই চরম বৈপরীত্যের মাঝখান থেকে সাধারণ মানুষ কী বুঝবে? বাজেটটা আসলেই ভালো কিছু দিল, নাকি সবটাই খারাপ– এ সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর কোনো উপায় নেই সাধারণ মানুষের।

আমজনতা দূরের কথা, সচেতন শিক্ষিত মানুষের পক্ষেও বুঝে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না যে, বাজেটটা মোটের উপর কেমন হল। এরকম একটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির ভেতরে থেকে কেটে যাচ্ছে আমাদের দশকের পর দশক। বাজেট নিয়ে আমাদের মধ্যে সত্যিকারের সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে না। বাজেট ঘোষণার দিনে বাজেট নয়, আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে থাকে ক্রিকেট বা অন্য কোনো বিষয়।

বাজেট ১৬ কোটি মানুষের প্রতিটি মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। যারা মোটামুটি স্বচ্ছল তাদের উপর বাজেটের প্রভাবের মাত্রা কম বলে তারা গা করেন না। আর যারা দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষ তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না যে, বাজেট নামক একখানা দলিল কী করে তার আয়-ব্যয়ের উপর প্রভাব ফেলে। তারা শুধু বুঝতে পারেন, নিজের জীবন কেমন যাচ্ছে।

অতি ধনী লোকেরা বাজেটের গুরুত্ব খুব ভালো বোঝেন বলে তারা সদা প্রস্তুত থাকেন বাজেট বিষয়ে। বাজেটের কয়েক মাস আগে থেকেই চলে তাদের আলাপ-আলোচনা, মিটিং-সিটিং। ব্যবসায়ী সংগঠনের নামে, পেশাদারদের সংগঠনের নামে, এনজিওদের ব্যানারে, সুশীল সমাজের গোলটেবিলে, মিডিয়ার খবরে, রাজনৈতিক নেতাদের মুখে, যখন যে পদ্ধতি কার্যকর বলে মনে করেন তখন সে ঘুঁটি দিয়ে চাল দেয় বাজেটকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অনুকূলে ব্যবহার করার জন্য। অতি ধনীদের মিটিং-সিটিং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। সরকার সে চাপে চ্যাপ্টা হয়ে অতি ধনীদের কাছে নতি স্বীকার করে বাজেট পেশ করে। এসব উল্টোমুখী কথাবার্তার কারণে সাধারণ মানুষ থাকে বিভ্রান্তিতে।

বাজেট ভালো হয়েছে না, খারাপ হয়েছে তা বিচার করার মানদণ্ড কী? সর্বজনসম্মত কোনো মানদণ্ড কি আদৌ আছে? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক আলোচনা যতটা অনুসরণ করার সুযোগ পাই তা থেকে বলতে পারি, উন্নত দেশসমূহ থেকে শুরু করে প্রতিটি দেশেই বাজেট এবং অর্থনৈতিক নীতিমালা সবসময় একটি বিতর্কিত বিষয়। বিজ্ঞানীরা পারলেও অর্থনীতিবিদেরা কখনও কোনো বিষয়ে একমত হতে পারেন না।

বাংলাদেশসহ বর্তমান পৃথিবীর সব দেশেই অর্থনীতিবিদদের মধ্যে তিনটি ধারা প্রবল। এক. দক্ষিণপন্থী, দুই. সুশীলপন্থী এবং তিন নম্বরে মধ্যবামপন্থী।

দক্ষিণপন্থীরা মনে করেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তথা সরকারের ভূমিকা যত কম রাখা যায় ততই বেসরকারি খাত বিকাশের সুযোগ পাবে। বেসরকারি খাত যেহেতু সরকারের তুলনায় অনেক বিশাল সেহেতু বেসরকারি খাত বিকশিত হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন আপনা-আপনি হয়ে যাবে। তাই তারা সবসময় করের হার কমাতে চান। অবকাঠামো নির্মাণে সরকারের নয়, পুঁজিপতিদের ভূমিকা বৃদ্ধির কথা বলেন; সামাজিক সেবার বিপক্ষে থাকেন। এরা মনে করেন সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে কিছু অকর্মণ্য লোকের করের পয়সায় পরিপোষণ করা হচ্ছে।

সুশীলপন্থীরা করকর্তন বা সামাজিক সেবা বৃদ্ধি বা কর্তনের মতো স্পষ্ট বিষয়গুলোতে কথা বলেন না। বিশ্বায়ন, জলবায়ু, উদার অর্থনীতি, অভিবাসন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তারা অনেক কথা বলেন। তারা বিশ্বায়ন নিয়ে কথা বললেও শ্রমিকের অবাধ চলাচল নিয়ে কিছুই বলেন না। তারা মুক্ত বাণিজ্যের কথা বলেন, কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপ যে কৃষিপণ্যের জন্য ভর্তুকি দেয় তা বন্ধ করতে বলেন না। অর্থনৈতিক বিষয়ে তাদের অবস্থান ঠিক কোন স্থানে তা নির্ণয় করা যায় না। তারা সবকিছুতে মধ্যপন্থী। তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো দর্শন নেই। তারা সবকিছুর মাঝখানে কথা বলে ভালো ও মন্দের মিশেল দিয়ে একটা 'গ্রে এরিয়া' (বা ঘোলাজল) তৈরি করেন।

পুঁজিবাদীরা যেহেতু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী, তাই তারা সুশীল সৃষ্ট ঘোলাজলে টপ টপ করে মাছ ধরে নিজেদের পকেট ভর্তি করে ফেলেন। সম্প্রতি ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এরা জয় লাভ করেছে। তাদের সমর্থনের কারণেই রাজনীতিতে প্রায় অচেনা ইমানুয়েল মাক্রোঁ প্রতিষ্ঠিত সব রাজনৈতিক দল ও নেতাদের হারিয়ে দিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। রিগ্যান-থ্যাচার প্রবর্তিত মুক্তবাজার অর্থনীতির দুনিয়ায় কিছুটা দূরে থেকে পুঁজিবাদের পক্ষে কথা বলার জন্য সারা পৃথিবীতে এই এক নতুন শ্রেণি সৃষ্টি করেছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ।

শক্তিশালী বামপন্থীদের অবর্তমানে আরেক দল হচ্ছে মধ্যবামপন্থী। তারা মনে করেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের যথেষ্ট ভূমিকা থাকা উচিত। সরকার অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ না করলে পুঁজিবাদীরা সম্পূর্ণ অর্থনীতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে। অর্থনীতিতে সরকারের জোরালো অংশগ্রহণ থাকলে দ্রব্য ও সেবার মূল্যের উপর পুঁজিপতিরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পাবে না। সামাজিক সেবা খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করা উচিত। এতে সমাজের পিছিয়ে পড়া লোকেরা শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের সুবিধা পেলে তরতর করে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে।

সুশিক্ষিত ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষ বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নততর সমাজ গঠনে অধিকতর ভূমিকা রাখতে পারবে। আর তা হলে সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি এগিয়ে যাবে। তাই তারা যার যত বেশি আয় তার তত বেশি হারে কর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন। এরা কর্পোরেট কর বৃদ্ধির পক্ষে, সরকারি খরচে বেশি বেশি অবকাঠামো নির্মাণের পক্ষে। এরা পরোক্ষ নয়, প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে বাজেট অর্থায়নের কথা বলেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর কথা বলেন।

মধ্যবাম ধারার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বার্নি স্যান্ডার্স ও যুক্তরাজ্যের জেরেমি করবিন অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। ২০১১ সালের 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' আন্দোলনের ফলে সচেতন মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার ফলে মধ্যবাম ধারার রাজনীতির প্রতি বিশ্বজুড়ে সমর্থন বাড়ছে।

আমাদের দেশেও এই তিন ধারার লোক রয়েছে। ডানপন্থী ও মধ্যবামপন্থীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও এখানে প্রবলভাবে আধিপত্য করছে সুশীলপন্থীরা। সুশীলেরা বস্তুত ধনিক শ্রেণির কথাই বলেন। এদের চাপ উপেক্ষা করে অর্থমন্ত্রী কয়েক বছর আগে ব্যক্তিখাতে সর্বোচ্চ কর হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করেছেন। অনেকদিন ধরে চাপ থাকা সত্ত্বেও কমাচ্ছেন না কর্পোরেট করের হার। নতি স্বীকার করেছেন পোশাক শিল্প মালিকদের চাপের কাছে। পোশাক শিল্পের কর ২০% থেকে কমিয়ে করেছেন ১৫%। পুঁজিবাদের স্বর্গ, যুক্তরাজ্যের বিরোধী দল লেবার পার্টির প্রধান জেরেমি করবিন তাঁর সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যক্তিখাতে কর হার ৫০ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলেছেন; কর্পোরেট কর হার বৃদ্ধির কথা বলেছেন ৪ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে সব রকম পণ্য ও সেবার উপর ১৫% হারে ভ্যাট প্রদানের বিধান করা হয়েছে। চলতি বছর পর্যন্ত এই হার বিভিন্ন পণ্য ও সেবার জন্য বিভিন্ন রকম। একই সঙ্গে ভ্যাটের আওতামুক্ত মাঝারি আকারের ব্যবসায়ীদের জন্য টার্নওভার করের আওতা ৩০ লাখ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৬ লাখ এবং এর সর্বোচ্চ সীমা ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে এক কোটি ৫০ লাখ। ফলে আরও বেশি সংখ্যক নিম্ন আয়ের ব্যবসায়ী আগামী বছর থেকে ভ্যাট ও টার্নওভার করের আওতার বাইরে চলে যাবেন; আরও বেশি সংখ্যক মধ্যম আয়ের ব্যবসায়ী ভ্যাটের চাপ থেকে অব্যহতি পাবেন।

এছাড়াও প্রস্তাবিত বাজেটে ৫০০ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যকে নতুন করে ভ্যাটের আওতামুক্ত করার ফলে আগামী অর্থবছর থেকে প্রায় এক হাজার পণ্য ভ্যাটের আওতার বাইরে থাকবে। এই ব্যবস্থার ফলে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের বেশ ভালোভাবেই ভ্যাটের আওতামুক্ত করা হয়েছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমবে। ভ্যাটের আওতাধীন সব পণ্য ও সেবার উপর একই হারে ভ্যাট ধার্য করায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মানুষ যেসব পণ্য ও সেবা ব্যবহার করেন তার উপর ভ্যাটের চাপ বেড়ে যাবে; মধ্যবিত্তের সঙ্গে উচ্চবিত্তের অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যাবে।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে প্রতি বছর বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই খাতে বরাদ্দ বাজেটের ৬%। প্রস্তাবিত বাজেটে একদিকে যেমন সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে অন্যদিকে তেমনি বাড়ানো হয়েছে ভাতার পরিমাণও। এ বাজেট বাস্তবায়িত হলে ভাতাপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ, দুঃস্থ নারী, প্রতিবন্ধী, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মা ও দরিদ্র মাতার সংখ্যা হবে ৬৩.৯ লাখ।

এছাড়া বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, হৃদরোগী ও স্ট্রোকে আক্রান্ত মানুষ, চা শ্রমিক এবং ভিজিডিসহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দুটি ঈদ বোনাস যুক্ত হচ্ছে আগামী অর্থবছর থেকে।

এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ মানবসম্পদ উন্নয়নে যা জিডিপির ২৮.৭ শতাংশ বা এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত। বছরের পর বছর এ খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বরাদ্দ করা হলেও ফলাফল ভালো আসছে না।

শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন শিক্ষাবিদেরা; সরকারি হাসপাতালগুলো দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। একটু স্বচ্ছল রোগীদের ডাক্তারেরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে নিজেদের ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেন তাদের পকেট থেকে টাকা নামিয়ে রাখার জন্য। রোগীর চিকিৎসা এখন রোগের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে রোগীর আর্থিক সক্ষমতার উপর। ক্যানসার, হৃদরোগ বা কিডনি ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ভিটেমাটি বেচে চিকিৎসা করাতে হয়। শিক্ষক ও ডাক্তারদের দুর্নীতি কমাতে না পারায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা ঢেলেও তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না; গণসেবা বাড়ছে না।

দেশের অর্থনীতির প্রধান কয়েকটি দুর্বল দিক সুস্থ করে তোলা সম্পর্কে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই দুর্বল দিকগুলো হচ্ছে– প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি ও দফায় দফায় ব্যয় বৃদ্ধি; বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা; রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে ধীর গতি, বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স কমে যাওয়া; ব্যাংকিং খাতে খেলাফি ঋণের আস্ফালন; প্রবৃদ্ধির সমান্তরালে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না হওয়া এবং শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের আধিক্য।

এসব বিষয়ের সঙ্গে কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সেবা জড়িত। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগুলো নির্মাণ সমাপ্ত করে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো যত দ্রুত চালু করা যাবে এবং ব্যাংকগুলোর উপর থেকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করা যাবে তত দ্রুত এসব বিষয়ের সমাধান হবে।

বাজেট ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়াল না কমাল তার উপর নির্ভর করে বলা যায়– বাজেট ভালো হয়েছে না, খারাপ হয়েছে। সচ্ছল মানুষের সুবিধা বা অসুবিধা বিবেচনা করলে বাজেটের গুণাগুণ নির্ধারণ করা যায় না। বাজেটের ভালো-মন্দ নির্ধারণের একমাত্র মানদণ্ড হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। পুঁজিবাদী সমাজে নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মসংস্থান যেহেতু বহুলাংশে নির্ভর করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উপর। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অন্যতম পথ বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের সুব্যবস্থা। বৃহৎ শিল্পে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ করে থাকে অতি ধনী লোকেরা।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের সুবিধা দিয়ে বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লাভের উপর করারোপ করে অতিলাভের সুযোগ রুদ্ধ করা যায়। শ্রমিকের প্রাপ্য আদায়ে সরকারের ভূমিকা বৃদ্ধি করে শ্রমিককে শোষণের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। অতি লাভের সুযোগ দেওয়া হলে, শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ধনী আরও ধনী হতে থাকে; খেটে খাওয়া মানুষ আরও দরিদ্র হয়ে যায়।

প্রস্তাবিত বাজেটে এই দিকগুলোর মধ্যে অনেকটা সামঞ্জস্য রক্ষা করা হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এখন একটা যুদ্ধ ঘোষণা করে দুর্নীতি দমন করতে পারলে বাজেট প্রকৃত অর্থে জনকল্যাণে আসবে। নতুবা জনকল্যাণমুখী বাজেট কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের নয়, পকেট ভর্তি করবে দুর্নীতিবাজদের।