পদ্মা ব্রিজ দিয়ে কী হবে?

মুহম্মদ জাফর ইকবালমুহম্মদ জাফর ইকবাল
Published : 16 June 2017, 11:42 AM
Updated : 16 June 2017, 11:42 AM

১.

একটা দেশ কেমন চলছে সেটা বোঝার উপায় কী? জ্ঞানী-গুণী মানুষদের নিশ্চয়ই এটা বের করার নানা উপায় আছে। তারা অর্থনীতির দিকে তাকাবেন; দেশের আইন-শৃঙ্খলা বিবেচনা করবেন; দুর্নীতির পরিমাপ করবেন; দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যাচাই করবেন এবং আরও অনেক কিচু বিশ্লেষণ করে একটা রায় দেবেন।

আসলে দেশ কেমন চলছে সেটা বের করা খুবই সহজ। দেশের একজন সংখ্যালঘু মানুষকে নিরিবিলি জিজ্ঞেস করবেন, 'দেশটি কেমন চলছে?' সেই সংখ্যালঘু মানুষটি যদি বলেন 'দেশ ভালো চলছে', তাহলে বুঝতে হবে দেশটি ভালো চলছে। আর সেই মানুষটি যদি ম্লান মুখে মাথা নেড়ে বলেন 'দেশটি ভালো চলছে না', তাহলে বুঝতে হবে দেশ আসলেই ভালো চলছে না।

দেশে দশটা পদ্মা সেতু, এক ডজন স্যাটেলাইট আর দশ হাজার ডলার পার ক্যাপিটা আয় হলেও যদি সংখ্যালঘু মানুষটি বলেন 'দেশ ভালো নেই' তাহলে বুঝতে হবে, আসলেই দেশ ভালো নেই।

(সংখ্যালঘু শব্দটি লিখতে আমার খুব সংকোচ হয়। সবাই একই দেশের মানুষ। এর মাঝে কেউ কেউ সংখ্যাগুরু, কেউ কেউ সংখ্যালঘু, সেটি আবার কেমন কথা! কিন্তু আমি সে কথাটি বলতে চাইছি সেটি বোঝানোর জন্যে এই শব্দটি ব্যবহার করা ছাড়া উপায় ছিল না।)

এখন যদি আমরা এই দেশের একজন হিন্দু, সাঁওতাল বা পাহাড়ি মানুষকে জিজ্ঞেস করি 'দেশ কেমন চলছে' তারা কী বলবেন? নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সবাইকে ঘরছাড়া করা হয়েছিল। গাইবান্ধায় পুলিশেরা সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিচ্ছে, পত্রপত্রিকায় সেই ছবি ছাপা হয়েছে। সর্বশেষ হচ্ছে রাঙামাটিতে লংগদুর ঘটনা। পাহাড়ি মানুষদের বাড়ি জ্বালিয়ে তাদের সর্বস্ব লুট করে নেওয়া হয়েছে।

প্রাণ বাচাঁনোর জন্যে যে মা তার সন্তানদের বুকে চেপে ধরে মাইলের পর মাইল পাহাড় অতিক্রম করে জঙ্গলে লুকিয়ে আছেন, বৃষ্টিতে ভিজেছেন, রৌদ্রে পুড়েছেন, অভুক্ত থেকে মশার কামড় খেয়ে প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে চমকে চমকে উঠেছেন– আমি যদি তাকে বলি 'বাংলাদেশ অনেক বড় সম্ভাবনার দেশ, এবারে উন্নয়নের বাজেটটাই হয়েছে চার লক্ষ কোটি টাকার, পদ্মা ব্রিজের চল্লিশ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে, আগামী মাসে আমাদের নিজস্ব বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হবে– সেই অসহায মা কি আমার কথা শুনে শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবেন না? তাঁকে কি আমি কোনোভাবে বুঝাতে পারব আমাদের অনেক কষ্ট করে, যুদ্ধ করে, রক্ত দিয়ে পাওয়া দেশটি স্বপ্নের একটি দেশ?

আমি তাঁকে কিংবা তাঁর মতো অসংখ্য পাহাড়ি মানুষকে সেটি বোঝাতে পারব না। তাদের কাছে এই দেশটি হচ্ছে একটি বিভিষীকা যেখানে প্রকাশ্যে হাজার হাজার মানুষ এসে পুরোপুরি নিরপরাধ মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। তাদের রক্ষা করার কেউ নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকে এই ঘটনাগুলো ঘটতে দেয়। এই ঘটনাগুলি ঘটবে সেটি সবাই আঁচ করতে পারে, তারপরও কেউ সেটা থামানোর চেষ্টা করে না।

আমি নিজেকে এই পাহাড়ি মানুষদের জায়গায় বসিয়ে পুরো বিষয়টা কল্পনা করে আতঙ্কে শিউরে উঠেছি।

পৃথিবীতে অন্যায় কিংবা অপরাধ হয় না তা নয়। আমরা প্রতি মুহূর্তেই আমাদের চারপাশে এগুলো দেখছি। কিন্তু লংগদুর ঘটনাটা ভিন্ন। যুবলীগের একজন কর্মীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কে মেরেছে ঠিকভাবে জানা নেই। প্রচার করা হল, দুজন চাকমা তরুণ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের শাস্তি দেওয়ার জন্যে বেছে নেওয়া হল পুরোপুরি নির্দোষ কিছু পাহাড়ি গ্রামবাসীকে। একজন দুইজন ক্রুদ্ধ মানুষ নয়, হাজার হাজার সংগঠিত মানুষ পেট্রোলের টিন আর ট্রাক্টর নিয়ে হাজির হল। পেট্টল দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে আগুন দেওয়া হল। ট্রাক্টর ব্যবহার করা হল লুট করা মালপত্র বোঝাই করে নেওয়ার জন্যে।

বিচ্ছিন্ন একজন কিংবা দুইজন মানুষ বাড়াবাড়ি কিছু একটা করে ফেলেছে সেটি বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু কয়েক হাজার মানুষ মিলে একটা ভয়ংকর অন্যায় করার জন্যে একত্র হয়েছে, সেটা আমরা বিশ্বাস করি কেমন করে?

কিন্তু আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। কারণ আমরা বার বার এই ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আমরা কেমন করে এত হৃদয়হীন হয়ে গেলাম!

২.

আমরা জানি কিছুদিন আগেও আমাদের ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ে আদিবাসী মানুষদের সম্পর্কে অনেক ধরনের অসম্মানজনক কথা লেখা থাকত। সচেতন মানুষেরা একটি একটি করে বিষয়গুলো সবার চোখের সামনে এনেছেন। তখন সেগুলো ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন তো আমরা করতেই পারি, এই পাঠ্যবইগুলো তো হেজিপেজি অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, রুচিহীন, বুদ্ধিহীন মানুষেরা লিখেন না– এই বইগুলো লিখেন গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা। তাহলে পাঠ্যবইগুলোতে এরকম অবিশ্বাস্য সাম্প্রদায়িক কথা কেমন করে লেখা হয়? কেমন করে আদিবাসী মানুষদের এত অসম্মান করা হয়?

কারণটা আমরা অনুমান করতে পারি। আমরা যাদেরকে বড় বড় শিক্ষিত মানুষ হিসেবে ধরে নিয়েছি তাদের মনের গভীরে লুকিয়ে আছে সংকীর্ণতা। যারা 'আমার মতো নয়' তারা অন্যরকম। তার মানেই নাক শিটকে তাকানো।

অথচ পুরো ব্যাপারটাই আসলে ঠিক তার বিপরীত। সারাজীবনে আমি যদি একটা বিষয় শিখে থাকি তাহলে সেটা হচ্ছে, একটা উপলদ্ধি যে, 'বৈচিত্রই হচ্ছে সৌন্দর্য'। কোনো মানুষ কিংবা সম্প্রদায় যদি অন্যরকম হয়ে থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে বৈচিত্র্য এবং সেই বৈচিত্র্যটুকুই সৌন্দর্য।

পৃথিবীতে অনেক সৌভাগ্যবান দেশ রয়েছে যেখানে অনেক দেশের অনেক মানুষ পাশাপাশি থাকেন। তারা দেখতে ভিন্ন, তাদের মুখের ভাষা ভিন্ন, তাদের কালচার ভিন্ন, ধর্ম ভিন্ন, খাবার কিংবা পোশাক ভিন্ন। আমরা সেদিক থেকে অনেক দুর্ভাগা। আমাদের দেশে মানুষের মাঝে সেই বৈচিত্র্য নেই। ঘর থেকে বের হয়ে আমরা যেদিকেই তাকাই সেদিকেই আমরা একই রকম মানুষ দেখতে পাই– তাদের মুখের ভাষা, চেহারা, পোশাক কোনো কিছুতে পার্থক্য নেই।

আমাদের দেশের একটুখানি ভিন্ন ধরনের মানুষ হচ্ছেন সাঁওতাল কিংবা গারো মানুষ, পাহাড়ি মানুষ। এই মানুষগুলোকে আমাদের বুক আগলে রাখার কথা, অথচ আমরা তাদের অবহেলা করি।

আমাদের পরের প্রজন্মকে শেখাতে হবে পৃথিবীর সৌন্দর্য হচ্ছে বৈচিত্র্য। সারা পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হচ্ছে 'ডাইভারসিটি'। একটি দেশের যত বেশি ডাইভারসিটি সেই দেশটি তত সম্ভবনাময়। নূতন পৃথিবী আধুনিক পৃথিবী। আধুনিক পৃথিবীর মানুষেরা একে অন্যের সাথে বিভেদ করে না। শুধু যে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করে না তা নয়, গাছ-ফুল-পশু-পাখি সবাই মিলে যে একটা বড় পৃথিবী এবং সবার যে পাশাপাশি বেঁচে থাকার অধিকার আছে সেটিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।

অথচ আমরা সবিস্ময়ে দেখতে পাই একজন দুইজন নয়, কয়েক হাজার মানুষ মারমুখী হযে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কী তাদের অপরাধ? তাদের অপরাধ, সেই মানুষগুলো আমাদের থেকে একটু ভিন্ন।

৩.

আমার শৈশবটি কেটেছে বাংলাদেশের নানা এলাকায়। বাবা পুলিশের অফিসার হিসেবে দুই তিন বছর পর পর নূতন জায়গায বদলি হযে যেতেন। সেই সুযোগে আমরা বাঙামাটি আর বান্দরবান এই দুই জায়গাতেও ছিলাম। বান্দরবানে আমি স্কুলে পড়েছি। আমাদের ক্লাসে বাঙালি ছেলেমেয়ের পাশাপাশি পাহাড়ি ছেলেমেয়েরাও ছিল। তাদের অনেকে ভালো বাংলা বলতে পারত না। এখন অনুমান করি, সে কারণে লেখাপড়াটা নিশ্চয়ই তাদের জন্যে অনেক কঠিন ছিল। ক্লাসের ভেতরে লেখাপড়া নিয়ে আমাদের আগ্রহ ছিল না। ক্লাস ছুটির পর বনে-জঙ্গল-পাহাড়ে-নদীতে ঘুরে বেড়ানোতে আমাদের আগ্রহ ছিল বেশি। তাই ভালো বাংলা না জানলেও সেটা কোনো সমস্যা হত না।

ধর্ম, ভাষা, গায়ের রং, শরীরের গঠন কিংবা কালচার ভিন্ন হলেও সব মানুষ যে একেবারে একই রকম সেটি আমি শিখেছি নিজের অভিজ্ঞতায়।

বান্দরবানের সেই স্কুলে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে চমকপ্রদ শিক্ষক পেয়েছিলাম যাঁর কথা আমি কখনও ভুলিনি। আমি আমার নিজের শিক্ষকজীবনে তাঁর শেখানো বিষয়গুলো এখনও ব্যবহার করে যাচ্ছি এবং এখনও ম্যাজিকের মতো ফল পেয়ে যাচ্ছি।

আমাদের এই শিক্ষক ছিলেন একজন পাহাড়ি (সম্ভবত মারমা) মহিলা। পাহাড়ি পোশাকে ক্লাসে আসতেন। একজন মানুষকে বিচার করতে হলে কখনও তাঁর চেহারা নিয়ে কথা বলতে হয় না। কিন্তু অসৌজন্যমূলক হলেও আমাকে একটুখানি বলতে হচ্ছে। মধ্যবয়স্কা এই মহিলার গলগণ্ড রোগ ছিল বলে তাঁকে কোনো হিসাবে সুন্দরী বা আকর্ষণীয় বলার উপায় নেই। ভদ্রমহিলা এক দুইটির বেশি বাংলা শব্দ জানতেন না। তিনি আমাদের ড্রয়িং টিচার ছিলেন। কিন্তু ছবি আঁকতে পারতেন না। কোনোদিন চক হাতে বোর্ডে কিছু আঁকার চেষ্টা করেননি। কিন্তু তারপরও আমাদের ড্রয়িং ক্লাশ নিতে কখনও তাঁর কোনো অসুবিধা হত না। ক্লাসে এসে তিনি বলতেন, 'লাউ আঁক' কিংবা 'বেগুন আঁক'– এর বেশি কোনো কিছু বলেছেন বলে মনে পড়ে না।

আমরা তখন লাউ কিংবা বেগুন আঁকতাম। আমাদের সবারই স্লেট-পেন্সিল ছিল। যাবতীয় শিল্পকর্ম সেখানেই করা হত। ছেলেমেয়েরা লাউ কিংবা বেগুন এঁকে আমাদের ড্রয়িং টিচারের কাছে নিয়ে যেত। লাউয়ের এবং বেগুনের আকার-আকৃতি দেখে তিনি বিভিন্ন মাত্রার উল্লাস প্রকাশ করতেন এবং চক দিয়ে স্লেটের কোনায় মার্ক দিতেন। কেউ চার, কেউ পাঁচ, কেউ ছয় কিংবা সাত। আমার ছবি আঁকার হাত ভালো ছিল। তাই আমার লাউ কিংবা বেগুন দেখে তিনি উল্লাসিত হয়ে দশ দিয়ে দিতেন।

ড্রয়িং ক্লাস হতে লাগল। তিনি আমাদের শিল্পকর্মে নম্বর দিতে লাগলেন এবং আমরা আবিষ্কার করলাম তাঁর দেওয়া নম্বরও বাড়তে শুরু করেছে। দশের বাধা অতিক্রম করে কেউ পনের, কেউ সতের পেতে লাগল। কত এর ভেতর পনের কিংবা সতের সেটা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন ছিল না। হয়তো প্রজাপতি আঁকতে দিয়েছেন, কেউ প্রজাপতি এঁকে নিয়ে গেছে এবং তাকে বাইশ দিয়েছেন। পরের জনের প্রজাপতি হয়তো আরও সুন্দর হয়েছে, তাকে তিরিশ দিলেন। এর পরের জন হয়তো পুরো চল্লিশ পেয়ে গেল।

আমরা সব ক্লাসেই লেখাপড়া করে আসছি। কোথাও এরকম নম্বর পাইনি। একটা কলা এঁকে যখন নব্বই পেয়ে যাই তখন মনে হয় রাজ্য জয় করে ফেলেছি।

কাজেই আমাদের এই ড্রয়িং ক্লাসটা ছিল আনন্দময় একটা সময়। লাউ-কলা-প্রজাপতি শেষ করে তখন আমরা পশুপাখি আকঁতে শুরু করলাম। শুধুমাত্র একটা গরু এঁকে একদিন আমি আটশত পঞ্চাশ পেয়ে গেলাম। আনন্দে-উত্তেজনায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। আমাদের ড্রয়িং টিচার ততদিনে বুঝে গেছেন আমি ভালো আঁকতে পারি এবং সেজন্যে আমার প্রতি তাঁর এক ধরনের স্নেহ ছিল। প্রায় নিয়মিতভাবে আমি ক্লাসে সব সময় সবার চাইতে বেশি নম্বর পেয়ে আসছি।

একদিন ক্লাসে এসে বললেন, 'বুড়ডিশ আঁক'। শব্দটি আমি বুঝতে পারিনি, তখন অন্যরা বুঝিয়ে দিল। ড্রয়িং টিচার বৌদ্ধমূর্তি আঁকতে বলেছেন। আমি তখন বিপদে পড়ে গেলাম। বান্দরবানের ক্যাং ঘরে নানারকম বৌদ্ধমূর্তি দেখে এসেছি। কিন্তু তার ছবি আঁকার মতো খুঁটিনাটি লক্ষ্য করিনি। আমাদের ক্লাসে আরও একজন মারমা ছেলে ভালো ছবি আঁকত। সে অসাধারণ একটা বৌদ্ধমূর্তি এঁকে নিয়ে গেল এবং ড্রয়িং টিচার তাঁকে চৌদ্দশ নম্বর দিয়ে দিলেন। আমি বসে বসে মাথা চুলকে যাচ্ছি। আমার ড্রয়িং টিচারের তখন আমার জন্যে মায়া হল। মারমা ছেলেটির স্লেটটি আমার সামনে রেখে সেটা দেখে দেখে আঁকতে বললেন। আমি সেটা দেখে দেখে একটা বৌদ্ধমূর্তি আঁকলাম এবং আমিও চৌদ্দশ পেয়ে গেলাম।

এরপর এত বছর পার হয়ে গেছে, আমি আমার এই ড্রয়িং টিচারের কথা ভুলিনি। তিনি আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি দিয়ে গেছেন; সেটি হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দিতে হয়। আমিও আমার সারাটি জীবন ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দিয়ে আসার চেষ্টা করে আসছি এবং দেখে আসছি এটি ম্যাজিকের মতো কাজ করে।

এই মারমা ড্রয়িং টিচারের মতো নিশ্চয়ই একজন সাঁওতাল বৃদ্ধ কিংবা গারো যুবক রয়েছেন যাঁর কাছ থেকে আমার জীবনের কোনো একটি শিক্ষা পাওয়ার কথা ছিল– আমরা সেটা পাইনি। আমরা মানুষে মানুষে বিভাজন করে নিজেদের ভাষা-ধর্ম কালচার নিযে অহংকার করে অন্যদের তাচ্ছিল্য করতে শিখিয়েছি, অবহেলা করতে শিখিয়েছি। আমরা যদি আধুনিক পৃথিবীর আধুনিক মানুষ হতে চাই তাহলে সবাইকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে বেঁচে থাকা শিখতে হবে।

৪.

হয়তো বাংলাদেশ কিছুদিনের মাঝে অনেক উন্নত হয়ে যাবে। আমাদের মাথাপিছু গড় আয় বেড়ে যাবে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আমরা এগিয়ে যাব। আমাদের প্রশ্ন ফাঁস হবে না, স্কুলে আনন্দময় পরিবেশে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে। নিজেদের অর্থে আমরা বিশাল বিশাল পদ্মা ব্রিজ তৈরি করব। কিন্তু যদি একটি পাহাড়ি শিশু তার মায়ের হাত ধরে আতঙ্কে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়ের জন্যে জঙ্গলে ছুটে যেতে থাকে তাহলে কি আমাদের সব উন্নয়ন পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে যাবে না?

দেশের একটি নাগরিককেও যদি আমরা সম্মান নিয়ে শান্তিতে নিজের ঘরে ঘুমানোর পরিবেশ তৈরি করে দিতে না পারি তাহলে বিশাল পদ্মা ব্রিজ দিয়ে কী হবে?