খেলা কবে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হবে?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 8 Nov 2011, 05:54 AM
Updated : 16 June 2017, 05:11 AM

অভিনন্দন প্রিয় টিম টাইগার্স। আমাদের জীবদ্দশায় বাংলাদেশ এমন একটা বড় টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে খেলবে এটাই আমরা ভাবতে পারিনি। এটা নবীন দেশের জন্য বড় পাওয়া। ক্রিকেটের ইতিহাসে আমরা নবীনই বটে।

ভারত, পাকিস্তান ক্রিকেট খেলছে দীর্ঘসময় ধরে। তাদের অভিজ্ঞতা তাদের পাওয়া ও হারানোর ইতিহাস অনেক বড়। সেখানে আমরা এখনও গুটিগুটি পায়ে পথ চলছি। তবে আমাদের খেলোয়াড়দের অভিনন্দনের পাশাপাশি ধন্যবাদও দিতে হয়। তাদের মাথা ঠান্ডা। মাঠে তাদের উল্লাস ও পরাজয়ের বেদনা দুই পরিমিত। বিশেষ করে মাশরাফিকে দেখলেই আমি কেমন জানি সংবেদনশীল হয়ে পড়ি। জান দিয়ে খেলা আমাদের ১১ জন খেলোয়াড়কে আরও ভালো লাগে এই কারণে খেলার বাইরে মাঠে-সমাজে-দেশে যারা তাদের ভালোবাসার নামে দাঙ্গা বাঁধানোর মতো পরিবেশ তৈরি করে ফেলে, এরা তাদের কথা শোনেন না। এদের দিকে ফিরেও তাকান না।

সমর্থন আর জোশ– এ দুটো বিষয় এক করে গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছি আমরা। বিশেষত পাকিস্তান আর ভারতের সঙ্গে খেলা হলে 'খেলা' আর 'খেলা' থাকে না। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নানা কারণে বৈরিতার। একসময় এক দেশ এক পতাকার নিচে বসবাস পরে স্বাধীন হওয়ার কারণে পাকিরা আমাদের মানতে পারে না। সাতচল্লিশে তারা ধরে নিয়েছিল প্রভুত্ব করেই যাবে আজীবন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তা মানেনি। শুধু মানেনি না, একাত্তরে এমন জবাব দিয়েছিল যা পাকিস্তানের কথিত সেরা সামরিক শক্তির ভীত নাড়িয়ে তাদের আত্মসমর্পনে বাধ্য করেছিল।

সেই দুশমনি পাকিরা ভুলতে পারেনি। তারা এখনও চায় ছলে-বলে-কৌশলে বাংলাদেশকে তাদের ছায়া করে রাখতে। পাকি ক্রিকেটার কমেন্টেটররা সুযোগ পেলেই আমাদের আপমান করে। কিন্তু তার জবাব দিতে হবে খেলায়। খেলায় জিতলেই আসল উত্তর মিলে যায়। সেটা না করে পাকিদের সঙ্গে খেলার আগে হিংসা-উন্মাদনা আর এটাকে মুক্তিযুদ্ধের 'সোল এজেন্সি' নেওয়ার মতো করে পরিবেশ তৈরি করা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ এক বাস্তবতা তৈরি করছে।

ভারত আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ দেশ। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান ও ত্যাগ ছাড়া স্বাধীনতা পেতাম না আমরা। সময়ের স্রোতে মানুষ, রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি সব বদলে যায়। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও চির শান্তির বা অমলিন থাকেনি। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ও ভারতের রাজনীতি তার প্রাপ্য বা ব্যবসা সুদে-মূলে উশুল করে নিচ্ছে। আছে পানি সমস্যা। আছে সীমান্ত সমস্যা। আছে গরু সমস্যা। আছে ভুল বোঝাবুঝির সমস্যা।

কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা 'সাম্প্রদায়িকতা'। সেদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন দারুণ একটা কথা লিখেছেন। বলা হচ্ছে এই প্রজন্ম নাকি মনে করে তাদের দাদার আমলে দুশমনি ছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে। বাবা-চাচার আমলে পাকিস্তান ছিল দুশমন। এই প্রজন্মের শত্রু নাকি ভারত।

চিন্তা করুন কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দুর্ভাবনা। এই কথাগুলো যে কতটা সত্য, না বললেও বোঝা যায়। ভারতের সঙ্গে খেলা পড়লেই একশ্রেণির মানুষের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। আমি মেলবোর্নের মাঠেও তা দেখেছি। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এমন চিৎকার করছিলেন কেউ কেউ, মনে হচ্ছিল, কোথাও যুদ্ধ বেঁধে গেছে।

ভারতের সঙ্গে খেলা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে তেতে উঠতে থাকে সামাজিক মিডিয়া। আমি এটাকে বলি 'স্ন্যাপ শট'। 'এক্সরে'। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এমনকি বৃদ্ধদের ভেতর থেকেও বেরিয়ে আসতে থেকে সাম্প্রদায়িকতার হিলহিলে বিষ। সবচেয়ে বিপদে পড়ে দেশের হিন্দুরা। ধর্ম নামের আফিম আমাদের এমন বুঁদ করেছে যে আমরা ধরে নিয়েছি বৌদ্ধ মানে শ্রীলঙ্কার সমর্থক। খ্রিস্টানরা সমর্থন করে বিলেত বা অন্য দেশ। মুসলমান মানে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ আর হিন্দু মানেই ভারত। আমাকে একজন এমনও বলেছেন সৌম্য নাকি ভারতের সঙ্গে খেলার সময় আসলে চায় না তাঁর ব্যাটে রান আসুক।

বলছিলাম হিন্দুদের কথা। ভারতের সঙ্গে খেলার আগে এখন তাদের ভেতর একটা প্রতিযোগিতা ও দেখানোর প্রবণতা শুরু হয়ে যায়, কে কতটা বাংলাদেশকে ভালোবাসে। তারা খুব ভালো করে জানে যত ভাবেই তারা চেষ্টা করুক না কেন সংখ্যাগুরু মানুষের বেশিরভাগই তাদের এই ভূমিকা বিশ্বাস করে না। তাদের বদ্ধমূল ধারণা হিন্দুরা ঘরে ঘরে ভারত জয়ের জন্য পূজা দিচ্ছে আর বাইরে বাংলাদেশ সমর্থনের ভান করছে।

বলা বাহুল্য অল্প কিছু প্রগতিশীল নামধারী মানুষ এর বাইরে। তাদের কাছে খেলা মানে খেলা। কারণ তারা খেলা বোঝে। বেশিরভাগ অন্ধসমর্থক মূলত ক্রিকেট বোঝেই না। আপনি আলাপ করে দেখুন। ক্রিকেটের পজিশন– গালি, স্লিপ, কভার, একস্ট্রা কভার চেনে না এরা। মাতম করা মানুষের বেশিরভাগ জানে না কত বলে এক ওভার। কেন আম্পায়ার ঐ জায়গায় দাঁড়ায়।

তাদের জানার বিষয় একটা: বিপরীতে কে? ভারত হলে মার শালারে। পাকিস্তান হলে ধর শালারে।

এই জাতি কি আসলেই ক্রিকেটপ্রেমী? এই যে সেমিফাইনালে বিরাট কোহলি জিহ্বা দেখালেন, এ নিয়ে দৃশ্যপটে এখন মা কালীও আবির্ভূতা। কালীর জিভের সঙ্গে বিরাট কোহলির জিহ্বার সম্পর্ক নেই জেনেও হিন্দুদের অপমান করার জন্য এসব ঘটনার জন্ম দেওয়া হচ্ছে। অথচ নিউজিল্যান্ডের হাকাসহ দুনিয়ার নানা দেশে জিহ্বা বের করে উল্লাস প্রকাশের নজির আছে। অধিনায়ক হিসেবে বিরাটের এই মুখভঙ্গি দৃষ্টিকটূ। সেটা আমারও ভালো লাগেনি। কিন্তু এরপর তিনি যে মাশরাফির গলা জড়িয়ে ধরে আন্তরিকভাবে কী বললেন, সেটা নিয়ে তো কিছু বললাম না আমরা।

বলেছি, ভারতের সঙ্গে খেলা পড়লেই দেশে বহু হিন্দুর বুকে কাঁপন ধরে যায়। অফিসে কলিগদের বাঁকা চাহনি। বসের অবিশ্বাস। চায়ের দোকানে গালাগালি, রাস্তায় মাতম আর বিজয় উল্লাসের পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক উসকানি ও সমাজের অবিশ্বাসে খেলা হবে ওঠে দুঃষহ এক অভিজ্ঞতা।

অথচ বাংলাদেশ টিম এমনিতেই ভালো খেলছে। তারা তাদের মতো করে এগিয়ে চলেছে। আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের আসল জায়গায় সমর্থন দেওয়া। সেটা না করে কোন দেশে কে কী বলল, কে কী মন্তব্য করল সেটা নিয়েই দিনরাত এককরে ফেলি আমরা।

আমাদের নজরে পড়ে না একজন চমৎকার ইংরেজি বলা ভাষ্যকার নেই আমাদের। নেই টেক্কা দেওয়ার মতো মিডিয়ার শক্তি। ছেলেদের আরও কোচিং আরও মনোবল বাড়ানোর জন্য যে পজেটিভ সমথর্নের দরকার সেটাও দিতে পারছি না আমরা।

এর নাম ক্রিকেট? এর নাম উল্লাস? না, এর আসল নাম 'সামাজিক পচন'?

যেসব মানুষ এ জাতীয় বিষয় উসকে দেন তাদের ভেতর মুখোশধারী প্রগতিশীলও আছেন। বাংলাদেশের বহুল প্রচলিত একটি বাংলা দৈনিক সব নৈতিকতা ভেঙে খেলার আগে আগে যে অপপ্রচার করেছিল তাতে যে কোনো কিছু হতে পারত। একটা বিষয় দিবালোকের মতো স্পষ্ট: জানা অজানা কারণে ভারত বিরোধিতা ও হিন্দু বিরোধিতা একাকার, এবং তা তুঙ্গে। জীবনের নানা জায়গায় আধুনিকতা, ভদ্রতা বা শিষ্টাচারের আশু প্রচলন ও অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা না হলে মুক্তি নেই আমাদের।

একটা কথা ভুলে যাচ্ছি এমন আক্রোশ থাকে দুর্বলের। এমন হীন মারমুখী আচরণ করে পরাজিতের দল। আমরা কি ধরে নিয়েছি কোনো খেলায়ই জিতব না আমরা? আমরা মাঠে নামি শুধু হারতে? সে কারণেই কি কারো কোনো কিছু সহ্য করতে পারি না?

বাংলাদেশের এখন সামনে যাওয়ার সময়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে নতুন আত্মবিশ্বাসে। তাদের অন্ধ মারমুখী আর আত্মঘাতী করার পরিবর্তে আমরা কি সহনশীল, সংযমী জয়ী করে তুলব না? এগোতে দেব না জাতি ও দেশকে?

খেলা কবে খেলা হয়ে উঠবে বাঙালির মনে?